1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

আমার নন্দন কানন

 

আমার নন্দন কানন

 মানসী বসু

আমার নাম মানসী। আমি থাকি বৈদ্যবাটী নামে একটি ছোট্ট শহরে। অনেকেরই অনেক রকম নেশা থাকে,আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার ও একটি নেশা আছে। আমি ছোট বেলায় মায়ের সঙ্গে গাছ লাগাতাম। গাছের নেশা আমার ছোট্ট বেলা থেকেই ছিল। বাড়ির উঠোনে শীতের উত্তুরে হাওয়ায়  কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন বাগানে রংবেরঙের প্রজাপতি তাদের পাখা মেলে কিংবা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় তখন মনে হয় এই জায়গাটুকু যেন “ স্বর্গের নন্দন কানন”। আমার বাড়িতে শুধু উঠোনে গাছ আছে তা নয়, বাড়ির ছাদে,  বারান্দায় এমনকি ঘরেতে গাছ লাগিয়ে রেখেছি। গাছ আমাদের অনেক গঠনমূলক, সৃজনমূলক চিন্তা ভাবনা করতে শেখায়। আজ বলব আমার বাড়িতে কি ধরনের গাছ আছে। আমার বাড়িতে যেমন ফুল পাতাবাহারের গাছ আছে,তেমনি শাক সবজির ফলের গাছ আছে। তাদের  যত্ন একেবারে সহজ, একটু ভালবাসা দিলে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়। প্রথমে বলি আমি ফল বা শাক-সব্জির গাছে কোনোরকম রাসায়নিক সার বা রাসায়নিক কীটনাশক  ব্যবহার করি না, কিন্তু ফুলের গাছে ব্যবহার করি। বাগান করা খুব সহজ, কিন্তু বাগান করার সময় কিছু কিছু কথা মনে রাখতে  হবে। যারা আমার মতো প্রায় সব গাছ টবে করতে চান, তাদের ক্ষেত্রে টব নির্বাচন খুব জরুরী।এক এক গাছের জন্য এক এক রকম টব প্রয়োজন, যেমন গোলাপের ক্ষেত্রে ১০ ইঞ্চি বা তার থেকে বড় টব আর্দশ এবং ফলের জন্য ১২ ইঞ্চি্র বেশি বড় টব আর্দশ।

মাটি তৈরিঃ আমি  বেশিভাগ গাছ মাটির টবে করি। আমি মাটি তৈরি করে রাখি গাছ লাগানোর  প্রায় ৭/৮ দিন আগে। তৈরি মাটির মধ্যে থাকে৩০ % সাধারণ মাটি,৩০% সাদা বালি,৪০% গোবর সার।

জৈব সার:  আমি প্রধানত বাড়ির  ফেলে  দেওয়া ডিমের খোলা  গুঁড়িয়ে (ক্যালশিয়ামের জন্য), কলার খোসা (পটাশিয়াম) রোদে শুকিয়ে এবং গুঁড়িয়ে, ফেলে দেওয়া শাক-সব্জির খোসা, চায়ের পাতা পচিয়ে তার জলটা আর সর্ষের খোল পচিয়ে তার জলটা (গ্রীষ্মকালে দুই সপ্তাহ অন্তর ও শীতকালে একসপ্তাহ অন্তর) দিই।                    

(একটি ১০ লিটার বালতির জলের মধ্যে মাত্র এক মগ সর্ষের খোল পচা দিতে হবে)

জৈব কীটনাশকঃ  নিম পাতা ,রসুনের কোয়া, হলুদ একটি পাত্রে জল দিয়ে ফুটিয়ে জলটি ছেঁকে বিকাল  বেলা বা ভোরে গাছে স্প্রে করতে হবে দুদিন  অন্তর তিনবার (যদি গাছে পোকা আক্রমন করে)।

এবার বলি আমার বাগানে কি কি ফল শাক সবজি আছে। প্রথমে বলিঃ

১) বাতাবি লেবুঃ এই গাছটি অনেক পুরোনো। গাছটিতে আমি প্রধানত বাড়ির ফেলে দেওয়া শাক-সব্জির খোসা, চায়ের পাতা পচিয়ে তার জলটা আর সর্ষের খোল পচিয়ে তার জলটা দিই উপরে বর্ণিত নিয়মে।

২) আমার বাগানে একটি গন্ধরাজ লেবু টবে লাগানো আছে। যার পাতায় হাত দিলে চারদিক গন্ধে ভরে যায় আর লেবুতে যেমন রস তেমন গন্ধ। আমার বাগানের রাজা  হল এই গন্ধরাজ লেবু। এছাড়া  আমার বাগানে দুটি পাতিলেবু  ও একটি  কাগজী লেবু গাছ আছে।

৩) সবেদাঃ এই গাছটি টবে বসানো। গাছটির মাত্র ৩ বছর বয়স। এবার নিয়ে ২ বার ফল পাচ্ছি। কোনো ঝামেলা নেই খুব ভাল গাছ। তাড়াতাড়ি ফল দেয়।

বেগুন, পালং শাক, টমেটো, ফুলকপি, শিম এগুলো আমার বাগানে প্রতি বছর দেখা যায়। গরমকালে লাল শাক, ঢ্যাঁড়শ ,বরবটি, লাউ, কুমড়ো, শশা এরা আমার বাগান কে আলোকিত করে রাখে। এছাড়া যার কথা না বলে তার মন খারাপ হবে সে হল আমার প্রিয় কারিপাতা গাছ, সারাবছর সবুজ পাতা দিয়ে শোভা বৃদ্ধি করে  আমার বাগানের আর আমার রান্নাতেও।

এবার  চলে আসি বাগানের অপ্সরাদের কথা নিয়ে। এরা তাদের রূপে-গন্ধে-বর্ণে একে অপরকে ছাপিয়ে যায়। এদের  রূপ গন্ধের জন্য পোকামাকড়  খুব আক্রমণ করে। এদের দমন  করতে আমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রথমদিকে। এক্ষেত্রে আমি রাসায়নিক কীটনাশক  আর রাসানিক সার  ব্যবহার করি। এছাড়া ও এদেরকে আমি  জৈব সার এবং আমার বানানো কীটনাশক দিয়ে থাকি এক এক জনের চাহিদা অনুযায়ী। তাহলে বলি প্রথমে আমার বাগানের শীতকালে কোন কোন ফুলপরী তাদের রূপে আমাদের বিভোর করে রাখে-

গোলাপঃ  ইনি হলেন আমার বাগানের শীতের রানী। এনার যত্ন একটু বেশি, রানী বলে কথা। মহারানির খাদ্য হল-সুপার ফসফেট, N-P-K (10-26-26), পটাস, হাড়গুড়ো, শিংকুচি, সর্ষের খোলপচা জল। যেহেতু রানী তাই শত্রুর পরিমাণও বেশি ,সেই শত্রুদের দমনে প্রতিষেধকগুলি হল ডাই মিথাইল 30 কম্পোজিশনের যেকোনো কীটনাশক যেমন টাফগর (Tafgor) (যেকোনো পোকামাকড়  জন্য) ,Saaf (ফাঙ্গাসের জন্য)। একে খাবার আর প্রতিষেধক এক সাথে দেওয়া যায় না, রেগে যায় কিন্তু। তাই আমি মাসের ১ম ও ৩য় সপ্তাহে খাবার এবং ২য় (টাফগর) ও ৪র্থ (Saaf) সপ্তাহে প্রতিষেধক দিয়ে থাকি। আমার কাছে ৫ রকম গোলাপ আছে। তারা হলঃ

১) হেড লাইনার ২)ব্ল্যাক লেডি  ৩) ডবল ডে লাইট  ৪)মেদিনীপুর ডে লাইট ৫) মিনি গোলাপ। ফুল শুকিয়ে গেলে সব সময়  ফুলের নীচে পাঁচ পাতা উপর থেকে কেটে saaf গুলে কাটা জায়গায় লাগিয়ে দিতে হবে।

v পিটুনিয়াঃ  ইনি   হলেন  বাগানের রাজকুমারী। এনার যত্ন খুব  কম। মাসে এক বার খাবার দিলেই সন্তুষ্ট। পোকামাকড় তেমন আক্রমণ করে না। শীতকালে বাগান কে ভরিয়ে রাখে বিভিন্ন রঙে। আমার বাগানে প্রতিবছর ৭/৮ টা রঙের পিটুনিয়া থাকে। এই রাজকুমারীদের জন্য ছড়ানো টব আর্দশ।

v ডালিয়াঃ এনার যত্নও খুব কম, বিভিন্ন রঙের হয়, সর্ষের খোলপচা  জল দিলেই হয়।

v চন্দ্রমল্লিকাঃ “আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ফুটেছে কলি” রবিঠাকুর নিজের গানে যে উপমা দিয়েছেন তার  থেকে  ভাল কিছু আমি খুঁজে পেলাম না। প্রতিবছর  এনাকে আমার বাগানে আনতে হবেই। এনাকে ছাড়া আমার বাগান সম্পূর্ণ হবে না, এরা বিভিন্ন রঙের এবং ধরনের হয়ে থাকলেও আমার হলুদ ও মেরুন রঙের চন্দ্রমল্লিকা প্রিয়। এনাকে খুব কালোমাকড় আক্রমণ করে, তাই আমাকে নিয়মিত টাফগর/নিমতেল স্প্রে করতে হয় ।

v গ্যাজেনিয়াঃ আমার প্রিয়ফুলদের মধ্যে ইনি একজন। তিনি ঘুম থেকে ওঠেন সুয্যিমামার সাথে সাথে। সুয্যিমামা তার খুব ভাল বন্ধু। সেজন্য সুর্য না উঠলে তিনিও জাগেন না। এনার জল খুব  লাগে, জল জমলে গোড়া পচে যায়। এনারও যত্ন তেমন কিছু নেই, পোকা আক্রমণ তেমন হয় না বলেই চলে। ইনি বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে্ন। ঠিক মত যত্ন করলে সারা বছর এই পরী বেঁচে থাকেন।

এছাড়াও শীতকালে জারবেরা, এস্টার, বেবি ডল, প্যাঞ্জি বাগানকে ভরিয়ে রাখে।

গরমকালে প্রথম যে ফুলের কথা বলব সেটি হল-

v অ্যাডেনিয়ামঃ আমার মরুভূমির রানী যাকে মরুভূমির গোলাপও বলে লোকে। যেহেতু মরুভূমির গাছ তাই জল খুব কম লাগে। এনার মাটির ধরনও আলাদা। ৬০% সাদাবালি ও ৪০% মাটি দিয়ে তৈরি হবে এনার মাটি। এনাকে সর্ষের খোল দেওয়া যাবে না, শুধু পটাশ দিতে হবে মাঝে মাঝে। বিভিন্ন রঙের হয়।গরমকালে এনাকে ৩দিন অন্তর জল দিতে হবে, কিন্তু শীত কালে এনাকে ৭/১০ দিন অন্তর জল দিতে হবে কারণ শীতকালে এনারা ঘুমান। সারাবাছর এনারা ফুল দেন। বর্ষার জল এনাদের খুব পছন্দ কিন্তু গোড়ায় জল জমলেই রেগে যান। তাই এ্নাদের টবের নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক ভাবে করতে হবে।

v অ্যালামুন্ডাঃ ইনি আমাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে এই বছর আমার বাগান আলো করে আছেন।গাছটিতে প্রচুর রোদ লাগে। যত্ন বেশি করতে হয় না কিন্তু ইনি প্রচুর জল খান। গ্রীষ্মের দাবদাহে বাগানে যেন এই পরী আগুন লাগিয়ে দেন। বিভিন্ন রঙের হয়, কিন্তু আমার কাছে হলুদ এবং মেরুন রঙের অ্যালামুন্ডা আছে।

v জবাঃ সারাবছর আমার বাগান আলো করে থাকে। লোকে বলে শীতে নাকি জবা তেমন ফোটে না, কিন্তু আমার বাগানে সারা বছর জবা থাকে। এনাকে খুব মিলিবাগ আক্রমণ করে সময় মতো টাফগর/নিমতেল ব্যবহার করতে হয়। এই সুন্দরীকে গোলাপের খাবারই দেবো কিন্তু ইউরিয়াটা শুধু যোগ করব। আমার কাছে অনেক ধরনের জবা আছে।

v ভিনকা/নয়নতারাঃ আমার বাগানকে ইনি আরো সুন্দর করে তুলেছে্ন ।ভিনকা হল নয়নতারার বিদেশি প্রজাতি। নয়নতারা /ভিনকা সারা বছর বাঁচে, এদের যত্নও কম। ভিনকা বিভিন্ন রঙের হয় কিন্তু নয়নতারা দুটি রঙের হয়। ভিনকা বৃষ্টির জল বেশি খেলে মারা যেতে পারে।

v ক্যাকটাসঃ  আমার  বাগানে  একটা জায়গা জুড়ে রয়েছে আমার কণ্টক সুন্দরী। বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস হয়ে থাকে প্রকৃতিতে। কিন্তু আমার কাছে  মাত্র চার ধরনের কন্টকসুন্দরী আছে।

এছাড়া বহু রঙের দেশি বিদেশি পর্তুলিকা (নাইন ও ক্লক বলে জানি), পাথরকুচিও আছে।

এবার চলে আসি পাতাবাহার সুন্দরীদের কথা।এদের পাতাগুলি এত সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না।প্রথমে বলি-

v কলিয়াসঃ ইনি বিভিন্ন ধরনের ও রঙের হয়ে থাকেন। আমার বাগানে ইনি এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে্ন দেখে মনে সবুজের মধ্যে মেরুন রঙের চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। এই গাছের কিছু যত্ন লাগে না। গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে দিলেই গাছ হয়ে যাবে।

v স্নেক প্ল্যান্টঃ স্নেক প্ল্যান্ট দেখতে খুব সুন্দর, ঝামেলাহীন গাছ, জল খুব কম লাগে। প্রকৃতিতে স্নেক প্ল্যান্ট অনেক ধরনের হয়। আমার কাছে চার রকমের স্নেক আছে, এগুলি ইনডোরেও রাখা যায়। একটা লাগালে বাড়ি ভরে যায়, খুব শক্তপোক্ত গাছ।

v জিজি প্ল্যান্টঃ ইনি ইনডোর প্ল্যান্ট, জল খুব কম লাগে। পাতাগুলি এত সুন্দর ঠিক মনে হয় পাতার উপর কেউ যেন মোমের প্রলেপ দিয়ে রেখেছে।

v সিঙ্গোনিয়ামঃ  প্রকৃতিতে অনেক ধরনের সিঙ্গোনিয়াম আছে। আমার কাছে একরকমই আছে। ইনিও ইনডোর প্ল্যান্ট। আমার ব্যলকনিতে একটি স্থান জুড়ে আছে।

পার্পেল হার্ট, মানি প্ল্যান্ট, ওয়ান্ডারিং জিও প্ল্যান্ট, টার্টেল ভাইন, বেবি টিয়ার্স প্ল্যান্ট, মনস্টার প্ল্যান্ট এই গাছগুলি আমার বারান্দাকে রূপে ভরিয়ে রেখেছে। তার উপর উপরি পাওনা হল  নানা ধরনের পাখির আনাগোনা। আমরা যেমন ওই বারান্দায় গিয়ে মনে শান্তি ,চোখের শান্তি পাই ঠিক তেমনি মনে হয় এখানে এসে পাখিরা মনের শান্তির খোঁজ পায়। এই গাছগুলিতে তেমন কিছুই দিতে হয়  না শুধু একটু ভালোবেসে জল দিতে হবে।

এই হল আমার পরীদের সম্ভার। যাদের ছাড়া আমি এক দিন ও থাকতে পারি না। যতদিন আমি আছি ওরাও আমার সাথে থাকবে।













manasibasu1@gmail.com
হুগলী

1 comment: