1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

একটি বাজে ছেলের গল্প

ছবি  : ইন্টারনেট 

একটি বাজে ছেলের গল্প

সুমন সেন

একটা বিশাল বড় পেন্ডুলামকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে সে। পেন্ডুলাম-এর দুপাশে দুটো বড় বড় পাহাড়ের গুহা। একটা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সুন্দরী মেয়ে, সাদা পোশাক পরা। অন্য গুহাটার সামনে রয়েছে একটা ভয়ংকর দানব; এত্তো লম্বা, এই মোটা মোটা দাঁত; কাছে গেলেই যেন ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে! কিন্তু... ওই মেয়েটার মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তার!

কী করবে বুঝতে পারছে না সে। পেন্ডুলাম-টা তো এত তীব্র গতিতে দুলছে যে, একবার এদিকে গিয়ে পড়ে তো আরেকবার ওদিকে গিয়ে পড়ে – এরকম অবস্থা তার! সে প্রাণপণে চেপে ধরে রয়েছে পেন্ডুলাম। তবে আর কতক্ষণ পারবে জানা নেই। তার হাতের বাঁধন আলগা হচ্ছে আস্তে আস্তে। অবশ হয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। নীচে জ্বলন্ত লাভা টগবগ করে ফুটছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। শরীর দিচ্ছে না আর। যে কোনো একটা দিকে লাফ দিতেই হবে। নয়তো যেতে হবে ফুটন্ত লাভার অতলে।

আশ্চর্য! এতটা চেনা সত্ত্বেও মেয়েটার মুখটা মনে করতে পারছে না কেনো সে? যাক, ওসব ভেবে লাভ নেই এখন! চোখ বন্ধ করে, দিক লক্ষ্য না করেই লাফ দিল সে।

হঠাৎ ঘুম টা ভেঙে গেলো অনিকেত-এর। এত বাজে স্বপ্ন! এত্ত টেনশন! বাপরে! মাথাটা দপ্‌দপ্‌ করছে তার।

রিয়া অনিকেতকে ছেড়ে চলে যাবার পর ৩ বছর কেটে গিয়েছে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত মাঝে মাঝেই এই স্বপ্নটা দেখে অনিকেত। এই স্বপ্নটার উৎস কী? অথবা তার অবচেতন - এই স্বপ্নের মাধ্যমে তাকে কিছু বোঝাতে চাইছে কিনা – কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না সে।

ভালো মেয়ে ছিল রিয়া, ভালো প্রেমিকা ছিল। অনিকেতকে খুব ভালোবাসত। ছোটোবেলা থেকে একইসাথে বড় হয়েছে তারা। একইসাথে খেলেছে, ঘুরেছে, পড়েছে। পরবর্তীকালে প্রেমটাও শুরু হয়েছিল ওভাবেই।

অনিকেতের চোখের সামনেই হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্টটা। সেদিন ফুচ্‌কা খাবার জন্য বায়না করছিল রিয়া। তারপর রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যেতে গিয়ে একটা লড়ি এসে ধাক্কা মেরে দেয় তাকে। তারপর হাসপাতাল। অনিকেতই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফোন করে খবর দিয়েছিল তার বাড়িতে। পরীক্ষা করে দেখা গেল – শরীরের বহু হাড়ে ভাঙ্গন এবং চিড় ধরেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তার মাথা বেঁচে গিয়েছিল, তাতে বিশেষ আঘাত লাগেনি। চিকিৎসা চলছিল। খুব খারাপ অবস্থা থেকেও ক্রমে ক্রমে উন্নতি হচ্ছিল তার। কিন্তু হঠাৎই মাসখানেক পর থেকে শুরু হয় অন্য মুশকিল। মাল্টি-অরগান ফেলিওর। অল্প অল্প করে অনিকেতের চোখের সামনেই মরে গেল রিয়া।

ব্যাস! তারপর থেকেই খেই হারিয়ে গেল অনিকেতের জীবনে। আর কোনোদিনও তার জীবন সাধারণভাবে, সাধারণ গতিতে চলেনি। টি.সি.এস-এর মত কোম্পানীর চাকরিটা ছেড়ে দিল। শুরু করল পাড়ার রকে বসে কিছু উটকো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা। সাথে যোগ হল গাঁজা ও মদের নেশা। তারপর ধরল জুয়া খেলা। প্রচন্ডভাবে জুয়ার নেশাতে পেল তাকে। এলাকার সবথেকে ভদ্র ছেলেদের মধ্যে একজন – অনিকেত চক্রবর্তীর নাম এখন এলাকার সবথেকে বাজে ছেলেদের তালিকায় গন্য হতে শুরু হল। ভদ্রলোকেরা তাকে দেখলে থুথু ফেলতে শুরু করল। তবে তাতে তার কিছু এলোও না আর গেলও না। বুক উঁচিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকল। একবার তো এক অবিবাহিত বয়স্ক টিউশন মাস্টারকে হকি-স্টিক দিয়ে মেরে পা ভেঙ্গে দিল সে। যদিও... মাস্টারটির নামেও কানাঘুষো শোনা যেত – মাস্টার নাকি মেয়ে ছাত্রীদের প্রতি একটু বেশিই সদয়, আবার মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই নাকি ছাত্রীদের ‘মা’ ‘মা’ জড়িয়ে ধরে ভুলভাল জায়গা ছুঁয়ে দিতেন। যাইহোক, ঠ্যাং ভাঙ্গার সুবাদে তিন রাত জেল খাটাও হয়ে যায় অনিকেতের। তারপর তার মা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে তাকে।

অনিকেতের ছোটোবেলা থেকেই ওর বাবা পরলোকগত। হিরের টুকরো ছেলের ইদানিং কালের জীবনযাত্রা দেখে মায়ের বুক ফেটে যায় কষ্টে। রিয়ার ব্যাপারে কিছুই লুকোনো ছিল না অনিকেতের মায়ের কাছে। রিয়ার মৃত্যুর পর অনিকেতের এরকম হাল দেখে ভেবেছিলেন – ছেলের যদি বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে হয়ত ছেলে আবার সুস্থ জীবনযাপন শুরু করবে। এই ভেবে অস্মিতার বাড়ির লোকজনের সাথে কথাও বলে এসেছিলেন তিনি। অস্মিতা পাশের পাড়ায় থাকে। সে মনে মনে ভালোবাসে অনিকেতকে – একথা অনিকেতের মায়ের অজানা নয়। ব্যাপারটা অনিকেতের কর্ণগোচর হতেই অস্মিতার বাড়ি বয়ে তাকে সে এমন গালমন্দ করে এসেছে যে মনের দুঃখে তারপর থেকে অস্মিতা তার মুখের দিকে তাকায় না পর্যন্ত।

প্রিয়জন বলে তেমন আর কেউ নেই অনিকেতের। ইদানিং যেসব বন্ধুদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, তারা তো বরাবরই তাকে ঈর্ষা করত। এখনও অনিকেতের জীবনটা নরকের পথে নিয়ে যাবার সহকারী হয়ে তারা মনে মনে উৎফুল্লই হচ্ছে হয়তো। কাছের আত্মীয়-স্বজনরাও তাকে এখন আর দেখতে পারে না। কুলাঙ্গার উপাধি পেয়েছে সে। সকলের কাছেই অনিকেত এখন একটা থার্ড-ক্লাস ছেলে। শুধুমাত্র মায়ের কাছেই ছেলে আগেও নয়নের মণি ছিল, আজও তাই আছে। আরেকটা মানুষ আছে, যে কিনা অনিকেত দুনিয়ার এক নম্বর খারাপ ছেলে হয়ে গেলেও তাকে একই ভাবে ভালোবেসে যাবে। সে হল – দেবশ্রী, অনিকেতের পাতানো বোন।

দেবশ্রী অনিকেতদের উল্টোদিকের বাড়িতেই ভাড়া থাকে। দরিদ্র বাড়ির মেয়ে। কিন্তু দারুণ মেধাবী। ওর বাবা একটা পাঁড় মাতাল। প্রতিদিন মদ খেয়ে এসে ওর মাকে মারধোর করে। বহু বছর ধরেই তারা ওই বাড়িটাতে ভাড়া আছে। অনিকেত তখন ছোটো ছিল যখন তারা প্রথমবারের মত ওই পাড়ায় এলো। অনিকেতের কোনো বোন নেই বলে সে অনেকবার মায়ের কাছে দুঃখ করেছে। দেবশ্রীরা ওদের পাড়াতে আসতেই ওর মা দেবশ্রীকে দেখিয়ে অনিকেতকে বলেছিল – ‘ওই দেখ তোর বোন এসেছে।’ তারপরেই অনিকেতের দেবশ্রীকে বোন পাতানো। রাখি-পূর্ণিমাতে রাখি, ভাইফোঁটায় ফোঁটা দেওয়া ছাড়াও – অনিকেতের মা দেবশ্রীকে নিজের মেয়ের মতনই স্নেহ করেন। প্রথম প্রথম তো দেবশ্রী মাতাল বাবার কাছ থেকে ভয়ে পালিয়ে আসত অনিকেতের মায়ের কাছে। পরবর্তীকালে তার দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে অনিকেতদের বাড়িতে, থাকা-খাওয়া-পড়া সব চলতে থাকে অনিকেতের সাথে। অনিকেতের মা-ও ছেলের জন্য কিছু কিনলে সমানভাবে দেবশ্রীর জন্যও কিছু কিনতেন। পরবর্তীকালে দেবশ্রীর পড়াশোনার ব্যাপারেও যথাসাধ্য সাহায্য করেন তারা। ভাই-বোনের সম্পর্কের পত্তন থেকেই তাদের মধ্যে সত্যিকারের ভাই-বোনের মতো ভালোবাসা-খুনসুটি – এসবের কোনোদিন অভাব হয়নি। এখনও মা ব্যাতীত সারা পৃথিবী জুড়ে একমাত্র এই মানুষটিই অনিকেতের শুভাকাঙ্খী, যে কিনা দাদার ভালোর জন্য সবকিছু করতে পারে।

এম.এ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে দেবশ্রী। বহুবার নানারকম পন্থা অবলম্বন করেছে সে দাদার মাদক দ্রব্য আর জুয়ার নেশা ছাড়াতে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। সাময়িক ক্ষণের জন্য জয়লাভ করলেও পরে তার দাদা আবার ফিরে গিয়েছে বিপথে। একবার তো অনিকেত জুয়াতে হেরে তার সাধের রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটাকেই বেচে দিল। আরেকবার জুয়ায় হেরে গুন্ডাদের হাতে মার খাওয়ার আগে তার মা নিজের গয়না বন্ধক রেখে তাকে ছাড়িয়ে আনল। দেবশ্রী এসব কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। মনে-প্রাণে চায় দাদার অসৎ সঙ্গ ছাড়াতে। সে নিজে একজন হার্ট পেশেন্ট। কয়েক মাস আগেই ধরা পড়েছে তার হৃদপিন্ডের ফুটোটা। সম্পূর্ণভাবে সারাতে হলে অপারেশন করতে হবে। হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন। কিন্তু তাতে প্রচুর খরচ। অত টাকা নেই তাদের। আপাতত ওষুধ খেয়েই চলছে তার জীবন। তবে, সে জোরে কথা বলতে পারে না, ভারি কাজ করতে পারে না, বেশি চিন্তা করতেও পারে না। তবুও দাদার ভালোর জন্য সে বিভিন্ন নেশামুক্তি সেন্টারে যোগাযোগ করেছে, ওষুধ এনে খাইয়েছে দাদাকে। কিন্তু তাতে তেমন কিছু প্রভাব পড়েনি অনিকেতের উপর। কয়েকজন সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথেও কথা বলেছে দেবশ্রী। তার বিশ্বাস – দাদাকে নেশা করা ছাড়িয়ে যদি ঠিকঠাক কাউন্সেলিং করানো হয়, তাহলে দাদা্র জীবন হয়ত আবার সঠিক স্রোতে বয়ে চলবে।

হঠাৎ করেই সেদিন ঘটে গেল সেই অঘটনটা। সেদিন সাইকিয়াট্রিস্ট দীপক হাজরার সাথে কথা বলে কলকাতা থেকে ফিরছিল দেবশ্রী। ফিরতে বেশ রাতই হয়ে গিয়েছিল। ওরকম সময় অনিকেত রকে বসে বন্ধুদের সাথে জুয়ার বাজি লড়ে। দূর থেকে সে দেখতে পেল একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে আর কাছেই একটা টাটা-সুমো গাড়ি থেকে কয়েকটা ছেলে নেমে তার চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে। খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে মেয়েটাকে। পঞ্চা গুন্ডার দল। মেয়েটাকে ভালো করে দেখল অনিকেত – দেবশ্রী। খেলা ছেড়ে অনিকেত উঠে গেল ওদের দিকে। ওদের মধ্যে একজন দেবশ্রীর হাত ধরে টান মারল।

“ওই ওই” –বলে অনিকেত সোজা গিয়ে ধাক্কা মারল সেই ছেলেটার বুকে। কিছুটা দূরে ছিট্‌কে পড়ল ছেলেটা।

মনে হচ্ছে এতে অপমানিত বোধ করেছে ছেলেটা। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। প্রচন্ড পরিমাণে নেশা করে রয়েছে ছেলেটা, চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল, পা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। উঠেই অন্যকিছু না ভেবে সোজা জামার নীচ থেকে একটা দেশী কাট্টা বের করে অনিকেতের বুকের উপর ঠেকিয়ে ট্রিগারে চালিয়ে দেয় সে। দুম করে একটা আওয়াজের সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়েই রাস্তার পাশে লুটিয়ে পড়ে অনিকেত। কাট্টা হাতে ছেলেটা যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে কাজটা করে ফেলেছে। যেন কিছু ভর করেছিল তার উপর। যখন সম্বিৎ ফিরল, সে দেখতে পেল – অদূরেই রকে কতকগুলো ছেলে চোখ বড় বড় করে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছে। কাট্টা হাতে ছেলেটা ওদের দিক লক্ষ্য করে একটা ঈশারা করল। প্রথমে বন্দুকের নলটা নিজের ঠোঁটের সামনে লম্বভাবে রাখল, তারপর সেটিকে ঘুরিয়ে নিজের গলার এপাশ থেকে ওপাশ টেনে নিয়ে গেল। রকে বসে থাকা ছেলেরা মনে হয় ঈশারাটা বুঝে গেছে, তারা মৃদু ঘাড় নাড়াল। আর সাথে সাথেই পঞ্চা গুন্ডার দল হুটোপাটি করে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

অনিকেত বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তার পাশের মাটি। দেবশ্রীও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কিছুটা দূরেই। রকে বসে থাকা কয়েকজন উঠে চলে গেল নিজেদের বাড়ির দিকে, আর কয়েকজন মনে অনেক দ্বন্দ্ব নিয়ে এক পা দু’ পা করে এগিয়ে এল অনিকেতের দিকে। নিজেদের মধ্যে কিছু ভয়ার্ত কথোপকথনের পর হাত দিল অনিকেতের গায়ে। পালস্‌ চলছে, মরেনি এখনও। তার মানে গুলিটা হার্টে লাগেনি। দেবশ্রীরও পালস্‌ চলছে তবে খুব ধীর গতিতে, মনে হচ্ছে এক্ষণি বন্ধ হয়ে যাবে।

সকলেই কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে। কী করা উচিত বুঝতে পারছে না, নিজেরাই নিজেদের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। পঞ্চা গুন্ডা সবাইকে শেষ করে দেবে! পরিবার সমেত শেষ করে দেবে! আর পরিত্রাণ নেই! কিন্তু তাদের বন্ধু আর ভগিনীসম -দুজনকে এভাবে ফেলে রেখে তারা চলে যেতে পারে না!

কোনোরকমে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা হল। দুজনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। পুলিশে খবর দেওয়া হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুজনেরই সংকটপূর্ণ অবস্থা। দুজনের কাউকেই হয়ত বাঁচানো যাবে না। হার্টের রোগী দেবশ্রীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ধরা পড়ে। আর অনিকেতের মাথায় শুদ্ধ রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছোতে পারছে না, ব্রেইন ডেড্‌। সুতরাং ক্লিনিকালি সে মৃত। বেঁচে ফেরার আর কোনো আশা নেই বললেই চলে অনিকেতের ক্ষেত্রে।

আজ নিঃস্ব অনিকেতের মা। তার প্রিয় দুটি প্রাণ দুই বিছানায় শুয়ে, মৃত্যুর দোরগোড়ায়। হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নেন অনিকেতের মা। তিনি ডাক্তারদের জানান তিনি ছেলের দেহ দান করতে চান। আর তার হৃদপিন্ডটি যেন প্রতিস্থাপিত করা হয় দেবশ্রীর মধ্যে।

বছর তিনেক আগে যখন মাল্টি-অরগান ফেলিওর হয়ে রিয়া মারা যায়, তখন অনিকেত তার মাকে জানিয়েছিল – সে কখনও মারা গেলে যেন তার দেহ দান করে দেওয়া হয়। আজ অনিকেতের মায়ের দুঃখ হচ্ছে না। তাঁর ছেলের চোখ, কিডনি, স্কিন টিস্যু সহ ভালো থাকা প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপিত হবে তারই মত অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মধ্যে; আর তাদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে অনিকেত। সবথেকে আনন্দের ব্যাপারটা হল - তার সবথেকে কাছের অঙ্গটি থাকবে তাঁর আরেক মেয়ের কাছে। নতুন হার্ট নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে দেবশ্রীর। যে সবসময় তাঁর কাছেই থাকবে। ছেলের মনকে সারাজীবন খুব কাছ থেকেই অনুভব করতে পারবেন তিনি!

***

একটা বিশাল বড় পেন্ডুলামকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে অনিকেত। পেন্ডুলাম-এর দুপাশে দুটো বড় বড় পাহাড়ের গুহা। একটা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সুন্দরী মেয়ে, সাদা পোশাক পরা। অন্য গুহাটার সামনে রয়েছে একটা ভয়ংকর দানব; এত্তো লম্বা, এই মোটা মোটা দাঁত; কাছে গেলেই যেন ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে! কিন্তু... ওই মেয়েটার মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তার!

কি করবে বুঝতে পারছে না সে। পেন্ডুলাম-টা তো এত তীব্র গতিতে দুলছে যে, একবার এদিকে গিয়ে পড়ে তো একবার ওদিকে গিয়ে পড়ে – এরকম অবস্থা তার! সে প্রাণপণে চেপে ধরে রয়েছে পেন্ডুলাম। তবে আর কতক্ষণ পারবে জানা নেই। তার হাতের বাঁধন আলগা হচ্ছে আস্তে আস্তে। অবশ হয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। নীচে জ্বলন্ত লাভা টগবগ করে ফুটছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। শরীর দিচ্ছে না আর। যে কোনো একটা দিকে লাফ দিতেই হবে। নয়তো যেতে হবে ফুটন্ত লাভার অতলে।

হঠাৎ মেয়েটার দিকে ভালো করে দেখল অনিকেত। কি ব্যাপার! আজ চিনতে পেরেছে অনিকেত ওই মেয়েটাকে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার রিয়া তার দিকেই হাসিমুখ করে তাকিয়ে আছে দু’হাত বাড়িয়ে। স্মিত হাসি খেলে গেল অনিকেতের মুখেও। চোখ বন্ধ করে রিয়ার দিক লক্ষ্য করে লাফ দিল সে।

আজ খুব ভালো লাগছে অনিকেতের। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। এরকম মানসিক তৃপ্তি সে যেন কতকাল অনুভব করেনি!

suman.sen303@gmail.com

1 comment:

  1. খুব ভালো লাগল গল্পটা পড়ে

    ReplyDelete