1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

পাঁঠার মাংস


পাঁঠার মাংস

অমিতাভ সাহা

       কন্ট্রাক্টর রুনুবাবু বহুদিন ধরে অফিসের সাহেবের পিছুপিছু ঘুরছেন একটা কাজ পাওয়ার জন্য। লকডাউনের বাজারে কাজকর্ম নেই, খুবই বাজে অবস্থা। সাহেবকে তেল মেরে হোক, বা যেমন করেই হোক, একটা কাজ বাগাতেই হবে। তার জন্য সামান্য কিছু খরচাপাতি হলে তাও সই। কিন্তু সাহেব ওনাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না। সাহেব বয়স্ক, রাশভারি মানুষ। সামনাসামনি জোরাজোরিও করা যায় না।

বিশ্বস্তসূত্রে খবর পেলেন, কচি পাঁঠার মাংসের ঝোল সাহেবের খুব পছন্দ। তাই রুনুবাবু ভাবলেন, সাহেবকে একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবেন। কদিন পরেই ওনার বিবাহবার্ষিকী ছিল। তাই ভাবলেন, এই অছিলায় সাহেবকে ডেকে খাওয়ানো যায়। সাহেবকে অফিসে গিয়ে ইনভাইট করে এলেন, “স্যার, এই রোববার দুপুরে গরীবের বাড়িতে কিন্তু পদধূলি দিতেই হবে। নাহলে মাইন্ড করব”। সাহেবকে অনেক কষ্টে রাজি করালেন।

রুনুবাবুর বাড়ি ছিল কুচবিহার শহরে। রোববার সকালবেলা চাকর হরেনকে ডেকে হাজার টাকা দিয়ে বললেন, “শোন, ডোডেয়ারহাট থেকে কচি পাঁঠার মাংস নিয়ে আসবি। কম সে কম এক কিলো। ঐ টাকায় যা হবে তাই নিয়ে আসবি। আজ সাহেব এখানে খাবেন”। কুচবিহার শহরের নিকটে ডোডেয়ারহাটে ভালো পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়।

হরেন তো হাজার টাকা হাতে পেয়ে মহাখুশি। বলল, “আর আমার যাওয়া-আসার ভাড়া দেবে না?”।

রুনুবাবু বললেন, “যাওয়া-আসার ভাড়া ওর মধ্যেই দেওয়া আছে রে হারামজাদা”।

হরেন ওর মালিককে ভালো মত চেনে। এমন কঞ্জুস লোক আর দুটি নেই। এতদিন এ বাড়িতে চাকরি করছে, না কোনদিন পুজো বোনাস পেয়েছে, না কখনো কোন বকশিস। তাই আজকে যখন হাজার টাকা হাতে পেয়েছে, তখন এর সদ্গতি করতেই হবে।

অনেকদিন হরেনের বাড়িতে পাঁঠার মাংস ওঠেনি। বাবুর দেওয়া টাকা থেকে সরিয়ে কিভাবে নিজের বাড়ির জন্য মাংস নেবে, তাই ভাবতে লাগল। বাবুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওর পরিচিত একটা মাংসের দোকানে চলে গেল। হরেন জানত, ঐ দোকানের ছেলেটা ডোডেয়ারহাট থেকে পাঁঠা নিয়ে এসে ওর দোকানে কাটে। কচি পাঁঠার মাংসের দাম জিজ্ঞেস করল। ছেলেটা বলল, “আটশ টাকা কিলো”।

হরেন বলল, “বাপ রে! এত দাম বেড়েছে! পাঁঠা তো আর হাতই দেওয়া যাবে না”

ছেলেটা -“এখন এ রকমই দাম”

হরেন- “এর থেকে সস্তার মাল নেই?”

ছেলেটা-“সস্তায় পাবে। তবে পাঁঠা পাবে না। পাঁঠী হবে। পাঁচশ টাকায় পাবে”।

হরেন শুনে খুশি হয়ে বলল, “তুই পাঁঠীর মাংসই এক কিলো দে”

ছেলেটা- “মাংসটা কিন্তু একটু শক্ত হবে। পরে এসে নালিশ করতে পারবে না”

হরেন -“তুই দে না। আর ঐ যে কচি পাঁঠাটা ঝুলিয়ে রেখেছিস, ওখান থেকে পাঁচশ গ্রাম দে”

দোকানের ছেলেটা তাই দিল। হরেন রুনুবাবুর বাড়িতে এক কিলো মাংস দিয়ে আর পাঁচশ গ্রাম মাংস হাপিস করে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল।

রুনুবাবুর গিন্নি মাংস ধুতে গিয়ে কেমন একটা গন্ধ পেলেন। রুনুবাবুকে এসে বললেন, “মাংসটা মনে হয় কচি নয় গো। কেমন যেন গন্ধ করছে। মনে হয় বুড়ো পাঁঠা। কাকে দিয়ে আনিয়েছ?”

রুনুবাবু দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বললেন, “হরেনকে দিয়েই তো আনালাম। শালা, আজকের দিনেই ডোবাল মনে হচ্ছে। তুমি এক কাজ করো। মাংসটা লেবুর রস মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দাও। তারপর জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নাও। তাহলে বোধ হয় গন্ধটা যাবে”।

গিন্নি তাই করলেন। গন্ধটা খানিকটা গেল। তারপর প্রেসার কুকারে মাংসটা ভেজে নিয়ে মশলা মাখিয়ে মাংসটা কষিয়ে নিয়ে পরিমাণমত জল দিয়ে কুকারে তিন-চারটে সিটি দিয়ে মাংস নামিয়ে নিলেন। মাংস টেস্ট করার জন্য রুনুবাবুকে ডেকে বাটিতে একটুকরো মাংস তুলে দিলেন। উনি মুখে দিয়ে দেখেন, মাংস রীতিমত শক্ত, দাঁত দিয়ে টেনে ছেঁড়া যাচ্ছে না। বললেন, “সর্বনাশ! এ তো বুড়ো পাঁঠা নিয়ে এসেছে। এই মাংস খেতে তো দাঁত খুলে চলে আসবে। তুমি এক কাজ করো, আরও সাত-আটটা সিটি মেরে দাও। না হলে এ মাংস সেদ্ধ হবে না”। গিন্নি তাই করলেন। তারপর প্রেসার কুকার থেকে বের করে দেখলেন, মাংসটা একটু বেশিই সেদ্ধ হয়ে গেছে। হাড় আর মাংস আলাদা হয়ে গেছে।

রুনুবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “এই মাংস না খাওয়ালেই ভালো হত। খাইয়ে আরও বদনাম কুড়নো। হরেন হারামজাদাকে পাই আগে”।

দুপুরবেলা সাহেব গাড়ি করে রুনুবাবুর বাড়ি এলেন। এসেই রুনুবাবুকে বললেন, “একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। দাঁত ফেলে এসেছি বাড়িতে। গাড়িতে আসার সময় মাঝরাস্তায় মনে পড়ল। তাই আজ আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হল না। প্লিজ কিছু মনে করবেন না”-বলেই একটা ফোকলা হাসি দিলেন।

রুনুবাবু জানতেন না, অফিসে সাহেবের যে সুন্দর দাঁতগুলো দেখেছিলেন, সেগুলি আসলে এক্সট্রা লাগানো দাঁত। উনি একটু ভেবে বললেন, “আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আপনার জন্য কচি পাঁঠার ঝোল রান্না করেছি। একদম নরম, মুখে দিলেই গলে যাবে। ডোডেয়ারহাটের কচি পাঁঠা”।

কচি পাঁঠার ঝোলের কথা শুনে সাহেবের মুখেও জল চলে এলো। উনি আর না করলেন না। মাংস খাবার সময় সাহেবের মুখ কিঞ্চিৎ বিকৃত দেখে রুনুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন হয়েছে স্যার মাংসটা?”

সাহেব একটু বিরক্তির স্বরে বললেন, “এই আপনার কচি পাঁঠা! পুরো চিমড়ে মাংস। এ তো মনে হচ্ছে বয়স্ক পাঁঠীর মাংস। প্রেসারে সিটি দিলেই মাংস কচি হয়ে যায় নাকি? আপনি বোকা পাঁঠা পেয়েছেন আমাকে?”

সাহেবের মুড পুরো খিঁচড়ে গেল। উনি কোনমতে খেয়ে উঠে গেলেন। রুনুবাবু ভীষণ অপদস্থ হলেন। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল হরেনের উপর।

সাহেব চলে যাবার পর উনি গেলেন হরেনের বাড়ি ওর গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করতে। হরেনের বাবা দাওয়ায় খাটিয়ায় আরাম করে বসে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন। রুনুবাবুকে দেখে ব্যস্ত হয়ে সামনে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসালেন। রুনুবাবু হরেনের কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, “এই তো এখানেই ছিল। একটু আগেই খাওয়া দাওয়া করে উঠল। তা বাবু, আপনার যে এত দয়ার শরীর জানতাম না। আজ কতদিন পরে যে আপনার দৌলতে কচি পাঁঠার মাংস খেলাম! কচি পাঁঠার স্বাদ তো ভুলতেই বসেছিলাম। হরেন বাড়ি ফিরে বলল, সাহেব মাংস দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমাদের লোক বেশি, দু টুকরো করে ভাগে পেয়েছি। তবু কচি পাঁঠার মাংস দু টুকরো খেলেও শান্তি। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন”।

রুনুবাবু একটা মেকী হাসি দিয়ে বললেন, “অনেকদিন আপনাদের জন্য কিছু পাঠানো হয়নি। তাই ভাবলাম আর কি!”

কিন্তু মনেমনে হরেনের উপর রাগে গজগজ করছিলেন। ভাবলেন, ওনার বাড়িতে পাঁঠীর মাংস গছিয়ে নিজের বাড়ির জন্য কচি পাঁঠার মাংস নিয়ে এসেছে!  দাঁড়া তোকে আগে একলা পাই! কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরতে হল।

হরেন আঁচ করতে পেরেছিল, বাবু নিশ্চয়ই নালিশ জানাতে ওদের বাড়ি এসেছেন। তাই দূর থেকে দেখতে পেয়েই চম্পট দিয়েছিল। বিকেল অব্দি আর বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখেনি।

amitava6@gmail.com 
কোচবিহার

No comments:

Post a Comment