1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

শবযান

                              

ছবি : ইন্টারনেট 

শবযান 

সুব্রত কুমার ঘোষ

   বাসে ওঠার পর থেকেই শরৎবাবু দেখছেন শবযানটি বাসটার পিছু পিছু আসছে। ঠিক যেন চুম্বকের মতো বাসটার পিছু নিয়েছে। বাসের গতি বাড়লে শবযানটির গতি বাড়ে,বাস ধীরে চললে ওর গতিও কমে যায়।যেন বাসটাই ওর পথপ্রদর্শক। কিংবা হতেই পারে বাসের কোনো যাত্রীই ওর পরবর্তী সওয়ারী। তাকে নিয়ে যেতেই ওর এমন অনুসারী চলন।

   খালি শবযান। অনন্তলোকের এক যাত্রীকে শেষবারের মতো প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছে। ঘিয়ে রঙের শবযানটির দেওয়াল জুড়ে রিং আকারের পুষ্পস্তবক মোড়া। কাঁচের কফিনে সার দিয়ে গাঁদা ফুলের মালা ঝোলানো। হলুদ ফুলগুলো এখনো টকটক করছে। যেন মনে হচ্ছে সদ্য গাছ থেকে তোলা হয়েছে,গায়ে তার শিশিরের গন্ধও যাইনি। চারকোণে রজনীগন্ধার স্টিক বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে। মেঝেতে পড়ে ধূপের কিছু অবশেষ। কফিনের গায়ে লেপ্টে আছে শরতের শিশিরবাষ্প।

    বাসের পিছনে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন শরৎবাবু। কাঁচের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন শবযানটি। দুলকি চালে বাসের পিছু পিছু আসছে। একজন মাঝবয়সি লোক বসে আছে ড্রাইভার সিটে।শরৎবাবু ভাবছিলেন--- যাকে ও রেখে এলো সেই মৃতদেহটি কেমন ছিল ! যুবক কেউ ! নাকি ওনারই মতো ষাটোর্ধ্ব একজন । সে কি নারী ছিল না পুরুষ ! কি হয়েছিল তার !-- রোগ, দূর্ঘটনা না আত্মহত্যা। আচ্ছা এইসময় ওর আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চয় ভীষন ভেঙ্গে পড়েছে ! ছেলেমেয়েরা হাহাকার করছে ! আর যদি স্ত্রী বেঁচে থাকেন তার অবস্থা নিশ্চয়---! মিনতির চলে যাবার দিনে নিজের অবস্থা কেমন ছিল মনে করার চেষ্টা করলেন শরৎবাবু।না-প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েননি সেদিন। চোখের কোণে জল ছিল না। শুধু থমথমে মুখে একটা হতাশার বাষ্প নিঃসৃত হচ্ছিল ! ---' এত তাড়াতাড়ি কেন ! আরো কিছুসময় দুজনে একসাথে পথ চলাই যেত !' আত্মীয় পাড়াপ্রতিবেশীরা দলে দলে আসছিল সমবেদনা জানাতে। তিনি প্রত্যেকের সাথেই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছিলেন। সন্ধ্যায় যখন নিজের ঘরে ঢুকলেন ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তার।যদিও বহুদিনই এ বাড়ীতে দুজন ছাড়া আর মানুষ ছিল না, তবু মনে হচ্ছিল একজনের অনুপস্থিতি ঘরটাকে বড্ড বেশি নিঃস্ব করে দিয়েছে।

   বাসটি আচমকা ব্রেক কষাতে পিছনে কিছুটা হেলে পড়েছিলেন শরৎবাবু। কোনক্রমে পাশের খুঁটিটা ধরে টাল সামলালেন। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন এতক্ষণ। শরৎবাবু বাসের ওপরের রডটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।

    শবযানটি তেমনিভাবেই ঢিমেতালে বাসটি অনুসরন করছে। ওর গতি দেখে মনে হচ্ছে  ফেরার কোনো তাড়া নেই। কিংবা হয়তো যমরাজের স্পষ্ট নির্দেশ আছে পরবর্তী সওয়ারীর জন্য অপেক্ষার।তাই ইচ্ছে করে দেরি করছে।

     বাসে ওঠার পর থেকেই শবযানটি দেখছেন শরৎবাবু।বলা চলে দেখতে বাধ্য করছিল শবযানটি। শরৎবাবু অনেকবার চেষ্টা করছিলেন মুখ ঘুরিয়ে থাকার।। কিন্তু অদ্ভুত এক সর্বনাশী নেশার মতো ওটা ওর দিকে টানছিল। কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারছিলেন না। আর তাছাড়া একটু যে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াবেন তার উপায়ও ছিল না। বাসটি বেশ ভীড়। গায়ে গায়ে যাত্রী।

     লোকাল বাস থেমে থেমে চলছে। প্রতি স্টপে দাঁড়াচ্ছে। যাত্রী ওঠানামা করছে। সামনের স্টপে একজন নামবেন বলে উঠে যেতেই শরৎবাবু সিট পেলেন। জানালার পাশে। যদিও একেবারে পিছনের সিটে, ঝাঁকুনি হবে একটু। তবু শরৎবাবু ভাবলেন দাঁড়িয়ে যাবার থেকে তো ভালো হলো। এই ভিড় বাসে দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। হাঁটুর ব্যাথাটা ইদানিং ভালোই কাবু করে ফেলেছে।

     বসার পর শরৎবাবু বেশ আরাম বোধ করলেন। তখন থেকে শবযানটি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে একটা উদ্বেগের চাপ অনুভব করছিলেন। এখন আর ওটা দেখতে হবে না ভেবে স্বস্তি পাচ্ছিলেন। শরৎবাবু পাশের সিটের ছেলেটির সাথে গল্প জুড়ে দিলেন।

--- ছাত্র ?

কোলের ওপর পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা দেখে তাই ধারনা করলেন। ছেলেটি ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বললো।

--- কি সে পড়ো ?

--- এম এস সি ফিজিক্স।

--- ফিজিক্স ! একটু আনন্দিত দেখালো শরৎবাবুকে ।---" আমার ছেলেরও সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। এখন ইনফোসিসে আছে। ব্যাঙ্গালোর।" কথাটা বলতে বলতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল ওনার। যখনই বলেন বাবা হিসেবে ভীষন গর্ব অনুভব করেন।

থামলেন না শরৎবাবু।

--- জানো ভীষন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল আমার খোকা। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হতো।--- মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে দারুন রেজাল্ট করেছিল।

ছেলেটি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। শরৎবাবু আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন--" বি এস সি'তে কোন ক্লাশ ?"

--- ফার্স্ট ক্লাস ।

--- বাহ ! আমার খোকারও তাই। সেভেন্টি ফাইভ পার্সেন্ট।

এবার ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো, " বর্ধমান যাবেন?"

--- হাঁ বাবা । একবার ডাক্তারের কাছে যাবো। আর বোলো না কাল সন্ধ্যায় মাথা ঘুরে পড়ে গেছি। বুকে একটু ব্যাথা হচ্ছিলো। ভাবলাম একবার ডাক্তারের কাছে ঘুরে যাই।

--- একা আছেন ?

--- হাঁ বাবা। 

--- এই অসুস্থ শরীরে একা একা যাচ্ছেন ! কাউকে সঙ্গে আনতে পারতেন ।

ছেলেটি বিনয়ের সাথেই বললো।

একটু অস্বস্তিতে পড়লেন শরৎবাবু। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। শরীরে এখন হাজারো রোগের বাসা। সত্যিই তো একা একা ট্রাভেল করা উচিৎ নয়। কিন্তু কাকে সঙ্গে আনবেন ! মিনতি নেই। খোকা পড়ে আছে দুহাজার কিমি দূরে। থাকার মধ্যে তো ওই কাজের মেয়েটি। ওকে কি করে সঙ্গে আনবেন !

--- না-সেরকম কিছু হয়নি--। ওই একটু আ্যসিডিটির প্রবলেম আর কি ! 

নিজের অস্বস্তি হালকা করার চেষ্টা করলেন শরৎবাবু।

--- তবু-বয়েস হয়েছে আপনার। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একা একা ট্রাভেল করা রিস্কি।

শরৎবাবু ছেলেটির কথায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পেলেন। বেশ ভালো লাগলো ওনার। তিনি কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। বলা চলে প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না। ছেলেটির কাঁধে আলতো করে চাপ দিয়ে বাইরে চোখ ফেরালেন।

   সকালের পরিছন্ন আলোয় আবার একটা নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। অল্প অল্প করে মানুষজন রাস্তায় নামছে। কেউবা প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছে কেউ হয়তো কাজে। কেউ কেউ রাস্তায় এমনই দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে চা-পিপাসু মানুষের জটলা। শরৎবাবু দেখছিলেন ছোট ছোট জনপদগুলো আবার জেগে উঠছে। রাতের স্থবিরতা সরিয়ে আবার নতুনভাবে পথ চলা শুরু হয়েছে।

     সকালের বাতাসে একটু ঠাণ্ডা মতন লাগছিল শরৎবাবুর। এতক্ষন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ছিলেন। শীত শীত লাগছে বলে সরে এসে সিটে ঠেস দিয়ে বসলেন।

     ভিড়ে ঠাসা বাস। সকালের বাসে শহরে যাবার লোকের সংখ্যাই বেশি। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে প্রাণচঞ্চল মানুষ শহরের পথে। তাদের মুখর বার্তালাপে বাসের ভেতর গমগম করছে।

     শরৎবাবুর ফোনের রিং বেজে উঠলো। হাতব্যাগের চেন টেনে ফোনটা বের করে স্ক্রিনটা দেখে ভ্রু কোঁচকালেন ! এত সকালে খোকা ফোন করছে !

--- বল ? একটু উদ্বিগ্ন হয়েই বললেন।

--- তোমার বৌমা বলছিল কলকাতায় শিফট করবে। আমারও তাই ইচ্ছা---।

--- এ তো ভালো কথা ! শরৎবাবু খুশি হতে গিয়েও চিন্তিত কন্ঠে বললেন, " কিন্তু তোর চাকরি?"

--- আমি এখন এখানেই থাকছি। টুপুরেরটা চেঞ্জ হচ্ছে।আমিও বছর দুয়ের মধ্যে চলে যাব।

--- ও আচ্ছা আচ্ছা ! এবার আশ্বস্ত হলেন উনি।

--- তবে একটা কন্ডিশন আছে !

--- কন্ডিশন !  একটু অবাকই দেখাল শরৎবাবুকে।

--- হুম ! তোমাকেও আমাদের কাছে চলে আসতে হবে। একা ওখানে থাকা যাবে না।

--- আমি-মানে-আমার তো কোনো অসুবিধা নেই। তোদের যদি কোনো অসুবিধা হয় !

কথাটা বললেন বটে তবে ভিতরে ভিতরে ভীষন খুশি হলেন। এই বুড়ো বয়সের বাকি ক'টা দিন ছেলেবৌমার সাথে কাটানো, ওদের যত্নআত্তি, নাতির সান্নিধ্য--- একটা খুশির সংসার--- একটু নিশ্চিন্তে বাঁচা ! আশাতিরিন লোভে দুচোখ চকচক করছিল শরৎবাবুর।

--- অসুবিধার কি আছে ! একটু মানিয়ে টানিয়ে

 নেবে। তুমি থাকলে টুপুরের ভালোই লাগবে।

আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো খোকা।

অল্পক্ষণ বিরতি নিয়ে ওপাশ থেকে আবার শোনা গেলো। এবার একটু আমতা আমতা করে।

--- তবে-একটু সমস্যা আছে ।-- মানে--একটু প্রেসারে আছি ---

শরৎবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, " কেন কেন কি হয়েছে ?"

--- তেমন কিছু না। ওই একটু মানি প্রবলেম আর কি !---মানে বুঝতেই পারছো এ ওয়ান সিটিতে থাকা খাওয়ার খরচ , হাউস রেন্ট , মেন্টেন্স খরচ, গাড়ির ই এম আই , তার ওপর অর্কর স্কুলের মোটা ডোনেশন--- দুজনের স্যালারিতে কভার হচ্ছে না।মানে-কি বলবো তোমাকে এই মূহূর্তে আমার হাত একদম শূন্য।

শরৎবাবু কিছু বললেন না। ওপাশ থেকেই আবার শোনা গেল---

--- বলছিলাম তুমি তো আমাদের কাছেই থাকছো--তাহলে গ্রামের সম্পত্তি রেখে কি হবে ! শুধু শুধু বেদখল হয়ে যাবে। তারচেয়ে বিক্রি করে দাও। ভালো দাম পাওয়া যাবে।

এখনো শরৎবাবু চুপ করেই রইলেন। শুনছিলেন পুত্রের কথা।

--- কলকাতায় নিজেদের একটা ফ্ল্যাট হলে ভালো হবে। তাই বলছি তুমি যদি একটু হেল্প করো।-- না না আমার জন্য না। তোমার নাতির ভবিষ্যতের জন্য-- মানে দাদু হিসাবে---!

শরৎবাবু এবার হেসে ফেললেন। শুষ্ক যন্ত্রণাক্লিষ্ট  হাসি। তারপর গভীর দীর্ঘশ্বাস চেপে কেটে কেটে বললেন, " যে নাতির মুখটাই ভালো করে দেখতে পেলাম না তার প্রতি আর কতটা স্নেহ জন্মাবে!" 

ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ কিছু শোনা গেল না। বোধহয় অস্বস্তিতে পড়েছে। শরৎবাবু একটুক্ষণ থেমে স্পষ্ট করে বললেন, " তোরা তোদের মতো থাক। আমি এখানেই আছি। মরার পর ইচ্ছে হলে আসিস। যা থাকবে নিয়ে যাস। এখন আমি কিছুই বিক্রি করবো না।"

ওপাশেরজন বিরক্ত হলো বোধহয়। রুক্ষস্বরে বললো,  " তাহলে পচে মরো! আমাকে আর দোষ দিও না।"

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলো। শরৎবাবু ফোনের নীল আলোটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। চোখের কোণদুটো জলে চিকচিক করছিল। কাল রাতেই খোকাকে ফোন করে নিজের অসুস্থতার খবর দিয়েছিলেন। অথচ সেকথা একবার  ভুলেও তুললো না। শুধু চালাকি ! চালাকি করে বৃদ্ধ অসুস্থ পিতার সবকিছু আত্মসাৎ করার ফন্দি---!

শরৎবাবু দরদর করে ঘামছিলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বুকের মধ্যে অসহ্য মোচড়ানো ব্যাথা চাগাড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। হটাৎ করেই যেন চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলেন না শরৎবাবু। বুকটা চেপে ধরে জানালার ফ্রেমে মাথাটা এলিয়ে দিলেন। ক্লান্ত বিষন্ন ঘোলাটে চোখদুটো তখন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে বাইরে খোঁজার চেষ্টা করছে সেই ফুলে ফুলে সুসজ্জিত শবযানটিকে।

   ...........................সমাপ্ত................................

subratabiosc@gmail.com
পূর্ব বর্ধমান

No comments:

Post a Comment