হাতুড়ি হাতে
প্রতীক মিত্র
অনেকদিন ধরেই সবাই বিরক্ত।বাবা কারো কথা শুনছে না।ওরাও বাবার কথা শুনছে না।
কোভিডের বাড়াবাড়ির পর থেকে বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ। ইভনিং ওয়াকে বন্ধুগুলো
হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলেছে।বাবাকে সেই গ্রুপে ঢুকিয়েওছে।বাবার অবশ্য ওইসব ফোনের
মধ্যে খুটুর খুটুর পছন্দ নয়।চুপ করে বসে থাকা ওর স্বভাবে নেই।অথচ বাড়ির ছেলে-মেয়ে
নাতি-নাতনি সবাই খালি উপদেশ দিয়ে চলেছে।বসে থাকো।রেস্ট নাও।কিসের রেস্ট রে!সুধীন
কি মানুষ না আসবাব?দাদু ডাকটা শুনতে ভালো লাগে না বলে
নাতি-নাতনিদেরও বলে দিয়েছে,বাবা বলে ডাকবি!দাপুটে লোক,আগে পুলিশে ছিল;কে আর ট্যাঁফোঁ করবে। পরিশ্রমের একটা ছুতো
চাই সুধীনের,
নইলে কারোকে জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ।ব্যস!তখন
গিয়ে একটু স্বস্তি সে পায়।মেয়েরা যখন মাঝে মাঝে এসে থেকে ঘুরে যায়,ছেলেরাও চেষ্টা করে খোঁজ নিয়ে যেতে।তখন তাদের
আলোচনায় অনধিকার প্রবেশ করেই ফ্যালে সুধীন আর তারপরই তক্কো।তক্কো কোথাও পরিণতি পায়
না।বৃথাই উত্তেজিত হয় ওরা,
মানে সুধীনের ছেলেমেয়ে।বুড়ো ইচ্ছে করে করছে
এসব।তারা ভাবতে থাকে। সেই সুধীনই একবার তিনদিন পুরোনো খবরের কাগজে চোখ রাখতে রাখতে
জানলার বাইরে চেয়েছিল একটা পাখির ডাককে অনুসরণ করে।অনেকটা এরকমই ডাক ও নিজেও নকল
করতে পারতো।ছেলে-মেয়েদের কান্নাও ভোলাতো ওই ডাকের অনুকরণ করে।ডাকটা যদি বা একটু
আধটু ডেকে উঠতে পারছিল,
পাখিটার নাম কিছুতেই মনে আনতে পারছিল
না।বেশখানিক্ষণ স্মৃতিকে চাপ দিয়েও কাজ হাসিল না করাতে শেষমেশ এমনিই গালে হাত দিয়ে
জানলার দিকে মুখ করে বসে রইল পাখিদের ডাক শুনতে।সত্যিই তো মাথায় বেশি ভাবনা-চিন্তা
এনে হবে কি!তবুও ভাবনাগুলো চলে আসতোই।হাতপা ছুঁড়তো।তা সে ছোট ছেলেটার বয়ত্রিশ এর
বিয়ে না হওয়া হোক কিম্বা বাকি ছেলেমেয়েদের ওর সাথে সম্পত্তির বিষয়ে কথা না
বলা।দাবড়ানি যেমন ছোটো ছেলেকে দেয় প্রেম করে প্রেয়শী না পাওয়ার ফলে তেমনি অন্য
ছেলেমেয়েদেরও ছাড়ে না।বাবার আপত্তির কারণে তারা বিরক্ত হয়।কেউ হাসে,অধিকাংশরা রেগে যায়।আজব তো!এ আবার বাবার কি
কথা?আমাদের এইসব সম্পত্তির কোনো দরকার নেই।যদিও
সুধীন জানে একটাও অন্যজনকে পছন্দ করে না।ছোটো ছেলের জন্য ব্যথিত হৃদয়ে মেয়ে দেখা
শুরু তো করে কিন্তু বিরক্তি তারও কমে না। ছেলেমেয়েরা বন্ধুমহলে কথা বলতে গিয়ে
হাসাহাসি করে,ভাবে,বাবা কি ওদের কে মেগা সিরিয়ালি মাল পেয়েছে? যাজ্ঞে।বিরক্তি ফলে উভয় পক্ষের তরফেই বেড়েছে বই কমেনি।মেয়েরা চলে গেলে ছেলেরাও
যেযার বাড়ি ফিরে গেছে।সুধীনের বাড়িতে গেলে আপাতভাবে কিছু বোঝা যাবে না।সুধীন
আসবাবের মতনই চুপচাপ।সুধীনের বউও।ছেলেমেয়েদের সাথে ফোনে কথা সুধীনের গিন্নিই
চালায়।ওরা খোঁজ নেয় বাবা ঠিক আছে কিনা।আছে,মা বলে।এই অবদি সব ঠিক।কিন্তু যেই কোনো কারণে বা অকারণে ছেলেমেয়েরা হাজির হয়
সেই ভিটেতে ওমনি খুট খুট করে আওয়াজ শোনা যায়।সুধীন হাতুড়ি হাতে কখনো উঠোন দিয়ে
ঢোকার মুল দরজাটাকে মেরামত করতে শুরু করে কখনো বা দক্ষিণের ঘরের জানলাটাকে।সেইসব
কাজ মিটলে বাকি থাকে না যখন কিছুই তখনও নিজের পুরোনো প্রায় বাতিল সাইকেলটাকে
মেরামত করতে শুরু করে।কেউ কিছু ছিজ্ঞেস করলে ও উত্তর ওখান থেকেই দেয়।বাইরে
প্রতিবেশিরা স্বস্তি পায় এই ভেবে যে বুড়োর রাগ কমেছে।তাদের কানে শুধু খুট খুট
শব্দটা ভাসতেই থাকে।একটা নেশার মত।এমনকি ছোটোছেলের শেষমেশ ঘটক দেখে বিয়ে ঠিক হয়ে
যাওয়ার পরও।খুট খুট শব্দটা।
No comments:
Post a Comment