1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বিলীন

ছবি : ইন্টারনেট 

       বিলীন

সৌরিন ভট্টাচার্য্য       

(১)

আজ আকাশের রঙ বড়ই নীল । পেঁজা তুলোর মতন কিছু মেঘ ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে সূর্যের চারিপাশে । পড়ন্ত বেলার সূর্যকিরণের সোনালী রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে সরু গলিটার বাঁধানো রাস্তাটাকে । মৃদু বাতাসে আমগাছের পাতাগুলি দুলছে, একত্রআবেগে | দূরে কোন বাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে আসছে মান্না দের গান "একটি কুড়ি দুটি পাতা রতনপুর বাগিচায়..." | সব মিলিয়ে এক মনোরম বিকেল | একটা লাল টপ আর জিন্স পড়ে সদর দরজা সন্তর্পণে ঠেলে বাইরে বেরোলো আকাশলীনা | সদর দরজার পর একটা অর্ধগোলাকার গ্রিল, তার পরে বাড়ির প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত একটা ছোট গ্রিল | রবীন্দ্রচাঁদ সরণির একপ্রান্তে তাদের ছিমছাম দোতলা বাড়ি | বাড়িতে থাকে সে, ছোট ভাই, ও মা | বাবা চাকুরীর কারণে দীর্ঘদিন শহরের বাইরে, পুজোতে ও অন্যান্য ছুটিতে অল্প কদিনের জন্য বাড়ি আসেন | ছোট থেকেই আকাশলীনা ভীষণ ভাবপ্রবণ | বড় গ্রিল খুলে বহির্ভাগে পা রাখতেই অল্প অল্প করে একরাশ ভাবনা আর কল্পনা মিলমিশ খেয়ে তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো | মনে পড়তে লাগলো ছোটবেলার কথা, বেড়ে ওঠবার সাথে সাথে নিষ্পাপ আনন্দগুলোর অবলুপ্তির বেদনা; পারিপার্শ্বিকের জীবনের কোলাহলে তার বেড়ে উঠে পূর্ণবয়স্ক যুবতী হয়ে ওঠার ব্যতিক্রমী ইতিবিবরণ | সেই একদম ছোটবেলা থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে লীন হয়ে যেত সে, মাথা যতটা ওপর করা যায় ততটা ওপর করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতো আকাশে ভাষা ইতস্তত মেঘ, কয়েকটা পাখি, আকাশি নীলের স্বপ্নের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতো | বাবা বরাবরই তাকে উৎসাহিত করতেন খেলাধুলায়, শিল্পে, সাহিত্যে | নিজে কোনোদিন লেখালেখি না করলেও মেয়েকে সর্বদাই অনুপ্রাণিত করতেন শৈল্পিক চরিত্রবিকাশে | বাবার দীর্ঘঅভাব সে মেটাতো চারকোলে ছবি এঁকে, রূপকথার ছোট ছোট ঘটনাপঞ্জি আপন ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে | রূপকথার বই ছোটবেলায় তার খুব প্রিয় ছিল | দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সাহিত্যসম্ভার সে পড়ে শেষ করেছিল মাত্র তেরো বছর বয়েসে | নিঝুম নিরালায় একা একা বসে থাকার সময় চাঁদটা তার খুব কাছে চলে আসতো | কলঙ্করেখাগুলো স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতো সে | কখনো নীল ডানা মেলে পরীরা এসে তার মাথায় হাত বোলাতো, বাক্যালাপ করতো তার সাথে | লোডশেডিঙের সময় দত্তবাড়ির ছাদের ছায়ার জ্যামিতিক বিন্যাসে তার চোখে ভেসে উঠতো নানা আকার-আকৃতি |  একটু বড় হওয়ার পর তার ঝোঁক আসে কমিক্স ও মাঙ্গার উপর | নিজেকে কল্পনা করে সে নানা স্থানে, ভাবের ডানা মেলে উড়ে যায় জাপান থেকে বেলিজ, সুইডেন থেকে সুরিনাম | নিজের ডায়ারির মসীর কৃষ্ণ শৃঙ্খলে নিজের কল্পকথা লিখে রাখে সে | 

কোলাপ্সিবল গেটটা ঠেলে দিয়ে স্মার্টফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে নিজের চুলের বাহার একবার দেখে নিলো সে | চুলটা কিছুদিন আগেই ববকাট করে কেটে লাল রঙে রঞ্জিত করেছে | কাঁধে একটা ব্যাগ, হাতে তার স্মার্টফোনটি শক্ত করে ধরা | বাড়ির কারোর ঘুম ভাঙাতে চায়না সে |  বরাবরই সে সামাজিক রীতিনীতি থেকে কিছুটা বিপথগামী ।  মাধ্যমিকের সময়েই সে ঠোঁটে পিয়ার্সিং করে নিয়েছিল, ইদানিং বাম ভুরুর উপর আরেকটা করেছে | নিজের অবয়বে, পোশাকে নিত্যনতুন পরিবর্তন আনতে খুবই ভালোবাসে | দু চোখে আজকে সে গোল্ডেন আইল্যাশ পড়েছে ! সামাজিক রীতিনীতির বিপথে চলবার জন্য খোলাখুলি অনেক কটূক্তিও তাকে শুনতে হয়েছে বারংবার | বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার গার্ডিয়ান কল করেছিলেন, তার বান্ধবীরাও বলে যে "when she does that, she must be asking for it" | বরাবরই একটা হালকা হাসি হেসে সে বুঝিয়ে দায়ে যে সে অন্যদের আপত্তিতে সে খুব একটা কিছু মনে করে না | মনে চলে আসে মায়ের কথা |  তার মা এইসব "ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার" বিষচক্ষে দেখতেন | তার আপত্তি ছিল টিনএজ আকাশলীনা পোশাক-আশাক, ফ্যাশন, চুলের রং, সংগীতের অনুরক্তি ইত্যাদি নিয়ে | মার সাথে মেয়ের মানসিক ব্যবধান অনেকটাই | তার মা একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষিকা | খুবই রাশভারী আবেগবর্জিতা দৃঢ় চরিত্রের মহিলা | আকাশলীনা হঠাৎ হঠাৎ করে ওঠা  খামখেয়ালি আবদার এবং শখগুলো একদমই বরদাস্ত করতে পারেননা তিনি | অনেকবার নানান শিল্পকর্ম উনুনে সমর্পিত করেছেন রাগের মাথায় |  বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও তাকে ভয় ও সমীহ করে চলে | সকাল সন্ধ্যে বাড়িতে যখন ব্যাচ পড়ান তখন কেবল তার গমগমে কণ্ঠস্বর শোনা যায় | আকাশলীনার বয়েস যখন চার, তখন জন্ম হয় তার ভাইয়ের | ঊন ওজনের ছোট্ট ভাইটাকে অনেক সময়েই সামলাতে হয়েছে তাকে মায়ের অনুপস্থিতিতে | শৈশবের একটা অংশ সে ব্যাতিত করেছে ভাইকে স্নেহস্পর্শে রাঙিয়ে তুলতে তুলতে | এখন তার সাথে তার ভাইয়ের মনের ব্যবধান অনেকাংশেই বেড়েছে | দুজনে ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ | ভাই অনেক বেশি বস্তুবাদী, জেদি ও বদমেজাজি | সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে | তার ইচ্ছে ভালো কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ভালো চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়া , আইআইটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়া | আকাশলীনার একাডেমিক বিষয় মনস্তত্ব | বাড়ির কাছেই একটা অখ্যাত মেয়েদের কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে, যদিও কলকাতার নামজাদা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে সে পড়বার সুযোগ পেয়েছিলো | বরাবরই সে বাড়ির চারিপাশের ফুল-ফল-বাড়ি-রাস্তা-জলের ট্যাঙ্ক-গাছপালা-আকাশ-মাঠ নিয়ে থাকতে ভালোবাসে | চেনা পরিবেশটা ছেড়ে অজানা কলকাতার গলিতে মেসবাড়ি করে থাকার কথা ভাবলেই তার দম বন্ধ হয়ে ওঠে | এখনো সে মুড হলে মাঝেসাঝে ছবি আঁকে | নিজেকে ভালোবাসতে মগ্ন সে | তবে আজ তার আত্মপ্রণয়ে শুভ ছেদ পড়তে চলেছে | সময় আসন্ন |

(২)

রবীন্দ্রচাঁদ সরণি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা পেরিয়ে ডানদিকে কিছুদূর এগোলে একটা পুরানো পরিত্যাক্ত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, তার পেছনেই নোনাধরা পাড় সমেত বাঁধানো পুকুর, যাতে কচুরিপানার রাজত্ব আকাশলীনা জন্মের পূর্ব সময় থেকেই | চারপাশে আগাছা, লতাগুল্মের অবাধ বেড়ে ওঠার পরিবেশ | একসময় এখানে কোনো জমিদারের গ্রীষ্মকালীন আশ্রয় ছিল, পারিষদ নিয়ে এসে উঠতেন বাড়িটাতে দুই মাসের জন্য | তার খাজনা আদায়ের নির্মমতা নিয়ে এখনও নানা জনশ্রুতি শোনা যায় | আকাশলীনা নিজেকে অনেকবার কল্পনা করেছে এই পুকুর থেকে জমিদারের সাথে মাছ ধরবার | সেই পুকুরপাড়ে আজ একজন আগুন্তুক আসবার কথা, আকাশলীনা সাথে দেখা করবার জন্য | এই প্রথম বাড়ির কাউকে না জানিয়ে সে কোনো পুরুষের সাথে দেখা করতে বেরিয়েছে, ভাবতেই তার দেহের রোমকূপগুলি শিহরিত হয়ে ওঠে, একটা অজানা আশংকায়, উত্তেজনায় পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে | তার একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে, শেয়ার করেছে জীবনের নানা ছোটোখাটো ঘটনা, সুখ, দুঃখ, ভালোলাগা-ভালোবাসা | তার স্ব-আরোপিত ঘনিষ্ঠতাবিহীন জীবনের প্রথম বুক মোচড়ানো অনুভূতি, একটু অন্যরকম লাগা, উদরে প্রজাপতি কিলবিল করবার সংবেদন দিয়েছে এই ছেলেটাই |

ছেলেটার সাথে আলাপ ফেসবুকে | এমনিতে সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের ছবি বা স্ট্যাটাস আপডেট দেয়না আকাশলীনা, প্রোফাইলটাও ছদ্মনামে বানানো | কারোর সাথে চ্যাট করবার অভ্যাস নেই, তবু এই ছেলেটা যেদিন প্রথম পিং করলো, সেদিন একটু বিস্মিতই হয়ে গেছিলো সে | প্রথমদিন কথা বলতেই অনেক কিছু বলেছিলো ছেলেটা; হবিস, কি কি গান শোনে, কোন কোন মুভি তার প্রিয়, জীবনে কি কি মহৎ কাজ করবার ইচ্ছে আছে তার, ইত্যাদি | ফ্রেন্ডশিপ হিস্ট্রিতে আকাশলীনা দেখলো যে ছেলেটা তিন মাস আগে তার ফ্রেন্ডলিস্টে জয়েন করেছে | বায়োতে দেওয়া "এবার নিজেকে ভালোবাসো তুমি" | সেই লেখাটা পরে কিরকম যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা এসেছিলো তার মনে | এরপর ছেলেটা নিজে থেকেই একরকম জোর করে তার সাথে চ্যাট শুরু করতো, বিভিন্ন গানের লিংক পাঠাতো | প্রায় সবকটাই আকাশলীনা পছন্দ হয়ে যেত | এর আগে জীবনে কারোর প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়ে ওঠেনি সে | মেসেঞ্জার আপ ইন্সটল করেছিল মূলত ছেলেটার সাথে কথা বলবার জন্যই | তার সৃষ্টি, রূপকথা, চারকোলের আঁকা সবকিছু গোগ্রাসে গিলে ফেলতো ছেলেটা | পরে যখন ওরা ভিডিও চ্যাটিং শুরু করলো তখন ছেলেটা তাকে উৎসাহিত করতো সৃজনসম্ভারের নৈবেদ্য দিয়ে ঘর সাজানোর জন্য ! তার কথাগুলো যথক্ষন না মানা হতো ততক্ষণ ছেলেটা ঘ্যান ঘ্যান করে যেত খুব কমনীয় স্বরে | ঘর সাজাতে সাজাতে আকাশলীনা  মনে মনে ভাবতো "এ এক অদ্ভুত পাগল ছেলে !"   

কিছুদিন আগে দুজনে রাজি হয় দেখা করবার জন্য, একান্ত নিভৃতে | আকাশলীনা মনে কেমন যেন এক মাদকতার রেশ ছড়িয়ে যায় পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়ে | সন্তর্পণে নিজের কাঁধের ব্যাগটা একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গা দেখে গাছের বেদীর কোলে হেলান দিয়ে রাখে | ফোনটা নিয়ে নম্বর ডায়াল করতে যায় | কিছুক্ষণ চেষ্টা করবার পর ডায়ালটোন বেজে ওঠে | সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক তার পেছনে একটা বেহালার মূর্ছনা মূর্ত হয়ে ওঠে, আঘাত করে শ্রবণেন্দ্রিয়ে | ত্রস্ত পায়ে চকিতে ঘুরে দাঁড়ায় সে | 

(৩)

"হাই | যদি আমি খুব একটা ভুল না করি, তুমিই তো আকাশলীনা, রাইট?" , মৃদু গলায় ছেলেটা বলে ওঠে | উত্তর দেবার আগে চট করে ছেলেটাকে আপাদমস্তক দেখে নেয় আকাশলীনা | একটা সাদা শার্ট, আস্তিন গোটানো হাতে শিরা-উপশিরাগুলি খুব স্পষ্ট, বড় ডায়ালের ঘড়ি বা হাতে, ফেডেড জিন্স | সবমিলিয়ে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে, সুপৌরুষের অধিকারী ছেলেটার চোখে মুখে একটা মনোরম প্রশান্তির ছাপ |

"সুদীপ্ত! ওহ মাই গড ! আমায় একদম ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে ! এরকম ভূতের মতন এসে আবির্ভাব হওয়ার কারণ কি ? হ্যাঁ চ্যাম্পিয়ন ?", টিজিং কণ্ঠস্বরে বলে ফেলে আকাশলীনা | ফেসবুকে চ্যাটিংর সময় সে আন্দাজ করতে পারেনি যে ছেলেটা তার পাঁচ ফুট নয় এর কাঠামোর থেকেও লম্বা হবে | ভিডিও কলের যেমন লাগতো, হুবহু সেরকমই দেখতে ছেলেটা | ঠোঁটের কোণের হাসিটা হয়তো বোনাস |

ততক্ষণে ছেলেটা ব্যাগটা সরিয়ে বেদীতে দুই পা তুলে বাবু হয়ে বসে পড়েছে | "এসো বোসো আমার পাশে | কতক্ষন দাঁড়িয়েছিলে এখানে? আই আযম সর্রী যে একটু লেট্ হয়ে গেলো | প্লিস ডোন্ট মাইন্ড |", আদ্র কণ্ঠস্বরে সে কৈফিয়ত জ্ঞাপন করে | আকাশলীনা হাসিমুখে তা গ্রহণ করে | সুদীপ্তের কাছে ঘেঁষে বসে | সুদীপ্ত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে | মাধবীশিশির মিশ্রণের একটি বহুল জনপ্রিয় কাট | আকাশলীনাকে একটা অফার করে | আকাশলীনা না করে না | দুজনে সিগারেট  সে জানে যে আকাশলীনা মাঝেসাঝে সিগারেট খায় | শিল্পীদের প্রয়োজন হয় | সাধারণ মানুষদের থেকে হয়তো একটু বেশিই প্রয়োজন হয় | মনকল্পের দ্যোতনকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশের জন্য, দেহজ উদ্দীপনার জন্য | দুজন নানা গল্পে মত্ত হয় | আঙুলের ফাঁকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে ঘনিষ্ঠ সিগারেট | ধূমায়মান নিকোটিনে দূরের সদ্য জ্বলে ওঠা সোডিয়াম বাতির ঔজ্জ্বল্যকে উদ্ভাসিত করে, দ্যুতি ছড়িয়ে পরে দুজনের দেহময় নৈকট্যে | পশ্চিম আকাশে সূর্য্যকিরণ দীর্ঘায়িত হতে থাকে |

আকাশলীনা হিপ পকেটে করে এনেছিল একটা ছোট্ট পেন্সিলে আঁকা ছবি | সুদীপ্তকে উপহার দেবে | সাধারণ নোটপ্যাডের কাগজের উপর অসাধারণ ডিটেইলিং-এ করা | অনেক আগের অঙ্কন | একজন রাজপুত্র সমুদ্রসৈকতে একলা পরিভ্রমণ করছেন, কিছু ঘোড়া পেছন পেছন খেদহীন নিরুলেক্ত খুরে চষে বেড়াচ্ছে বহ্নিময় তট | অগ্নিদাহের সুস্পষ্ট সংকটময় একটা ছবি | আকাশলীনা ঘুম ভেঙে গেছিলো অনেকদিন আগে, মাঝরাত্রে | সে নিজেকে দেখছিলো যে  প্রচন্ড দহনে জ্বালাময়ী উন্মাদনায় জীবনের ভিখ মংছিলো সেই রাজপুত্রের নিকট হাতজোড় করে | রাজপুত্রের চোখে তীব্র অগ্নিকিরণ জ্বলে উঠেছিল, তার দেহের অস্থিমজ্জা পুড়ে গেছিলো অসহায়তার লেলিহান শিখায় | বিকট চিৎকারে ঘুম ভেঙে সে উঠে বসেছিল | ধড়ফড়িয়ে নেমে সে বাথরুমের কল খুলে মাথা ভিজিয়েছিলো অনেকক্ষণ | বাইরে মা ও ভাই দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন বারবার, ভেবেছিলেন যে সাংঘাতিক কিছু একটা বিপদগ্রস্ত হয়েছে আকাশলীনা | বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে দরজা খুলে দিয়ে সটান বিছানায় শুয়ে পড়েছিল, কোনো কথা উচ্চারণ না করেই | চোখময় বিভীষিকা | পরেরদিন ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠেছিল সে, নিজের অজান্তেই |

উপহারটা হাতে নিয়ে সুদীপ্তের ভ্রু কুঁচকে গেছিলো | পরক্ষনেই ফুটে উঠেছিল প্রশান্ত একটা স্মিত মুখ, "মেনি মেনি থাঙ্কস রে ! এটার কথা তো আমায় আগে বলিসনি তুই ! কি সুন্দর এঁকেছিস রে ! আই লাভ ইট !", ঘন্টাখানেকের কথোপকথনে তারা 'তুমি' থেকে 'তুই'তে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে নেমে এসেছে | তবু ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হতেই আকাশলীনার মনে হলো যে সেই অর্চিষ্মান রাজপুত্রের এক ঝলক ফুটে উঠলো সুদীপ্তের চোখে, বুকটা হঠাৎ করে দ্রুম দ্রুম দামামা বাজাতে আরম্ভ করলো | নিজের অভিঘাত কোনোমতে সামলে শুষ্ক একটা হাসি হেসে বিদায় জানালো | বাড়ির পথে পা বাড়ালো সে | এতক্ষণ ছেলেটার সাথে এতো ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলবার পর এরকম কেন মনে হচ্ছে তার ! একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো |পালপাড়ার অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে ছেলেটা, ওখান দিয়ে বড়রাস্তায় ওঠবার শর্টকাট রাস্তা | কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ ফুটে উঠেছে, সন্ধ্যার বাতাসের বাষ্পায়নে শৈত্যের সৃষ্টি হলো তার ললাটে |    

(৪)

তিন মাস কেটে গেছে | আকাশলীনা মাথা এখন সুদীপ্তর স্কন্ধের ওপর নির্বাপিত | দুজনে দুজনের ঘনিষ্ঠ হয়েছে | ফেসবুকে স্টেটাস রাখা হয়েছে 'ইন এ রিলেশনশিপ' | দিনগুলি এতো ঘনঘন আসছে-যাচ্ছে ও এতো ঘটনাবহুল তার জীবন হয়ে উঠেছে যে সে খেই হারিয়ে ফেলেছে | এর আগে সপ্তাহঅন্তে  চুপটি করে অনায়াসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কবিতা পড়তো, চুল ও ত্বকের পরিচর্যা করতো ও কল্পনার ফল্গুধারায় আত্মসমর্পণ করে দিতো সে | এখনো করে ঠিক সেটাই, তবে সেটা সুদীপ্তের বাহুডোরে | একে অপরের সত্ত্বার মাঝে যে কখন বিলীন হয়ে গেছে তার হিসেবে রাখতে পারেনি আকাশলীনা | ফোন, চ্যাট, একসাথে সিনেমা, রেঁস্তোরায় আহার | দুজনের মনের পারস্পরিক সমর্পণ | ইতিমধ্যে ভবিষ্যতের কথাও সে ভাবা শুরু করেছে | তাদের সম্পর্কের যে একটা পরিণতি হওয়ার সাবলীল সম্ভাবনা রয়েছে সেটাও সে খতিয়ে দেখেছে | মাত্র দু বছর আগেও সে ভাবতে পারতো না যে সে প্রেমে পড়বে এরকম ভাবে হোঁচট খেয়ে ! মা ও ভাই বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা | আকাশলীনাও আর ব্যাপারটা চেপে রাখে না | মা কিছু জিজ্ঞেস করলে সরাসরি বলে দে যে, 'বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেরোচ্ছি মা, বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে' | সম্পর্কে আসবার পর তার ব্যক্তিগত উৎফুল্লতাও বেড়েছে | তিনটে জলরঙের ছবি এঁকেছে সে | সৃজনশীলতার তুঙ্গে সে এখন | বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটা শর্ট ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখাও শুরু করেছে | পেশায় সুদীপ্ত সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, আকাশলীনা চেয়ে বছরতিনেকের বড় মাত্র |  নিজে ফটোগ্রাফিও করে মাঝে সাঝে | তাদের যুগলছবি একটা ফটোফ্রেমে বন্দি আছে আকাশলীনা বেডরুমের টেবিলের কোণটায় | ভাবতেই তার মনের মধ্যে একমুঠো রাঙা আবির কে যেন লেপে দে | তারা এখন একটা দম্পতি, গাঢ় প্রণয়ের ঊর্ণর মাঝে আলিঙ্গনাবদ্ধ |

 ট্রেনটা খড়দহ ছাড়িয়ে টিটাগড়ের দিকে ছুটছে | ঘড়িতে বাজে রাত পৌনে এগারোটা | কামরায় প্রায় লোকজন নেই | সারাদিনের ঘোরাফেরায় পরিশ্রান্ত আকাশলীনার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে তার প্রেমাস্পদ | প্রসন্ন মনে চোখ বুজে মুহূর্তটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে সে | কিছুদূর এগিয়ে এসে ট্রেনটার গতি হ্রাস হলো, আস্তে আস্তে থেমে দাঁড়ালো | বোধহয় যাওয়ার সিগন্যাল নেই সামনে | কম্পার্টমেন্টের আলোগুলি ঝপ করে নিভে গেলো | কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, খড়দহ ও টিটাগড়ের মাঝে এটা সব ট্রেনেই হয় | একটা ইমার্জেন্সি আলো নিষ্প্রভভাবে জ্বলে উঠলো কম্পার্টমেন্টের ওই ধারে | আকাশলীনা চোখ খুলে বাইরে তাকালো | আজ পূর্ণিমার রাত, জ্যোৎস্নাস্নাত রেললাইন, নুড়ি, পাথর, বাতাসে গাছেদের দুলুনি, নিকসকৃষ্ণ ছায়া এক অদ্ভুত পরাবাস্তব পরিবেশের সৃষ্টি করেছে | পেলব জ্যোতিষ্করেণু ফুটে উঠেছে আকাশের গাত্রে | সুদীপ্ত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে | আকাশলীনা মনের কোণে উন্মত্ততা দেখা দিলো | দুই হাত এগিয়ে সুদীপ্তের গলা জড়িয়ে ধরলো | মৃদুভাবে স্পর্শ করলো গালদুটো | অধরোষ্ঠ এগিয়ে দিলো চুম্বনের প্রত্যাশায় | সুদীপ্ত ধীরে মুখ ফেরালো তার প্রেমিকার অধীর আননের সম্মুখে | এমন সময় আকাশলীনাকে চমকে দিয়ে বাইরে একটা রাতপাখি ভয়ার্ত গলায় সতর্কবাণী জানাতে জানাতে উড়ে গেলো জানালার খুব কাছ থেকে | তার চোখ অনপেখিতভাবে বিস্ফারিত হয়ে উঠলো, থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো সমগ্র দেহ |

(৫)

অচ্ছদপটল প্রসারিত করে আকাশলীনা দেখলো চোখের সামনে থাকা মানুষটাকে, তিন সেকেন্ডের জন্য | দুচোখ কচলে ফের দেখলো সে | না, তার দেখবার কোনোমাত্র ভুল নেই | তার দর্শনেন্দ্রিয় তার সাথে কোনোরকম ছলচাতুরী করছে না | সুদীপ্তের চোখ দুটো জ্বলছে, নিভছে | সেই অর্চিষ্মান রাজপুত্রের মুখের আদল পুরো কেটে বসানো সুদীপ্তের মুখে | সেইরকম চাহনি, গড়ন, কেশবিন্যাস | প্রতিটা নিঃস্বাশের সাথে নির্গত হচ্ছে আগুনের হলকা |  কপালে অসংখ বলিরেখা | একদম নিথর অবস্থায় বসেই রয়েছে সে | আকাশলীনা লাফ দিয়ে ট্রেনের মেঝেতে পড়লো, তার ওড়না আটকে গেছে দুই সিটের ফাঁকে | তড়িঘড়ি টানতে গিয়ে ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে গেলো সেটা | তীক্ষ্ণ স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো সে | এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখলো, গোটা কম্পার্টমেন্টে কেউ নেই | আগরপাড়া থেকে সে চোখ বন্ধ করে দিয়েছিলো তাই আগে বুঝতে পারেনি যে সে বড় এক হয়ে পড়েছে | সুদীপ্ত দুটো হাত ছড়িয়ে দিলো, এবার হয়তো সে আস্তে আস্তে  উঠে দাঁড়াবে | আতঙ্কিত চোখ সুদীপ্তর দিকে সাঁটিয়ে সে দেহটা ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে গেলো গেটের কাছে | ততক্ষণে সুদীপ্ত উঠে দাঁড়িয়েছে | গটগট করে হেটে চলে এসেছে খুব কাছে | মুখে একটা ক্রূর হাসি ফুটে উঠেছে তার | এক হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো সিঁটিয়ে যাওয়া আকাশলীনার গাল | হাতটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে গেলো সে, পারলো না | গালের মাংস দ্রুত গলে গলে পড়ছে তার কামিজের ওপর | রক্ত বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে সেই ছোঁয়ায় |  অত্যুষ্ণ হাতের স্পর্শে লাভার উত্তাপ প্রতিফলিত হচ্ছে ধমনীতে ধমনীতে | ট্রেন চলতে আরম্ভ করেছে |

রক্ত জল করা চিৎকার করে এক লাফ দিলো আকাশলীনা | সজোরে পতিত হলো ধরণীতলে | গড়িয়ে গিয়ে পড়লো পাশের লাইনে | ডান জানুসন্ধিতে সাংঘাতিক আঘাত লেগেছে, বেদনায় বিবশ হয়ে পড়েছে সে | হয়তো তার পুরো অস্তিত্বই ভেঙে গুড়িয়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে অস্থির সাথে | পাশের ট্রেন ততক্ষণে ছুটে এগিয়ে গেছে | দুটো জ্বলন্ত চোখ এখনো স্পষ্ট, তিমিরের মাঝে দুটো আলোককণা | চিৎ হয়ে লাইনে শুয়ে পড়লো সে | দেহের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেছে তার |

আলোআঁধারী চেতনায় সে বুঝতে পারছে যে তার মাথার দিকে একটা ভারী জবরজং ধাতব কাঠামো বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে | এখনো তার দেহের নিকট আসতে কিছুটা সময় নেবে | পর্যাপ্ত সময় আছে দেহটা বিপদসীমার বাইরে নিয়ে যাওয়ার | কিন্তু দেহ তার সাথে যেন আর নেই | হেডলাইটের আলোয় ধাঁধিয়ে গেছে তার চোখ | আলোকের ঝর্ণাধারা উৎসারিত হচ্ছে বাঁশির শব্দের কম্পাঙ্কের অকস্মাৎ ডুপলের শিফটে | আঃ! এই জ্যোৎস্না, এই অংশুমালীর স্নেহক্ষরণ, দ্রুতবেগে ধাবমান আলোর তেজ বড়োই নরম, বড়ই মোলায়েম | একটা বেহালার মূর্ছনাও সে শুনতে পেল আগমনী মৃত্যুচিত্রের নিস্বনে | চোখ বুজে গেলো আপনাআপনি, প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় | 'আজ বড়ই আনন্দের দিন', অস্ফুট উচ্চারণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে |  দেহভার ক্রমশ লাঘব হতে আরম্ভ করলো, ভেসে উঠলো তার দেহ, নিরঞ্জনা সমীরণে |   

(৬)

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে | মাথাটা যন্ত্রণায় দপদপ করছে | গলা শুকিয়ে কাঠ | অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে মাথার কাছ থেকে জলের বোতলটা খুলে জল খেতে গেলো সে | গায়ে অনেকটা জল পড়লো, জামার অনেকটা ভিজিয়ে দিলো | জল খেয়ে কিছুক্ষণ রগ ধরে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলো সে | বালিশের তলা থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে স্ক্রিনটা আনলক করলো | রাত দুটো বেজে ৪৩ মিনিট | কি সাংঘাতিক বিভীষিকাময় স্বপ্নই না দেখলো সে ! ভাবতে ভাবতে সারাদেহ শিহরণ জাগিয়ে তুললো | না, সুদীপ্তকে একটা কল করা দরকার | বাড়ি পৌঁছে আসবার পর যথারীতি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়া হয়েছিল | শুয়ে পড়বার আগে আবশ্যিক ফোন কলটাই করতে সে আজ পারেনি | ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর | ট্রেনে আসবার সময়ের ঘটনাক্রমটা ভাববার চেষ্টা করলো আকাশলীনা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে | আগরপাড়া স্টেশন অতিক্রম করবার পর স্মৃতিটা কেমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা | পরের স্মৃতি হিসেবে মনে আছে যে সে খাবার টেবিলে বসে রয়েছে, মা সুস্বাদু কষা মাংস পরিবেশন করছেন | তবে আজকের মাংসের স্বাদটা কেমন যেন অদ্ভুত ছিল, গন্ধহীন, অনেকটা শুকরের মাংস ভাজার মতো কিন্তু পুরোপুরি সেরকম নয় | তারপর, ভাই কি যেন বলছিলো তাকে, মনে পড়ছেনা এখন | মাথাটা আবার দপদপানি শুরু করলো, থাক, বেশি ভাবাভাবিতে কাজ নেই | ফোনবুক ওপেন করে সুদীপ্তের নম্বর ডায়াল করতে উদ্যত হলো |

কল হিস্ট্রিতে কোথাও "সুদীপ্ত" এন্ট্রি নেই | বিহ্বল হয়ে কন্টাক্টসে গিয়ে সুদীপ্তের নম্বর খুঁজলো সে | তাও কোথাও চোখে পড়ছে না ! তবে কি অন্য নাম সেভ করেছিল ! সচরাচর আকাশলীনা কারোর ডাকনামে বা অন্য কোনো নামে নম্বর সেভ করে না | হতবাক হয়ে সে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো | জানালাটা কখন একটুখানি ফাঁক হয়ে গেছে, জ্যোৎস্নারেখা সুন্দর সরলরৈখিক পথ বেছে নিয়ে তার শয্যা উদ্ভাসিত করে দিয়েছে | মোবাইল ডাটা অন করে ফেসবুকের ইনবক্স খুললো এক লহমায় | কোথাও সুদীপ্তের নাম নেই | আকাশলীনার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা চোরাস্রোত বয়ে গেলো | সুদীপ্ত কি তাকে ব্লক করে দিয়েছে? না তার ফোনে অনুপ্রবেশ করে নিজের নম্বর ডিলিট করে দিয়েছে? গ্যালারি খুললো, সেখানে সুদীপ্তের কোনো ছবিই নেই ! অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে যে আজকেই সে কয়েকটা সেলফি তুলেছিল ! "কি হচ্ছে এগুলো আমার সাথে? " অসংলগ্ন কণ্ঠে অভ্যন্তর থেকে কথাগুলো উৎসারিত হলো | পুরো ব্যাপারটা সে কোনো ভাবেই আত্মস্থ করতে পারছে না, তার মন বার বার বলছে যে এর কিছু একটা ব্যাখ্যা হবেই; সে বারবার ভুল দেখছে আজকে | 

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো আকাশলীনা | মনে পড়তে লাগলো ছোটবেলার কিছু কিছু কথা | অনেকদিন এগুলো ভুলে গেছিলো সে | ফ্রয়েডীয় অবচেতন স্তরে এতো কিছু লুক্কায়িত ছিল ! ছোট্টবেলা থেকে নানা নৈসর্গিক দৃশ্যকল্পের সক্রিয় সাক্ষী সে | আকাশ থেকে কারা যেন ডানা মেলে নেমে আসতো তার কাছে; তাদের দেহময় স্নিগ্ধ মোলায়েম আলোয় জুড়িয়ে যেত তার ছোট্ট ঘরটা | পেছনের বাড়ির মৃত কাকিমা প্রায়ই জানালা দিয়ে এসে তার সাথে গল্প করে যেতেন, মাঝে মাঝে বলতেন যে অমাবস্যায় জানালাটা একদম বন্ধ রাখতে - অতর্কিতে 'বিপদ' আসতে পারে | একবার একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে তাকে ভূগোলের পড়া দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কার্টোগ্রাফি শিখিয়েছিলেন | তিনি বলতেন যে দুশো বছর ধরে ভূস্তরের সহস্র হাত নিচে কোনো এক তৈলধমনীতে তিনি বাস করছেন, সেখান থেকেই উঠে আসেন আকাশলীনাকে সঙ্গে দিতে |  তার বাবা অবশ্য বরাবরই এগুলো "আকাশলীনা কল্পনাপ্রবণ মনের অভিব্যক্তি" রূপে ব্যাখ্যা করতেন, যখন তার মা তার বাবার কাছে মেয়ের মানসিক ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন | বাবা বরাবরই তার ফ্যান্টাসিপ্রবণ স্বভাবের সমর্থন জানিয়েছেন, মা রূপকথার বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পর চুপিচুপি তিনিই নতুন বই কিনে দিতেন | ভাবতে ভাবতে আকাশলীনা দুচোখ ভিজে এলো, আবছা চোখে তাকালো কোণে রাখা ক্যানভাসের দিকে |

হালকা একটা ছায়ামূর্তির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে, ক্রমশই যেন একটা ধোঁয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে | ঘুলঘুলি দিয়ে আসা একটুকরো চাঁদ এবার ঘরের মধ্যে এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে | ধীরে ধীরে জানালাটা খুলে যাচ্ছে | পারিপার্শ্বিকের সকল দ্রব্য, আসবাব, খাট, স্ট্যান্ডফ্যান, জানালার পর্দা, টেবিল, ওয়ার্ডরোব সবকিছু লীন হয়ে গেছে বিরল বায়ুস্তরে | আকাশটা যেন এসে গ্রাস করছে | এক সুবিশাল তট, দিগন্তব্যপ্ত, কুলকিনারাবিহীন | আকাশলীনার দেহ সম্পূর্ণ নিরাবরণ | তার সামনে দাঁড়ানো এক ইম্যানিস যুবক, সমাবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে | সে কি সঙ্গমমুখী ? অনুমান করতে ব্যর্থ হলো আকাশলীনা | দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো, আকাশলীনা দেখতে পেলো সেই ক্ষণকালের স্ফুলিঙ্গময় কনীনিকায় এক চিরকালের ইঙ্গিত | তার পা দুটো এবার থরথর করে কাঁপছে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে | সমগ্র দেহে উষ্ণ রক্ত যেন কুলকুল শব্দে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে, স্পষ্ট শুনছে সে ! বুভুক্ষু আকাশ এসে গ্রাস করছে তাকে, ধীরে ধীরে ভক্ষণ করছে তার সমগ্র শরীর | অস্থিপঞ্জর দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে সান্দ্রতাপূর্ণ চন্দ্রগহনে | বিলীন হয়ে যাচ্ছে তার অবয়বের লেশখানি, সেই গগনপুরুষের সুঠাম কাঠামোতে, এক বুক ভরা সুরভিতরঙ্গে |      

sourinrcb@gmail.com
ব্যারাকপুর

No comments:

Post a Comment