1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

দেউলপুরের পোলো বল


দেউলপুরের পোলো বল

কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

     পোলো খেলা ছিল বড়লোকদের খেলা। সাধারণত রাজরাজারা এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাই এই খেলা খেলতেন। সাহেব-সুবোরাও খেলতেন বিনোদনের জন্য। কেউ কেউ এই খেলাকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন। পৃথিবীতে প্রচলিত হাজারো খেলার মধ্যে পোলো অন্যতম প্রাচীন খেলা। এর বয়স আনুমানিক ২০০০ বছর। পারস্যে (বর্তমানে ইরান) এই খেলার জন্ম। সেই সময়ে আর কোনো দেশে পোলো খেলা হত কী না তা জানা নেই। তাই পারস্যকেই এই খেলার আবিষ্কারক বলে ধরে নেওয়া হয়। সেদেশের সম্ভ্রান্ত বংশের পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এই খেলা অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাদশাহ দ্বিতীয় খসরু পারভেজের হারেমে থাকা রানিরাও পোলো খেলায় অংশ নিতেন। ধীরে ধীরে খেলাটি পারস্য থেকে আরব, তিব্বত হয়ে ভারতে আসে। এদেশে পোলো খেলার শুরু সুলিতান কুতুবউদ্দিন আইবক এর আমলে। একদিন খেলার সময় দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে একটা লাঠি আর বল দিয়ে পোলো খেলা   ইংরেজদের মনে ধরে। এর পরে খেলাটা ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জন্মলগ্ন থেকেই পোলো রাজা-বাদসাদের খেলা। তাই এর অপর নাম ‘দ্য স্পোর্টস অফ কিং’।

     পোলো খেলার জন্ম পারস্যে হলেও আধুনিক পোলোর সূচনা ভারতে ব্রিটিশদের হাত ধরে। সম্ভবত মনিপুর নিবাসী ব্রিটিশরাই এদেশে প্রথম পোলো খেলা শুরু করেন। তাঁরা সাধারণত ইম্ফলে আউটার পোলো গ্রাউন্ডে খেলতেন। এই মাঠটি ইম্ফল পোলো গ্রাউন্ড নামে ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। তাঁদের খেলা দেখে সেখানকার রাজা ও সম্ভ্রান্তরা এই খেলায় আকৃষ্ট  হন এবং তাঁরাও খেলা শুরু করেন। তবে তাঁরা ব্রিটিশদের মতো উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে খেলতেন না। খেলতেন রাজপ্রাসাদ বা দুর্গের মধ্যে ইনার পোলো গ্রাউন্ডে। প্রথম পোলো ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৩৪ সালে অসমের শিলচর শহরে। ১৮৬২ সালে দু’জন ব্রিটিশ সেনার উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘ক্যালকাটা পোলো ক্লাব’। সেই সঙ্গে পোলো খেলার ইতিহাসে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয় কলকাতা। সময়ের সাথে সাথে এই খেলার নিয়মকানুন এবং খেলার ধরন অনেকটাই পালটে গেছে।          

     পোলো খেলার সঙ্গে হকি খেলার কিছুটা মিল থাকলেও অমিলও অনেক। যেমন, পোলো খেলায় খেলোয়াড়রা মাটিতে  না দৌড়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলে। এই খেলার নিয়মকানুনও আলাদা। ঘোড়ার পিঠে বসে মাটিতে বলের নাগাল পাওয়ার  জন্য হকি-স্টিকের তুলনায় এই খেলার স্টিক অনেক লম্বা হয়। এদের বলা হয় ‘ম্যালেট’। প্রতিযোগী দল দুটির একেকটিতে চারজন করে খেলোয়াড় থাকে। যে মাঠে খেলা হয় তার মাপ থাকে ৯০০ ফুট X ৪৮০ ফুট। দু’পাশের দুই গোলপোস্টর দুই বারের মধ্যে দূরত্ব থাকে ২৪ ফুট। অত্যন্ত পরিশ্রমের খেলা। একটানা বেশি সময় ধরে খেলা যায় না। মাঝে মাঝে খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিতে হয়। সাধারণত ৬, ৭, ৮ রাউন্ডে খেলাটি হয়। এই রাউন্ডকে বলা হয় চুক্কার। প্রতিটি চুক্কারের স্থিতিকাল ৭·৫ মিনিট। পোলো খেলার জন্য ভালো ঘোড়সওয়ার হতে হয়। জয়পুরে  ঘোড়ার পরিবর্তে হাতি এবং উট ব্যবহার করতে দেখা যায়। অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলা। তাই মূলত রাজরাজা এবং অর্থবান লোকেদের মধ্যেই এই খেলা সীমাবদ্ধ ছিল। এই খেলাটির প্রতি সাধারণ মানুষের যাতে আগ্রহ জন্মায় এবং তারাও যাতে খেলতে পারে সেই উদ্দেশ্যে বর্তমানে ঘোড়া, হাতি, উট-এর পরিবর্তে কোথাও কোথাও সাইকেল ব্যবহার করা হচ্ছে।

     ‘ক্যালকাটা পোলো ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে) উচ্চবিত্ত লোকেদের মধ্যে পোলো খেলার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ফলে চাহিদা বাড়তে থাকে ম্যালেট ও পোলো বলের। পোলো বল তৈরির প্রধান উপকরণ হল কাঠ। পরবর্তীকালে দেউলপুরের শিল্পীদের হাতে এই বল তৈরি হল এই এলাকায় জন্মানো এক বিশেষ ধরনের বাঁশ গাছের গোড়া দিয়ে। দেখা গেল কাঠ দিয়ে তৈরি বলের চেয়ে এই বল অনেক বেশি উন্নত মানের। ফলে বাঁশের গোড়া দিয়ে তৈরি পোলো বল সহজেই দেশ বিদেশের পোলো-বিলাসীদের মন জয় করে নিল। দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, জয়পুর, থেকে শুরু করে সুদূর ইংল্যান্ড, আমেরিকা কোথায় না যেত এই বল! তবে সবথেকে বেশি চাহিদা ছিল ব্রিটেনে। শুধু আমেরিকা ও লন্ডনেই দেড় থেকে দু’লক্ষ বল রপ্তানি হত দেউলপুর থেকে। হাওড়ার এই ছোট্ট গ্রামটি সেসময় সারা বছরই সরগরম থাকত পোলো খেলোয়াড়দের আনাগোনায়। অনেকেই চাইতেন পছন্দের বলটি নিজের হাতে বাছাই করে নিতে। এভাবে বল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের খেলোয়াড়দের উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশি। বিপুল চাহিদা সামাল দিতে তখন দেউলপুরের ঘরে ঘরে তৈরি হত এই বল। কোলে অ্যান্ড দাস, বাগ কোম্পানি, বাগ ব্রাদার্স ইত্যাদি নামে প্রায় ৫-৬ টা কোম্পানিও গড়ে উঠেছিল এই গ্রামে।   

     এই বল তৈরির সরঞ্জাম ছিল খুব সামান্য। র‌্যাঁদা, বাটালি, ফাইল আর হাতের কৌশলে শিল্পীরা তৈরি করতেন আন্তর্জাতিক মানের এই পোলো বল। খেলার মাঠে এই বল ছোটে ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত গতিতে। আর কাঠের বলের মতো হঠাৎ করে ফেটেও যায় না।   

     ১৯৯০ সালের শেষ থেকে পোলো বল রপ্তানিতে প্রবল ধাক্কা খায় দেউলপুর। বাজার দখল করে নেয় আর্জেন্টিনার সিন্থেটিক বল। তাই অনেকেই বাপ-ঠাকুর্দার ব্যবসা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য কাজ। গ্রামের গুটি কয়েক পরিবার এখনও তাদের পুরোণো পারিবারিক ব্যবসাকে ঘিরে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ধুলোগোড়ি চৌরাস্তায় পৌঁছে পশ্চিম দিকে ৮ কিলোমিটার পথ গেলে পৌঁছে যাওয়া যাবে দেউলপুর গ্রামে।

     দেউলপুরের পোলো বল এখন ইতিহাস। তবে পোলো খেলার সঙ্গে এখানকার মানুষের সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে যায়নি। আগেকার সেই রমরমা না থাকলেও এখানে এখন তৈরি হচ্ছে পোলো স্টিক যা অদূর ভবিষ্যতে স্টিক ব্যবসায়ে আর্জেন্টিনার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। স্টিক ছাড়াও খেলার কিছু সরঞ্জামও তৈরি হচ্ছে সেই সঙ্গে চলছে সিন্থেটিক বল তৈরির পরিকল্পনা যা কার্যকার হলে দেউলপুর হয়ত আবার ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব।

kbb.scwriter@gmail.com

No comments:

Post a Comment