1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

সময়

ছবি : ইন্টারনেট 

সময়

তপন  তরফদার

                 এক এক সময়ে মনে হয় এই দমবন্ধ সময়ের শেষ হবে না। আসলে মনের উপর এতো চাপ পরে সময়ের হিসাব রাখতে পারেনা। একজন পোয়াতি  তার সন্তানকে পৃথিবীতে আনার সময় তাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে জেনেও ভাবি মায়ের মনে হয় সময় শেষ হচ্ছে না। বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন। ভাবী পিতার মুখ পলে পলে শুকাতে থাকে। যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। পরিস্থিতি কয়েক মুহূর্তে বদল  হয়ে বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ভেসে যায় বসন্ত যখন বাড়িতে নতুন অতিথি আসার আওয়াজ আঁতুরঘর থেকে ভেসে আসে। গোয়ালঘর থেকে বসন্ত  লাফিয়ে কাদাখোঁচা উঠানে নেমে  আঁতুরঘরের বন্ধ দরজার দিকে মুখ করে দাইমা ক্ষণদার উদ্দেশ্যে বলে কী হয়েছে? ক্ষণদা এক সোহাগ মেশানো রসালো গলায় বলে - রসগোল্লা আনা, আমার জন্য গরদের শাড়ী নিয়ে আয় - তোর ছেলে হয়েছে।

                বসন্ত , যে বেশ কিছু সময় ধরে চোরের মতো গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। খবর শোনার মুহূর্তেই বসন্তর বুকের ছাতি দীর্ঘ হয়ে যায়। মুখে লটারি পাওয়ার হাসি। ছেলে হয়েছে। সাত রাজার ধন এক মানিক।

                বলরামপুরের পঞ্চায়েত অফিস, সরযু বালা বিদ্যালয়ে যাওয়ার তেমাথা রাস্তার প্রথম বাড়িটা  বসন্তদের। বসন্তদের ভিটে দুটো রাস্তা পেয়েছে। বসন্তর পিছনে হেমন্তর ভিটে। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্র ধরে এই দুই তেলি পরিবার এক হয়েই থাকে। কয়েক বছর আগে বসন্তর ও হেমন্তের বাবা এক সময়ে একই সঙ্গে গঙ্গাসাগরে নৌকা ডুবিতে মারা গেছে। বসন্ত, হেমন্তর বিয়ে প্রায় একই সময় হলেও হেমন্তের দুই ছেলে এক মেয়ে হয়ে গেছে। এতটা সময় পেরিয়ে গেলেও বসন্তর কোনো ছেলেপিলে হয়নি। গ্রামে রটেগেছে বসন্তের বউ উষা বাঁজা। উষার সময় কাটেনা। সবসময় বিমর্ষ হয়ে থাকে। হেমন্তর বউ সন্ধ্যা মনে মনে খুব খুশি ছিল - ওদের কোন বাচ্চাকাচ্চা না হলে - ওই ভিটেটার স্বত্ব হেমন্তর ছেলেরাই ভোগ করবে।

        বড় রাস্তার ধারে স্কুলে,পঞ্চায়েত অফিসে ঢোকার রাস্তা। রাস্তা ঢালাই হয়ে গেলেই লোক চলাচল বেড়ে যাবে। শোনা যাচ্ছে কিছু দিনের মধ্যেই সরযু বালা স্কুল উচ্চ  মাধ্যমিক হয়ে যাবে। পঞ্চায়েত অফিসের পাশে ব্যাঙ্ক খোলা হবে। ওই তেমাথায় জমিতে যদি ‘মনিহারি স্টোর্স’ খোলা যায়, ভালই জমে যাবে। এ টু জেড সব পাওয়া যাবে। সব আশায় ছাই ফেলে দিল নবজাতক।  সন্ধ্যা, হেমন্তকে বলে – চিন্তা করোনা। কাক-পক্ষীয়ও টের পাবে না-ঠিক সময়ে আমি সব ঠিক করে দেবো।

                    বসন্ত ছেলের নাম রাখলো অনন্ত। অন্নপ্রাশনের দিন সন্ধ্যা কোমর বেঁধে রান্না করে দিল। অনন্তর মুখে ঠুসে দিল পঞ্চব্যাঞ্জন। অন্নপ্রাশনেই প্রথম অন্ন পেটে যায়। সারা জীবন যেন অন্ন পায়। বাচ্চাকে পেট পুরে খাওয়াতে হয়। অনন্ত বিকালেই কেমন নেতিয়ে পড়ল। ওরা গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার যামিনীর কাছে নিয়ে যায়। যামিনী ডাক্তার মনে করে সমস্ত রোগের উৎস পেট। পেট যদি পরিস্কার থাকে - বিশেষ করে বাচ্চাদের স্ফূর্তি ভালই থাকবে। যামিনী  ডাক্তার অনন্তর পেট-সাফার ওষুধ দিয়ে দেয়। বেশ কয়েকবার বাহ্ন্যি করার পর শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল অনন্ত। ঘুম থেকে উঠে বাচ্চা হাসিখুশি, হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। হাসি শুনতে পেয়  হেমন্ত  সন্ধ্যাকে বলল - কি গো, সবতো ঠিকই আছে। সন্ধ্যা বলে – মনে হয় ধুতরোটা কম পরেছিল।

               অনন্ত ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। স্কুলের পিওন নিশীথের বউ, মেয়ে প্রভাতী সময় পেলেই অনন্তর সাথে গল্প করতে আসে। প্রভাতী-অনন্ত খেলনাপাতি খেলে। অনন্ত হয় বর, প্রভাতী  হয় বউ। প্রভাতী পাকা গিন্নির মতো বলে - তুমি চান করে এসো, আমার ভাত রান্না হয়ে গেছে – তোমাকে খেতে দেবো।

              অনন্তের দশ বছরের জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন না করলেও কাছের কয়েক জনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। সন্ধ্যা পায়েস এনেছে অনন্তর জন্য। এখন অনন্তকে হাতে করে খাওয়াতে হয়না। লাউ-চিংড়ি খেয়ে উঃ আঃ করছে অনন্ত।উষা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে - লঙ্কা খেয়ে ফেলেছিস, পায়েস মুখে দে। ঝাল কমে যাবে। অনন্ত সন্ধ্যার আনা পায়েস মুখে দেয়। জিভে কেমন যেন ঠেকে। কিছু বলে না - হয়তঃ ঝালের জন্য পায়েসটার স্বাদ এমন তিতকুটে লাগছে।

                     বিকাল থেকেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা - বমি করতে যায় অথচ বমি হয় না। যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে থাকে অনন্ত। যামিনী  ডাক্তার এবারও পেট পরিষ্কারের ওষুধই দিল - কিন্তু কোন কাজ হল না। মুখ  দিয়ে গ্যাঁজলার মতো নিল রঙের থুথু বেরাতে থাকে। ডাক্তার বমির ধরন দেখেই বলে এখুনি একে বড় হা্সপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমি ভাল বুঝছি না। বেশ কিছু  সময় ধরে যমে মানুষে টানাটানি। মানুষ  জিতে গেল। বেঁচে গেল অনন্ত কিন্তু বাঁদিকের হাত পা কেমন বেঁকে গেছে। বাঁদিকের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা পরে। কথা বলতে গেলে চোখে মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছবি ফুটে ওঠে। সন্ধ্যা আপশোষ করে বলে - কলকের বিষ মেরে ফেলতে পারল না। বসন্ত একেবারে ভেঙে পড়ল।  ভেবে কুলকিনারা পায়না বসন্ত – সুস্থ ছেলেটার এ কি হল? তাপ দেওয়া তাসার মত গুমগুম করে বেজে যায় মন। বেশ কিছু বছর পরেও বসন্ত মনে করে নিশ্চয় কোন পাপ করেছিল - তাই এই সাজা। সব কিছু ভুলে থাকার জন্য আদিবাসী পাড়ায় যাতায়াত শুরু করল। এখন আদিবাসীদের ডেরায় হাঁড়িয়ার সঙ্গে চোলাই ও চালু হয়ে গেছে। হেমন্তও লুকিয়ে লুকিয়ে ধেনোমদের বোতল কে এনে দেয়। সজনে ফুলের এক বিশেষ গন্ধ থাকে, যারা জানে তাদের নাকে ধাক্কা মারে। এই ধেনোর এক বিশেষ মহিমা আছে  যা ছড়িয়ে পরে দাবানলের মতো - সবাই জেনে যায় বসন্ত “নেশা করে”। হেমন্তর এনে দেওয়া ধেনো খেয়ে বসন্তর বুকে যন্ত্রণা শুরু হয়। ওরও মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতে থাকে। বুক চেপে শুয়ে পড়তেই উষা তালপাতার হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে। এই সময়ে এই হাওয়া কোন কাজে লাগেনা। অকালেই উবে যায়। ওদিকে পিওন নিশীথ মারা গেল। যামিনী ডাক্তার রোগটা যে ‘ডেঙ্গু’, ধরতেই পারেনি। প্রভাতীর মা রাত্রি, স্কুল সীমানায় এক প্রান্তে নির্জন ডোবার ধারে বাঁশ বাগানের পাশে টিনের চালার মাটির ঘরে যেখানে থাকে, সেখানে রাতের অন্ধকারে দরজায় টোকা পড়তে লাগল। রাত হলেই মা-মেয়ে দুজনেই সিঁটিয়ে থাকে, বুঝতে পারে ওরা গ্রামেরই পঞ্চায়েতের লোক।

               ওদিকে  হেমন্ত - উষা নিজেদের আকাঙ্খা পূরণ করতে কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। উষাকে পাখি পড়ানোর মতো সব সময় বলতে তাকে ছেলের চিকিৎসার জন্য, তোমাদের সংসার চালানোর জন্য ভিটেটা বিক্রি করে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাও। মামার বাড়িতে ন্যালাখ্যাপা ছেলে অনেক সাহায্য পাবে।


            উষা নিজের শ্বশুর বাড়ির ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি নয়। হেমন্তরা বুঝতে পারে, চালটা ঠিক ধোপে টিকল না। হাল ছাড়ার পাত্র নয় হেমন্তরা। কিছুদিন বাদে বলে - বউদি তোমরা তো মাত্র দুজন, এতবড় জায়গা নিয়ে কি করবে। তোমার ছেলেকে দিয়ে তো কিছু হবেনা। আমি তোমাকে ভিটের এক দিকে ঘর করে দেবো। জমির জন্য টাকাও দেব। উষা বুঝতে পারে বাঘের থাবার সামনে পড়েছে। দুর্বলের সাহায্যের জন্য এই সময়ে কেউ এগিয়ে আসেনা। এখন রাজনীতির ঝান্ডা না ধরলে বাঁচা যাবে না। হেমন্ত  পঞ্চায়েতের দলের লোক হয়ে গেছে। উষা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে অসহায়, ফুলের মতো ফুটে আছে। সবাই তাকে দখল করতে তৎপর। মুখ নীচু করে বলে - ঠাকুরপো তুমি যা ভাল বোঝো করো।


        নিশীথ নিজে ভাল লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছিল। মেয়েরা নতুন কিছু সাহসী কাজ, প্রতিভার জোরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবর মেয়েকে দিত। উৎসাহ দিয়ে বলতো - জানিসতো মা, এক মেয়ে এভারেষ্ট জয় করেছে। প্রভাতী বলে, জানি অনেক মেয়েই পাহাড়ে উঠেছে। নিশীথ বলে, ওর নাম অরুণিমা সিনহা এক পায়ে ভর করে উঠেছে।মনে রাখিস  প্রভাতী  মনের জোরই আসল জোর।


          ছিপছিপে শ্যামাঙ্গী প্রতিমার মতো মুখ ও চুল প্রভাতীর তার শরীরে ক্লান্তি নেই, চনমনে চিতল হরিণী। গাঁইয়া মুখ হলেও মুখে বালি সরানো ফল্গু নদীর মতো লাবণ্য। বুদ্ধিতে খনার থেকে কিছু কম নয়। প্রভাতী  চায় প্রথমেই স্কুলের জায়গাটা ছাড়তে। ঝুপসি গাব, মহানীম গাছের মাঝে ফাঁকা জমিতে রাতের অন্ধকারে ভুতের নাচের আসর বসে - ওরাই রাত্রে দরজায় আওয়াজ তোলে। রুখে দাঁড়ালে বাঁশ ঝাড়ের ভিতরে পালায়। এইভাবে আর কতদিন। যদি ওরা রাতে দরজা ভেঙ্গে  ঘরে ঢুকে পরে। মাথা ঘুরতে থাকে বিষয়টি মনে আসলেই।

                অনন্তর বাড়িতে যায় প্রভাতী  ওদের খোঁজখবর নিতে। সুখ-দুঃখের গল্প করতে। উষাকে আশ্বাস দেয় - চিন্তা করবেন না মাসিমা, ভাল হয়ে যাবে। উষার মুখে শুকনো হাসি। সে দিনের সূর্য অনন্তদের বকুল গাছের পাতায় শেষ আলোর চুম্বন দিয়ে বিদায় নিচ্ছে। এই সময়েই হেমন্ত  এসে বলে - বৌদি তোমাদের দলিলটা দাও। কালই রেজিষ্ট্রি করব, তোমাকে নিয়ে যাব - ওখানেই সব টাকা দিয়ে দেবো। বলে ওঠে - না “মা” – আপনি দলিল দেবেন না। আমার শ্বশুর বাড়ির ভিটে আমরাই রক্ষা করব।

           হেমন্ত  রেগে গিয়ে বলে - সেদিনের ছুঁড়ি, আমার সাথে রসিকতা হচ্ছে। প্রভাতীর পাথরে খোদাই করা চোখ মুখ আরো দৃঢ় করে বলে - আমরা সবাই এক হয়েই সবাইকে বাঁচতে সাহস জোগাবো। আমার বাবা মারা গেছে – ওই শকুনরা আমাদের ছিঁড়ে খাবে। অসহায় বিধবার ভিটে হায়নারা খাবে, তা হবেনা।আমি অনন্তকে বিয়ে করে সব সামলে নেব। অনন্তকে নিয়ে সিধে প্রভাতী কালীতলায় চলে আসে। পূজারীর কাছ থেকে সিঁদুর চেয়ে নিয়ে অনন্তকে বলে পড়িয়ে দিতে। অনন্তর চোখে মুখে যুদ্ধ জয়ের ছবি। একটুও হাত কাঁপে না। বুদ্ধপূর্ণিমার আলো, সমগ্র জগতকে মোহময়ী করে তুলেছে। প্রভাতী  অনন্তকে নিয়ে ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিয়ে গাইতে থাকে - ও রজনীগন্ধা তোমার ..........। বেচারা, সন্ধ্যারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দুই বিধবা পরস্পরের হাত ধরে শরীরের ইশারায়

বুঝিয়ে দেয় তাদের ও সময়  আসে। সময় বদলাতে কোন সময় লাগেনা।


tapan.tarafdar@gmail.com
খড়গপুর 


No comments:

Post a Comment