হাত বাড়ালেই বন্ধু
অর্পিতা বসু
দেশ ভাগের পর থেকেই উস্রি নদীর এপারে শান্তিপুর হয়েছে হিন্দু গ্রাম আর ঠিক
ওপারের বেগমপুর হয়েছে মুসলিম গ্রাম। সরকার থেকেই অশান্তির ভয় এড়িয়ে চলার জন্যে
ওই গ্রামের সব হিন্দুদের এপারে আর এখানকার মুসলিমদের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যারা
স্থাবর - অস্থাবর সম্পত্তির মায়া কাটাতে পারে নি তাদের প্রশাসন প্রাণের মায়া
কাটাতে বলে ছেড়ে দেয়। তারপর থেকেই একটা অদৃশ্য কাঁটাতারের বেড়া এসে গেল চেনা
মানুষগুলোর মাঝে। চেনা মুখ,
চেনা সম্পর্ক গুলো যেন সব অচেনা হয়ে গেল।
অবিশ্বাস দানা বাঁধল আর তা এখন বিষবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের মানুষ গুলোর
মাঝে।
মানুষ গুলোকে সরিয়ে দিল কিন্তু বেগমপুরে রয়ে গেল অশ্বত্থ গাছের তলায় বুড়ো
শিবের মহাজাগ্রত থান। দূর দূর থেকে মানুষ আসত সেখানে। আর শান্তিপুরে রয়ে গেল ওদের
মসজিদ। সেই সূত্র ধরেই আজও দুই গ্রামের মানুষ নদী পেরিয়ে দুই গ্রামে যাতায়াত
করে। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মগত প্রয়োজনে। এত বছরেও তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার
চেষ্টা করে নি। দুই পক্ষই আড়চোখে দেখে একে অপরকে। একদিন যে রামচরণ আমির মিঞার
ছেলে আবুলকে দেখিয়ে বলত,
রঘু আবুলের মত বড় মনের মানুষ হও, ওর কাছে পড়তে যেও। আজ তাদের পরিবারের মধ্যে
নেই মুখ দেখাদেখি।
যে আমিনা বিধুজেঠার বাগানের ফল কুড়িয়ে ভাইবোনদের খাওয়াতো আবার একা মানুষ
বিধু জেঠাকেও খাওয়াতে ভুলতো না সে আর বিধুজেঠার শেষসময়ে পাশে থাকতে পারল না।
সম্পর্কগুলো এভাবেই বিভেদ নীতির নাগপাশে পড়ে অচিরেই শেষ হয়ে গেল। আর এখন তাদের
পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তো কোন টানই নেই।
আমপান আসছে। তবু রাধাচরণ তার রুগ্ন মেয়েকে নিয়ে নদী পেরিয়ে গেল বাবার থানে।
বৈদ্য মশাই যে জবাব দিয়ে দিয়েছেন। কাকভোরে বের হল, স্ত্রীকে আশ্বাস দিলো দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবেন। এদিকে বাবার থানে মেয়েকে
বাবার চরণামৃত খাইয়ে ঠাকুর মশাই জরিবুটি দিয়ে ওষুধ বানাতে সময় নিলেন। আশ্বাস
দিলেন এই ওষুধ অব্যর্থ। বাবার আশীর্বাদে মেয়ে সারবেই। কিন্তু বেলা গরিয়ে গেলে
ঠাকুরমশাই বললেন তিনি ও ওই পথেই ফিরবেন শান্তিপুর। তাই অপেক্ষা করে ওনার সাথে বের
হলেন। কিন্তু একটাও গাড়ি মিলল না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত মেয়ে আর চলতে পারে না।
শেষে বাধ্য হয়ে গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে বসে। ঠাকুর মশাই পড়ল আতান্তরে। তা বুঝে
রাধাচরণ তাকে এগিয়ে যেতে বললেন।
ঠাকুরমশাই এগোলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আর বসা ঠিক হবে না বলে মেয়েকে ধরে ধরে
নিয়ে এগোতে শুরু করল রাধাচরণ।নদীর তীরে গিয়ে দেখে ঠাকুর মশাইও দাঁড়িয়ে। নৌকা
চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এরমধ্যেই শোঁ শোঁ শব্দ।
এলো সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। কী ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য। দূরে মাঠের ওপারে ধুলো
কুন্ডুলি পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠেছে। সেই বিশালাকার কুন্ডুলি তাদের দিকেই ধেয়ে
আসছে। তা দেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিন জনে ভয়ে দৌড়তে লাগল। জানে না কোথায়
যাচ্ছে তবু ছুটছে প্রাণের তাগিদে। সামনে বেগমপুর হাইস্কুলে ঢুকল। সেখানে নদীর তীরে
যারা কুঁড়ে ঘরে থাকে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ওদের দেখে থমকে গেল ঠাকুর মশাই।
কিন্তু ওরা বলল,
আসুন ঠাকুরমশাই।
এ গ্রামের সবাই তাকে চেনে কিন্তু তিনি তেমন করে এদের চেনেন না। মনে সংশয়, ভয় নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। রাধাচরণ ও মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন। মেয়ে আর চলতে পারছে
না দেখে একজন যুবা পাশের ঘর থেকে বেঞ্চ এনে বসতে দিল।
ভাগ্যিস সরকার এতো বড় একটা স্কুল তৈরি করেছিল, যার ছাত্র সংখ্যার থেকে ঘরের সংখ্যা বেশি।
ধীরে ধীরে ঝড় ঘনীভূত হল। হাওয়ার ও যে কত রকম শব্দ হয় তা শুনছে সবাই চুপ করে বসে। ঝড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির জল বারান্দা ছাপিয়ে ঘরে ঢুকছে দেখে সব দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে রইল। প্রকৃতির উদ্দাম নৃত্য কখন যে থামবে! রাধাচরণের মেয়ে মুনিয়ার আর হুশ নেই। সে অচেতন প্রায়।
ওদিকে রাধাচরণের স্ত্রী দোতলা বাড়ি আগলে বসে কেঁদে কেঁদে সারা। স্বামী আর মেয়ে কোথায় আটকে পড়ল? কী করবে? কাকে বলবে? এই ভয়ঙ্কর ঝড়ে ওই অচেনাদের মাঝে আদৌ তারা সুরক্ষিত তো? এরমধ্যেই দরজায় ধাক্কা।
দোতলা থেকে ছুটে এসে দরজা খুলে দেখে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক তার পোয়াতি কে নিয়ে
হাতজোড় করে আশ্রয় চাইছে। কিছুতেই না বলতে পারলেন না। একতলার একটা ঘরে আশ্রয় দিল।
ওরাও ওপারে যাওয়ার নৌকা না পেয়ে মসজিদে ফিরছিল। কিন্তু ঝড়ে আর এগোতে পারলো না। মুনিয়ার মা আঁতকে উঠল।
মসজিদ!
নাম কী বোন?
রাজিয়া আর আমি রসিক খান।
আশ্রয় দিয়ে তো আর বের করে দেওয়া যায় না। তাই ওদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও থাকতে দিল।
সারারাত চলল এ দুর্যোগ।
কেউ ডাকছে আল্লাহ কে। কেউ ডাকছে ঈশ্বরকে। কারোর চোখে ঘুম নেই।
আলো, খাবার, জল ছাড়া সারারাত মানুষ শুধু প্রকৃতিকে শান্ত হতে বলল।
ভোরের আলো ফুটলে সবাই দেখে স্কুলের মাঠ জলে ডুবে। চারিদিকে জল। নদী যেন স্কুলে চলে এসেছে। ওরা যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে। কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে? আর যারা নদীর আশেপাশে নিজেদের ঘর ছেড়ে এসেছিল সেসব নিশ্চিহ্ন। প্রকৃতির জল আর চোখের জল একাকার হয়ে গেল। অসহায়, অভুক্ত মানুষ গুলো মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।
ওদিকে মুনিয়ার মা সকালে দেখে চারিদিকে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। আর শুনল নদী
সংলগ্ন এলাকা জলে ভেসে গেছে। ওরা প্রাণে বেঁচে আছে তো! এখন প্রশ্ন এটাই। মানুষ গুলোকে
আশ্রয় দিয়েছে তাই রান্না করে খেতে দিল যৎসামান্য। পোয়াতি মেয়েটা আজন্মের খিদে
নিয়ে খাচ্ছে দেখে মুনিয়ার মা নিজের খাবারটাও দিয়ে দিল। মুনিয়া হওয়ার সময় তারও
এমনই হয়েছিল। পেট যেন কিছুতেই ভরত না। আর এখন মুনিয়া আর ওর বাবা ঠিক আছে কিনা না
জেনে খাবে কি করে?
খাওয়ায় তার রুচি নেই। দুপুরে, রাতে দুবেলাই তিনি খান নি তা খেয়াল করে
রাজিয়া বলল,
দিদি!
মুনিয়ার মা এ ডাকে চমকে উঠল। তারপর এ অসহায় অবস্থায় পাশে এরাই তো সঙ্গী।
তাই সবটা খুলে বলল।
রসিক সব শুনে বলল, দিদি চিন্তা করবেন না। আমাদের যেমন আল্লাহ তার মশিহার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তেমন ওনাদেরও ভগবান সুরক্ষিত রেখেছেন। মুনিয়ার মা কেঁদে ফেলে বলল, তাই যেন হয় ভাই।
ওদিকে স্কুল বাড়িতে নৌকা নিয়ে কিছু লোক এসে খবর দিয়ে গেল জল সরতে আর ভাঙা গাছ
সরাতে তিন-চার দিন সময় লাগবে। ততদিন এখানেই থাকতে হবে। ওরা প্রতিদিন একবার করে
এসে খাবার দিয়ে যাবে। মাথা গুনে নিল। রাধাচরণ আর মুনিয়াকে নতুন দেখে পরিচয় চাইলে
আফজল মিঞা এগিয়ে এসে বলল,
আমার ভাই। ভিনগাঁয় থাকে। আমার বাড়ি এসে
ফিরতে পারে নি। রাধাচরণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। দূরত্ব কতকিছু মনগড়া
চিন্তা ভাবনা সৃষ্টি করে।
লোকগুলো চোখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল, এখন মুড়ি আর চিঁড়ে গুড় দিয়ে গেলাম। আর জলের ব্যাড়েল চারটে।
এত লোকের এইটুকু খাবার আর জল?
আজ এতে চালিয়ে নাও। কাল দেখছি কী করা যায়।
ওই খাবার খুব অল্প করে সবাই ভাগ করতে থাকল। শুধু ঠাকুরমশাই আর রাধাচরণ
মুনিয়াকে নিয়ে চুপ করে বসে রইল। আমিনা বিবি এগিয়ে এসে বলল, আমাদের ছোঁয়া খেতে দোষ আছে?
ঠাকুরমশাই আর রাধাচরণ কান চাপা দিয়ে বলল, ছি ছি। কখনোই না।
কম আছে তাই....
আমিনা বিবি বলল,
কম আছে তো কম করেই সবাই খাবো। মেয়ে টাকে
খাবার আর জল দিন আগে।
দুহাত পেতে খাবার নিল ওরা।
আরো দুইদিন কাটল এভাবে। জল সরেছে। স্কুলের মাঠে আম পড়েছে দেখে সব কুড়িয়ে এনে ফুটো করে চুষে খাচ্ছে। আফজল দুটো এনে মুনিয়াকে দিয়ে বলল, খাও মা। মুনিয়া একগাল হেসে নিল।
ওদিকে জল কমেছে বলে পাশের বাড়ির রায় গিন্নি মুনিয়া দের খবর নিতে এসে দেখে
আগন্তুকদের। মুনিয়ার মা বলল, আমার ভাই, ভাইয়ের বৌ। ওরা এসেছিল ওদের মা নেই তাই আমি
সাধ খাওয়ালাম। আর ফিরতে পারে নি ঝড়ের জন্য। ওদিকে মুনিয়া আর ওর বাবা বাবার থান
থেকে ফিরতে পারে নি।
রায় গিন্নি আতঙ্কিত হয়ে বলল, সেকি গো!
বেগমপুরে! কী সর্বনাশ।
ওভাবে বলো না দিদি। ওরাও আমাদের মত মানুষ। বিবেক - মনুষ্যত্ব ওদেরও আছে। আর যদি বলো নেই তাহলে আমাদের ও নেই। এক হাতে তো তালি বাজে না।
পরিস্থিতি অনেকটা সামলে উঠেছে। কাল সকালে নৌকা চলাচল শুরু হবে। শুনে একগাল
হেসে মুনিয়া বলল,
বাবা কাল বাড়ি যাব। এবার আমি একদম ভালো হয়ে
যাবো। আফজল এসে নিজের হাত থেকে একটা তাবিজ খুলে মুনিয়ার হাতে বেঁধে বলল, হ্যাঁ মা একেবারে ভালো হয়ে যাবি। তোর
ভগবানের আশীর্বাদ আর আমার আল্লাহর দোয়া দুই রইল তোর কাছে।
রাধাচরণ কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন আফজল মিঞা কে।
ঠাকুরমশাই এতদিন আসছে এ গ্রামে কিন্তু মানুষ গুলোকে চিনল আজ।
সকাল হতেই সবাই চলল নিজের গন্তব্যে। নদীর আশেপাশের বাড়ি নিশ্চিহ্ন দেখে রাধাচরণ বলল, আফজল ভাই যোগাযোগ রেখো। তোমাদের কোন প্রয়োজনে লাগতে পারলে আমি ধন্য হব। সব সময় জানবে তোমাদের আর এক ভাই থাকে নদীর ওপারে। নির্দ্বিধায় ঠাকুরমশাই এর সঙ্গে চলে যাবে আমার বাড়িতে। আফজল মিঞা ছলছল চোখে রাধাচরণের হাত দুটো শক্ত করে ধরল।
ওদিকে কাল সকালে নৌকা চলবে শুনে মুনিয়ার মা রাতে বাড়িতে যা ছিল তাই দিয়ে
পাঁচ পদ রান্না করে খাওয়ালো রাজিয়াকে। সকালে ওরা চলে যাওয়ার সময় দুজনে হাতজোড়
করে নমস্কার করল। রসিক বলল,
দিদি কয়েক দিন পর এসে দাদা আর মুনিয়ার খবর
নিয়ে যাবো।
দিদি ছলছল চোখে ওদের আশীর্বাদ করে একটা মাদুলি নিজের হাত থেকে খুলে রাজিয়ার
হাতে পরিয়ে বলল,
কোন বিপদ তোমায় স্পর্শ করবে না। সুখবর
অবশ্যই
দিও।
************
No comments:
Post a Comment