![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
সম্প্রীতির বন্ধন
শাশ্বতী মুন্সী
সাপ্তাহিক রুটিনে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন শেষের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে বিকেল ৪টে অবধি | সোম থেকে শুক্রবার এই রুটিনের আওতায় পড়ে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা |
ছুটির পরে স্কুলের বাতসে কলরবের রেশ ছড়িয়ে ছাত্রছাত্রীর দল বাড়ি চলে গেছে | অন্যান্য শুক্রবার এই সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারাও নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার পথ ধরেন কিন্তু আজকে তাঁদের আরো কিছুক্ষন থাকতে হবে | বিশেষ ব্যাপারে আলোচনার জন্য প্রধান শিক্ষক মিটিং ডেকেছেন |
স্কুল বিল্ডিং এর দোতলার নির্দিষ্ট ঘরে সহ-প্রধান শিক্ষিকা এবং সব শিক্ষক-শিক্ষিকা জড়ো হতে সন্দীপ চক্রবর্তী বলতে আরম্ভ করলেন,
-" লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলে হাতের কাজও শেখানো হয় | এবারে ঠিক করেছি সব শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের রুটিনে কর্মশিক্ষার পিরিয়ডে নতুন কিছু শেখাতে হবে, পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর রুটিনে সপ্তাহে দুটো দিন কর্মশিক্ষার পিরিয়ড থাকে, সেই সঙ্গে এক্সট্রা ১টা পিরিয়ড যোগ করে দেবো, আর দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর রুটিনে একটু রদবদল করে অন্তত ২টো পিরিয়ড রাখতে হবে, ঐদিন তাদের স্থায়ী রুটিন বহির্ভুত কর্মশিক্ষার পিরিয়ড থাকবে | এই পিরিয়ড গুলোতে রাখী তৈরী শেখানো হবে | ল্যাপটপে রাখীর বিভিন্ন ছবি এবং তৈরীর পদ্ধতি দেখিয়ে হাতে কলমে ওদের শেখানোর দায়িত্ব আপনাদের..শেখার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে বসেই রাখী বানাতে হবে এবং বাড়িতেও যত পারে বেশি সংখ্যক রাখি বানানো আবশ্যিক..কারণ ওদের হাতে তৈরী রাখী একে অন্যকে পরিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই রাখী উৎসব পালন করা হবে..
এবার বলুন আপনাদের কী মতামত..
বিজ্ঞানের শিক্ষক বরুন চট্টরাজ বলেন,
-" এ তো ভীষণ ভালো উদ্যোগ, বরাবর তো দোকানে কেনা রাখী দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা উৎসব পালন করে থাকে, এবারে নিজেদের বানানো রাখী বন্ধু-বান্ধব সহ বিদ্যালয়ের সকল দাদা-দিদি ভাই বোনেদের পরানোর সুযোগ পাবে.."
--" হ্যাঁ, এছাড়া সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ বাড়বে.. ", বললেন ইতিহাসের শিক্ষিকা অনিমা গুহ |
ওনাদের কথার সুরে নিজেদের মত মিশিয়ে বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা এমন কর্মসূচিতে যোগদানের সম্মত হন |
সোমবার বিদ্যালয় পাঠ্যক্রম শুরু হবার পরে ফোর্থ ক্লাস স্টাফ হরেনকে দিয়ে প্রতিটা শ্রেণীর বিভাগীয় কক্ষে উক্ত বিষয়ের নোটিস পাঠিয়ে দিলেন সন্দীপবাবু | নতুন কর্মসূচির ব্যাপারটা বিস্তারে ক্লাস টিচাররা বুঝিয়ে দিতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা দেয় |
জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে এই অভিনব কর্মসূচির প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে | চলবে মাস খানেকের একটু বেশি সময় ধরে | এখন বিদ্যালয়ের একটা ঘর আপাতভাবে রাখী তৈরী কারখানা | ঘরের মাঝে টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুঁতি, পাঠ, খড়, জরি, ঝিনুক, ধান স্পঞ্জ, প্লাস্টিকের ফুল, আঠা, রঙিন কাগজ ইত্যাদি রাখী তৈরীর বিভিন্ন উপকরণ | আর সেগুলো নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে | স্পেশাল পিরিয়ডের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখানো পদ্ধতিতে নিজেদের হাতে রাখী বানাতে পারছে, এতেই খুব খুশি পড়ুয়ার দল |
দোকানে রকমারি রাখী অভাব নেই | দিন দিন রাখীর জৌলুস, নকশার বৈচিত্র বাড়ছে | আর অনলাইনে তো রাখীর হাজারও সম্ভার | এসবের মাঝেও নিজেদের হাতে রাখী বানানো একেবারে অন্য স্বাদের ব্যাপার, তা মেনেছে ছাত্রছাত্রীরা | স্কুলের এমন উদ্যোগে রাখী বন্ধন ঘিরে আগ্রহ-চেষ্টার কমতি নেই সপ্তম, দশম, নবম, এমনকি পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সঙ্গীতা, অমল, রুহিনা, সঞ্জীব, জাহির, মারিয়ম, মকবুল, নাজিমাদের |
অগণিত হাতের সম্মিলিত চেষ্টায় তৈরী হল বহু সংখ্যক রাখী |
চলতি বছরে শ্রাবনী পূর্ণিমার তিথি পড়েছে ১২ই আগস্ট | সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ সকল শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা উপস্থিত হয়েছে বিদ্যালয়ে | বাউন্ডারি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা স্কুল কম্পাউন্ডের বাম দিকে সিমেন্ট নির্মিত স্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাখী বন্ধন উৎসব প্রচলনের সংক্ষিপ্ত পৌরাণিক ব্যাখ্যা-সহ ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে বক্তব্য রাখতে প্রধান শিক্ষক মহাশয় বললেন,
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মেতে উঠেছিল বাংলা | এদিকে ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে ভাগ করে বিদ্রোহের গতি রুদ্ধ করে দেওয়া | তাই পাশ হয়ে গিয়েছিল বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব | এক ধর্মের মানুষ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে যার হাতে রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার ধর্ম আলাদা | হাতে হাত রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল এই প্রতীকী প্রতিবাদ | কবির ডাকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা বাংলা এক হয়েছিল সেদিন | সেসময় থেকে বাংলায় রাখী উৎসব হয়ে উঠল সর্বসাধারণের | সেই ধারা এখনও অব্যাহত |
জানো তোমরা, আজ রাখী পূর্ণিমার দিন কেন বিদ্যালয়ে খুলে রেখেছি? কারণ একালের প্রজন্ম যাতে সেই ধারার বহমানতা বজায় রাখতে পারে |
তারপর সঙ্গীত শিক্ষিকা রিতা কুন্ডুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হল বিখ্যাত সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত...
" বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান.."
সম্পূর্ণ গানটি শেষ হতে একটা বড়ো বাক্সে একত্রিত রাখা সুন্দর রাখীগুলো দাদা, দিদি, ভাইবোন, বন্ধু বান্ধবদের হাতে পরিয়ে দিল সকল ছাত্রছাত্রীরা | বাদ গেলেন না শিক্ষক-শিক্ষিকারা | অনুষ্ঠানের শেষ দিকে সবার মধ্যে মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করা হল |
রবি ঠাকুর প্রচলিত প্রথার অনুসারী হয়ে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির নজির স্থাপন হল অভিনব পন্থায় |
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment