1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বাবা গণুশ

 

ছবি  : চিরঞ্জিত ঘোষ

বাবা গণুশ

মৌসুমী চক্রবর্তী

           আজ প্রায় চারমাস হলো মেঘনা আর শচীন যুগলকর এসেছে কুয়েতে। কিছু বছরের জন্য, হয়তবা আজীবনের জন্য। দুজনেই একই কলেজ থেকে সিভিল এন্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি কোম্পানীতে কাজ করছিল। কিন্তু  পে প্যাকেজ এতটাই কম যে নিজেদের দুজনের সংসার চালিয়ে , স্টাডি লোন শোধ করে, আই - বাবা কে কিছু পাঠাতে পারত না। অথচ দুজনের বাড়ি থেকেই অনেক আশা নিয়ে তাদের পড়াশোনা করিয়েছে। তাই কুয়েতের জব অফার আর স্যালারি প্যাকেজ দেখে আর কিছু চিন্তা না করেই চলে এসেছে ওরা। তারপর শুরু হলো কাজ আর বাড়ী এই জীবন। বাকি কলিগদের সাথে উইক এন্ড সেভাবে কাটাতে পারেনা। কারন মধ্যবিত্ত পরিবারে, মারাঠি মূল্যবোধে বড় হয়েছে তারা। সাততারা হোটেল “জুমেইরা” তে গিয়ে এতগুলো টাকা খরচ করতে বাধে , তাদের । যদিও স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব আর নেই তাদের। আই -বাবাও কোল্হাপুর থেকে মাড আইল্যান্ডের দানা পানি বীচের কাছে কেনা তাদের নতুন অ্যাপার্টমেন্টে সিফ্ট করেছে। মেঘনার আই -বাবা মালাডে ফ্ল্যাট কিনেছেন। মেঘনার ছোটোবোন রমনা মডেল হতে চায় । তাই মুম্বাই ছিল তাদের ফার্স্ট চয়েস। সকাল বেলার চা ব্রেকফাস্ট বানাতে বানাতে মেঘনা ভাবছিল এ সব কথা। লান্চটাও বানিয়ে নিতে হবে। রমজান মাস চলছে বলে, তাদের সাইটে কিছু রান্না হচ্ছে না। বেশীরভাগ লেবার আর অফিসাররাই মুসলিম। তাই তাদের খাবার প্রশ্ন নেই। নন মুসলিমদের জন্য সাইটঅফিসের একটা ঘর এক ঘন্টার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। মেঘনা,শচীন, আশুতোষ, বিনীত আর নিহার - এরা খুব তাড়াতাড়ি লান্চ সেরে নেয়। অপরাধীর মতো , নি:শব্দে। কালো চশমার মধ্যে দিয়ে বাকিরা তাদের দেখতে থাকে, তারাও বাকিদের দেখে। মেঘনা মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস এই কালো চশমা ছিল তাই কতজনের নজর সে দেখল না! সে গুলো ঠিক কেমন ছিল ও বুঝল না!

        দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর এসে গেল। শচীন মেঘনা কে বলে, মনটা তার আজ পুরণপুলি খেতে চাইছে! মেঘনা ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলে , তার সাইটে আজ কিছু জরুরী কাজ আছে , সানডে তে করবে। আসলে গনেশ চতুর্থী এসে গেল , তাই মারাঠি মন নাচতে শুরু করেছে। কিন্তু কুয়েতে তো আর এই উৎসব কেউ পালন করবে না, যার যার নিজের ঘরে করতে পারো, কিন্তু প্রকাশ্যে নয়! শচীন কে না বললেও  সাইট ফেরত মেঘনা সুপার মার্কেট থেকে নারকেল, ময়দা , গুড়, খোয়া , ড্রাই ফ্রুট্স - সবই কিনে নিলো। পুরণ পুলির সঙ্গে মোদকও বানাবে কিছু । শচীন কে সারপ্রাইজ দেবে। শচীনের ফিরতে ঢের দেরী আছে, ততক্ষনে মেঘনা সব বানিয়ে ফেলবে। সুপার মার্কেটের বিলিং সেক্শনের কাছে কিছু প্যাকেট ক্লে রাখা আছে। মেঘনা সেগুলি দেখতে থাকল নেড়ে চেড়ে। পিছন থেকে একজন ভারতীয় বলে উঠলেন, ইস্সে আপ কোই ভি আইডল বানা সকতে হো ভাবিজী! লাস্টইয়ার হম্নে মাতাজী কো বনায়া থা , নবরাতা কে লিয়ে! মেঘনার মাথায় দারুন আইডিয়া এসে গেলো। ও পেছেনের ভদ্রলোক কে ধন্যবাদ জানিয়ে দু প্যাকেট ক্লে কিনে নিল।

      বাড়ী ফিরে, শুরু হলো সব আয়োজন। গনেশ চতুর্থীর আর দুদিন বাকি। তাই মেঘনা সবকিছু ফ্রীজে রাখল । শুধু ক্লে নিয়ে ওদের ইউটিলিটি এরিয়ায় গনেশ বানাতে বসল। ক্লে মডেলিং বানানোতে মেঘনা এক্সপার্ট। আর এই ক্লে খুব দ্রুত শুকিয়ে যায় , এটাই এর স্পেসিফিকেশন! গনেশ চতুর্থীর সকাল বেলা মেঘনা তাদের সাউন্ড সিস্টেমসে গণপতি বন্দনা চালিয়ে দেয়। শচীন লাফ দিয়ে উঠে পড়ে, সমস্ত যোগাড়যন্ন্ত্র দেখে অবাক হয়ে যায়। মেঘনা পুরো মারাঠি সাজে সুসজ্জিতা, শচীনের জন্য নতুন পান্জাবীর সেট বার করে দিয়ে তাকে স্নানে পাঠায়। তারপর ঘর ভর্তী বন্ধু বান্ধবীর ভিড়! মজা , গান , খাওয়াদাওয়া। মেঘনার মন চলে যায় পাড়ার প্যান্ডেলে। সেখানে কতজনের ভিড় এখন! টেলিভিশন অন করে, “মাঝা আনন্দ” চ্যানেলে ঘোষনা হচ্ছে কেউ বাইরে প্যান্ডেলে ভিড় করতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রীচা সন্দেশ , মারাঠি মানুষ দের উদ্দেশ্যে । ‘ভক্তনান্চী ই- দর্শন’। তার মানে দেশেও সবাই বাড়িতেই সেলিব্রেট করছে, তাদের মতোই।সে নিজের গেস্টদের তদারকিতে নেমে পড়ে,এমন নির্মল আনন্দ জুমেইরা তে পয়সার বিনিময়ে পাওয়া যায় না! 

      পরের দিন , টবের মধ্যে গণেশ বিসর্জন দেয় মেঘনা শচীন এই বলে, ‘গণপতি বাপ্পা মরিয়া ,পুদাল্যা বর্ষী লভকরিয়া ‘-মন ভারী হয়। বাবা আর আই দানাপানি বীচে ছোট্টো গণেশ বিসর্জন দিয়েছেন , হোয়াট্সযাপ ভিডিও কলে , আই এর আনন্দে উজ্জ্বল মুখ দেখে শচীনের খুব ভালো লাগে। মনখারাপ সেরে যায়।

        রাতে আর রান্নার ইচ্ছে থাকে না মেঘনার। সামনের রেস্টুরেন্টে খেতে যায় তারা। ভেজ খাবার কি কি আছে জানতে চায়। ওয়েটার টি কিছুদিন বম্বের একটি হোটেলে কাজ করেছে, সেই সুবাদে সাজেস্ট করে , তন্দুরি রুটি আর রোস্টেড ব্রিন্জেল। পছন্দ হয় শচীনের। বিল দিতে গিয়ে দেখে তারা খেয়েছে রুটির সঙ্গে ‘বাবা গণুশ’!! জানতে পারে , বেগুন পোড়ার ডিশ কে বলে বাবা গণুশ!! 

        অ্যামাজনে অর্ডার করে নানারকম সব্জীর বীজ আনায় মেঘনা। যে টবে গণপতি বিসর্জন দিয়েছিলো , তাতে পুঁতে দেয় বেগুনের বীজ। বাকি বীজ অন্যান্য টবে লাগিয়েছে। এখন এই টবের বাগান শচীন মেঘনার  রোজকার ক্লান্তি কাটিয়ে অক্সিজেনের যোগান দেয়। 

        কিছুমাস পড়ে, বেগুনের গাছে দুলতে থাকে গাঢ় বেগুনী রংয়ের  বেগুন। মেঘনা সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা গণেশের টবে দুলতে থাকে , বাবা গণুশ।সেই জীবন্ত ঈশ্বরের কাছে মেঘনা চায় তার আই -বাবার আনন্দের জীবন  আর পৃথিবীর রোগমুক্তি।

mousumichak74@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment