1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

আরো একবার

 

ছবি : ইন্টারনেট 

আরো একবার

পৌষালী বিশ্বাস 

 ফিরে এলো সে বৃষ্টি হয়ে। গতকাল যখন বিকেলে তুমুল বৃষ্টি পড়ছিল, তখন আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম। বৃষ্টির জন্য রাস্তা পুরো ভিজে গেছে। হঠাৎ করেই আর একটু হলেই পিছলে যাচ্ছিলাম ওমনি আঠের উনিশ বছরের একটা ছেলে কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে সামলাল। ছেলেটা না এলে আমি হয়ত পড়েই যেতাম। এই বয়সে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। মেঘে মেঘে ষাট কবেই পেরিয়ে গিয়েছি। এখন পড়ে টরে গেলে আর রক্ষে নেই, পুত্রবধূ শ্রীতমার কাছে তখন বোঝা হওয়া ছাড়া আর কোনো পথই থাকবে না। একমাত্র ছেলে কিঙ্কর ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত, পুত্রবধূ শ্রীতমা ওখানে একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার। নাতনি ওখানের স্কুলে পড়ে। শ্রীতমা এখন লিভে এসেছে। ছেলেকে ছেড়ে দিব্য আছে। ছেলেও ওখানে বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছে বউকে ছেড়ে। এই এক হয়েছে আজকের যুগের ছেলে মেয়েদের, ওদের কাছে কেরিয়ার আগে। যাক বাবা ওরা ওদের বৃত্তে ভালো থাকুক। আমি কিন্তু আমার ছেলের অধীনে থাকি না। আমার বর সাতশো স্কোয়ারের ফ্ল্যাট করে গেছে, এখন সেটার একমাত্র মালিক আমি। ব্যাঙ্কেও প্রচুর টাকা রেখে গেছে আমার জন্য। এখন আমি ইন্টারেস্টের টাকায় বসে বসে খাই। আমার কোনো চিন্তা নেই। পাশের ঘরেই শ্রীতমা এসে রয়েছে এখন কিছু দিনের জন্য। 


           কালকে যে ছেলেটি আমায় বাঁচাল তার নাম জানতেই বুকের ভেতরটা যেন কীরকম আনচান আনচান শুরু হয়ে গেল। একলব্য মিত্র। আজকের দিনেও এরকম কেউ নাম রাখে? নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে ভালো করে দেখলাম। যদিও চশমার পাওয়ার অনেকদিন আগেই বেড়েছে তাও ভালো করে দেখতে দেখতে বুকের ভিতর সুনামি হতে শুরু করল। সেই এক চোখ, মুখ, কথা বলার ধরন। এত মিল। সব আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলাম। কোথায় থাকে, কে কে বাড়িতে আছে সব। না ঠিকই ধরেছি, এ সেই। অর্থাৎ পুরুষোত্তম মিত্রের একমাত্র নাতি। একদম পুরো দাদুর মত দেখতে হয়েছে। সেই যেন আঠের বছরের ছিপছিপে পুরুশোত্তম।

 ছেলেটি আমাকে আবার গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিল। আমাকে কথা দিয়েছে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। ওর মুখেই জানতে পারি পুরুষোত্তম এখন একদম বিছানা নিয়ে নিয়েছে, বিছানা থেকে নাকি উঠতেই পারে না। বয়স হলে যা হয়। কিন্তু সেই যুবক বয়সের সেই অভ্যেসটা নাকি এখনো আছে। এখনো নাকি কবিতা লেখে। নাতিকে দিয়ে খাতা আনিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কবিতা লেখে। নাতি বলে আমি লিখে দিই, কিন্তু নিজের হাতে কবিতা না লিখলে নাকি হয় না, সে যতই অক্ষরগুলো কাঁপা হোক না কেন। 


               সেদিন একলব্য এলো আমায় দেখতে। অনেক গল্প করলাম। ওর দাদুর সম্পর্কেও জানলাম। ও বুঝতেও পারল না যে ওর দাদুকে আমি বহু পূর্বেই চিনতাম। যাবার সময় বললাম, একলাব্য আমিও একটু আধটু কবিতা লিখি। একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললাম, তা এই কবিতাটা তোমার দাদুকে দিও কেমন, উনি পড়বেন, কত গুণী মানুষ। কোথাও ভুল টুল হলে বলে দেবেন। একলাব্য খুবই গভীর চোখ দিয়ে আমার দিকে একবার দেখল। আমি ওর ওই গভীর চোখ দেখে খুবই চমকে গেলাম, এক ঝটকায় সেই আঠেরর পুরুষোত্তমের চোখের কথা মনে পড়ে গেল।

              দুদিন পরে আবার একলব্য এল, হাতে ওর একটা রঙিন খাম। আমায় দিয়ে বলল, দাদু আপনার কবিতা পড়েছেন, উনি আমাকে এই খামটা দিতে বলেছেন। বহু যুগ পর রঙিন খাম পাওয়া। এই মুহূর্তে বড্ড ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সেই সতের বছর বয়সে। উফঃ, সেইসব স্বর্ণময় দিনগুলো।পুরুষোত্তম কলেজ ফেরত রোজ একটা করে রঙিন খাম দিত। খাম খুলতেই সাদা পাতার চারদিকে কত আল্পনা আঁকা আর মাঝখান জুড়ে কবিতা লেখা থাকত। রোজ আমাকে কবিতা লিখে লিখে দিত। আমি ছাদে গিয়ে পড়তাম। কি যে ভালো লাগত আমার তখন। মনে হত, পারলে একমাত্র পুরুষোত্তমই আমাকে প্রজাপতি করে দিতে পারবে। ও বলত, আমি নাকি ওর কবিতার প্রেরণা। কিন্তু বেশিদিন আর ওর কবিতা পড়তে পারলাম না। কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। বাবা মাকে তখন পুরুষোত্তমের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারিনি। 

বিয়ের পরের দিন গাড়িতে উঠছি হঠাৎ পিছনে পুরুষোত্তম। শেষ রঙিন খাম দিয়ে বলেছিল, জাগরী যেখানেই থাকো, যেমন অবস্থাতেই থাকো কবিতা লেখা ছেড়ো না। আমিও কবিতা লেখা ছাড়ব না। জানবে এই কবিতার মধ্যেই আমরা আমৃত্যু থেকে যাব।

                          আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার পুরুষোত্তমের কবিতা আমার হাতের মধ্যে। কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছে, জাগরী তোমার কবিতা দেখেই বুঝতে পেরেছি এ তোমার লেখা। আমার শরীর এখন বিদ্রোহ করছে, সব কিছু আর মনে রাখতে পারিনা। ছেলের সংসারে একটা কোণে পড়ে আছি। নাতিটাই যা একদম আমার মত হয়েছে। কত স্মৃতি ভুলে গেছি। কিন্তু তোমাকে বড্ড মনে রেখেছি, কে জানে তোমাকে কেন ভুলতে পারলাম না। আজ এই অবেলায়,অসময়ে, অকারণে হঠাৎ তোমার এসে যাওয়া বড্ড ভালো লাগছে জাগরী। ভগবানের কাছে এইটুকুই প্রার্থনা করি, আরও যেন কয়েকটা দিন বাঁচতে পারি। তোমার জন্য আজ এই কটা লাইন লিখলাম,

             ' ব্যস্ত মুহূর্তের দো-টানায়

                     যখন হেঁটে যাই,

            পিছনে ফেলে রেখে যাই তাকে।

                 মুহূর্তে মুহূর্তে বারবার সে 

                     হাতছানি দিয়ে ডাকে। ' 

আমি পড়লাম। বারবার পড়লাম। ধূসর ঝাপসা চোখে পড়লাম, তবুও পড়ে গেলাম...

              এভাবেই মাঝে মাঝে একলব্যর হাত দিয়ে আমাদের দুজনের কবিতা দেওয়া নেওয়া হতে লাগল। হঠাৎ করেই দু সপ্তাহ একলব্য এল না। আমি তো ছটফট করছি। বাড়িও যেতে পারছিনা। এ শরীরে একা রিস্ক নেওয়া উচিতও নয়। প্রায় আড়াই সপ্তাহ বাদে একলব্য এল হাতে রঙিন খাম নিয়ে। ও বলল, ওর পরীক্ষা চলছিল তাই আস্তে পারেনি। সেদিন রাতের বেলায় রঙিন খাম খুলে আবার পুরুষোত্তমের কবিতা পড়তে লাগলাম। পুরুষোত্তম কি সুন্দর করে লিখেছে,

                     ' ভিজিয়ে দিলে কোন সাধনায়,

                       ভাসিয়ে দিলে কোন অজানায়।

                        স্মৃতি, সে তো বৃষ্টির মতো,

                      আসে, ভেজায়, আবার চলে যায়, 

                     রোদ হলেই শুকিয়ে যায়।

                   ভালো থেকো মাটির গন্ধে '...

  তারপর থেকে প্রায়ই আসতে লাগল একলাব্য, হাতে রঙিন খাম নিয়ে। আমার আর পুরুষোত্তমের কবিতা দেওয়া নেওয়া জারি থাকল। 

                হঠাৎ সেদিন একলব্য যাওয়ার সময় মোবাইলটা ভুল করে ফেলে গিয়েছে। আমি তো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। হঠাৎ মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল, কি মনে করে ফোনটা ধরলাম, হ্যালো বলতেও দিল না, ওপার থেকে একটি অল্প বয়সী মেয়ের গলা, একলাব্য আজ ফিরলাম, তোর দাদুর মৃত্যুর খবরটা শুনে খুবই দুঃখিত। প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল একবারও জানালি না, এসে বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। 

মেয়েটার কথাগুলো শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিলাম।

বারবার মনের মধ্যে চিন্তা হতে লাগল, এখন যে একলাব্য কবিতা গুলো আনে তাহলে কবিতাগুলো কে লেখে? আর পুরুষোত্তম এভাবে চলে গেল ! 

                 পরের দিন একলব্য এলো হাতে রঙিন খামে কবিতা নিয়ে। সঙ্গে করে মোবাইলটা নিয়ে চলে গেল। যেতে না যেতেই খাম খুলে কবিতা পড়তে লাগলাম,

       'কালকেই তোমাকে ভাবছিলাম, যখনই আষাঢ়ের বিকেলে সূর্যাস্তের  মুখোমুখি হয়েছিলাম।

বড্ড ইচ্ছে করছিল এরকম কোন আষাঢ়ের এক বিকেলে আমি তুমি মুখোমুখি দাঁড়াবো সূর্যাস্তকে সাক্ষী রেখে।

আচ্ছা তখনো কি জীবনানন্দের "আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি" --- কবিতা তোমায় শোনাব?

অথবা নাম না কোনো ধানক্ষেতের পাশে সূর্যাস্তর হাতে হাত রেখে জীবনানন্দকে ঠোঁটে রেখে  তুমি বলবে,

 " জীবন গিয়েছে চ'লে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার---

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার ! "

সত্যি মুহূর্তগুলো, দোয়েল পাখির মতো উড়ে উড়ে বেড়ায়, কিন্তু স্মৃতি সেতো মনের দেওয়ালে আঁকিবুকি কেটেই রয়ে যায়।

অর্ধ কবিতাখানি লিখে রেখে চলে যায়

আদৌ কি চলে যায় !

আদৌ কি ছাড়া যায় ' ! 

             এবার এখন আমি লেখাগুলো পুরো ভালো করে দেখলাম এই কদিনের কবিতা লেখায় অক্ষরগুলো ট্যারা ব্যাকা হয়নি। আগের কবিতাগুলোর অক্ষর ট্যারা ব্যাকা হত কারণ পুরুষোত্তম কাঁপা কাঁপা হাতে লিখত বলে। 

          একলব্য পুরো ওর দাদুর মতো হয়েছে। দাদুর মতোই কবিতা লেখে। দাদুর পুরোনো প্রিয় মানুষটিকে কষ্ট দিতে চায়নি, বোঝাতে চায়নি দাদুর অনুপস্থিতি। কবিতার মধ্যে দিয়েই দাদুর বহু পুরোনো প্রিয় মানুষটির কাছে ওর দাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

             এরপর একলব্য প্রায় আসতে শুরু করলো হাতে কবিতার রঙিন খাম নিয়ে। সেদিন মোবাইলের ঘটনাটা একলব্য জানতে পেরেছিল কিনা আমি জানি না। ও কিছু বলেনি, আমিও কিছু বলিনি।

আজ ব্যাঙ্গালোর চলে যাচ্ছি ছেলের কাছে। শ্রীতমাও যাচ্ছে। কাল সকালে একলাব্যর আসার কথা। ওকে আর বলিনি আমার চলে যাওয়ার কথা। ও কাল নিশ্চিত এসে ফিরে যাবে। যাক ও অন্তত এই বোঝা থেকে রেহাই পাবে। আর আমাকে কবিতা লিখে দিতে হবে না। পুরুষোত্তম যে আর নেই এ কথাটা আর কোনোদিন ওকে বলতে হবে না। একলব্যর প্রতি একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল। আসলে ওকে দেখলেই বড্ড নিজেকে বাঁচতে ইচ্ছে করত। 

একা একা কি বাঁচা যায়!

            আজ আমার কবিতার বই প্রকাশ হচ্ছে। যে কটা কবিতা পুরুষোত্তমের জন্য লিখেছিলাম  সবগুলো এক করে একটা কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। আমি যেতে পারব না। কোমরের ব্যথার জন্য নড়তে পারছি না। বইমেলার দশদিন পর প্রকাশক বলল, বইটার নাকি খুব ভালো সেল হয়েছে। একশো কপি বার করেছিল, একজন নাকি পঞ্চাশ কপি কিনে নিয়েছে। বাবা! এরকম পাঠক হয় নাকি!

  কিছুদিন পর একটা খাম এল কোরিয়ারে। খাম খুলে দেখি আমারই কবিতার একটি বই আর বইয়ের ভেতরে রঙিন খামে একটি কবিতা লেখা,

              ' এভাবে তুমি দেখলে, আমার আবার আরেকবার জন্ম নিতে ইচ্ছে করে। ওদিকে কি দেখছ? রঙিন আগামীকে নাকি সবুজ অতীতকে? কিভাবে বোঝাবো তোমাকে দেখতে দেখতে আমি অনেক কঠিন পথ পার হয়ে যাই। পেরিয়ে এসেছি বিবর্ণ অতীতের এবড়ো খেবড়ো  রাস্তা। আজ বহু মুহূর্তের পর তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মনে হলো যেন গোধূলির শান্ত নিস্তরঙ্গ নদীর সামনে এসে বসলাম। তুমি সামনে হাঁটছ আর আমি তোমার চারপাশে হাওয়ার মতো বয়ে যাচ্ছি। 

থেকে যাব তোমার অভিমানের আয়নায় '।

 চল্লিশ বছর আগে সেদিন শ্রাবণের বিকেলে পুরুষোত্তম কথাটা ঠিকই বলেছিল, আমরা থেকে যাব কবিতায়, থেকে যাব অক্ষরে অক্ষরে। 

 আজ একলব্য পুনরায় সেটা প্রমাণ করে দিল যে কোনকিছুই হারায় না। থেকে যায়, রয়ে যায়...

poushalibiswas00@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment