1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

কালরাত্রি

ছবি  : ইন্টারনেট 

কালরাত্রি

রণিত ভৌমিক


 ----১----


সেদিন ভোর রাতে ফোনের এলার্মটা কান অবধি পৌঁছালেও, ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। উঠে দেখি ঘড়িতে তখন বাজে তিনটে পঞ্চাশ। বাড়ির সামনে এসে অফিসের গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে, এগিয়ে চলল সল্টলেকের অফিস পাড়ার দিকে। সল্টলেকের অফিস পাড়া অর্থাৎ সেক্টর-৫ হল কলকাতার মধ্যে এমন এক জায়গায়, যার সারা দিনের মধ্যে একটি ঘণ্টাও বিশ্রাম নেই। এখানে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাও হয়ত কম পরে। এই এলাকায় মানুষের কথোপকথনের চেয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের ঠুকঠাক শব্দই বেশি শোনা যায়।

ভোরবেলা গাড়ির জানালার ভিতর থেকে শহরের রাজপথগুলো দেখার মজাটাই আলাদা। একদিকে, ভোরের আলো নতুন সূচনার জানান দিচ্ছে আর অন্যদিকে রাস্তার ত্রিফলা লাইটগুলো গতদিনের সমস্ত ক্লান্তিকে যেন নিজের মধ্যে গ্রাস করে নিয়ে ক্রমশই নিভে আসছে। সেদিন অবশ্য খানিকটা মেঘলা হয়েছিল আর তাই কিছুটা পথ যেতে না যেতেই বৃষ্টির দেখা পেলাম।

বৃষ্টিটা বাড়ছে দেখে, ড্রাইভার তাড়াতাড়ি জানালার কাচগুলো তুলে দিল। তবে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝাপটে এসে মুখে লাগার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত ভালো লাগা মিশে থাকে। সেই ভালো লাগার অনুভূতিটা আদতে একটু আলাদা। ঠিক যেমন নিজের জীবনের প্রিয় মানুষটি-কে অন্য কারোর সঙ্গে সুখে থাকতে দেখে, মনে-মনে তার খুশিতেই নিজের খুশিকে খুঁজে উপভোগ করার মতো একটা বিষয়। হয়ত সবার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব হয় না। কিন্তু যারা পারে, তারাই একমাত্র ভালোবাসার প্রকৃত অর্থটা বোঝে। হ্যাঁ! কারণ 'ভালোবাসা' শব্দটা শুধুমাত্র ওই সামান্য চাওয়া-পাওয়ার বৃত্তটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। 

কথাগুলো নিজের মনে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ জ্ঞান হল, পকেটে রাখা ফোনটা প্রায় বার তিনেক বেজে কেটে গেছে। ফোনটা বের করে দেখি তানিয়ার নম্বর থেকে তিনটে মিস কল। 

হুম! তানিয়া, আমার জীবনের সেই প্রিয় মানুষটি। আবার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও বটে। ওর সঙ্গে রাজদীপদার বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। তানিয়া, আমি আর রাজদীপদা তিনজনেই একই কলেজে পড়তাম। তবে, রাজদীপদা ছিল আমাদের থেকে এক বছরের সিনিয়র। ওদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্কটা সংক্ষেপে বলতে গেলে, গোটা দশেক ব্রেকাপ আর অসংখ্য ঝগড়ায় ভরপুর একটা প্রেম। কিন্তু তারপরও ভালোবাসা ওদের জীবনে সুখের ডানা মেলেছে। বিয়ের পর ওদের মধ্যে যে ঝগড়া হয় না, তেমনটা নয়। কিন্তু ওরা দুজনেই দুজনের মধ্যে সুখ খুঁজে পায়। হাসিখুশিতেই ওরা দিন কাটাচ্ছে। আর ওদের এই খুশি দূর থেকে দেখে, আমিও সমান আনন্দিত। তানিয়ার খুশির মধ্যে আজও নিজের খুশিটা বরাবরের মত খুঁজে চলেছি।

ফেরা যাক সেদিনের প্রসঙ্গে, তানিয়ার মিস কলগুলো দেখার পর ওকে ফোন করলাম এবং ফোনের অপর দিক থেকে ওর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই আমি চমকে উঠলাম। তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,

- সাম্য, তোর রাজদীপদাকে নিয়ে আমি হসপিটাল যাচ্ছি। তুই পারলে চলে আয়, প্লিজ।

- (কথাটা শোনা মাত্র ওকে জিজ্ঞেস করলাম) রাজদীপদার কী হয়েছে? 

- গত রাতে ঘুমের মধ্যেই দু-বার অ্যাটাক হয়ে গেছে। আমি পাশে শুয়েও বুঝতে পারিনি রে। ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায়, চোখ খুলে দেখি মানুষটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। 

- তুই কিছু চিন্তা করিস না। আমি যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করছি।

- হ্যাঁ! তাড়াতাড়ি আয়, সাম্য। আমি খুব একা রে। 

ফোনটা রাখার পর, গাড়ির ড্রাইভারকে বলে মাঝ পথেই নেমে পড়লাম। সেদিন আর অফিসের কথা না ভেবে, হসপিটাল যাওয়ার জন্য বাইপাসের ট্যাক্সি ধরলাম। 


----২----

হসপিটাল পৌঁছে প্রথমেই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দিকে ছুটে গেলাম এবং সেখানে গিয়ে দেখি, সামনের সিটে বসে তানিয়া এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে। আর ওর পাশে বসা এক বয়স্ক মহিলা ক্রমাগত ওকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে, সিট ছেড়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল তানিয়া। ওই ওয়ার্ডে উপস্থিত সবাই একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালেও, ওই মুহূর্তে আমি সেই বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইনি বরং ওর এলোমেলো চুলগুলো মুখের কাছ থেকে সরিয়ে, ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম এবং সিটে বসিয়ে ওর পাশের সেই বয়স্ক মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম,

- রাজদীপদাকে কী ওটি-তে নিয়ে গেছে?

- (বয়স্ক মহিলাটি আমার পরিচয় সম্মন্ধে জানার কৌতূহল নিয়ে বলল) হ্যাঁ! একটু আগেই নিয়ে গেছে। তুমি কী তানিয়ার ভাই?

- (আমি ওনার কৌতূহল দূর করতে বললাম) না! বন্ধু। ওদের দু-জনেরই খুব কাছের বন্ধু।

- (মহিলাটি আমার কথা শুনে বলল) আমারও স্বামীর আজ অপারেশন আছে, পাশের ওটিতেই ওকে ঢুকিয়েছে।

- আপনি একা এসেছেন? 

- (ঠোঁটের এক কোণে হাসি নিয়ে ওনার জবাব) হ্যাঁ! কি আর করব, ছেলে বাইরে থাকে। ওর আসতে গোটা দিন পেরিয়ে যাবে। আর বাবা, আমার কোনও বন্ধুও তো নেই, যে পাশে এসে দাঁড়াবে। 

ওনার শেষ কথাটা শুনে বুঝতে পারলাম, যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেন, বিবাহিত মহিলার পাশে একজন পুরুষ বন্ধুকে এসে দাঁড়াতে দেখলে, আজও সমাজ বিষয়টাকে অন্য চোখে দেখে।   

এদিকে, যত সময় গড়াচ্ছে, ততই যেন আতঙ্কে তানিয়া মনের দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ছে। আমি নার্সের সঙ্গে কথা বলে ফিরতেই, আমার জামাটা টেনে ধরে ওর প্রশ্ন,

- সাম্য, ওরা কী বলল, তোর রাজদীপদা বেঁচে ফিরবে তো?

- হ্যাঁ! রে। তবে, রাজদীপদার যেহেতু দুটো অ্যাটাক পর পর হয়েছে, তাই হার্টের অবস্থাটা একটু ক্রিটিকাল।

- ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলব। একেবারে শেষ করে ফেলব। 

কিছু মুহূর্ত আগে অবধি শক্ত মুঠো করে ধরে রাখা আমার জমাটা ছেড়ে দিয়ে, তানিয়া নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে সিটে বসে পড়ল।

এমন পরিস্থিতিতে কাউকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়ত সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ কিন্তু তাও ওদের ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে করিয়ে আমি তানিয়াকে বললাম,

- আচ্ছা! তুই যদি এইভাবে ভেঙ্গে পরিস, তাহলে ঈশানীকে কে দেখবে বলত? তোর শাশুড়ির বয়স হয়েছে, ওনার দিকটাও তো ভাববি।

- (মেয়ের কথা শুনে তানিয়ার হুঁশ ফিরল) এই সাম্য, আমার শাশুড়িমাকে একবার ফোন করবি।

- হুম!

নম্বরটা ডায়েল করে তানিয়ার হাতে ফোনটা দিলাম এবং কিছুক্ষণ নিজের শাশুড়ির সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর তানিয়াকে একটু শান্ত হয়ে বসতে দেখলাম। 

প্রায় চার ঘণ্টা হতে চলল, এদিকে পাশের ওই বয়স্ক মহিলার স্বামীর অপারেশন শেষে তাকে বেডেও দিয়ে দিল। কিন্তু তাও রাজদীপদার হার্টের কোনও উন্নতির লক্ষণ ডাক্তারদের চোখে পড়ল না। টেনশনের মধ্যে সময় যেন থমকে গিয়েছিল, কিছুতেই আর এগচ্ছিল না। 


----৩----

ঘড়িতে তখন বাজে ঠিক ১১টা, ওটির দরজার উপর লাগানো লাল আলোটা গেল নিভে। দরজা খোলার আওয়াজটা কানে আসতেই তানিয়া নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ওটির দরজার দিকে দৌড়ে গেল, আমিও গেলাম ওর সঙ্গে। ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই ওনাকে প্রশ্ন করল তানিয়া,

- ডাক্তারবাবু, আমার স্বামীর জ্ঞান ফিরেছে? ও ভালো আছে তো?

ডাক্তারবাবুকে লক্ষ্য করলাম সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে, উনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ওনার সেই নিস্তব্ধতা দেখে আমার মনে একটু সন্দেহ হল আর ওই সন্দেহ থেকেই ওনাকে বেশ কঠোর ভাষায় বললাম,

- আচ্ছা! আপনি চুপ করে আছেন কেন, ভালো মন্দ কিছু তো একটা বলুন, দেখতে পাচ্ছেন না পেশেন্টের স্ত্রী সকাল থেকে কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে?

এবার আর চুপ না থেকে ডাক্তারবাবু নিজের নিরাবতা ভেঙ্গে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

- উই আর সরি, আমরা ওনার স্বামীকে সুস্থ করার যথাযত চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওনার হার্ট পর পর দুটো অ্যাটাক সহ্য করতে পারেনি। অপারেশন টেবিলেই ওনার হার্ট আমাদের চিকিৎসায় সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, তাও একটা মিরাকলের আশায় আমরা শেষ অবধি আমাদের সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু মেডিক্যাল সাইন্সে সবসময় মিরাকেল ঘটে না।

কথাটা শোনা মাত্র তানিয়া মেঝেতে বসে পড়ল। ওর শরীরে তখন কোনও সাড় নেই, দু-চোখ দিয়ে শুধু আজস্র জল পড়ে চলেছে। মেঝে থেকে উঠিয়ে আমি ওকে দাঁড় করালাম এবং সেই মুহূর্তে ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে ওর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বারবার বের হচ্ছিল,

- আর একবার চেষ্টা করে দেখবেন, ডাক্তারবাবু। ও এবার ঠিক সারা দেবে। আর একটি বার চেষ্টা করে দেখুন, প্লিজ।  

সত্যি, এইরকম সময় ডাক্তাররা খুবই অসহায় বোধ করেন। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ব্যক্তির প্রিয়জনেদের কান্না এবং আরও একবার তাকে ফিরে পাওয়ার আবেক থেকে করা অনুরোধটা না রাখতে পারার যন্ত্রণা, বারবার ওনাদের মনে আঘাত আনে। এই পেশায় আসার পর, ওনাদের যেমন আছে মানুষকে সুস্থ করে তোলার আনন্দ, তেমনি আছে যন্ত্রণা। যা শুরু হয় অপারেশন টেবিলে মৃতের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সঙ্গে এবং চলতে থাকে তার প্রিয়জনদের কান্না ও সেইসব পূরণ করতে না পারা অনুরোধ অবধি।   

তানিয়ার শাশুড়িকে জানানোর আগে আমাদের কিছু কাছের বন্ধুকে এই দুঃখের সংবাদটা দিলাম, যাতে ওরা রাজদীপদার বাড়ি আগে থেকে পৌঁছে গিয়ে ঈশানী ও কাকিমাকে সামলাতে পারে। 

চার ঘণ্টা পর যখন রাজদীপদার মৃতদেহ নিয়ে ওদের বাড়ি নীচে পৌঁছালাম, তখন ওখানে উপস্থিত পরিবারের লোকজন সহ বাকিরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও, ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র রাজদীপদার মা। উনি মনের দিক থেকে যথেষ্ট শক্ত ছিলেন। নিজের নাত্নিকে কোলে নিয়ে সবার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। আর তানিয়া? ও একেবারে চুপচাপ হয়ে স্ট্রেচারের সামনে দাঁড়িয়ে রাজদীপদার বন্ধ চোখ দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দূরে ঠাকুমার কোল থেকে পুরো ঘটনাটা অনেকক্ষণ লক্ষ্য করার পর হয়ত ছোট্ট ঈশানীও ওর বাবার মৃত্যুটা বুঝতে পেরেছিল আর তাই শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার মুহূর্তটাতেই ও কেঁদে উঠল। 

শ্মশানের গনগনে আগুনে একটা গোটা দেহকে মুহূর্তের মধ্যে ছাই হয়ে যেতে দেখলাম। রিংয়ের মতো আকাশের উদ্দেশ্যে উঠতে থাকা কালো ধূঁয়োগুলোর মাধ্যমে রাজদীপদার বিদায় জানানো এবং তারপর গঙ্গায় নেমে যাওয়া উত্তপ্ত নাভির বুদবুদ। এই প্রত্যেকটা বিষয় যেন সেদিন আমার মনের মধ্যে একটা দাগ রেখে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় তাই নিজের ভাবনাতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তানিয়া আর ওর মেয়ের আগামীদিনের কথা ভেবে খুব চিন্তা হচ্ছিল। কারণ প্রিয়জনের চলে যাওয়াটা বাস্তব জীবনে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষ আর সূর্যাস্তের পর ফুরিয়ে যাওয়া দিন, কখনোই ফিরে আসে না। আমরা কেবলমাত্র সেই মানুষটিকে ছায়াসঙ্গী রূপে নিজেদের সঙ্গে রেখে, দৈনন্দিনের ব্যস্ত জীবনে এগোনোর চেষ্টা করি মাত্র। সংসারের মূল মানুষটি যখন চলে যায়, তখন আমরা বুঝতে পারি আকাশটা কত বড়, সেখানে হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা তখনই ডানা মেলে। কিন্তু এটাও মানতে হবে, সব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও জীবন এগিয়ে চলে। অতএব তানিয়াকেও ওর ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। 


----৪----


দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গেল, রাজদীপদার শ্রাদ্ধের পর পরিবারের সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। এখন ওদের বাড়িতে আছে বলতে কাকিমা ওরফে রাজদীপদার মা, তানিয়া আর ঈশানী। আমি যতটা সম্ভব ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করলেও, এই কদিনে তানিয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত বদল লক্ষ্য করেছি। ও এখন আমাকে নিজের বিষয় বেশি জড়াতে চায় না, এমনকি আগের চেয়ে আমাদের মধ্যে কথাবার্তাও কম হয়। হতে পারে স্বামীর অবর্তমানে, অন্য আরেকজন পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে সমাজ ওকে কটু কথা বলবে সেই ভেবেই হয়ত তানিয়া আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। আমাদের মধ্যে যেটুকু কথা হয় তার মধ্যে তানিয়া ওর হাবে ভাবে আমাকে ভালো মতোই বুঝিয়ে দেয় যে ওদের জন্য আমি কিছু করতে গেলে, সেটা হবে ওদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো। আর এই বিষয়টাই আমাকে প্রত্যেক মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে। 

একদিন তাই অফিস ফেরত ওদের বাড়ি চলে গেলাম এবং তানিয়াকে সামনে পেয়ে কিছু বলতে যাব, তার আগেই ও আমাকে বলল,

- সাম্য, একটা সাহায্য চাইতে পারি তোর কাছে?

এতদিন পর এই প্রথম কোনও সাহায্য চাইছে তানিয়া আমার কাছে অতএব ওকে বললাম,

- হ্যাঁ! বল, কীভাবে তোকে সাহায্য করতে পারি।

- (একটু থেমে তানিয়া বলল) তুই জানিস, রাজদীপের যা জমানো টাকা আছে, তাতে আমাদের তিনজনের অনেক বছর ভালো মতোই চলে যাবে কিন্তু তাও আমি একটা চাকরি করতে চাই। বলতে পারিস, সাময়িক কিছুক্ষণের জন্য দুর্ঘটনাটা ভুলে থাকার একটা চেষ্টা। আবার আমার মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমার এই সিদ্ধান্ত।

- তুই বললে আমি আমার অফিসেই দেখতে পারি।

- (টেবিলের উপর শুয়ে রাখা ফুলদানিটা সোজা করে রেখে তানিয়ার উত্তর) তাতে তোর কোনও অসুবিধা হবে না তো, সাম্য?

- আমার সুবিধা অসুবিধা কোনওটাই হবে না, নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। 

- আমি কথাটা সেই ভাবে বলতে চাইনি রে। প্লিজ, কিছু মনে করিস না।

- না! রে তানিয়া, আমি কিছু মনে করিনি। তাহলে ওই কথা রইল, অফিসে কথা বলে দেখি কতটা কি করা যায়। তুই আগামীকালের মধ্যে আমাকে একটা তোর সিভি মেইল করে দিস। 

আমাদের কথোপকথনের মাঝেই ওর শাশুড়ি সন্ধ্যাবেলার চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে টেবিলে রাখল। 

- একি কাকিমা, এইসব আবার কেন? 

- না! না! বাবা, এতদিন পর তুমি এলে, এইটুকু তো করতেই পারি। 

- কাকিমা, আপনি কেমন আছেন?

- চলে যাচ্ছে, বাবা। বউমা আর নাত্নিকে নিয়ে চেষ্টা করছি জীবনের বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিতে।

সামনে দাঁড়িয়ে তানিয়া নিজের চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে, ভেঙে পড়ল কান্নায়। কাকিমার চোখ দুটোও দেখলাম ছলছল করে উঠেছে। ওই মুহূর্তে আমি কী করব সত্যি বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  

এদিকে, শহরের মাঝখানে বড় ঘড়ির ঘণ্টাটা বেজে উঠল। আর সেইসঙ্গে কাকিমা নিজের চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, 

- সাতটা বাজল বোধহয়, নাত্নিকে খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। তোমরা কথা বলো, আমি যাই ওইদিকে। 

ওনার প্রস্থানের পর আমি তানিয়ার কাছে গিয়ে ওকে বললাম,

- তুই এইভাবে ভেঙ্গে পড়লে, বাকি দুজনের কী হবে শুনি? 

- না! আসলে ওর মায়ের কথাগুলো শুনে ওর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। জানিস সাম্য, এইরকম সময় রাজদীপ রোজ অফিস থেকে ফিরে একইভাবে বসে ওর মায়ের হাতের বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাদের সঙ্গে গল্প করত। দিনের এই একটা সময় আমাদের তিনজনের কাছে ছিল অত্যন্ত ব্যক্তিগত। ওর মা আর আমি দুজনেই এখন এই সময়টা চোখের জলে কাটাই। 

- দেখ তানিয়া, হয়ত তুই ভাববি আমি আবারও তোকে সান্ত্বনা দিচ্ছি কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখিস, রাজদীপদার কথাই যদি তুই ভেবে যাস, তাহলে তোদের মেয়ের কথা কে ভাববে? ওর একটা গোটা জীবন পরে আছে। আজ না হয় ও ছোট কিন্তু কাল ও বড় হবে, পড়াশোনা সহ জীবনের বাকি বিষয়গুলো তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই এখন থেকে তুই শক্ত হতে না পারলে, পরবর্তী সময় সবকিছু সামলানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে। 

- হুম! জানি রে, তাই তো চাকরিটা করতে চাইছি। 

ঈশানী সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে যখন বাড়ি ফেরার জন্য গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে জুতো পড়ছিলাম, তখন হঠাৎ পিছন থেকে তানিয়া ডেকে উঠল,

- সাম্য, সরি পিছন থেকে ডাকলাম। আসলে তোকে একটা কথা বলতে চাই।

- কী?

- থাঙ্কস রে, এইভাবে দুর্দিনে আমাদের পাশে থাকার জন্য।

- (একটু হেসে বললাম) তুই আবার কবে থেকে ফর্মালিটি করছিস? তাও আবার আমাকে! আমি তোর পাশে সবসময় থাকতে চেয়েছি তানিয়া কিন্তু এই কদিন তুই আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলিস।

- (উত্তরটা না দিয়ে বরং কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইল তানিয়া) যা, তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।

- হুম! তোরা সাবধানে থাকিস। 


 ----৫----


কিছুদিনের মধ্যে তানিয়াকে ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাদের অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হল এবং একমাসের মাথায় কল লেটার ওর বাড়িও পৌঁছে গেল। আমাদের অফিসের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে জয়েন করল তানিয়া। এখন ওর জীবনটা আবারও নতুন করে সাজিয়ে তোলার পালা কিন্তু ও কী সত্যি নিজের জীবন নতুন করে গড়ে তুলতে চায়? উত্তরটা 'না' ধরে নেওয়াটাই শ্রেয় কারণ তানিয়া আজও রাজদীপদার স্মৃতি আঁকড়ে প্রতিটা দিন একইভাবে কাটিয়ে যাচ্ছে। 

আশ্বিনের আকাশে এখন বিদায়ের সুর। মা দুর্গা ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। শহরের কিছু কিছু জায়গায় প্যান্ডেল খোলার কাজ শুরু হলেও, বেশিরভাগ রাস্তার মোড়েতেই পড়ে আছে মস্ত সাজানো প্যান্ডেলগুলো। গোটা শহরটা যেন টানা চারদিন আনন্দ উৎসবে মেতে থাকার পর আবার ব্যস্ততায় নিজেকে মুড়ে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

এবার পুজোর দিনগুলো আমার বাড়ির চারদেওয়ালের মধ্যে কাটলেও, বিজায়ার দিন হঠাৎ তানিয়ার শাশুড়ির ফোন পেয়ে আমাকে ওদের বাড়ি ছুটতে হল। ওদের বাড়ি পৌঁছে টের পেলাম, সেদিন কাকিমা আমাকে তানিয়ার অজান্তেই ডেকে পাঠিয়েছেন। তানিয়া তখন মেয়েকে নিয়ে কাছেপিঠে একটু ঘুরতে গিয়েছে আর সেই সুযোগে কাকিমা আমাকে ওনার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন,

- সাম্য, তুমি আমাদের জন্য আজ অবধি যা করেছ। আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময় তুমি যেইভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছ, তার জন্য তোমার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব। 

- আজ আবার এইসব কথা কেন তুলছেন, কাকিমা। আমি তো আপনাদের নিজের মনে করেই করেছি। দয়া করে এর জন্য 'ঋণী' শব্দটা ব্যাবহার করবেন না।

- দেখো বাবা, আমার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক দিনটায় তুমি আমার পাশে ছিলে। ওইদিন যখন নিজের ছেলেকে ওই অবস্থায় শেষ যাত্রায় যেতে দেখছিলাম, তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। সেদিন থেকে তুমি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোয়, মনে একটু বল পেয়েছি বলতে পারো। সেই থেকে তোমার ওপর আমি কেমন যেন ভরসা করে ফেলেছি। আমাদের আপদে বিপদে সবসময় তুমি থাকার চেষ্টা করেছ আর তাই বলতে দ্বিধা নেই যে এক ছেলেকে হারিয়ে আমি আরেক ছেলেকে কাছে পেয়েছি। আজ পুজোর শেষ দিনে তাই তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে ফিরিয়ে দিওনা বাবা। 

- নিজের ছেলের স্থান যাকে দিয়েছেন, তাকে এইভাবে বলছেন? কাকিমা, আপনি নির্ধিদায় বলতে পারেন।

একটু থেমে, আমার হাত দুটোকে নিজের দুটো হাত দিয়ে ধরে কাকিমা বললেন,

- তানিয়া আর ঈশানীর বাকি জীবনের ভার তুমি নেবে, বাবা?

কথাটা শোনা মাত্র আমার চারপাশের সবকিছু যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল, আমি বললাম

- আপনি যা বলছেন সেটা কী ভেবে বলছেন? তানিয়া কী জানে?

- না! আগে তোমার সিদ্ধান্তটা জানতে চাই। তুমি রাজি থাকলে, তবেই বউমাকে বলব। এই বুড়ো মানুষটাকে তুমি আজ ফিরিয়ে দিওনা, বাবা। তুমি তানিয়ার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তাই আমার বিশ্বাস তানিয়া আর ঈশানী তোমার কাছে খুব ভালো থাকবে। 

- কিন্তু?

- এতে কোনও কিন্তু নেই, বাবা। আজ আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এই অন্যায় আবদার করছি শুধুমাত্র নিজের নাত্নি আর বউমার স্বার্থে। ওদের বাকি জীবন এখন পুরোটাই অনিশ্চয়তায় ভরা। তুমি তানিয়াকে বিয়ে করলে ওরা পায়ের নিজে শক্ত মাটি ফিরে পাবে, নাহলে আমি মরেও যে শান্তি পাব না।

সেদিন তানিয়া আর ঈশানীর সঙ্গে দেখা হয়নি। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পর রাস্তা শুধু হেঁটেই চলেছি, মনের মধ্যে তখন যেন শত দেউ আছড়ে পড়ছে, শত ভাবনারা মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা গাছের তলায় তাই বসে নিজের চিন্তায় হারিয়ে আছি, হঠাৎ কোথা থেকে এক মানসিক ভারসাম্যহীন লোক নোংরা বস্ত্রে আমার পাশে এসে বসল এবং অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে চেয়ে সে বিড়বিড় করতে লাগল,

- মনের ভেতর আটকে রাখা পাখিটা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, ওকে মুক্তি দে। সময়ের স্রোতে তোর ভেলা যেদিকে ভাসতে চাইছে, সেদিকেই ভাসিয়ে দে। 

লোকটির কথাগুলো প্রাথমিক ভাবে শুনে পাগলের প্রলাপ মনে হলেও, এর গভীর অর্থটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম সুতরাং তার দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আবারও বলল, 

- যা রে, যা। পাল তুলে স্রোতে ভেসে যা। মনের কথা আর চেপে রেখে কী লাভ? বলে দে, বলে দে তাকে।      

সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। রাস্তার ওই লোকটির বলা কথাগুলো নিছকই কাকতালীয় নাকি এটা বিধাতার কোনও সংকেত, যা উনি লোকটির মাধ্যমে আমাকে দিতে চাইলেন। দু-তিন দিনের মধ্যে তাই ঠিক করে ফেললাম কাকিমার কথা অনুযায়ী তানিয়া আর ঈশানীর বাকি জীবনের দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেব। যার ফলস্বরূপ, পৌঁছে গেলাম তানিয়াদের বাড়ি এবং কাকিমাকে নিজের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে এলাম। তবে, তানিয়ার দিক থেকে আমাকে মেনে নেওয়াটা কী আদৌও সম্ভবপর হবে? আমার দিক থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর কাকিমা ওকে রাজি করানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিলেন। 

কিছুদিনের মধ্যে তানিয়া আমাকে ওর বাড়ি ডেকে পাঠাল এবং আমিও চটজলদি ওদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। তানিয়ার সামনে যেতেই লক্ষ্য করলাম ওর মুখটা বেশ থমথমে। আমার দিকে যেন ঘেন্নার চোখে তাকিয়ে বলল,

- তোর মনে তাহলে এটাই ছিল, সাম্য। এতদিন শুধু ভালো মানুষ সেজে থাকার অভিনয় করে গেলি।

- (আমি তো অবাক) তুই এইসব কি বলছিস!

- যা বলছি ঠিকই, বলছি। আমার আর আমার মেয়ের একা হয়ে পড়ার সুযোগটাই তুই নিতে চাইছিস, তাই তো? বন্ধুত্বের আড়ালে এটাই তোর আসল উদ্দেশ্য ছিল, তাই না?

তানিয়াকে উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে, কাকিমা পাশের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি উঠে এসে ওকে বলল,

- তুমি ওকে ভুল বুঝছ বউমা। বিয়ের প্রস্থাবটা আমি ওকে দিয়েছিলাম। সাম্যর মতো ভালো ছেলে আর হয় না। ও আর এখন তোমার শুধু ভালো বন্ধুই নয়, আমার আরেক ছেলেও বটে। আমার বিশ্বাস ঈশানীর বাবার সব কর্তব্য সাম্য পালন করার ক্ষমতা রাখে। তোমরা ভালো থাকবে ওর কাছে।

- (কান্নায় ভেঙ্গে পড়া তানিয়ার উক্তি) আরেকটা বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, মা। এটা আমার কাছে কতটা অসম্ভব, কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। যে মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম, এখনো ভালোবাসি, যেই মানুষটা আমাকে ঘিরে রয়েছে। সেই মানুষটার জায়গায় আমি অন্য কাউকে কীভাবে বসাবো বলতে পারেন? তার ওপর আবার সাম্যর সঙ্গে বিয়ের কথা, যে কিনা আমার শুধুমাত্র ভালো বন্ধু। না! মা, আমাকে দয়া করে এই ব্যাপারে আর বলবেন না। 

ওইদিন ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ঈশানী ওর ঠাকুমার কোল থেকেই আমার জামাটা টেনে ধরেছিল। তখনো কথা বলতে শেখেনি বলেই হয়ত নিজের মনের ভাবটা ওইভাবে সে বোঝাতে চাইছিল। ছোট্ট শিশুটার গালে তাই একটা আলত চুমু দিয়ে, চোখে জমাট বাঁধা কষ্টটা নিজের সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। তানিয়া আমাকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যাতে ওর সঙ্গে আমি আর কোনওভাবেই যোগাযোগ রাখার চেষ্টা না করি। এমনকি, আমাদের এত বছরের বন্ধুত্বটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ও শেষ করে দিতেও দু-বার ভাবল না।

এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল, তানিয়া কিংবা কাকিমা, কারোর সঙ্গেই কোনও যোগাযোগ নেই। ফলে, সকাল থেকে বিকেল অফিস আর তারপর বাড়ি। এইভাবেই আমার একটার পর একটা দিন কাটছিল। মনে কোনও আনন্দ নেই সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে আমার জীবনটা প্রায় থমকে গিয়েছিল। কিন্তু আবারও একটা ফোন যেন সবকিছু বদলে দিল। 

- হ্যালো! 

- আমি তানিয়া বলছি, তোর সঙ্গে একবার আজ বিকেলে দেখা করা যাবে?

- (প্রায় বিড়বিড় করার মতো করেই বললাম) হ্যাঁ! কটায় তোর বাড়ি যাব বল?

- না! আমাদের বাড়ি আসিস না। আমি অন্য কোথাও তোর সঙ্গে একা দেখা করতে চাই।

- তাহলে আমরা ময়দানে দেখা করি? 

- ঠিক আছে, তাহলে বিকেল ৪টে নাগাদ বিড়লা প্লানেটোরিয়ামের সামনে। 

কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিল তানিয়া। আর আমি, রইলাম দিনের শেষ প্রহরের অপেক্ষায়। 


----৬----

সেদিনের বিকেলটা একটু অন্যরকম। বিগত কয়েকটা দিনের একাকীত্বের জীবন কাটানোর পর, আবার ওর সামনে আসা। কিন্তু কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল তানিয়া? ওর কী বলার থাকতে পারে আমায়? আচ্ছা! ওকি আমায় আরও অপমান করতে ডাকছে, নাকি নিজের মত বদলে তানিয়া নতুন ভাবে বাঁচার সিদ্ধান্তটা নিয়ে আলোচনা করবে বলেই আমাকে ডেকে পাঠাল? এইসব প্রশ্ন মনের মধ্যে নিয়ে আমি ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম বিড়লা প্লানেটোরিয়ামের সামনে।

দূর থেকে তানিয়াকে আসতে দেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম এবং তারপর ময়দানের খোলা আকাশ আর সবুজ ঘাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুরু হল আমাদের দীর্ঘ কথোপকথন। 

- আমাদের বন্ধুদের একসঙ্গে কাটানো দুর্গা পুজোর দিনগুলোর কথা তোর মনে আছে, সাম্য?

- মনে আছে। সেইসব দিন কী ভোলা যায় রে। পুজোর সময় সবকিছু কত সুন্দর করে নিয়মে বাঁধা ছিল। একদিন নর্থে ঠাকুর দেখা, দু-দিন সাউথ আর অষ্টমীর সকালটা অঞ্জলি দিয়েই বেরিয়ে পড়া। প্রথমে লঞ্চে করে গঙ্গার বক্ষে ঘুরে বেরানো, তারপর সোজা হাতিবাগান। স্টারে একসঙ্গে সবাই মিলে সিনেমা দেখা। কী সুন্দর দিনগুলোই না কাটিয়েছি। ভাবলেও এখন অবাক লাগে, জানিস।

- (কথার শেষে তানিয়া বলে উঠল) ইদানীং একটা কথা খুব সত্যি বলে মনে হয়।

- কোন কথা?

- কলেজে পড়াকালীন এমনকি তারপরও আমাকে অনেকেই বলেছিল যে তুই আমাকে ভালোবাসিস, তখন বিষয়টা হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম কারণ আমি জানতাম তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, ওরা কতটা ঠিক বলেছিল। এতদিন ধরে তোর মনে তাহলে এই বাসনাটাই ছিল, সাম্য!

- তুই আমাকে ভুল ভাবছিস, তানিয়া। আমি হয়ত তোকে বন্ধুর চেয়েও বেশি ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে তোর আর রাজদীপদার সম্পর্ক কখনো ভেঙ্গে যাক, সেটা চাইনি। এমনকি নিজের মনের কথাটা কোনোদিনও তোকে জানাইনি কারণ আমি সবসময় তোর সুখের মধ্যে নিজের সুখ খুঁজতে চেয়েছি। আমি রাজদীপদার মৃত্যুর সুযোগ নিতে চাইনি। এটা তোর ভুল ধারণা, আমি শুধু চেয়েছি তোদের পাশে থাকতে। আর তাই কাকিমার প্রস্তাবটা মেনে নিয়েছিলাম।

- ঠিক আছে, সাম্য। তুই যখন একটা জীবন্ত লাশকে বিয়ে করতে চাস, তখন আমি যা যা বলব, তোকে সেটা মেনে নিতে হবে। আমি তোর পাশে থাকলেও, আমার মন থাকবে অনেক দূরে। আমার কাছে তোর কোনও দাবি থাকবে না। আমাকে তুই কখনো স্পর্শ করার চেষ্টা করবি না। আমার কাছ থেকে কোনওদিন ভালোবাসার প্রত্যাশা রাখবি না। শুধু স্বামীর পরিচয়টুকু ছাড়া আমার ওপর তোর আর কোনও অধিকার থাকবে না। মৃত্যুর দিন অবধি নয়। রাজদীপকে আমি কখনো ভুলতে পারব না আর চাইও না ভুলতে। ওর ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েই আমি আমার মেয়ের স্বার্থে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব। অতএব এই সবকিছু যদি তুই মেনে নিতে পারিস, তাহলে তোদের সিদ্ধান্তটাই আমি মেনে নেব।      

- (চুপ করে থাকার পর বললাম) আচ্ছা! বেশ। তাই হবে।

- আমি আমার সব সত্যিটা আগেই তোকে বলে রাখলাম, যাতে পরবর্তী সময় তুই আমাকে দোষ দিতে না পারিস। আমি তোর ভালোবাসার মূল্য কখনো দিতে পারব না, সাম্য। এটা জেনেও কেন তুই নিজের জীবনটা আমার সঙ্গে জড়াতে চাইছিস? কেন? 

- তোর এই কেন-টাও কী বাকি শর্তগুলোর মধ্যে পড়ে? আমি তোর শর্তগুলো মেনে নিলাম, তানিয়া। কথা দিচ্ছি, বিয়ের পর তুই যেমন চাস, যেইভাবে থাকতে চাস, তেমনই হবে।  

হ্যাঁ! বিয়ের আগে তানিয়াকে দেওয়া কথাটা আমি আজও রেখে চলেছি। একবছর ধরে আমরা একই ঘরে থাকলেও, আমাদের মন দুটো একে অপরের থেকে অনেক দূরে। ছোট্ট ঈশানী এখন কথা বলতে শিখেছে। তানিয়া ওকে আমায় বাবা নয়, বাবাই ডাকতে শিখিয়েছে। ওর মুখে বাবাই ডাকটা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। এখন ঈশানীকে ঘিরেই আমাদের সময় কেটে যায়। কাকিমা মাঝে মধ্যে আমাদের সঙ্গে এসে থাকলেও, উনি ওনার নিজের বাড়িতেই থাকতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।  

দিনের শেষে অফিস থেকে ফিরে ঈশানীর সঙ্গে সময় কাটানোটা যেন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওর মিষ্টি হাসি আর নরম হাতে আমায় জড়িয়ে ধড়াটা হয়ত কিছুটা হলেও তানিয়ার থেকে না পাওয়া আমার জীবনের ভালোবাসার ভাণ্ডারটা পূর্ণ করে দেয়। ছোটবেলায় বড়োদের মুখে শুনেছি যে বিয়ের পরদিন স্বামী-স্ত্রীর নাকি একঘরে থাকতে নেই, এমনকি মুখও দেখতে নেই। ওইদিনটাকে বলা হয় কালরাত্রি। কিন্তু তখন ছোট বয়সে বুঝিনি যে আমার জীবনে এই ‘কালরাত্রি’ শব্দটা এতটা অর্থ বহন করবে। তানিয়া হয়ত আর কোনোদিনও রাজদীপদার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তাই সমাজের চোখে ‘কালরাত্রি’ নিছক একটা বিয়ের নিয়ম হলেও, আমাদের দু’জনের কাছে এই ‘কালরাত্রি’ শব্দটা চিরজীবনের সঙ্গী।

(সমাপ্তি)

bhowmikranit1@gmail.com
হাওড়া

No comments:

Post a Comment