ক্ষিদে
দেবানন্দ মুখোপাধ্যায়
বিরাট বড় ঝাঁ চকচকে আলোকিত শপিংমল।কত লোক, কত বিচিত্র পোশাকের রঙ্গিন মানুষ চলমান সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে বা নেমে আসছে।এ পৃথিবীর বুকে যেনো এক মিনি স্বর্গ!দ্বাররক্ষী আগেই সবাইকে মেপে নিচ্ছে তার তীক্ষ্ণ চোখে,হাতে ধরা যন্ত্রে,কেউ কিছু অবৈধ জিনিসপত্র নিয়ে ঢুকছে কি না!
শপিংমল না বিমানবন্দর বোঝার উপায় নেই।এক অবৈধ মন ছাড়া কোনো কিছুই মানুষের চোখকে বা হাতে ধরা মেশিনকে ফাঁকি দিতে পারেনা আজকাল।
আমরাও ঢুকি,কিছুটা সময় কাটানোর জন্য,কিছুটা কেনাকাটার জন্য।আসলে রিটায়ার করার পর সময় আর কাটতেই চায়না।তাই ইদানিং বাড়ির কাছের এই শপিংমলটায় আমরা বুড়ো বুড়িতে একটা সময় কাটানোর জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছি এই বছরখানেক হোলো।আগে অবশ্য যাওয়ার সময় পেতামনা,একটাই রবিবার ছুটির দিন।সেদিন আর কোথাও যেতে ভালো লাগতোনা,বরং সেদিন কোথাও যেতে হবে ভাবলে গায়ে জ্বর চলে আসতো।আর এখন?এখন তো রোজই রবিবার,ছুটির দিন,রেস্ত থাক্ বা না থাক্ দুজনে বেরিয়ে পড়ি।ছেলে বাইরে, মানে কর্মসূত্রে চেন্নাই প্রবাসী। সপরিবারে ওখানেই থাকে।ফাঁকা ফাঁকা লাগে খুবই, কিন্তু কি আর করা যায়,অগত্যা আমাদের এই মিনি স্বর্গদর্শন করতে বের হওয়া।
#
তা সেদিন হঠাৎ মনে হোলো ওরা যখন আসে তখন মাঝে মাঝে এখান থেকে পিজ্জা,বার্গার আরও কি সব কিনে নিয়ে যায়,আমাদের জন্য।বিশেষ করে আমাদের আট বছরের নাতির খুবই প্রিয় এই পিজ্জা।তা আজকে বুড়ো বয়সে ভীমরতি যাকে বলে,শখ হোলো আজ দুজনে এই 'ডি ডি টু'তে বসেই খাবো আজ দুপুরের খাবার।আমাদের বয়সকালে তো এসব ছিলনা,দেখি শখ মিটিয়ে।কে আর দেখছে!শুধু কাজের মেয়ে মালতি সন্ধ্যার সময় আসবে,তার আগে বাড়ি গেলেই হোলো -- তা সন্ধ্যার ঢের দেরি।
#
যেমন ভাবা তেমন কাজ।পাঁচতলার ফুডকোর্টে আমরা মুখোমুখি বসলাম।একটু লজ্জা লজ্জা যে লাগছিলোনা তা নয়।আমাদের বয়সীরা তো সাধারণত এই সময় খেতে আসেনা,সন্ধ্যের দিকে সপরিবারে আসে, বিশেষ করে এই ফুডকোর্টে।অবশ্য পুজোর আগের কয়েকদিন,দিন কেনো আগের মাসটাতেই বলা ভালো, অনেকে কেনাকাটা করতে আসে,তাদের এই সময় দেখা যায় এই ফুডকোর্টে।আসলে এ মলের জীবনচিত্র বলতে গেলে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ।তা,সপরিবার বলতে আমরা সাকুল্যে দুজন,তাও আবার বেকার বয়ষ্ক লোক।ছেলে অবশ্য বউমা নাতিকে নিয়ে বছরে এক দু'বার আসে কলকাতায়,আমরাও যাই ওদের ওখানে।মোটকথা হোলো বছরের অধিকাংশ সময়েই আমরা দু' জনই মাত্র আমাদের পরিবারের লোক এই মহানগরে। একটু লজ্জা লজ্জা লেগেই থাকছে মনের মধ্যে।
দুটো পিজ্জা আর দুটো মকটেলের অর্ডার দিয়ে চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।আশেপাশে সবই কচিকাঁচাদের ভীড়।কিছুটা দুরে আমাদের বয়সী এক দম্পতিকে দেখে লজ্জা ভাবটা একটু কাটলো।
#
একটু আগে খাবার সার্ভ করে গেছে।পিজ্জা একটু একটু করে ভাঙছি আর খাচ্ছি।অনিতাকে জিজ্ঞেস করলাম " কেমন লাগছে?"
"ভালোই। তবে সত্যি বলতে কি খোকাদের সাথে আসা,আর আমরা দুজন আসার অনেক পার্থক্য।কেমন যেন লজ্জা লাগছে"।
"রাখো তো লজ্জা,আমারও লাগচছিলো প্রথমে। এনজয় করো ব্যাপারটা,খাবারটা।খোকাতো অফিসে,ভিডিওকলে ধরবো?বা বৌমাকে?"
" একদম না,আমি আর খেতেই পারবোনা এখানে বসে তাহলে।এমনিতেই লজ্জা লাগছে,কোনোরকমে খেয়ে উঠতে পারলে বাঁচি।আর তোমার তো পুলক উথলে উঠছে দেখছি।খবরদার ওরা যেন না জানে এ সব।"
" তুমি তো সেই কলেজ লাইফের লাজুকলতাই রয়ে গেছো।হায় রে! আমাদের যৌবনে শপিংমল,ফুডকোর্ট,আইনক্স এরা তো জন্মানো তো দুরের কথা,স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি এরা জন্মাবে।তখন আমাদের কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা হল,ভিক্টোরিয়া,চিড়িয়াখানা, কফিহাউস,গোলঘরের কষা মাংস,ইত্যাদির বেশী কিছু নয় ব্যাস্।মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সময়ে যদি.....
যাক্ ভেবে লাব নেই।জীবনটাকে উপভোগ করতে গেলে কি পাইনি হিসেব করতে নেই অনিতা।"
হঠাৎ অনিতা বলে " একটা কথা বলবো?"
" বলো? মালতির জন্য একটা নিয়ে যাবে,ও আমাদের জন্য অনেক করে।"
" ওরা এ সব খায়নি,নিয়ে যাওয়াটা কি উচিৎ হবে? খেয়ে যদি কিছু হয়?তখন তো ও আমাদেরই দায়ী করবে।"
" কি আর হবে? আমাদেরই কি খাওয়ার অভ্যেস আছে?"
" ঠিক আছে,তোমার যখন এতই ইচ্ছে একটা প্যাক করে দিতে বলি।"
#
ঠিকঠাক সময়েই বাড়ি ফিরলাম।হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা খেয়ে দু-চারটে ম্যাগাজিন নিয়ে বসলাম,টি ভি দেখতে আমার খুব একটা ভালো লাগে না।একটু পরেই মালতি এসে হাজির।রান্নাবান্না আর টুকটাক ঘরের কাজ করে মালতির যাওয়ার সময় অনিতা প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে" মালতি, এটা বাড়ি নিয়ে খাস।"
" কি গো এটা মাসীমা,কি সুন্দর বাস গো!"
" এটাকে পিজ্জা বলে।আজ আমরা ডি ডি টু বলে একটা মল আছে ওখানে গেছিলাম।মল কাকে বলে জানিস তো?"
" সে তো এক বিরাট মেলার মত জায়গা গো! মেলার মধ্যে কত দোকান,ঢুকলে মনে হয় স্বর্গে এসে পড়েছি।"
"তুই গেছিস?"
ব্যাজার মুখ করে মালতি বলে "আমার কি আর সেই কপাল আছে? তোমাদের জামাই যাদের গাড়ি চালায় সে একবার ওকে নিয়ে গেছিলো ভিতরে।ওই এসে গল্প করেছিলো।তবে ওরা ওকে কিছু দেয়নি কিনে।তোমরা ভগমান মানুষ, তাইতো আমার কথাও ভাবো।এর অনেক দাম তাই না মাসীমা?"
" দাম দিয়ে কি হবে তোর?"
"না,তা নয়।" খানিকক্ষন থেমে মালতি বলে" একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?"
অনিতা বলে " বল না,কি জানতে চাস?"
"ঐ যে দি দি টু না কি বললে ওখানে পান্তা ভাত পাওয়া যায়? কতদিন ভালো করে পান্তাভাত,আলুসিদ্ধ ভাজা শুকনোলঙ্কা,পিঁয়াজ দিয়ে খাইনি।"
আনিতা হতবাক হয়ে যায়।একটু থেমে বলে " দুর বোকা অত উঁচুতে কি মাটির কাছের খাবার পাওয়া যায়? আকাশের কোলে দোকান,ওখানে ওসব পাবি কোথায়? আর দামও আকাশছোঁয়া। ভাত তো মাটির কাছাকাছি লোকদের জন্য,আমরা একদিন শখ করে...." আবেগে কথা আটকে যায় অনিতার।
আমার কানে সবই ঢুকছে,ম্যাগাজিনের পাতা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।পাঁচতলার ফ্ল্যাটের বড় জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।পরপর ইট- বালি- সিমেন্টের দেবদারু গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি।
মনে মনে ভাবি,ক্ষিধে সবারই পায়।যে যার মতো সামর্থ অনুযায়ী মেটায়ও।
তবে,মানুষের ক্ষিধে দিন দিন এতো বাড়ছে যে তারা আকাশকেও ছাড়ছেনা,তাকেও গিলে খেতে শুরু করেছে।।
No comments:
Post a Comment