1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

দশভূজা

 



দশভূজা

রীনা ঘোষ


মা দুর্গার চরিত্রটি যদি শুধুই একটা পৌরাণিক কাহিনীর অংশ হিসাবে ধরি তাও তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমস্ত ভারতীয় নারীর তথা এ বিশ্বের সমস্ত নারীর সার। আমি ভারতীয় নারীই বলব, বিশেষ করে আমার বাংলার নারী - আমার ঘরের মা । কারণ এদের দেখেই তো আমরা ছোটো থেকে বড়ো হয়েছি।


বেশ কয়েকদিন ধরে আমার মায়ের বাঁ হাতের একটি আঙ্গুলে ব্যথা। ভালো করে দেখে বুঝলাম নখকুনি হয়েছে। এই রোগটা বর্ষাকালে আমাদের ঘরের মায়েদের খুব হয়। নখকুনি শব্দটি শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলেও আসল ব্যাপারটি হল - নখের পাশে যে নিচু মত অংশে নখ আটকানো থাকে সেই অংশে নোংরা জমে। তারপর ওই অংশটি ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করে , আর বেশ ব্যথাও হয়। আসলে এটি ক্যানডিডা অ্যালবিক্যশস নামের এক ছত্রাকের প্রভাব। মায়ের নখেও এটাই হয়েছে। বেশ কয়েকদিন হল হয়েছে কিন্তু কাওকে কিছু জানায়নি। শেষে যখন ব্যথা বেশি হল তখন আমি জানতে পারলাম এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে বললেন জল ঘাটাঘাটি কম করতে।  বাড়ি ফেরার পর মা হাতে এটা ওটা বেধে কাজ করতে লাগল। মাঝে মাঝে আমি সাহায্য করতে লাগলাম , কখনো বা বোন। কিন্তু বাসন মাজা, রান্না করা এগুলো করতে গেলে জল তো হাতে লাগবেই। সবচেয়ে ক্ষতি হতে লাগল বাসন মজার সাবানে। তাই আঙ্গুলটি সেরে উঠতে দেরি হচ্ছিল খুব। এরই মধ্যে একদিন সকালবেলা দরজা খুলতে গিয়ে লোহার পাল্লায় সেই আঙ্গুলটা চাপা লাগে এবং অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়।


সেইদিনই সকালে বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বললেন - " তোর মায়ের আঙ্গুলে ব্যথার জায়গায় লেগেছে। দেখ তো কিছু করতে পারিস কিনা।" বাবার এই 'করতে পারা ' মানে হল মাকে জল থেকে দূরে রাখা। মানে রান্নাটা মা করলেও বাসন মাজা থেকে অন্যান্য কাজ আমাকে করতে হবে। এখানে আমার বাবাকে নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন। আমার বাবার মত অদ্ভুত লোক আমি দ্বিতীয় দেখিনি। সকালে বাবা যখন বাড়ি থেকে বেড়োন তখন আমাদের নীচের ঘরে রাখা বাবার বাইকটা নিজেই বের করে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু কিছুতেই করবেন না। ঠিক সেই মুহূর্তে বাবার হাতে ব্যথা করে। শুধুমাত্র বাইকটা বার করার জন্য আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। আমি যতক্ষণ না নীচে নেমে গাড়ি বের করে দিচ্ছি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। আবার রাত্রে বাড়ি ফেরার পরও ওই একই নিয়ম। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি রেখে ঘরে ঢুকে যাবেন। আর সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এমন একটা ভাব করবেন যেন বাবাকে কেউ কোলে করে বিছানায় পৌঁছিয়ে দিলে বুঝি ওনার ভালো হয়। কিন্তু এই অসুস্থতা শুধুমাত্র সকাল আর রাত্রের ওইটুকু সময়ের জন্যই।  বাদবাকি সময় গুলোতে তিনি একদম সুস্থ। এমনকি কখনো সখনো যখন বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায় তখনও এই এক কাজ। মা দরজা খুললেই তাড়াহুড়ো করে উঠে আসবে উপরে। মা যদি বলে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে , তখন বাবার আবার উল্টো প্ল্যান । তখন বাবা জোরে জোরে বলবেন - " না না আমার মেয়ে এতো সকাল সকাল ঘুমোতেই পারে না। যা তো মা! গাড়িটা তুলে দে। তোর বাবার পায়ে খুব ব্যথা।" আমি এদিকে বাবার গাড়ির শব্দ শুনে ঘরের লাইট বন্ধ করে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকি কিন্তু মেয়ের মন তো! বাবার ডাক শুনে অভিনয় টিকিয়ে রাখতে পারি কই? অগত্যা আমাকেই যেতে হয়।


আমার বাবা বাড়িতে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই সোফায় বসে টিভি দেখেন। সোফার একদম সামনেই একটা কাঁচের টেবিল , যেখানে একটা গ্লাস আর  জলেরবতল রাখা থাকে বাবার জন্য। আমি আর বোন হয়তো পড়ছি আর মা রান্না ঘরে। বাবা কিন্তু হাত বাড়ালেই জলের গ্লাস বা বোতলটা পেয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। এমনকি গোটা হাতটাও বাড়াতে হবে না। তবুও আমার বাবা সেই সোফাতে বসে  আমাকে বা মাকে ডাকবে জলের গ্লাসটা হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। বোনকে এইরকম কাজের জন্য খুব একটা ডাকেন না কারণ আমার স্পষ্টবক্তা বোন বাবার মুখের উপরেই উত্তর দিয়ে দেয় অর্থাৎ এতো কাছে জলের গ্লাস , হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় - এই সত্য বাণী বলে দেয়। আবার সেই অগত্যা আমাকে বা মাকেই যেতে হয়। অবশ্য বাড়িতে বাবার এই কুড়েমি ভাবটার একটা কারণ আমি অনুভব করি। সেটা হল দীর্ঘদিনের একটানা পরিশ্রম। তাই হয়তো এই বয়সে একটু আরাম উপভোগ করতে চান। কিন্তু মাকে জিজ্ঞাসা করলে মা বলে - " তোর বাবা বাড়িতে সারাজীবনই এইরকম কুড়ে। শুধু আমাকে খাঁটাতে পারে। বাইরে পাথর ভেঙে ফেলবে কিন্তু বাড়ি ফিরলেই খোঁড়া।" মাঝে মাঝে ভবি আমরা ( আমি আর বোন) এইটুকুতেই এতো বিরক্ত হয়ে যায় কিন্তু মাকে তো এতগুলো বছর ধরে বাবার এই অভ্যাস গুলো সহ্য করে আসতে হয়েছে, এখনো করছে।

এইরকম অভ্যাসে অভ্যাসী আমার বাবা আমাকে বলে গেলেন মায়ের হাতের ব্যাপারটা একটু দেখতে।


আমার কাজ শুরু হল - প্রথমেই ঠাকুরঘর মুছে ঠাকুরের বাসন মেজে রাখলাম কারণ মা পুজো করবে সকলেই। তারপর সকালের চায়ের বাসন এবং আগের রাতের সমস্ত বাসন মাজলাম। সকাল সাতটা থেকে নটা বেজে গেল। দেখলাম বাবা চলে এসেছেন ইতিমধ্যে। বাবাকে আসতে দেখে মা বোনকে দিয়ে প্রেসার কুকারে ভাত বসালেন। মাত্র দুটো সিটি দিলেই হয়ে যায় তাই এই কাজটি বোন বেশ ভালো পারে। আসলে বাবার সকালে ভাত খাওয়া অভ্যাস। মা পুজো করে এসে বাবাকে সিদ্ধ দিয়ে ভাত খেতে দিল। আমি চলে গেলাম স্নান করতে। সকালের যোগ ব্যায়াম , পড়াশোনা সব ভুলে আমি ঠাকুর প্রণাম করে এসে খেয়ে নিলাম। খেয়ে উঠেই আবার সকালের খাওয়ার বাসন মাজতে শুরু করলাম। বাবা আবার বেড়িয়ে গেলেন বাজারে। আমি সবে একটু বসেছি আর মা একটু শুয়েছে , এই ঘণ্টা খানেক হবে। দেখলাম বাবা এলেন এবং এসেই প্রশ্ন - ' কিরে! দুপুরের রান্না কতদূর?' আমি বলতে যাচ্ছিলাম - এইতো ঘণ্টাখানেক ও হয়নি সকালের খাওয়া হল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম । বললাম - সবে তো এগারোটা বাজে। বাবা বললেন - ' মাকে কিছু করতে দিসনি তো?' আমি বললাম - না! তোমার জন্য সব বাসন জমিয়ে রেখেছি। কথাটা শুনে বাবা মুচকি হাসলেন।'


মা উঠে পড়ল। আমি আর মা মিলে শুরু করলাম দুপুরের রান্না। সোমবার শিবের উপোস তাই নিরামিষ রান্না হল। আমি সব্জি কেটে দিলাম। মা খুন্তি নাড়ল। আবার শেষে আমিও একটি পদ রান্না করলাম। যথারীতি বাবা খেয়ে বেড়িয়ে গেলেন নিজের কাজে। আমি সেই সমস্ত বাসন মাজলাম একা একা। তারপর আবার স্নান করলাম, শেষে খেতে বসলাম বেলা তিনটের সময়। খেয়ে উঠে বাসনপত্র গুলো সেভাবেই রেখে বিছানায় পড়তেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো। উঠে দেখি সন্ধে সাড়ে ছ'টা। তাড়াতাড়ি করে উঠে দুপুরের থালা কটা মেজে চা করলাম। বাবা ততক্ষণে বাড়ি এসে আবার পাড়ায় গেলেন একটা মিটিংয়ে।


বই নিয়ে আমি বসলাম চুপ করে। তখন দেখা হল আমার নিজের সাথে। মনে হল - মা এতো কাজ করে? সেই ষোলো বছর বয়স থেকে টানা ত্রিশ বছর। সারাদিনে কোনো বিশ্রাম নেই, একভাবে করে যায় সব। একা হাতে সামলেছে সমস্ত দিক। অভিযোগ, আবদার, রাগ , অভিমান - সব সহ্য করেছে। কখনো আবার সহ্যাতীত হয়ে গেলে রেগে বলেছে - 'চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে, থাক তোরা একা।' কিন্তু পেরেছে কই ? সেইতো আবার হাসিমুখে সবার জন্য ভাত বেড়ে দিয়েছে। রাগ ভাঙ্গিয়েছে, আবদার মিটিয়েছে। আমি একটা দিন একটু কাজ করেই এতটা হাঁপিয়ে গেছি। মনে হচ্ছে যেন কতদিন ধরে চলছে এই নিয়মে। কিন্তু মা - এক হাতে করেছে রান্না, তো আর এক হাতে বাসন মাজা। অন্য একটি হাত দিয়ে করেছে পুজো, তো আর একটি হাতে ঘর মোছা। আর একটি হাতে বাবার বাবার অদ্ভুত অভ্যাস আবার অন্য হাতে আমাদের আদরও করেছে। দেবী দুর্গার দশটি হাতের এটাই হয়তো মাহাত্ম্য। আমাদের মায়েদের দুটি হাত সংসারের জাঁতাকলে পড়ে দশটি হাতের সমান ভার বহন করে। মা দুর্গার মত গোটা বিশ্বের ভার যেন নিজের দুটি হাতে তুলে নেয়। এই জন্যই হয়তো 'মা' শব্দটি এতো প্রিয়। এই জন্যই হয়তো 'মা' এর এতো মাহাত্ম্য।

 (সমাপ্ত)

rina21.ghosh@gmail.com
কৃষ্ণনগর 


No comments:

Post a Comment