1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

মন

ছবি : ইন্টারনেট 

 মন

ডাঃ জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

                                                                           (১) 


পা টিপে টিপে ভারী হাতুড়িটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আমি সিঁড়ির তলার অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকছি।অনেক দিন ধরে ও আমার পিছনে লেগেছে ।আমার জীবনটাকে অতিষ্ট করে তুলেছে।রাত্রি হলেই আমাকে ও ভয় দেখায় যে আমার একমাত্র ছেলেটাকে ও মেরে ফেলবে আর আমার বউটাকে হাতাবে।অনেক দিন মুখ বুজে সহ্য করার পর আজ সুযোগটা হাতে এসেছে। আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর ফল ওকে আজ চোকাতেই হবে।এমনিতে আমাদের সিঁড়িগুলো বেশ চওড়া, সেইজন্য সিঁড়ির তোলার ঘরটাও বেশ বড়সড়।একজনের শোয়ার পক্ষে যথেষ্টই, তবে দাঁড়ালেই মাথায় ধাক্কা লাগে। ঘরটার মুখে একটা গ্রীল এর দরজা আছে।

আস্তে করে ঠেলতেই ওটা খুলে গেল।অল্প ক্যাঁচ করে একটা ধাতব আওয়াজ হওয়ায় থমকে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নিস্তব্ধ।দূরের বারান্দার হালকা আলোটা কিছুটা উঠানে পড়েছে।শীতকালের রাত্রে আমি মাথায় চাদর মুড়ে দিয়ে নিয়েছি, যাতে কেউ দেখতে না পায়।বহুদিন তক্কে তক্কে ছিলাম এই শুভদিনটার জন্য।ছোট্ট ঘরটার ভিতরে ওর হালকা নাক ডাকার আওয়াজ যেন শুনতে পেলাম।আমি নিশ্চিত ও ভিতরে লেপ ঢাকা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।এটাই সুবর্ণ সুযোগ।গ্রীলটার পরেই যে পর্দাটা সেটা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিলাম।ওই তো ও শুয়ে আছে।নাক ডাকাটা আর শোনা না গেলেও লেপের তলায় ওর অবয়বটা আমি পুরো বুঝতে পারছি।আমার কিন্তু হাত কাঁপছে না । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সহায় আমার।হাতুড়িটাকে মাথার ওপর তুলে ওই নিশ্চিন্তে লেপের নীচে শুয়ে থাকা অবয়বটাকে আর একবার দেখলাম।সিঁড়ির নিচের ঘর বলে এখানে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।একটু ঝুঁকে দাঁড়াতে হয়।হাতুড়িটা ওপরে তুলতেই ওটা হেলানো দেওয়ালের গায়ে লেগে গেলো।আমি সামলে নিলাম।তুই আমার জীবনটাকে নরক করে তুলেছিলি, আজ আমিই তোকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে তার প্রতিশোধ নেব।মোটা, ভারী হাতুড়িটা দিয়ে সামনে ঝুঁকে এবার সজোরে ওর লেপে মুড়ি দেওয়া  মাথায় বার বার বাড়ি মারতে থাকলাম।


       (২)


বেশ কিছুমাস আগে আমি সরকারি চাকরি থেকে  স্বেচ্ছাঅবসর নিয়ে বাড়িতে বসে আছি।চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেই প্রায় দু বছর আগে আমার পাশে বসা, আমার এতদিনের প্রানের বন্ধু হঠাৎই একদিন আমার পিছনে লাগা শুরু করেছিল।আমার নামে একে, ওকে লাগানো দিয়ে শুরু। একদিন ওকে সামনা সামনিই প্রতিবাদ করে বললাম

"দেখ পীযুষ, তুই আমার এতদিনের বন্ধু আর তুই কিনা আমার নামে লোককে উল্টোপাল্টা বলছিস?" ও যেন কিছুই জানে না এমন ভান করে আমার দিকে বড় বড় অবিশ্বাসের চক্ষে তাকিয়েছিল।

তারপর যেবার অফিসের বসের ঘর থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা চুরি গেল, পীযুষ আমাকে চোর বদনাম দিয়ে দিল।আমার সামনে অবশ্য বলেনি।আড়ালে আবডালে সকলকে বলতে শুনলাম ওটা নাকি আমিই বসের ঘরের ড্রয়ার থেকে সুযোগ বুঝে তুলে নিয়েছি।আমার কানে আসতো ও ফিসফিস  অফিসের অন্য লোকেদের কানে কানে আমার চুরির গল্পটা বলে বেড়াচ্ছে।কিন্তু কেউ আমাকে সামনা সামনি কিছুই বলেনা।বললে বরং আমি যে চুরি করতে পারিনা সেই যুক্তিটা সাজাতে পারতাম, সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম যে চুরিটা আমি করিনি।কিন্তু ওরা আমার আড়ালে চোর বলে হাসাহাসি করে।রাগ হলো।প্রচন্ড রাগ।ওদিকে আমার অবসরের সময়ও চলে আসছে।অকারণে চুরির বদনাম নিয়ে চলে যেতে হবে ভেবেই মাথায় খুন চড়ে গেল।একদিন দুপুরে টিফিনের সময় পীযুষ সবে খেয়ে ডেস্কে মাথা দিয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিল।আমি বেশ কয়েকদিন ধরেই বদলা নেবার সুযোগ খুঁজছিলাম।ওকে ওই অবস্থায় দেখেই আইডিয়াটা মাথায় খেলে গেল।ওরই ল্যাপটপ দিয়ে ওর মাথাতেই সজোরে আঘাত করতে যাবো বলে সবে ল্যাপটপটা মাথার ওপর তুলেছি তখনই সবাই হইহই করে ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরলো।শয়তানটা বেঁচে গেল সেযাত্রায়।  অফিসের সবাই আমাকে জোর করে হাসপাতালে ধরে নিয়ে এলো।কি সব ইনজেকশন দিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সে কি ঘুম।প্রায় দুদিন বেঘোরে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার পর যখন আমার একটু হুঁশ হলো দেখি হাসপাতালে আমার বেডের পাশের সোফায় আমার স্ত্রী আর পীযুষ বসে আছে।

ঘাপটি মেরে শুয়ে পরিষ্কার যেন শুনতে পারছি ওরা ফিসফিস করে প্রেম করছে।ছি ছি এই বয়সে আমার বউয়ের কি ভীমরতি হলো যে ওর  হাঁটুর বয়সী পীযুষ এর সাথে ফস্টিনস্টি করছে।এই প্রায় দুদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, এরমধ্যে ওরা আরো কিনা কি করেছে, কে জানে।ঘেন্নায় আমার গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো।

আমি ওদের দিকে পিছন ফিরে চোখ খুলে শুয়ে আছি।আমার ঠিক একফুট দূরে একটা ছোট ড্রয়ারের ওপর কাঁচের গ্লাসটা দেখেই মতলব টা ভেবে নিলাম।ওটা ধরেই পীযুষের মাথা লক্ষ্য করে  ছুড়বো।চুপি চুপি হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা ধরে পিছন ফিরে ছুড়তে যাবো, ব্যাস একজন নার্স ঘরে ঢুকে পড়ল।আমার আর সেদিন পীযুষকে শিক্ষা দেওয়া হলো না।

দুদিন পর হাসপাতালের থেকে ছুটি হয়ে বাড়ি ফিরলাম।কিন্তু কানে যেন সবসময় কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে।সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে শুয়েছি ,হটাৎ মনে হলো ছাদ থেকে কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকছে।দৌড়ে ছাদে গিয়ে দেখি মাথায় মুকুট, হাতে -কোমরে বহুমূল্য সোনার গয়নায় সুসজ্জিত এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ সুপুরুষ ব্যক্তি ছাদের জলের ট্যাংকের গায়ে একটা পা অন্য পায়ের ওপর দিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।দেখেই চিনতে পারলাম।আরে আমার আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ না।উনি এই গরীবের ছাদে ভর দুপুরে কি করছেন? টুপ করে একটা পেন্নাম ঠুকে হাত জড়ো করে বললাম," প্রভু,কি সৌভাগ্য আমার।আপনি আমাকে স্মরণ করেছেন।আমার নিদারুণ দুঃখের দিনে আপনি যে আমায় স্মরণ করেছেন, আমি কৃতার্থ। কি আজ্ঞা হয় আদেশ করুন।"

ভর দুপুরে খাঁ খাঁ করছে ছাদ।একদম মাথার ওপরে সূর্য।কয়েকটা পাতিকাক কোথা থেকে একটা মরা মেঠোইঁদুর ছাদে তুলে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণর পায়ের কাছে ওটার দখল নিয়ে নিজেদের ভিতর লড়াই করছে।যে মহাপ্রভু এতো বড় কুরুক্ষেত্রের লড়াই পরিচালনা করলেন উনি কি দাঁড়িয়ে কাকেদের লড়াই দেখবেন? দেখি শ্রীকৃষ্ণ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।সেই রহস্যময় হাসি।ওনার সুদর্শন চক্রটি তো দেখতে পারছি না।

" কিরে খুব কষ্টে আছিস তো?" শ্রীকৃষ্ণ আমায় জিজ্ঞাসা করলেন।

" প্রভু, আপনার কৃপায় খেতে পরতে সত্যিই কোনো কষ্ট নেই।পেনশনের টাকায় আমার চলে যায়।পৈতৃক বাড়িতে থাকি।রিটায়ারমেন্টের পুরো টাকাটাই ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট  করা আছে।কষ্ট কেবল আমার মনে।আমার  বিয়ে করা বউ আমার পুরনো অফিসের কলিগ পীযুষের সাথে প্রেম করে।।পীযুষ আমার একমাত্র ছেলেকেও মেরে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে।"

উনি আবার হাসলেন।ডান হাত তুলে অভয়বানী দিলেন

" সংসারে সবই মায়া রে।তোর কর্মফল তুই ভোগ করছিস।তা তোর অপেক্ষা কিসের?পীযুষ কে মেরে ফেল।"

" পাপ হবে না তো প্রভু?"

" তুই তো আমাকে হাসালি বৎস।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভাইকে দিয়ে  ভাইকে মারালাম, কোথাও কিছু পাপ হলো না।পাপ- পুণ্য সব আমি ঠিক করি।কর্ম করে ফলের আশা ত্যাগ কর।তোর যদি ওকে শত্রু মনে হয় তাহলে ওকে মেরে ফেল।" শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিলেন।

হটাৎ দেখি আমার স্ত্রী আমায় খুঁজতে ছাদে এসে হাজির হয়েছে।আমাকে জোর করে ডাকাডাকি শুরু করলো।আমি ভীষণ রেগে গেলাম।সবে শ্রীকৃষ্ণের সাথে শলাপরামর্শ শুরু করেছি অমনি বাধা পড়লো।

" ভর দুপুরে একলা ছাদে দাঁড়িয়ে কার সাথে বকবক করছো?" স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করলো।

"সামনে ওনাকে দেখতে পারছো না।স্বয়ং ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ ট্যাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।ওনার সাথে কথা বলছি।তুমি নিচে চলে যাও।আমি কথা শেষ করে আসছি।"

আমার স্ত্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।আমি চিৎকার করে শ্রীকৃষ্ণকে বলতে লাগলাম," তুমি দেখো ঠাকুর, এরা আমার ওপর কিরকম অত্যাচার করছে।"

আমাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে আমার স্ত্রী বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।এখনো আমি শ্রীকৃষ্ণের গায়ের থেকে বেরোনো সুন্দর চন্দনের গন্ধ পাচ্ছি।

ডাক্তার এসেছেন।আমাকে উনি বহুভাবে পুলিশি জেরা করলেন। তিনপাতার   প্রশ্নাবলি দেওয়া হলো।উনি বললেন ," এই প্রশ্নগুলোর জবাব লিখুন।"

আমি চিৎকার করে বললাম," আমি কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না।"

ডাক্তার বললেন," ভাওলেন্ট রুগী।এডমিট করতে হবে।"

আবার আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হলো।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

জেগে উঠে দেখি পীযুষ আর আমার স্ত্রী আমার পাশে কাঠের চেয়ারে বসে।আমার ছেলে পাশের সোফায় খেলা করছে।ওকে আমি বড্ড ভালোবাসি।আমার সুন্দর সংসারটা কেবল পীযুষ এর জন্য নষ্ট হয়ে গেল।ওকে পৃথিবী থেকে সরাতেই হবে।আমি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এর সম্মতি পেয়ে গিয়েছি।আর কাউকে এখন ভয় পাই না।

" শুনছো, পীযুষ আজ থেকে রোজ রাত্রে এখানেই থাকবে।" আমার ন্যাকা স্ত্রীর কথা শুনেই আমার মাথায় খুন চড়ে গেল।ঠিক করলাম আমার বাড়িতেই আজ আমি শত্রুকে শেষ করবো।

" দাদা, আপনি চিন্তা করবেন না।আপনার তো মোটে দুটো ঘর।আমি ঐ সিঁড়ির নিচের ঘরটাতেই রাত্রে এসে শুয়ে পড়বো।বৌদি একা থাকতে ভয় পাচ্ছে।শীতকাল সিঁড়ির নিচের ঘরে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না।" পীযুষ বললো।

হারামজাদাটা আমার বাড়িতেও এসে জুটলো।এবার কখন বউয়ের সাথে ফস্টিনস্টি করবে কে জানে।রাগে আমার গা গর গর করতে লাগলো।আমি ঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম।ইদানিং ওষুধের জন্য আমার ঘুমটা প্রচন্ড বেড়ে গেছে।রাত্রে চোখ খুলতেই পারি না।ওষুধ খাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই আমার বড় বড় হাই উঠতে থাকে।তারপর একদম সকাল নয়টায় ঘুম ভাঙে।সারাদিন ঘুমঘুম ভাবে আমি আছন্ন হয়ে থাকি।

সেদিন রাত্রে হাতে ওষুধ আর জলের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে ছেলেকে খেতে দিতে পাশের ঘরে স্ত্রী যেতেই আমি ওষুধটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। বাতি নিভিয়ে ঘাপটি মেরে শোয়ার ভান করে সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলাম।একঘন্টার মধ্যেই বারান্দার বাতিটা বাদ দিয়ে বাড়ির সব বাতি নিভে গেল।আমার স্ত্রী ছেলের সাথে আর পীযুষ মনে হয় সিঁড়ির নিচের ঘরে শুতে গেল।আমি হাতুড়িটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম।

                         (৩)


পাগলের মতো হাতুড়ির ঘা লেপের ওপর পড়ছিল।সব নিশ্চয়ই শেষ ।এত হাতুড়ির ঘা খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।হয়তো লেপটা পীযূষ এর রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে এতক্ষন।অন্ধকার বলে সবটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না।আমি হাতুড়িটা ওখানেই ফেলে আবার চুপিসারে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। মাথার কাছে স্পষ্ট দেখলাম শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।

                           (৪)


আমি একমাস হাসপাতালে কাটিয়ে আজ স্ত্রীর সাথেই ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরলাম।শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে।আমি অনেকটা রোগা হয়ে গেছি। অনেকদিন কালো রং না দেওয়ায় মাথার চুকগুলো সাদা দেখাচ্ছে। মাথার দুশ্চিন্তাটা আশ্চর্যভাবে এখন প্রায় নেই বললেই চলে।ছেলে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।আঃ কি আনন্দ।শ্রীকৃষ্ণ বা পীযুষ কাউকেই কোথাও দেখতে পেলাম না।

mukhopadhyayjaydip@ymail.com
কলকাতা 


No comments:

Post a Comment