1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

এও তো খুন


 এও তো খুন

সন্দীপ ঘোষ

      অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শেখর বোস আজ ছুটি পেলেন |  শারীরিক অসুস্থতার জন্য জেলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  ভরতি ছিলেন দিনসাতেক | স্ত্রীসহ বড় ছেলে তিপত্র, বড়বৌ আর তিন-তিনটে নাতি নিয়ে তার ভরা সংসার | যদিও ইতিমধ্যে বড় নাতিটার সাবালক প্রাপ্তি হয়েছে | বাকী দু'টোর এখনও  বছর কয়েক দেরি | তিপত্র'র দু'টো দোকান ,ঘরভাড়া আর তাছাড়া মাস গেলেই  বৌয়ের চাকরি আর বাবার পেনশন----সবমিলিয়ে তিপত্র'র আয়ের অঙ্কটা বেশ মোটা | এই ব্যবস্থাটা শেখরবাবুর নিজেরই হাতে গড়া |  তিনি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বেশ সম্পন্ন ঘরেই | অতএব নো টেনশন, অর্থাত্ ঝাড়া হাত পা | অবশ্য শেখরবাবু এটাই মনে করেন | আসলে সত্যিই কি তাই ? ছোটছেলে অরিত্র 'র প্রেমজ বিবাহ তিনি এবং তার স্ত্রী কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি | ঘরে ঠাঁই হয়নি তার  | শেখরবাবু , ছেলে অরিত্রকে পুরোপুরি ত্যাগ না করলেও বঞ্চনার নিরিখে ত্যাগ করেছেন বলাই যায় | অরিত্র স্ত্রী-কন্যা নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকে | অনেকেই হয়ত মনে করেন প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে বেশ মোটা অংকের রোজগার | কিন্তু না , অরিত্র'র পশার তেমন নেই | তাই ইনকাম সীমিত | দীর্ঘ দশবছর টিউশন পড়িয়ে অল্প সঞ্চয় থেকে এবং ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে দু'কাঠার একটি প্লট কিনে বাড়ির কাজ শুরু করেছে |

           অরিত্র ভালবাসতে জানে, ভাল রাখতে জানে, তাই স্বল্প আয়ের সংসারে স্বামী- স্ত্রী দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে দুই কন্যাকে নিয়ে বেশ আনন্দেই আছে | যেমন শ্রদ্ধাশীল, তেমন স্নেহপ্রবণও বটে সে | আন্তরিকতার স্রোত বইছে তার রক্তে | তার প্রতি ঘটে যাওয়া অবিচারের প্রতিবাদ করেছে  | বারবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তার বাবা-মা | তবুও সে এখনও ভেবে যায়, আর কেউ নয় তো------ 'বাবা-মা যে' | তাই বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি | বৌ সুমনাকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে যায় বাবাকে  দেখতে | বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অরিত্র বুঝতে পেরেছিল---মুখমন্ডলে সুস্থ হয়ে ওঠার  কী নিদারুণ আর্তি , শারীরিক পীড়নকে অবলীলায় হারিয়ে দেওয়ার তীব্র মানসিক শক্তি | তখনও অরিত্র জানেনা এ 'সাধারণ অসুখ' নয় | কি ঘটতে চলেছে জানেন না শেখরবাবু নিজেও |  ফুসফুসে নাকি জল জমেছে | জল বের করে দিলেই বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে , জানে সস্ত্রীক অরিত্র | বেড নেই ,মেঝেতে দেওয়ালের একপাশে বিছানা করে দেওয়া হয়েছে |পাশাপাশি  অন্য রোগীরাও রয়েছে | রয়েছে তাদের আত্মীয়স্বজনরা | শেখরবাবুর বড় ছেলে , মেয়ে-জামাইরা প্রত্যেকেই রয়েছে | বাবার এই দশায় প্রচন্ড কষ্ট হয় অরিত্র'র |

           বাবার বাড়ি ফেরার পর দিন শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে ফোনে খবরটা এল |  চমকে ওঠে অরিত্র | বছর ছয়েক আগে কেমোতে সুস্থ হয়ে ওঠা শেখরবাবু ফের মারণ রোগের শিকার হয়েছেন | নিয়মিত চেক আপ না হওয়ায় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুস- লিভারে | গলার আওয়াজ ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করেছে | অস্থির হয়ে ওঠে অরিত্র | দিদিদের সাথে কথা বলে জানতে পারে রেডিও থেরাপিতে বাবা সাময়িক সুস্থ হবে ঠিকই তবে বেশি দিন বাঁচবে না | তিপত্র'রও ঐ একই মত | সে বলে লাখদুয়েকের ধাক্কা ! কী হবে এতগুলো টাকা খরচা করে ? এই কথা শুনে অরিত্র নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না উত্তেজিত হয়ে ওঠে; বলে; ---- " বাবার নিজের পেনশনের টাকাগুলো কি ভূতে খেয়েছে ? সেগুলো গেল কোথায় ? অসুখটা বাবাকে জানানো হোক , যতদিন বাঁচে বাঁচুক | এ তো খুন |" উত্তর আসে; ----"তোর আছে তো চিকিত্সা করা ! বাবাকে বাঁচা |" বাড়ি বানাতে গিয়ে ব্যাঙ্কলোন করতে হয়েছে অরিত্রকে | তার কোথায়  টাকা ! 

       মেডিকেলে রেডিও থেরাপির ব্যবস্থা আছে কিন্তু শেখরবাবু কিছুতেই ঐ হাসপাতালে যেতে চাইছেন না তার কারন বেডহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ | বার বার বলা হচ্ছিল মেডিকেলে যাবার কথা , কিন্তু রাজি হননি শেখরবাবু | অরিত্র বুঝতে পেরেছিল বাবা তার শেষ অবস্থার কথা জানতে পারলে হাসপাতালে হোক কিংবা নার্সিংহোমে বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করবেন | তাই ওনাকে জানানোই হয়নি আসলে তার কী রোগ হয়েছে | অরিত্র বলার চেষ্টা করেছে, পারেনি, কেউ না কেউ বাধা দিয়েছে | একসময় কথা বন্ধ হয়েছে, চলে গেছে দাঁড়াবার শক্তিটুকু | ক্রমে শয্যাশায়ী | অরিত্র'র কানের কাছে মুখ এনে অনুচ্চারিত নিঃশ্বাসে বলেছেন ;---- "আমার কি হয়েছে ? আমি কি আর বাঁচবোনা ? আমি যে বাঁচতে চাই বাবা, তুই আমাকে বাঁচা |"  বাঁচার আর্তি  অরিত্রর হৃদয়টাকে মুচড়ে দেয় | কী করবে সে ! সে তো কপর্দকশুন্য | অরিত্র ফ্যালফ্যাল করে ক্রমশঃ নিঃস্পন্দ হতে চলা বাবার শরীরটাকে দেখতে থাকে |

sghoshkabi@gmail.com
বাঁকুড়া

No comments:

Post a Comment