1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

কবরের ঢাকনা ভেঙে

ছবি : ইন্টারনেট 

কবরের ঢাকনা ভেঙে 

উত্তম চক্রবর্তী

অনেক অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে জুঁই সরকার। বাবা মারা গেছিলেন সেই ছোটবেলায়। বিধবা মা মেয়েকে নিয়ে এসে উঠেছিলেন বাপের বাড়িতে মামাদের সংসারে। দুই মামার সংসার আলাদা হলেও ওদের গ্রামের বাড়িটা ছিল একই জমিতে। সেখানেই দাদু দিদার পরিত্যক্ত ঘরে স্থান পেয়েছিল মা ও মেয়ে। গ্রামের স্কুল থেকে হাই স্কুল পাশ করে বহরমপুর কলেজ থেকে বি কম পাশ করল যে বছর সেই বছরেই জুঁইয়ের বড় মামা তার চেনাজানা একটি বয়স্ক ব্যবসায়ী পাত্রের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেন জুঁই বা তার মাকে না জানিয়েই। দাদাদের দয়ায় মেয়েকে এতো বড় করে এখন তাদের না করেন কি ভাবে। বাধ্য হয়েই জুঁইয়ের মা সেই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর জানা গেল জুঁইয়ের স্বামীর যক্ষ্মা রোগ আছে।  

জুঁই গ্রাজুয়েট হলেও রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠায় নিজেও এই পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যাপারে না করে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই বিয়ে বেশি দিন টিকল না। এক বছরের মধ্যেই মুখে রক্ত উঠে মারা গেল জুঁইয়ের স্বমী বেয়াল্লিশ বছরের অনাদি ঘটক। জুঁইয়ের তখন বয়স মাত্র তেইশ। ঘাড় থেকে সম্পত্তির আরেক দাবীদারকে নামাতে বিধবা জুঁইকে  অলুক্ষুনে মেয়েছেলে, অনাদির মৃত্যুর জন্য দায়ী, বদচলন ইত্যাদি ইত্যাদি বদনাম দিয়ে ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা প্রায় এক কাপড়েই তাড়িয়ে দেয়। বেচারি জুঁই ফিরে আসে মায়ের কাছে। কিন্তু জুঁইয়ের বিধবা মা তার শিক্ষিত মেয়ের জীবনের এই পরিণতিতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। এ যেন বিধাতার কু দৃষ্টি পড়েছে ওঁর উপর।  মাস ছয়েক বাদেই উনি হার্টফেল করে মারা যান।

চালচুলো হিন বাছুরের মত একবার এখানে আরেকবার ওখানে না ঘুরে একটা চাকরী নিয়ে কলকাতায় চলে যাবে ঠিক করল জুঁই। মামা মামীদের গলগ্রহ হয়ে এই বাড়িতে পড়ে থাকার কোন মানে হয়না। জুঁই খবরের কাগজ দেখে বিভিন্ন জায়গায় ওর বায়ও ডাটা পাঠাতে থাকে। কিন্তু আজকাল চাকরী পেতে গেলে হয় অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নতুবা দরকার একটা জোরাল সুপারিশ। আর জুঁইয়ের এই দুটোর একটাও ছিল না। ফলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও জুঁই একটা চাকরী জোটাতে পারল না। অবশেষে একটা গভর্নেসের কাজের বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে ওর সি ভি পাঠিয়ে দেয় জুই।  

   

মৈনাক সেন একজন অন্ধ যুবক। বয়স আটাশ,ফর্সা, সুন্দর হ্যান্ড সাম চেহারা। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, দাঁড়ি গোঁফ কাটা ফ্রেস মুখ। বিশাল বড় লোকের একমাত্র ছেলে মৈনাক একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে চোখের দৃষ্টি হারায় গত জানুয়ারিতে। একটু বেশি রাতে গাড়ি নিয়ে দিল্লী রোড ধরে বর্ধমান থেকে ফিরছিল মৈনাক। সেখানে ওদের তিনখানা ধানকল আছে। মৈনাক কোনদিনই ড্রাইভার নিয়ে যায়না সেখানে, একাই গাড়ি চালিয়ে সকালে যায় আর সেই রাতেই ফিরে আসে। সেদিন রাত এগারোটা নাগাদ দিল্লী রোডের উপর সিঙ্গুরের ঠিক আগে গোপালনগর নামের এক জায়গায় একটা ক্রসিঙে অন্য দিক থেকে আসা একটা চলন্ত ট্র্যাক সজোরে এসে ধাক্কা মারে মৈনাকের হণ্ডা সিটি গাড়িতে। গাড়ি উল্টে যায়, লোকজন ছুটে আসে। মৈনাককে স্থানিয় লোকেরা একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় সিঙ্গুর নার্সিং হোমে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে পরের দিন ওরাই কলকাতায় পি জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে দেয়।

ডাক্তাররা তিনদিন জীবন মরনের সাথে লড়াই করে মৈনাককে বাঁচিয়ে তোলেন। কিন্তু মৈনাক ওর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় না। মৈনাকের বিধবা মা একমাত্র ছেলের এই অবস্থা দেখে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েন। মৈনাক ওদিকে মনেমনে বিদ্ধস্ত হতে থাকে। এই পনের দিনের মধ্যে খবর পেয়েও নাকি ওর ভালোবাসার মানুষটা হাসপাতালে ওকে একবারও দেখতেও আসেনি। যেই দিয়াকে মৈনাক ওর মায়ের পরেই মনে স্থান দিয়েছিল, সেই চব্বিশ বছরের সুন্দরী বড়লোকের একমাত্র মেয়ে দিয়া ধীরে ধীরে অন্ধ ও অসহায় মৈনাকের থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নেয়। জেনেশুনে কোন মেয়ে চায় একটা অন্ধ লোকের লাঠি হয়ে জীবন কাটাতে। 

তবুও মৈনাক কিন্তু ওর মা শ্যামলী দেবীকে কিছুই বুঝতে দিলো না। যদিও শ্যামলী দেবী জানতেন দিয়ার কথা, ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা এবং ভাবছিলেন এই বৈশাখেই চারহাত এক করে দেবেন। কিন্তু এইভাবে হটাত দিয়ার দুরে সরে যাওয়া উনি একদম পছন্দ করেন নি। কিন্তু ছেলের মনের দিকে তাকিয়ে ওকে কখনই এই নিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেননি শ্যামলী দেবী। ওঁর এই বিপদে মৈনাকের বড় দিদি শিলা বোম্বে থেকে ছুটে এসে কয়েক দিন কাটিয়ে যায় মায়ের কাছে। মাকে স্বান্তনা দিয়ে ভাইয়ের জন্য একটা গভর্নেস রাখবার পরামর্শ দিয়ে গেল।

মৈনাকের বাবার জমিদারি ছিল বর্ধমানের বুদবুদে। আগে আরও বেশ কয়েকটা ধান কল ছিল ওদের। কিন্তু ওর বাবা নবজীবন সেন জমিদারি থেকে আয় কমে যাওয়ায় তিনখানা ধান কল বেঁচে দেন। মৈনাক আজকালকার ছেলে। আটষট্টি বছর বয়সে বাবার কঠিন অসুখে মৃত্যুর পর বছর খানেক বাদেই মৈনাক শুধু ধান কলের উপর ভরসা না করে জমিদারির কিছু অংশ বেঁচে দিয়ে সেই টাকায় কলকাতায় জমি কিনে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ফাঁদিয়ে বসে ও সাথে বুদবুদে হাইওয়ের ধারে একটা পেট্রোল পাম্পও কিনে ফেলে। এখন তিন খানা ধান কল ও পেট্রোল পাম্পের ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তার চেয়েও বেশি আয় হয় ওর রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়। ওদের বালিগঞ্জ প্লেসের বিশাল বাড়িতেই ওর অফিসে মোট দশ জন কর্মচারী কাজ করে। তাদের দেখাশুনা করে মৈনাকের বিশ্বস্ত লোক রমেন কাকা। ওর বাবার আমলের এই ভদ্রলোক অবিবাহিত। এই বাড়িতেই থাকেন ও সেন বংশেরই একজন হয়ে উঠেছেন।     

শ্যামলী দেবী মেয়ের পরামর্শে রমেনকে বলেছিলেন যে ছেলের জন্য একজন সর্বক্ষণের গভর্নেস বা আয়ার ব্যবস্থা করতে। রমেন ঘোষ সেইমত কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় প্রায় দেড়শ এপ্লিকেশন এসে পৌঁছল। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথম রাউণ্ডে দশ জনকে ইন্টার্ভিউ নিয়ে কাউকেই ওঁর পছন্দ হয়নি। এবার দ্বিতীয় রাউণ্ডে আরও দশজনকে ডেকে পাঠানো হল ইন্টার্ভিউ দেবার জন্য। তাদের মধ্য মোট তিনজনকে পছন্দ হল রমেন ঘোষের। জুঁই ছাড়াও আরও দুজন কলকাতার মেয়ে ছিল সেই লিস্টে। শ্যামলী দেবী ফাইনাল ইন্টার্ভিউ নেবেন আগেই বলে রেখেছিলন। সেইমত সেদিন বেলা সাড়ে এগারোটায় একে একে ঐ তিনজনের ডাক পড়ল শ্যামলী দেবীর দোতলার চেম্বারে। রমেন ঘোষই তাদের নিয়ে যায় সেখানে।

কলকাতার দুইজন মেয়ে যাদের রমেন সিলেক্ট করেছিল তারা মনে হল বড্ড বেশি স্মার্ট আর চালাক। সাজ দেখে মনে হয় এরা যেন টালিগঞ্জে সীনেমার জন্য স্ক্রিন টেস্ট করতে এসেছে। অথচ জুঁই নামের মেয়েটিকে শ্যামলী দেবীর বেশ ভাল লেগে গেল। মেয়েটি গ্রামের গরীব বিধবা হলেও শিক্ষিতা এবং অত্যন্ত ধীর, বুদ্ধিমতী ও শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। শ্যামলী দেবী ঠিক এরকম মেয়েরই খোঁজ করছিলেন। জুঁইকে থাকা খাওয়া ছাড়াও মাসিক মায়না দশ হাজারে চাকরীটা দিয়ে দিলেন শ্যামলী দেবী। জুঁইকে বলা হল আজ থেকেই কাজে জয়েন করতে। জুঁই ভেবেছিল কাজটা না হলে বিকেলের ট্রেনেই গ্রামে ফিরে যাবে। সেই কারণে জুঁই সাথে কোন জামাকাপড় নিয়ে আসে নি। শ্যামলী দেবী মেয়েটা যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় তাই ওকে আশ্বাস দিলেন যে জুঁইয়ের প্রয়োজনীয় জামা কাপড়ের ব্যবস্থা উনিই করে দেবেন।

জুঁই সেদিন থেকেই সেন বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে গেল একজন গভর্নেস হিসাবে। বাড়ির অন্য লোকদের ও রমেন বাবুর সাথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারলো জুঁই। রমেন বাবু ছোটকা নামের একটি ছেলেকে ডেকে বলে দিলেন জুঁইকে ওর ঘর দেখিয়ে দিতে। দোতলার বারান্দার একদম শেষে একটা এটাচ বাথসহ কামড়া দেওয়া হল জুঁইকে। ঘরের মধ্যে একটা বিছানা ছাড়াও একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার রাখা। জুঁই দেখল একটা ষ্টীলের আলমারিও আছে ঘরে। জুঁই একটু শুয়ে রেস্ট নেবার পর বেলা সাড়ে চারটের সময় একজন কাজের মহিলা ওকে ডেকে নিয়ে গেল শ্যামলী দেবীর বসবার ঘরে। বারান্দার একপশে সোফা সেট শো কেস ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো একটা বসবার ঘরে একটা সোফায় বসেছিলেন শ্যামলী দেবী।

জুঁইকে সেই সকালের ড্রেসে দেখেই রেগে গেলেন উনি। ইন্টার কমে ফোন লাগালেন রমেন বাবুকে। জিজ্ঞাসা করলেন,’জুঁইয়ের জামা কাপড়ের কী হল রমেন ? মেয়েটা সেই সকালের ড্রেস পরেই আছে এখনো। জানোতো মৈনাক এসব একদম পছন্দ করে না। কথাটা ওর কানে যাবার আগেই আমি নতুন ড্রেসগুলি এই ঘরে দেখতে চাই রমেন।‘ ওদিক থেকে রমেন ঘোষ কী বলল বোঝা গেলনা, তবে জুঁই ম্যাডামের এই ধমকিয়ে কথা বলার ধরণ দেখেই বুঝল যে মহিলা তার ছেলের পছন্দ অপছন্দের যথেষ্ট খেয়াল রাখেন আর তার কর্মচারীরাও সেইভাবেই মালিককে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে। তবে শ্যামলী দেবীর এই কনসার্ণ  জুঁইয়ের বেশ ভালো লাগে। শহরের শিক্ষিত বড়লোকেরা যে কর্মচারীদের এতোটা খেয়াল রাখে জুঁই সেটা ভাবতেও পারেনি। ফোন রেখেই শ্যামলী দেবী জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ আমার ছেলেকে তোমাকেই এখন থেকে দেখাশোনা করতে হবে। ওর পছন্দ অপছন্দগুলি তাই এখন থেকেই তোমাকে জানিয়ে রাখা ভাল। মৈনাক ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ডিসিপ্লীণ্ড মানুষ। তবে খুব এডজাস্টবল।   

মৈনাকের সাথে জুঁইয়ের আলাপ হল সেদিনই বিকাল পাঁচটার সময়। একটা লাঠি হাতে টুক টুক করে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মার ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মৈনাক। জিজ্ঞাসা করল,’ তোমার ঘরে কি আর কেউ আছে মা ? মনে হচ্ছে তুমি কারও সাথে কথা বলছিলে। আমি কি পরে আসব মা ?’ জুঁই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মৈনাকের দিকে। ঘরে পরার একটা সাদা পাজামা আর তার উপরে গেরুয়া রঙের একটা পাঞ্জাবি পরা মৈনাককে তখন দারুণ দেখতে লাগছিল। মনে হচ্ছিল বিকেলের পশ্চিমের পরিষ্কার আকাশে সূর্য ঢলে পড়বার মুহূর্ত এসে গেছে। এতো সুন্দর হাণ্ডসাম একটা যুবক এইভাবে অন্ধ হয়ে বসে আছে ভাবতেই জুঁইয়ের মনটা হু হু করে উঠল। শ্যামলী দেবী বলে উঠলেন,’এসো মৈনাক, তোমার কথাই বলছিলাম আমি এই মেয়েটিকে। এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এসো, বোস এখানে।‘

জুঁই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল মৈনাক ঠিক আন্দাজ করে এগিয়ে এসে সোফায় ওর মার পাশে বসে পড়ল। ওর দৃষ্টি অন্য দিকে হলেও মৈনাক যেন অনুভব করতে পারছিল যে একটি মেয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। লাঠীটা একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে হাত জোড় করে বলল,’নমস্কার, আমি মৈনাক। আপনি বুঝি আজ থেকেই গভর্নেসের কাজে জয়েন করলেন...।‘  মৈনাক থামতেই শ্যামলী দেবী বলে ওঠেন,’হ্যাঁ মৈনাক। ওর নাম হল জুঁই। কি মিষ্টি না নামটা ? মেয়েটাও খুব মিষ্টি মেয়ে। আজ থেকে ওই তোমার সমস্ত দেখাশোনা করবে। আমি তো করলাম এতোদিন। এবার আমার ছুটি।‘

এতক্ষণে জুঁই কথা বলল। শান্ত মিষ্টি স্বরে বলল,’ আপনি আমাকে জুঁই নাম ধরেই ডাকবেন মৈনাক বাবু। আমাকে আপনি বলবেন না। আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট। আপনি আপনি বললে আমার লজ্জা করবে। আপনি তুমি করেই ডাকতে পারেন আমাকে। আমি কিচ্ছু ভাববো না।‘ শ্যামলী দেবী মুচকি মুচকি হাসছিলেন। জুঁই থামতেই বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছ তুমি জুঁই। আপনি বললে বাইরের লোক মনে হবে। আর তুমি তো এখন থেকে এ বাড়িরই একজন তাই না ? মৈনাক তুমি ওকে তুমি করেই ডাকবে। ও তোমার পাশের ঘরেই থাকবে। যখনই দরকার পড়বে বেল বাজিয়ে ওকে ডেকে নিও।‘ 

দোতলায় একটা খাবার হলঘর আছে। সেদিন রাতেই জুঁই প্রথম সেই ঘরে বসে মৈনাককে খাইয়ে দিল। তার আগে মৈনাকের ঘরে গিয়ে ওকে ধরে ধরে তুলে বিছানা থেকে নামিয়ে পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে এসেছে। মৈনাক জিজ্ঞাসা করেছিল,’ আমার লাঠিটা দাও জুঁই।‘ কিন্তু জুঁই সেটা দেয়নি। জবাবে বলেছিল,’আজ থেকে আমিই তো আপনার লাঠি মৈনাক বাবু। আপনি আমার উপর একশ ভাগ ভরসা করতে পারেন। আমার কাঁধে হাত রাখুন আর আমার সাথে সাথে চলুন। আমি আপনাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাব। আপনার মা ওখানে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন।‘

মৈনাককে খাইয়ে দিয়ে পাশের বেসিনে ওর মুখ ধুইয়ে আবার এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল জুঁই। মৈনাকই বলেছিল মার সাথে কথা আছে। জুঁই মৈনাককে বসিয়ে নিচের খাবার ঘরে চলে যায়। দুপুরে ওই ঘরেই দুজন কাজের লোক, রমেন বাবু ও দুজন কাজের মাসীর সাথে বসে খেয়েছে জুঁই। রাতের খাওয়া হয়ে গেল পর জুঁই আবার ওপরের খাবার ঘরে ফিরে আসে শ্যামলী দেবীর সাথে কথায় ব্যস্ত মৈনাককে ওর ঘরে নিয়ে যেতে। দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পায় মৈনাক বলছে,’ তার মানে তুমি বলছ জুঁই আমাকে স্নান করানো, জামা কাপড় পরানো সব করে দেবে ? আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা করছে মা। তুমি যেভাবে করছিলে সেভাবেই করোনা। বাকি সব কাজ নাহয় জুঁই করবে।‘

জুঁই লজ্জায় লাল হয়ে গেল মৈনাকের কথা শুনে। অপেক্ষা করতে থাকে শ্যামলী দেবী কি বলেন শুনবার জন্য। শ্যামলী দেবী বলে উঠলেন,’তুমি একটা বাচ্চা ছেলের মত কথা বোলনা মৈনাক। তুমি যখন এক্সিডেন্টের পর পনের দিন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে ছিলে তখন এসব কাজ কে করেছে ? তুমি কি নিজের হাতে সব করেছ নাকি ?’ মৈনাক বলে ওঠে,’ না। আমি করব কেন ? ওসব তো নার্সরাই করেছে।‘ সাথে সাথে শ্যামলী দেবী বললেন,’ জুঁইকেও একজন নার্স ভেবে নাও। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আর তোমার বিয়ে হয়ে গেলে এসব কাজ তো তোমার বৌও করত তাই না ? তবে অতো লজ্জার কি আছে ? আমি চাই না তুমি এই নিয়ে কোনরকম আপত্তি কর মৈনাক।‘ বলেই উঠে দাঁড়ালেন শ্যামলী দেবী। 

জুঁই একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। শ্যামলী দেবী জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ ঐতো জুঁই এসে গেছে। আচ্ছা জুঁই, তুমি এখন মৈনাককে ওর ঘরে শুয়ে দিয়ে তোমার নিজের ঘরে চলে যাও। আর শোনো, কাল থেকে তুমি ওপরেই এই ঘরে খাওয়া দাওয়া করবে। আমি মানদাকে বলে দেব মৈনাকের খাওয়া হয়ে গেলে পর তোমার খাবার বেড়ে দিতে। তোমার কাজ আর ওদের কাজ মোটেই এক নয় যে তুমি নিচে গিয়ে ওদের সাথে খাওয়া দাওয়া করবে জুঁই। আমি রমেনকেও বলে দেব।‘ মৈনাক কাঁধ নাড়িয়ে মার সাথে একমত হয়ে বলল,’সেটাই ভাল হবে। জুঁইকে তাহলে আর নিচে যেতে হবে না। চল জুঁই, এবার আমাকে ঘরে নিয়ে চল। ও কে, মা আমি শুতে যাচ্ছি তাহলে।‘

বিছানা আগেই রেডি ছিল। জুঁই মৈনাককে ঘরে নিয়ে গিয়ে বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,’যান, আপনি বাথরুম সেরে নিন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।‘ মৈনাকের জুঁইয়ের এই উপস্থিত বুদ্ধি বেশ ভাল লাগে। ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে বাথরুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে যায়। ভাবে মেয়েটা যথেষ্ট ভদ্র আর বুদ্ধিমতী। মনে হচ্ছে এই মেয়েটার উপর ভরসা রাখা যাবে। বাথরুম সেরে মৈনাক বেরিয়ে এলো পর ওর পাজামার দড়ি বাইরে ঝুলছে দেখেই ফিক করে হেসে ফেলে জুঁই। মৈনাক জিজ্ঞাসা করে,’ কি হল, হাসছ কেন ? কি হয়েছে ?’ জুঁই কোন উত্তর না দিয়ে নিজের হাতে মৈনাকের পাজামার দড়ি দুটো ওর কোমরের ভিতর গুঁজে দিয়ে বলল,’ কি হয়েছে ? এই যে এই হয়েছে।‘ মৈনাক হেসে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’ ও এই ব্যাপার। তোমার দেখি সব দিকে খেয়াল আছে, ভালো ভালো।‘

মৈনাককে ঠিক করে শুইয়ে গায়ে চাদর দিয়ে ঢেকে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে জুঁই বলল,’গুড নাইট, দরকার হলে ডাকবেন। আর এই যে আপনার লাঠি এই বিছানার পাশেই দাঁড় করিয়ে রেখে গেলাম। যদি বাথরুমে যেতে লাগে তবে এটা নিয়ে যেতে পাড়বেন তো না ?’ মৈনাক বলে ওঠে,’হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি পারি সব। তুমি কোন চিন্তা করোনা। যাও গিয়ে শুয়ে পরো। আমি সকাল সাতটায় উঠি। তখন চলে এসো।‘ মনে মনে ভাবল আচ্ছা সব মেয়েরাই কি মায়েদের মত এতো দায়িত্বশীল হয় ?

দেখতে দেখতে দেড় বছর পার হয়ে গেল। এর মাঝে দুইবার শুধু দেশে মামাদের সাথে দেখা করেছে জুঁই। মাসখানেক বাদে একবার ও নিজেই গিয়ে দেখা করে মামাদের সব জানায়। আরেকবার মাস চারেক আগে বড় মামার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ওর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দুদিন বাড়িতে থেকে আসে। সেবার কলকাতায় ফিরে এসেই দেখে মৈনাকের মুখ গম্ভীর। আসলে মৈনাক এখন জুঁই ছাড়া এক পাও চলতে পারেনা। জুঁই শুধু মৈনাককে স্নান করানো, খাওয়ানো, জামা কাপড় পরতে সাহায্য করে তাই না, মৈনাকের ব্যবসার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে। এখন এই দেড় বছরে মৈনাক ওর বর্ধমানের পেট্রোল পাম্প ও তিনখানা ধান কলের হিসাব নিকাশ সব জুঁইয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে। এমন কি রমেন ঘোষকেও এসে জুঁইকে বাইরের ব্যবসা পত্রের খবরাখবর সব টু এ পাই জানাতে হয়। জুঁই এখন সেন বংশের একমাত্র অন্ধ ওয়ারিশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।    

মৈনাকের মা দিনে দিনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সুগারের রোগী, ভিতর থেকেই অনেক রকম সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছে। বয়সও তো কম হয়নি। সাতষট্টি বছর হয়ে গেল, এখনো ছেলেটার মা ছাড়া চলেনা। জুঁই মেয়েটা ওর সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তারপরেও রোজ রাতে খাবার পর মার কাছে বসে ওর ব্যবসার কথা, কর্মচারীদের কথা, জুঁইয়ের কথা সবই খুলে না বললে ওর ভাত হজম হয়না। তবে শ্যামলী দেবী একটা জিনিষ দেখে অবাক হয়ে গেছেন। একটা গ্রাম্য পরিবেশে বড় হওয়া মেয়ে জুঁই এতো ভাল ব্যবসা বোঝে সেটা ওঁকে ভীষণ অবাক করে দিয়েছে। মৈনাকও জুঁইকে ছাড়া আজকাল নিজেকে একা ভাবতেই পারেনা। ওদের দুজনের দুজনের উপর এই ভরসা শ্যামলী দেবীর ভালো লাগে। বিশেষ করে ওর এক্সিডেন্টের পর যেভাবে দিয়া মৈনাককে ছেড়ে চলে গেছিল আর মৈনাক ভিতর থেকে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছিল, জুঁই আসবার পর মৈনাক সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। দিয়ার কথা আর কোনদিন মৈনাককে বলতে শোনেননি শ্যামলী দেবী। মৈনাক যেন একটা বাচ্চা ছেলে। একটা নতুন খেলনা পেয়ে আরেকটা পুরানো খেলনার কথা ভুলেই গেছে।

সেদিন রাতে খাবার পর জুঁইকে নিজের ঘরে চলে যেতে বললেন শ্যামলী দেবী। বললেন উনি নিজেই আজ ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসবেন। জুঁইও কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। মৈনাকের সাথে নিশ্চয়ই ওর মার কিছু গোপন পারিবারিক কথা আছে। পরশু রাতে শ্যামলী দেবী খাওয়া দাওয়া সেরে উঠবার সময় বোম্বে থেকে দিদির ফোন পেয়ে কথা বলতে বলতে উঠে চলে গেছিলেন। জুঁই মৈনাকের দিদিকে কখনো দেখেনি, শুধু ফটো দেখেছে। জুঁইয়ের কানে শুধু একটা কথাই এসেছিল,’না রে, আমার সাথে এখনো এই ব্যাপারে কোন কথা হয়নি ওর। কালই আমি মৈনাককে সব বলব। দেখি ও কী বলে ...?’  

জুঁই জানে মৈনাকের আগে একজন প্রেমিকা ছিল যার সাথে ওর বিয়ে প্রায় পাকা হয়ে গেছিল। রমেন বাবু একদিন ওকে সব খুলে বলেছে। রমেন বাবু লোকটা খুব ভালো লোক। মৈনাকের বাবার খুব বিশ্বস্ত ছিলেন। পূর্ব বঙ্গের মানুষ। আগে পিছে কেউ নেই। সব সময় শুধু মৈনাকের রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার উপর শকুনের দৃষ্টিতে নজর রেখে চলেছেন। নাহলে মৈনাকের মত একজন অন্ধ মানুষকে কলকাতার মত শহরের ধূর্ত লোকেরা মাথায় চাঁটি মেরে ওর সব পয়সা হজম করে ফেলত এতদিনে। মৈনাক নিজেও জুঁইকে বলেছে,’ মার পরে তোমাকে আর রমেন কাকাকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিশ্বাস করিনা জুঁই।‘

জুঁই রোজ সকালে সাড়ে ছটায় উঠে পড়ে। পরদিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে মৈনাকের ঘরে ঢুকে দেখে মৈনাক বিছানায় উঠে বসে আছে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই মৈনাক আগেই উঠে বসে আছে দেখে জুঁই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ’কি ব্যাপার, আপনি উঠে বসে আছেন কেন ? কি শরীর খারাপ হয়নিতো আবার ? দেখি তো কপালটা। কই, নাতো, জ্বর নেই তো ! তাহলে এতো সকালে উঠলেন যে আজ ? কোথাও যাবার প্ল্যান আছে নাকি ?” 

মৈনাক হাসতে হাসতে বলে,’ হল, তোমার কথা শেষ হল ? বা বা, একবার শুরু করলে আর শেষ হয় না। আমাকে কিছু বলতে দেবে নাকি তুমি একাই বক বক করে যাবে ?’

এবার জুঁই লজ্জা পেয়ে যায়। বিছানার একপাশে বসে মৈনাকের কাঁধে হাত রেখে বলে,’ ঠিক আছে বাবা। এই আমি আপনার পাশে বসলাম। এবার বলুন কী ব্যাপারটা কী ? এতো সকালে উঠেছেন কেন ?’

মৈনাক জুঁইয়ের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,’ আচ্ছা জুঁই। আমাকে একটা কথা বল আজ। একদম সত্যি কথা বলবে কিন্তু। আমি তোমার কাছে একটা সত্যি কথা জানতে চাই আজ।‘

জুঁইয়ের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। তিন দিন আগে মৈনাককে দুপুরে ঘুম পারিয়ে দিয়ে জুঁই ওর অন্ধদের জন্য তৈরি ব্রেইল পদ্ধতির হাতঘড়িটা খুলে ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে একটা ফোটো দেখতে পায়। তুলে দেখে বেশ সুন্দর দেখতে একটা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ের ফোটো। পিছনে ডট পেন দিয়ে লেখা “ টু মৈনাক উইথ লাভ “। নিচে একটা লিপস্টিকের ছাপ আর তার তলায় লেখা ‘দিয়া’। জুঁই বুঝতে পারে এই ফটোটা অনেক দিন আগের ফটো। কারণ এই দিয়া মেয়েটার সাথে মৈনাকের এখন আর কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে কি মৈনাক বুঝে ফেলেছে যে জুঁই দিয়ার ফটো দেখেছে ওর ড্রয়ারে। তাই কি আজ ওর কাছে সত্যি কথা জানতে চাইছে। জুঁই ভয়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল ,’ কী জানতে চান বলুন ?’

মৈনাক ওকে অবাক করে দিয়ে বলল,’ না, এখন থেকে আর কোন আপনি করে কথানা। আগে বল তুমি আমাকে তুমি তুমি করে কথা বলবে ?’ জুঁইয়ের মনের কোনে কোথাও সানাইয়ের সুর বেজে উঠল। আজ প্রায় তিন বছর হল জুঁই বিধবা হয়ে মামা বাড়ি এক বছর কাটিয়ে তারপর এই চাকরীতে জয়েন করেছে। মৈনাকের মত একটা অন্ধ ছেলেকে স্নান করানো, জামা কাপড় পরানো, খাওয়ানো, ওকে ঘুম পারিয়ে দেওয়া এসব কাজ করতে করতে প্রথম প্রথম নিজেকে একজন নার্সের সাথে তুলনা করত জুঁই। কিন্তু ধীরে ধীরে শ্যামলী দেবীর আদর, ভালোবাসা আর মৈনাকের ওর প্রতি বিশ্বাস আর ভরসা দেখে এবং মৈনাকের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে নিজের অজান্তে কখন যেন জুঁই নিজেকে এই বাড়ির এই পরিবারের বৌ ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। লজ্জায় ভয়ে কাউকেই কিছু প্রকাশ করেনি। আজ এতদিন বাদে  মৈনাক হটাত কেন ওকে তুমি করে ডাকতে বলছে ?     

জুঁই লাজুক কণ্ঠে বলে ওঠে, আচ্ছা ঠিক আছে বলব। কিন্তু হটাত এই কথা কেন বলবেন তো।‘ মৈনাক জুঁইয়ের হাতটা ছেড়ে দিয়ে রেগে গিয়ে বলে,’ আবার আপনি। এইমাত্র বললামনা শুধু ‘তুমি’ বলবে ?’

জুঁই মৈনাকের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলে,’ ঠিক আছে বাবা, তুমি তুমি তুমি। হল, বল এবার।‘

মৈনাক জুঁইয়ের কাঁধের দিকে তাকিয়ে বলে,’ আমাকে তোমার কেমন লাগে জুঁই ? আমি মানুষটা কেমন ?’ জুঁইয়ের চোখে মেঘ ফাটা বৃষ্টি নেমে আসে। এতোদিন এই অন্ধ মানুষটাকে উলঙ্গ করে স্নান করাচ্ছে, জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছে, খাইয়ে দিচ্ছে, ওকে ঘুম পর্যন্ত পারিয়ে দিচ্ছে জুঁই। কতবার ওর হাতের ছোঁয়া লেগেছে জুঁইয়ের সুগঠিত স্তনে, কতবার জুঁই মৈনাককে পরতে পরতে বাঁচাবার জন্য জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু কোনদিনও এই তরতাজা যুবকটা ওর শরীরকে অসম্মান করার প্রচেষ্টা করেনি। বরং জুঁই ওর গায়ে হাত দিলেই মৈনাক কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করত। ওর বোধ হয় তখন লজ্জা করত। অথচ জুঁইয়ের সেই অসুস্থ স্বামী তার স্বামিত্ব ফলাতে প্রায় দিনই রাতে কর্মজজ্ঞে ক্লান্ত জুঁইকে একপ্রকার ধর্ষণ করত। যদিও সন্তানের বাপ হবার ক্ষমতা ছিলনা মানুষটার। ডাক্তার একটা পরীক্ষা করেই বলে দিয়েছিল।

জুঁই মৈনাকের মুখটা ওর নিজের মুখের দিকে ঘুড়িয়ে দিয়ে বলল,’এই যে আমার মুখ এখানে। তুমি আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এসব কী ভাবতে বসেছ বলতো ? আমি কি তোমাকে কোনদিন খারাপ লোক বলেছি বা ভেবেছি কোনদিন ? হটাত তোমার মাথায় এই প্রশ্নটা এলো কেন মৈনাক ? বরং তুমি বল আমি মেয়েটা কেমন ? আমার পরিষেবায় কোন ত্রুটি নেই তো মৈনাক। তুমি খুশি তো ?’

মৈনাক হাসে আর দুই হাত দিয়ে জুঁইয়ের মুখটা তুলে ধরে। জুঁইয়ের শরীরে শিহরণ খেলে যায়। ওর তিন বছরের ধৈর্যের পরীক্ষা আজ। চুপ করে চোখ বুজে মৈনাকের ঠোঁটের ছোঁয়ার আশায় বসে থাকে। ভাবে আজ নিশ্চয়ই কবরের ঢাকনা ভেঙে মৈনাকের প্রেমের ফুল ফুটে উঠবে। কিন্তু মৈনাক সেদিকে না গিয়ে বলে,’তুমি একটা অসাধারণ মেয়ে জুঁই। আমি বোধ হয় তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। আর সেইজন্যই তোমার মনের কথাটা জানতে চাইছি। তুমি কিছু মনে করলে না তো জুঁই ?’ মৈনাক এমন ভাবে বলে কথাটা যেন ও একটা মারাত্মক অন্যায় কথা বলেছে একটা যুবতী মেয়েকে একা পেয়ে। 

জুঁই মৈনাকের কথায় হাসবে না কাঁদবে তখন। মৈনাককে দুই হাতে পেঁচিয়ে ধরে নিজের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ আমি না। তুমি একটা অসাধারণ মানুষ মৈনাক। আমি তোমার মত এতো ভদ্র সভ্য চরিত্রবান মানুষ আর দেখিনি। আমি তোমাকে ছাড়া আর বাঁচবো নাগো। তুমি আমার প্রেমে কি পড়বে, আমি অনেক দিন আগেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। কিন্তু তোমাকে বলবার সাহস পাইনি মৈনাক। আমি তোমাকে ভালোবাসি মৈনাক, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি গো।‘ বলেই জুঁই মৈনাকের মুখ তুলে ধরে ওর লাল টুকটুকে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় মৈনাকের ঠোঁটে। কতক্ষণ ওরা ঐ ভাবে ছিল জানে না। হটাত দরজায় টোকা পড়তেই চমকে ওঠে জুঁই আর মৈনাক দুজনেই।

জুঁই তাকিয়ে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন শ্যামলী দেবী। জুঁই লজ্জায় ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মৈনাক অবাক হয়ে শুন্যে দৃষ্টি মেলে রাখে। শ্যামলী দেবী ঘরে ঢুকে বলেন,’ আমি তোমাদের দুজনকেই এবার চিরকালের মত শাস্তি দিতে চাই। বোম্বে থেকে আমার মেয়ে শিলা আসছে সামনের মাসে। তোমাদের একসাথে ছাঁদনাতলায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। দেখি আমার এই মেয়েটাকে কে আমার থেকে দুরে নিয়ে যায়। একটা মেয়ে কতো দুরে থাকে। আরেকটা মেয়েকে আমি এই বাড়িতেই বেঁধে রাখবো। দেখি তোমরা কি করতে পারো।‘  মৈনাক অভিমানের সুরে বলে ওঠে,’ মা, তোমার মুখে শুধু মেয়ে মেয়ে আর মেয়ে। ছেলেটা বুঝি বাণের জলে ভেসে এসেছে।‘ শ্যামলী দেবী খাটে বসে হেসে মৈনাককে জড়িয়ে ধরেন। লজ্জায় জড়সড় জুঁইকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,’আর, এই মেয়ে। তুমি এখন থেকেই আমাকে মা বলা অভ্যাস করতো দেখি। বলো, কি হল চুপ করে আছো কেন ? বলো।‘  জুঁই লজ্জায় রাঙা হয়ে শ্যামলী দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,’মা, মাগো।‘

uttamchakraborty306@gmail.com
ব্যাঙ্গালোর

No comments:

Post a Comment