1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

শক্তিরূপেণ সংস্থিতা

ছবি : ইন্টারনেট 


শক্তিরূপেণ সংস্থিতা

শিল্পী চক্রবর্তী


আজ চৈতালির বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেছে।। প্রায় সারে দশটা বাজে এখন, এখনও পনেরো মিনিট হেঁটে যেতে হবে।। আসলে নতুন যে পড়ানোটা ধরেছে, সেই মেয়েটাকে পড়াতে পড়াতেই দেরী হয়ে গেল।। আসলে আজ ওর পড়াতে যেতেও দেরী হয়েছে,  প্রায় এক ঘন্টা লেট ছিল, তবে আগেই ও বৌদিকে, মানে ওর ছাত্রীর মা শর্বরীদেবীকে ফোন করে জানিয়েই দিয়েছিল যে, ওর যেতে দেরী হবে।। তাই, তেমনভাবে কোনো কথা শুনতে হয়নি।। আসলেই বৌদি অনেক ভালো, নয়ত একজন শিক্ষিকাকে আর কতোই বা ছাড় দেওয়া যায়।।

এসবই ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসছিল ও, রাস্তা পুরো ফাঁকা।। রাস্তার পাসের ভ্যাপারের হলুদ আলোয় রাস্তা পরিষ্কার হয়ে আছে এখন।। তবে, আজ সন্ধ্যায় মারাত্মক বৃষ্টি হওয়ায় এখন আর তেমনভাবে কেউ বায়রে নেই।। আর তার ওপর, কাল ভোরে মহালয়া।। অনেকেই কাল ভোরে উঠবে বলে আজ রাতে আগে শুয়েছে।। আবার কেউ কেউ যাবে তর্পন করতে।।

এই সময়টা আসলেই চৈতালির মনটা ভীষণ খুশী হয়ে যায়।। আর খুশী হবে নাই বা কেন, আমরা মানে বাঙালিরা যে, পুরো একটা বছর ধরে অপেক্ষা করি এই পূজোর জন্যে, আর মহালয় আসলেই মনে হয়, এই তো পূজো এসে গেছে।। আকাশে বাতাসে শিউলি-কাশের সাথে ভেসে বেড়ায় শারদীয়ার গন্ধ।। মা মা গন্ধ।। শঙ্খ , উলু , ধূপ , ধূনা, আর ঢাক।। সত্যিই এই ঢাকের শব্দেই যে স্পন্দিত হয়, বাঙালির প্রানের উৎসব, প্রানের পূজো, দূর্গা পূজো।। একটা আলাদাই তাৎপর্যময় আমাদের এই শারদ উৎসব, এই দূর্গাপূজা চৈতালি তো তাই মনে করে।। এসবই ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসছিল ও,।হঠাৎই মনে হল, পেছনে কারোর যেন পায়ের শব্দ পেল।। কিন্তু, যতদূর জানে, ও এই শটকার্ট রাস্তাটা ধরার পর, পেছনে আর কেউ ছিল না।। একটু দাঁড়ায়, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখ ও পেছনের দিকে, কই না তো, কেউ নেই।। তাহলে হয়ত মনের ভুল এমনটা ভেবেই আবারও সামনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে।। ফোনের চার্জটাও শেষ, নয়ত বাবাকে ফোন করে বললে, বাবা ওকে এই রাস্তা থেকে এসে নিয়ে যেত।। হয়ত এখন ওর ফোন সুইচ অফ পেয়ে দুশ্চিন্তাও করছেন ভীষণ।। 

চৈতালি আবারও নিজের মনে হাঁটা শুরু করে, এবং আবারও পায়ের শব্দ।। দু তিনজন একসাথে হেঁটে আসতে থাকলে যেমন মনে হয়, অনেকটা তেমনই।। এবার সত্যিই ভয় হয় ওর।। কেন যে শটকার্টটা নিণে গেল! নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে এই মুহূর্তে।। কিন্তু, এই মুহূর্তে ওর করনীয়টাই বা কী! না, যে বা যারাই থাক না কেন, ওকে এই গলির রাস্তা ছেড়ে তারাতারি সামনের মল্লিক পাড়ায় ঢুকতে হবে।। নয়ত এখানে বিপদে পড়লে ওকে বাঁচানোর জন্যে কেউ আসবে না।। বিপদ যে সয়ং আজ ওর কাঁধে নিজের খাঁড়া ধরেছে।। জোরে হাঁটা ধরে ও, আর সেই সাথে সাথেই ও শুনতে পায় অনুশরনকারীদেরও জোরে হাঁটার আওয়াজ।। ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।। আজ কি তাহলে ওর, চরমতম সেই বিপদটাই ঘটে যাবে।। হে মা দূর্গা, তুমি রক্ষা করো।। আমি এখন কি করব মা!! আমাকে বাঁচাও।। আজ আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মা বাবাও শেষ হয়ে যাবে।। হে মা দূর্গা, বাঁচাও মা বাঁচাও।। এক পর্যায়ে এসে ও দৌঁড়াতে শুরু করে।। নিজের সন্মানকে বাঁচানোর, আব্রুকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু ও করে।। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাগ্যও হয়ত ওর সাথ ছেড়ে দেয়।। সামনের একটা ভাঙা কারখানার সামনে গিয়ে পায়ে একটা গাছের ডাল আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।। আর তখনই হালকা হলুদ আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় তিনটে ছায়ামূর্তি।। নড়ে ওঠে কিছুটা, তারপর একজন ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে খুব চাপা গর্জন করে বলে, কি ভেবেছিলি, পালিয়ে বাঁচবি! আজ অবদি আমাদের হাতে যারা পড়েছে কেউ বাঁচেনি, তুইও বাঁচবি না।। তোকেও আমরা তাই হাল করব, যেটা বাকিদের সাথে করি।।

চৈতালি নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে, ওর সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।। পেছনের দিকে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ফেরে, আর দেখে, তিনটে ছেলে, হাতের মদের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।। তাদের মধ্যেই একজন ওরদিকে সরে এসে কথাগুলো বলছে, আর বাকি দুজন হিংস্র নেকড়ের মতো, ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে।। যেন চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে ওর শরীরটাকে।।

চৈতালী ভয়ে আঁতকে ওঠে, বসে বসেই নিজের শরীরটাকে ঘষরে ঘষরে সরাতে থাকে, আর ঠিক তখনই ছেলেটা ওর পা টা চেপে ধরে।। আর দুজন হো হো করে হেসে ওঠে….

এ পাখি তো ভেবেছে পালিয়ে যাবে, আরে তোরা দেখছিস কি, ধর শালীকে।। টেনে নিয়ে চল ওর ভাঙা মন্দিরের পেছনে।। মন্দির টা ভাঙা, কিন্তু পেছনের চাতালটা বেশ খাশা।। মজা নিতে বেশ ভালো লাগবে।। শরীরের জ্বালা টা মিটবে, চল চল ধর শালীকে, দেরী করলেই বিপদ।। কেউ এসে পড়তে পারে।।

চৈতালি আর একটা শেষ চেষ্টা করে, চেঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই একজন এসে ওর মুখ চেপে ধরে, চৈতালি ওদের সামনে হাতজোড় করে, কিন্তু লাভ কিছুই হয়না।। তিনজন মিলে, ওকে আর ওর জিনিসগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে তারাতারি পাসের ঝোঁপঝাড় পাড় করে, ভাঙা কালি মায়ের মন্দিরটায় নিয়ে যায়।। 

মন্দিরের পেছনের চাতালে নিয়ে গিয়ে ফেলে ওর শরীরটাকে।। তারপর টেনে ফেলে ওর বুকের থেকে ওরনাটাকে।। চৈতালি বারবার ছেড়ে দেওয়ার আর্তি জানাতে থাকে, আর ওরা, ওর এই ব্যাকুল আর্তি শুনে আরও হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে।।

ওরা এগিয়ে আসতে থাকে চৈতালি দিকে, আর চৈতালি পিছোতে শুরু করে।। তবে তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা চৈতালির ওপর।। চৈতালি নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওদের থেকে বাঁচার চেষ্টা করে ।। ধস্তাধস্তির জেরে একে পর এক পোশাক ওর থেকে ছিড়ে পড়তে থাকে, আর চৈতালী তবুও প্রানপন লড়ে যেতে থাকে।। আঁচরে কাঁমড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে উভয় পক্ষই, তবে কেউই কাউকে ছেড়ে দেওয়ার নয়।। কিন্তু, শেষ আঘাতটা চৈতালীই হানে ওদের ওপর, হাতের সামনে একটা ইটের টুকরো পেয়ে, সজোরে তার আঘাত বসায় একটি ছেলের মাথায়, এই দৃশ্য দেখে বাকি দুজন এগিয়ে আসলে ও হাতের ইটটা ওদের দিকেও ছুড়ে দেয়।। তারপর মন্দিরের পেছনের চাতাল থেকে সামনের অংশেয় চলে আসে, এবং মায়ের মন্দিরের দরজা, খোলা দেখে, সেখানে ঢুকে যায়।। তবে, তখনও শেষ জন ছুটে আসছে ওর দিকে, আর কোনো পথ না পেয়ে, মায়ের হাতের খর্গটাই টেনে নেয় নিজের হাতে, ওই শয়তান এবং ওর দিকে এগিয়ে আসলে সোজা খর্গের এক কোপ বসায় শয়তানটার মাথায়।।

মুহূর্তেই ছেলেটির দেখ লুটিয়ে পড়ে ওরই সামনে মাটিতে, আর এই বিভৎসতা দেখতে না পেরে ভয়েতে চিৎকার করে ওঠে ও।।

নিজের হাত পা গুলোকে যতটা সম্ভব বুকের মধ্যে চেপে ধরে, একভাবে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে।। তখন অবস্য ওর সামনে পড়ে থাকা ছেলেটার মাথা দিয়ে যুঝিয়ে রক্তের ধারা নেমে আসছে।।

ভয় আশঙ্কায় থর থর করে কাঁপছে চৈতালি।। এই মুহূর্তে ওর যে ঠিক কি করনীয় ও নিজেও জানে না, আর ও বুঝতেও পারছে না যে এই মুহূর্তে ও কি করবে?ওর হাত দিয়ে আজ খুন হয়ে গেছে তিনটে কিন্তু ওই বা কি করত, নিজেকে বাঁচানোর জন্য যদি আজ খুন করেও থাকে তাহলে ওকে সেটা করতেই হতো।। তার কারন একটা মেয়ের কাছে তার সম্মানটাই সবথেকে বেশী আর কিছু নয়।। আবারও ভয়ে কেঁপে ওঠে।।

হঠাৎই ওর মাথায় যেন কেউ হাত রাখে এবং চৈতালি চকিতে ঘুরে তাকায় তার দিকে।। প্রদীপের মৃদু আলোয় ও যা দেখে তা হলো, এক মহিলা মাথাভর্তি সিঁদুর গায়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি খোলা চুলে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।। তবে ওনার চেহারায় রয়েছে অদ্ভুত একটা লাবন্য, একটা অপার্থিব ছটা।। তবে চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত শান্ত, এবং ঠোঁটের কোনায় একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে রয়েছে।।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে মমতাময়ী কন্ঠে বলেন, কিরে মা ভয় পেয়ে গেছিস! ভয় পাস না, কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে।। আজ তুই যা করেছিস সেই একই কাজ একটা সময় দেবী দুর্গা করেছিলেন , আর সেটা কি জানিস? অসুর নিধন!! নারি দেহের প্রতি যতবার কোন অসুরের দৃষ্টি পড়বে, ততবারই তার অন্তিম কাল ঘনিয়ে আসবে।। ঠিক যতবার আমাদের এই সমাজের অসুরেরা, শয়তানেরা নারীদের প্রতি নিজেদের লোলুপ নজর ছুড়ে দেবে ততোবারই তাদের পতন নিশ্চিত হয়ে যাবে, এটা মনে রাখিস।। 

আজ তুই তোর সম্মান রক্ষার্থে এই অসুরদের বধ করছিস, এতে তোর কোন পাপ নেই, এতে তোর কোনো দোষ নেই।। আজ তিন জনকে বদ করেছিস, আর সেই সময় তো সহস্রাধিক অসুরের রক্তে ভেসে গিয়েছিল ভূমি, তান্ডব হয়েছিল সেই সময়, প্রলয় হয়েছিল।।

এরপর উনি আবারও, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।। শান্ত হ মা।। এভাবে ভয় পেলে হবে না।। তারপর ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে ওর দিকে একটা গরদের শাড়ি এগিয়ে দেয় যদিও চৈতালি জানেনা এই শাড়িটা কোথা থেকে এলো এবং ওর এটাও মনে আছে যে ও যখন এই মন্দিরে এসেছিল সেই সময় মন্দিরের ভেতরে বিগ্রহ এবং বিগ্রোহের সামনে একটা প্রদীপ ছাড়া আর কিছু ছিল না কিন্তু তারপরেই--

কি ভাবছিস রে মা আমি কি সেই কথা ভাবিস না আমি যেই হই না কেন আমিও একটি মেয়ে তোরই মতন যা বাড়ি ফিরে যা।। সব ঠিক আছে কিচ্ছু হয়নি আর চিন্তা করছিস কেন একটু পরেই তো সূর্য উঠবে।। একটু পরেই এই অন্ধকার কেটে যাবে আর ফুঠবে নতুন ভোরের আলো।।

একটু পরেই তো সকলের বাড়িতে বেজে উঠবে মায়ের আগমনী গান 

|| ওং জয়ত্বং দেবি চামুণ্ডে জয় ভূতাপহারিণি|

জয় সর্ব গতে দেবি কাল রাত্রি নমোஉস্তুতে ||


|| মধুকৈঠভবিদ্রাবি বিধাত্রু বরদে নমঃ

ওং জয়ন্তী মংগলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী||


|| দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোஉস্তুতে

রূপং দেহি জয়ং দেহি য়শো দেহি দ্বিষো জহি ||


|| মহিষাসুর নির্নাশি ভক্তানাং সুখদে নমঃ|

রূপং দেহি জয়ং দেহি য়শো দেহি দ্বিষো জহি ||


|| রক্ত বীজ বধে দেবি চণ্ড মুণ্ড বিনাশিনি |

রূপং দেহি জয়ং দেহি য়শো দেহি দ্বিষো জহি ||


একটু পরেই সকলের বাড়িতে শোনা যাবে, 

|| ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ,শক্তিরূপেন সংস্থিতা , নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ||


আর কিছু বলতে পারে না চৈতালি।। ও বুঝে গেছে, ওর সামনে যে আছে সে কে!! ভয়েতে আর একটাও শব্দ বের হয়না ওর গলা থেকে।। শুধু অস্ফূটে বেড়িয়ে আসে, ' মা '


●●●


পরেরদিন সকালে যখন ওর জ্ঞান ফিরল তখন মাথার সামনে নিজের মাকে বসে থাকতে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে।। তারপরে একভাবে কাঁদতে থাকে চৈতালি।। গত রাতের বিভৎসতার রেশ এখনো ওর মাথা থেকে যায়নি।। মায়ের কাছে জানতে পারে কালকে রাত্তিরে যখন ওকে খুঁজতে গিয়ে ছিল ওর বাবা এবং পাড়ার আরো কয়েকজন মিলে তখন ওকে কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় না তবে হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একজন মহিলা এসে ওদেরকে বলে মন্দিরের চাতালে একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তখন সেখানে ওর বাবা এবং পাড়ার লোকেরা ওকে উদ্ধার করে।। 

তবে তারপর নিজের মায়ের মুখ থেকে যেই কথাটা শুনেছিল চৈতালি সে কথাটা শুনে ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটি শীতল স্রোত নেবে গেছিল।। আজকে সকালেই নাকি তিনটে ছেলের মৃতদেহ একেবারে লন্ডভন্ড অবস্থায় পাওয়া গেছে ওই জঙ্গলেরই ভেতর থেকে তবে পুলিশ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি যে এই ছেলেগুলোর মৃত্যু কিভাবে হয়েছে?এদেরকে এইরকম নৃশংসভাবে খুন কে করেছে!!

সমাপ্ত

s.chakraborty7612@gmail.com

No comments:

Post a Comment