বাদল
দেবেশ
মজুমদার
পুলিশ যখন পুরো পাড়াটাই
ঘিরে ফেলেছে তখন বাদল হেটো কাপড়-ব্যাপারি বিনয় দত্তের বাড়ির বারান্দায় বসে আছে।
তখনও তার সামনে আধখাওয়া মুড়ির বাটি আর দু’তিন চুমুক দেওয়া চায়ের কাপটা বসানো
রয়েছে।
বিকেল প্রায় তিনটে বাজে। হাটে যাবার জন্য বিনয় তার কাপড়ের
গাঁঠরিটা বাঁধা শেষ করেছে।
গ্রামের দিকে হাট সপ্তাহে দুদিন বিকেল থেকে সন্ধে রাত পর্যন্ত বসে। বিনয় সপ্তাহে
পাঁচদিন সেসব আলাদা আলাদা হাটের চালাঘরে জামাকাপড়ের অস্থায়ী দোকান দেয়। সেখান থেকে
বিভিন্ন গ্রামের হেটোরা মাল কেনে। কিছু কিছু চেনা খদ্দের বাকিতে জামা-কাপড় কেনে।সেই সব খদ্দের প্রতি হাটবারে অল্প অল্প করে টাকা শোধ
দেয়। বাদলও তাই করে। সে শুধু ময়নাতলায় হাটে বিনয়কে টাকা দেয়। ময়নাতলারহাট মঙ্গলবার
আর রবিবার বসে।
গত মঙ্গলবার ময়নাতলার হাটে বাদল যেতে পারেনি। সেজন্য
বিনয়কে কোন টাকাও দিতে পারেনি। বাদল কথা দিলে সে কথা রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সেই
টাকা দিতে আজ বুধবার পাঠ পাড়ার
বিনয়ের বাড়িতে এসেছে সে। বাদলের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বুকপকেট থেকে ছোট নোটবইটা
বের করে তাতে লিখে নিতে নিতে বিনয় বলল- ‘এই টাকাটা তো তুমি সামনের রবিবারের
হাটেই দিতে পারতে বাদলদা। শুধু শুধু এই কড়া রোদ্দুরে কষ্ট করে আমার বাড়ি পর্যন্ত
এতটা আসার কোন দরকার ছিল না।
জবাবে বাদল কিছু একটা বলতে গিয়েও হঠাৎই থেমে যায়। মুড়ির
বাটি আর চায়ের কাপ বারান্দায় ফেলে রেখে উঠানে ছিটকে নামে। চাপা সতর্ক গলায় বলে-
‘পুলিশ’! বাদলের কথা শুনে বিনয় খুব হকচকিয়ে গিয়ে বলে-
-‘অ্যাঁ- কীসের পুলিশ! কই? কেন?
কোথায়?’
বাদল ততক্ষণে পরণের ধুতিটা মালকোঁচা মেরে নিয়ে এক লাফে
উঠানের জামরুল গাছটায় উঠে পড়ে সেখান থেকে আর এক লাফে বিনয়ের ঘরের চালে উঠে পড়েছে।
ঘরের চাল বেয়ে হামগুড়ি দিয়ে খানিক উপরের দিকে উঠে খুব সাবধানে একটু মাথা উঁচু
করতেই দেখতে পেল খানিকটা দূর থেকে চারিদিকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে।
বেশির ভাগ পুলিশের হাতেই বন্দুক। একটু একটু করে পুলিশের
বৃত্তটা ছোট হয়ে আসছে। সে যে বিনয়ের বড়িতে আছে সেটা যেভাবেই হোক পুলিশ জেনেই তবে
এসেছে। রাতের অন্ধকার হলে আলাদা কথা। কিন্তু দিনের চড়া আলোতে এইরকম সশস্ত্র পুলিশ
ছাম্বিং থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই হয়। বাদল খুব ঘাবড়ে গেল- খুব।
দারোগা হিসেবে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্যর খুব নামডাক।বিশেষ
করে সন্দেহভাজন ব্যক্তির
কাছে থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের পদ্ধতি ভেবে বের করার ক্ষেত্রে তাঁকে একজন
প্রতিভাবান দারোগাই বলা যায়। এ ব্যাপারে তাঁর নানা অবদানের মধ্যে সেরা অবদান হচ্ছে
ক্যানভাস-ধোলাই। যদিও সন্দেহভাজন আসামির স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য পুলিশের
কম্বল-ধোলাই একটি প্রচলিত এবং বেশ নামী পদ্ধতি, তবে বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। তাছাড়া এই পদ্ধতিটির
অসুবিধা হচ্ছে, এতে হাড় ভাঙে না বটে কিন্তু দেহে কালশিটে পড়ে
যায়।
দীপঙ্কর বাবু আপন বুদ্ধিবলে এই পদ্ধতিটির মূলগত সংস্কার
সাধন করে নিয়েছেন। কোথা থেকে বেশ খানিকটা মোটা ক্যানভাস জোগাড় করে তা দিয়ে সাড়ে
চার ফুট বাই সাড়ে সাত ফুট একটা থলে বানিয়ে নিয়েছেন। থালেটার এখানে সেখানে বেশ
কয়েকটা ফুটো করা আছে। কোন মানুষ কাউকে থলের ভিতর পুরো ঢুকিয়ে দিলেও সে আরামসে
শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারবে। জিনিসটা খুব কাজের। ক্যানভাস ধোলাইতে হাড় তো ভাঙেই না, কোন
কালশিটেও পড়ে না। অথচ ভীষণ যন্ত্রণা হয়।
দীপঙ্কর দারোগার ক্যনভাস
ধোলাইয়ের এত নাম ছড়িয়েছে যে সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে থানায় ধরে নিয়ে এসে তার মাথার
দিক দিয়ে থলেটা শুধু ঢাকা দিয়ে দিলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গড়গড় করে স্বীকারোক্তি
বেরিয়ে আসতে থাকে। এমন কী মাঝে মধ্যে নিরপরাধ ব্যাক্তিও ক্যানভাস ধোলাই অল্প খেয়েই
অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়েছে। নিজের এই দুর্দান্ত কৃতিত্বের জন্য তিনি হয়তো
পুলিশপদক পেয়ে যেতে পারেন বলে দীপঙ্কর দারোগা বেশ আশাবাদী।
দীপঙ্কর বাবুর খুব ইচ্ছা আছে বাদলকে একবার ক্যানভাসের
থলেটায় ঢোকাবার। কিন্তু নানা চেষ্টা সত্ত্বেও বাদল বরাবরই পুলিশের ধরাছোঁয়ার অনেক
বাইরে থেকে যাচ্ছে। এদিকে গত তিন মাসে পর পর দুটো ডাকাতি হয়ে গেছে দীপঙ্করের থানার
এলাকায়। কিন্তু দুটো কেসেরই সেভাবে কিনারা কিছু হয়নি। অনেক চেষ্টায় ওই ডাকাতির
সঙ্গে জড়িত জনাদুয়েককে ধরা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ক্যানভাস ধোলাইয়ের
পরও বিশেষ কিছুই জানা যায়নি।
তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তারা ডাকাতির সঙ্গে জড়িত
থাকলেও তারা দুজন কেউ কাউকে চেনে না। দলের প্রত্যেকের মাথা মুখ ঢাকা ছিল এবং কেউ
কারো আসল নাম বা পরিচয় জানেই না। নেতৃত্বে একজন ছিল বটে কিন্তু তারও মাথা মুখ
অন্যান্যদের মত ঢাকা ছিল। ডাকাতি দুটোর ধরণধারণ দেখে দীপঙ্কর বাবুর মনে হয়েছে দুটো
ডাকাতিরই নেতৃত্বে বাদল থাকলেও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দলের সকলের পরিচয় সম্ভবতঃ
জানে একমাত্র বাদল। সেজন্য বাদলকে ধরার জন্য দীপঙ্কর একেবারে মরণপণ করে লেগেছিল।
এক মক্কেলের খরচে আজকে থানায় দুপুরের পর বেশ মোটাসোটা
লাঞ্চ হয়েছিল। বড় দারোগার জন্য স্বাভাবিক ভাবে স্পেশাল ব্যবস্থা হয়েছিল। লাঞ্চের
পর একটু বিশ্রামের জন্য থানার লাগোয়া তাঁর কোয়ার্টারে গিয়ে দীপঙ্কর সবে একটু কাত
হবার কথা ভাবছিলেন। এমন সময় সোর্স মারফত খবর এল, বাদল
কিছুক্ষণ আগে হেটো কাপড়-ব্যাপারি বিনয় দত্তের বাড়িতে
ঢুকেছে।
বিশ্রাম মাথায় উঠলো। থানায় পুরো ফোর্স ঝেঁটিয়ে নিয়ে
তৎক্ষণাৎ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়লেন এবং মিনিট কুড়ি পঁচিশের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গিয়ে
এলাকাটা ঘিরে ফেললেন দীপঙ্কর। নিজে থাকলেন পুলিশী বৃত্তের পরিধি বরাবর এ জায়গায়।
গ্রামের প্রধান রাস্তার মাঝ বরাবর খোলা পিস্তল হাতে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আজ
যেভাবেই হোক বাদলকে ধরতেই হবে। এদিকে অবশ্য দুটো মস্ত বড় সুবিধার কথা আগে থেকেই
তাঁর জানা ছিল যে বাদল নিজে কোন রকম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না এবং সে মোটের উপর
খুন জখম এড়িয়ে চলে, অন্তত এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সে রকম কোন
অভিযোগ ওঠেনি। সেজন্য ধরে নেওয়া যায় আজ বাদল পালাতে পারবে না।
থানার বড় দারোগাবাবু বলে কথা। একজন গ্রামবাসী খাতির করে
একটা চেয়ার এনে রাস্তায় পেতে দিল তাঁকে বসার জন্য। আর পাঁচটা দারোগার মত দীপঙ্করের চেহারাটিও
ভাল রকম হৃষ্ট-পুষ্ট। বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশ বেশ ভারাক্রান্ত। লোকদেখানো সামান্য আপত্তি
করে তিনি বসেই পড়লেন চেয়ারটায়। তবে গুলিভরা পিস্তলটা হাতে করে উঁচিয়ে রাখলেন।
বাদল ডাকাত বটে তবে গরিব ছা-পোষা এবং একটু বিরল প্রকৃতির
ডাকাত। এমন কী সে পেশাদার ডাকাতও নয়। তাকে দেখলে ডাকাত বলে মনেই হয় না। রোগাটে আর ক্ষয়াটে চেহারা। বর্ষা আর শীতের
মরসুমে তাকে ক্ষেতমজুরের কাজ করতেও দেখা যায়। কোন কারণে নিরুপায় হয়ে পড়লে তখন
ডাকাতিতে নামে। তবে ডাকাতির অর্থের বেশির ভাগটাই অকাতরে ব্যয় করে ফেলে দলের
লোকেদের নানা সমস্যা ও প্রয়োজনে। ভাগ-বাঁটোয়ারার পর সবশেষে যেটুকু পড়ে থাকে তাতেই
কোন মতে নিজেরটা চালিয়ে নেয় বাদল। সেজন্য তার দলের লোকেরা তাকে প্রাণ দিয়ে
ভালোবাসে। বাদলের নেতৃত্বে কোন ডাকাতির কেসে কোনভাবে কেউ ধরা পড়লে পুলিশের হাজার
নির্যাতনেও বাদলের নাম কখনও মুখে আনতো না।
গ্রামের লোকেদের সঙ্গে বাদলের সম্পর্ক বেশ ভালো। যে কোন
বিপদে আপদে তারা বাদলকে পাশে পায়। তাছাড়া বাদলের কারণে একটা বড় নিরপত্তা ছিল
গ্রামবাসীদের। বাদল সেই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার জন্য সেখানে এখনও পর্যন্ত কখনও
ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি বা ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না এটা সবাই বোঝে।
আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার, বাদলের
কাছ থেকে ঘুষ না পেলেও পুলিশের কিছুলোকও শুধুমাত্র মানবিক কারণে তার প্রতি বিশেষ
সহানুভূতিশীল ছিল। বাদলকে এতকাল যাবৎ কিছুতেই পুলিশ ধরতে না পারার সেটাও ছিল একটা
কারণ। তবে আজকের কথা
আলাদা। দীপঙ্কর সশরীরে এখানে হাজির আছেন। আজ বাদল সত্যিই বড় ভয়ানক বিপদের মধ্যে
পড়ে গেছে। এই বিপদ থেকে আজ কোনভাবে বেরিয়ে যেতে পারা প্রায় অসম্ভব বললেই হয়।
বিনয়ের ঘরের চালের উপর থেকে পুরো পরিস্থিতি নজর করে বাদল
বুঝলো নীচে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। তা করতে গেলেই সে ধরা পড়ে যাবে।
তার চেয়ে আরো বড় কথা দৌড়ে পালাতে গেলে সে গুলি খেয়ে যেতে পারে। তা না করে একবাড়ির
চাল থেকে অন্য বাড়ির চালায় লাফিয়ে লাফিয়ে এলাকার একদম বাইরে চলে যাবার চেষ্টা বুদ্ধিমানের
কাজ হবে বলে
মনে করল। কিন্তু কাজটা ভীষণ
কঠিন। যত কঠিনই
হোক এটাই করবে বলে ভাবলো বাদল। এখানে অনেকেই তাকে বাড়ির ভিতর এখন গোপন আশ্রয় দিতে
রাজি হবে। কিন্তু পুলিশ প্রত্যেক বাড়িতেই ধরে ধরে তল্লাশি চালাচ্ছে। কোনভাবে সে
ধরা পড়ে গেলেই পুলিশ সেই আশ্রয়দাতাকেও গ্রেপ্তার করবে। বাদল কিছুতেই সেটা হতে দেবে
না।
খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। বেশি সময় কিন্তু সে পাবে
না। পুলিশী ঘেরাও ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। তিনটি বাড়ি পেরিয়ে নিমাই দাসের বাড়ির চালায়
এসে পড়লো বাদল। নিতান্ত গ্রাম্য এলাকা বলে পাড়ার অধিকাংশ বাড়ির ছাউনি খড়ের বা
টালির বা অ্যাসবেসটসের। নিমাই দাসের টালির চাল বেশ উঁচুমত করা। সেখান থেকে গণেশ
কামারের খড়ের নীচু চালায় লাফিয়ে চলে যেতে গিয়ে একজন কনস্টেবলের নজরে এসে গেল সে।
তৎক্ষণাৎ কনস্টেবলটি চেঁচিয়ে উঠলো গগনভেদী আওয়াজে-
-‘হুঁশিয়ার! আসামী উপরে উঠেছে! বাড়ির চালায় লাফিয়ে পালাবার
চেষ্টা করেছ’।
দারোগা দীপঙ্কর সে
চিৎকার শুনতে পেলেন। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তল বাগিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন।–
-‘খুব সাবধান সবাই! আসামী যেন কোনভাবেই পালতে না পারে’।
বাদল ততক্ষণে বুঝে গেছে যে বাড়ির চালায় লাফিয়ে সে এখান
থেকে কিছুতেই পালাতে পারবে না। সবারই নজর প্রধানতঃ উপরের দিকেই থাকবে। অর্থাৎ
নীচের বা উপরের দুদিকের পথই তার কাছে বন্ধ। এক মুহূর্ত ভেবেই সে ঘুরে গিয়ে নিমাই
দাসের টালির সেই উঁচু চালায় আবার লাফিয়ে উঠল। যেদিক থেকে দারোগার চিৎকার ভেসে
এসেছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল গ্রামের চওড়া রাস্তাটার মাঝ বরাবর দারোগা পিস্তল
হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেজন্য সেদিকটায় আর কোন পুলিশের লোক নেই।
আবার উঁচু চালায় উঠার ফলে কয়েকজন পুলিশের লোক তাকে ফের
দেখতে পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা সম্মিলিত চিৎকার শোনা গেল, ‘ওই
যে আসামী’!
দীপঙ্কর বুঝলেন আজ আর বাদলের রেহাই নেই। এত
পুলিশ আর সেইসঙ্গে তাঁকে দেখে ব্যাটা বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে গুলিয়ে ফেলেছে। একবার
এক বাড়ির চালায় উপর আবার তাকে দেখতে পাওয়া সত্বেও সেই একই বাড়ির চালার উপর আবার
তাকে দেখা গিয়েছে। প্রবল উৎসাহে তিনি গর্জন করে উঠলেন- ‘সবাই সাবধান! জ্যান্ত অথবা
মরা যেভাবেই হোক আজ বাদলকে চাই! দরকার হলে গুলি করেও ওকে নামাও’।
ডাকাতি করতে গিয়ে অনেক সময় গভীর সংকটজনক অবস্থায় পলকের
মধ্যে তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হয়। এবারেও বাদল তাই করলো। তার
ধারণা ছিল পুলিশের অল্প কয়েকজন মাত্র তাকে চেনে। আর এই দারোগার সঙ্গে এ পর্যন্ত
কখনো তার দেখা হয়নি, এই দুটো ব্যাপার মাথায় রেখে মরিয়া বাদল এবারের ভীষণ সংকট বাঁচার জন্য একটা শেষ চেষ্টা করে দেখবে বলে এক
ভীষণ দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।
বাদল এবার চালের নীচের দিকে সরে এল। তারপর প্রহরারত
পুলিশদের দৃষ্টিসীমা সাবধান এড়িয়ে উল্টোদিকেই ঘুরলো। ওইভাবে চালার একদম নীচের দিক
থেকে পর পর তিন চারটে বাড়ি পেরিয়ে গিয়ে সে যেখানটায় লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়লো
সেখানটায় একটা নর্দমা রয়েছে। দুপাশের দুটো বাড়ির পিছনের দিকের দেওয়াল। মাঝখান দিয়ে
কাঁচা নর্দমাটা বয়ে গেছে। নর্দমার দুই কিনারায় পা রেখে খুব সাবধানে জলকাদা এড়িয়ে
সে এগোতে লাগলো। কিন্তু এই নর্দমাটা সামনে এগিয়ে বড় রাস্তার নর্দমায় গিয়ে পড়েছে।
বড় রাস্তার একটু আগে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। মালকোঁচা মার
ধূতিটাকে আবার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলিয়ে স্বাভাবিক করে নিল। কোমরে বাঁধা গামছা
খুলে নিয়ে গায়ে চাদরের মতো করে জরিয়ে নিল। তারপর খুব শান্ত ভাবে বড় রাস্তার দিকে
এগিয়ে গেল।
দীপঙ্কর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।
এখন যা পরিস্থিতি তাতে যে কোন সময় বাদল ধরা পড়ে যাবে। দু’একবার শূন্যে পিস্তল
চালিয়ে বাদলকে বিভ্রান্ত করবার বা ভয় দেখাবার কথা ভাবলেন। কিন্তু তাতে তল্লাশিরত
কনস্টেবলদের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে ভেবে সেটা আর করলেন না। তাঁর কাছাকাছি কোন
কৌতুহলী ভিড় জমতে দেননি। তবুও তাঁর পিছন দিকে খানিকটা দূরে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে
ছিল। খানিকটা ইচ্ছা করেই তাদের আর হটিয়ে দেননি। বাদলকে তিনি না চিনলেও এরা সবাই
বাদলকে ভালোমত চেনে এবং চিনিয়েও দিতে পারবে। তাছাড়া অফিসিয়ালি সনাক্তকরণে’র জন্য
সাক্ষী হিসেবে এদের দরকার হবে। ছোটখাটো সেই জমায়েতটার দিকে একবার বিরক্তির
দৃষ্টিপাত করে তিনি আবার সামনের আর দুপাশের দিকে সতর্কভাবে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
একজন রোগাটে খাটো চেহারার লোক বড়
রাস্তা ধরে ধীর শান্ত পায়ে এদিকেই এগিয়ে আসছিল। ময়লাটে ধুতিপরা, গায়ে গামছা জড়ানো লোকটাকে এই সময়ে ওই রকম গদাইলস্করী চালে হেঁটে আসতে দেখে
দীপঙ্কর খুব বিরক্ত হলেন। এই উজবুকটা এখন তো যে কোন সময় গুলির মুখে পড়ে যেতে পারে।
আর সেই লোকটাকে দেখে দারোগার পিছনের জমায়েতটার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হল।
বাদল এখন সোজা এগিয়ে আসছে বড় দারোগার
দিকে। পাড়ার সবাই বুঝতে পারলো আজকের সশস্ত্র পুলিশ ছাম্বিং থেকে পার পাবার কোন
উপায় নেই বুঝে আর ভয়ঙ্কর ক্যানভাস ধোলাইয়ের ভয়ে সে নিরুপায় হয়ে নিজেই আগেভাগে ধরা
দিতে আসছে। বাদল এগিয়ে এসে
সম্মানজনক দুরত্বে দাঁড়িয়ে পড়ে দুহাত জুড়ে কপালে ঠেকিয়ে সামনে একটু ঝুঁকে পড়ে
দারোগাকে বললে- নমস্কার বড়োবাবু’।
নমস্কার আদৌ গ্রাহ্য না করে দীপঙ্কর
তার দিকে কটমট কর তাকিয়ে বললেন, -‘অ্যাই, তোর বাড়ি কোথায়? এদিকে যাচ্ছিস কোথায়?’
-‘আজ্ঞে বাড়োবাবু আমার বাড়ি
বোয়ারপু্রে। যাবো কুয়ারপুর আমার মাসিশাউড়ির বাড়িতে। তার নাকি খুব পেট ছেড়েছে।
ভোররাত থেকে নাকি আট দশ বার...’
-‘ফালতু কথা ছাড়্। তুই বাদলকে চিনিস
কিনা বল্?’
- ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বাদলকে চিনবো না কেন’?
-অ্যাঁ!বাদলকে চিনিস তুই? তাকে দেখলে ঠিকমতো চিনিয়ে দিতে পারবি?’
-‘তা পারবো না? একগাল হাসে লোকটা,-বাদল তো আমার ভাইপো। সে তো কেলাস টু’তে পড়ে’।
-‘ধোর্ ব্যাটা গাড়োল! ডাকাত- বাদল
ডাকাতকে চিনিস্ কী না বল্?’
-‘ডাকাত! ওরে বাবা, তাকে চিনি না তো। আমি তো থাকি না এখেনে। বর্ধমানে থেকে সেখানে রিশকা চালাই। তিন চার মাস অন্তর আসি। কালি রাত্তিরে বাড়ি এসেছি। আজ সকালে উঠে
এই গুরুতর বিত্তান্ত শুনেই...’
-‘ফালতু না বকে এখুনি কেটে পড় এখান
থেকে। এখানে যে কোন সময় গুলি চলতে পারে’।
-‘ওরে বাবা! তাহলে তো- তাহলে যাই
বড়োবাবু। নমস্কার...’।
আবার দারোগাকে সবিনয় যথাবিহিত আনত একটি
নমস্কার জানিয়ে লোকটি খুব ঘাবড়ে যাবার মত মুখ করে এবার তাড়াতাড়ি কুয়ারপুরের দিকে
হাঁটতে লাগলো।
তার চলে যাওয়া দেখে দারোগার খানিক
ওপাশে দঁড়িয়ে থাকা জমায়েতের লোকজন তাদের বুকের মধ্যে আটকে থাকা শ্বাসগুলো এবার
ভালোভাবে আর ঠিকমতো ছাড়তে লাগলো।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment