1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

রক্তঋণ

 


রক্তঋণ 

দেবানন্দ মুখোপাধ্যায়

হেলো কে বলছেন?”

 মোবাইলে অচেনা নম্বর দেখলে সাধারণতঃ ধরেন না শমীক দত্তশমীক দত্ত ,একটা বাজার চলতি,শুধু বাজার চলতি বললে ভুল হবে,বাংলা সাহিত্য জগতের এক দিক নির্দেশক মাসিক সাহিত্য পত্রিকাঅক্ষরপ্রেমীর সম্পাদক তিনি,কত ধরণের ফোন সারা দিনে যে ধরতে হয় তার ইয়ত্তা নেই কেউ লেখা পাঠিয়ে খবর নেবার চেষ্টা করে ,কেউ কোনো লেখার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতে ,কেউ  শুধু শুধুই ফোন করেযদিও পত্রিকাতে স্পষ্ট করে লেখাই থাকে কেউ অফিসের নম্বর ছাড়া  যোগাযোগ করবেন না,করেও না কেউ অবশ্য

তবে এই ফোনটার ক্ষেত্রে আলাদা এটা একদমই নিজস্ব নম্বর ,এটা জানে বাড়ির লোক ,প্রেসের কয়েকজন ,কিছু বাছাই করা ঘনিষ্ঠ লেখক বন্ধুবান্ধব কাজেই ফোনটা যখন বেজে উঠলো তখন খুব ব্যস্ততার মধ্যেও ফোনটা ধরেই     ললেন শমীক

কে?”

শমীক দত্ত বলছেন ?”

বলছিআপনি কে বলছেন?”

আমি তমলুকের মঈনুদ্দিন আলি বলছিকিছুদিন আগেই বোনের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসেছি ,যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি,সত্যি বলতে কি আপনার ফোন নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছি তাছাড়া আপনার এখন খুব নামডাক ,এই সব ভেবে খোঁজ করার চেষ্টাও করিনি আজ হঠাৎ করে আপনার নম্বরটা পেলাম ,আসলে যে চাচার বাড়িতে উঠেছি কালকেই জানলাম তার ছেলে আপনার পত্রিকার অফিসে কাজ করে ,এনায়েৎ নাম ওরতা কাল আপনার অফিসে গিয়েছিলাম আপনি ছিলেননা , তাই আজ ফোন করছি

অন্যমনস্কভাবে কথাগুলো শুনেই যাচ্ছিল শমীক আর ভাবার চেষ্টা করছিল কার গলাসাধারনতঃ এতক্ষন ধরে অচেনা কারোর কথা শোনার অভ্যাস নেই ,নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলকে মইনুদ্দিন আলি ?”

আমাকে ভুলেন গেলে চাতক ভাই ?অবশ্য অনেক বছর যোগাযোগ নেই  ঠিকই

এক ঝটকায় শমীক বাইশ বছর ফিরে গেল দুর শালা মনি বলবি তো !গলাতো বোঝাই যায়না তা এত আপনি আজ্ঞে করলে বুঝবোই বা কি করে ? তুই কোথায় ?চলে আয় বাড়িতে ঠিকানা বলে দিচ্ছি লিখে নে ,আর আমার নংটাই বা পেলি কোথায় ?”

যাক চিনেছিস,না চেনারই কথা,কতদিন পরে যোগাযোগ বল ? তুই আজ অন্যমনস্ক আছিস মনে হয় ,তোকে বললাম না এনায়েৎ যে তোর পত্রিকার একজন প্রধান লোক সে আমার চাচার ছেলে তা ছাড়া তোর যা এখন নামডাক তাতে তোর ঠিকানা পাওয়া কি এমন কথা ?নং তো এনায়েতই দিয়েছে ,প্রথমে অবশ্য দিতে চায়নি,একটু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল

সব ছাড় ,তুই চলে আয় ,এনায়েতের বাড়িতে  গাড়ি পাঠাচ্ছি আজ আমি বাড়িতেই আছি এবং টোটালি ফ্রি কতদিন পরে চাতক ভাই ডাকটা শুনলাম রে !আমার আর তর সইছে না তোকে দেখার জন্য আয় জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে

দেখ আড্ডা হয়তো মারা যাবে না ,বললাম না একটা বিপদে পড়েছি ,তোর সাহায্য চাই গাড়ি পাঠাতে হবে না ,আমি ঘন্টা দুয়ের পৌঁছে যাবো তোর কাছে

আয় আয় আমার আর ধৈর্য থাকছে না

রাশভারী শমীক দত্ত এখন গুনগুন করে গান করছেপ্যার কিয়া তো ডরণা ক্যায়াসত্যি কি তাই ?সে তো ভয়কে জয় করতে পারেনি ,চোরের মতো চুপিচুপি পালিয়ে এসেছিলতমলুকে একসাথে মনির সাথে পড়া ,একসাথে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা ,সিগারেট খাওয়া ,সব সঅঅব মনের পর্দায় সিনেমার মতো ভেসে উঠছে একে একেএকই পাড়ায় বাস করার সুবাদে ক্লাসের অন্যান্য ছেলেদের থেকে মনির সাথেই ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিলো শমীকের ,কিন্তু একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা যেনো সব সময় তাদের মধ্যে টানা ছিলো দুটো পরিবারের তরফ থেকেই,বিশেষ করে শমীকের বাড়ি থেকে৷মনির বাড়িতেই ওর ফুফাতো বোন নুরীর সাথে দেখাতখন শমীক কলেজে উঠবো উঠবো করছে আর নুরী ক্লাস টেনে প্রথম দর্শনেই ভালোলাগা তা থেকে রোজ নুরীকে দেখা একটা প্যাশানে দাঁড়িয়ে গেছিলো শমীকের,নুরীরও ভালো লাগতো ব্যাপারটা মনি প্রথম প্রথম একটু বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয় ,তবে দুজনকেই সাবধান করে দিয়েছিলো কি লাভ সব ভেবে?কোনো বাড়ি থেকেই সম্পর্ক মেনে নেবে না ,শেষে দুজনেই কষ্ট পাবে কিন্তু সব ক্ষেত্রে যা হয় ,কেউই পিছিয়ে আসতে পারেনি শমীকের মনিদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হোলো ,তবুও শমীক নুরীর স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো ছুটির সময় ,তখন থেকেই তো মনি ওকেচাতক ভাইবলে ডাকতে শুরু করেছিলো আজ আবার সেই ডাক তার স্মৃতির অতল তল থেকে অতীতকে তার সামনে এনে হাজির করলো

শেষ পর্যন্ত এক রকম বাধ্য হয়েই শমীকের বাবা শমীককে কলকাতায় মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেনআস্তে আস্তে তমলুকের সাথে যোগাযোগ কমতে শুরু করলো,বাংলা অনার্স পড়ার সুবাদে অনেক বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শিক্ষক,সাহিত্যিক ,লিটল ম্যাগাজিনের লোকজনের সাথে পরিচয় হওয়া ,তাদের সাথে সাহিত্য নিয়ে আলাপ আলোচনা ,কফিহাউসে আড্ডা সব মিলিয়ে জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করলোএইভাবে চলছিল বেশ ,কিন্তু পুরোনো স্মৃতি বিশেষ করে নুরীকে কি অত সহজে ভোলা যায় ?মাঝে মাঝে চিঠি লিখতো ,তারপর সেই যোগাযোগটাও বন্ধ হয়ে গেলো এর মধ্যে একটু একটু করে লেখালেখির জগতে তখন শমীক দত্তর নামটা ছড়াচ্ছিলো ,সে সময় একটা উঠতি অথচ বাজারে নাম করছে রকম প্রকাশনা সংস্থা তাকে প্রস্তাব দিলো ওদের একটা মাসিক সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক হবার জন্য পত্রিকাটা আহামরি কিছু নয় ,কাটতিও কিছু সে রকম নেই ,তবে শমীকের ষষ্ঠ ঈন্দ্রিয় বললো নিয়ে নিতে ব্যাস্ তারপর শুধু উত্থানের কাহিনিনিজের পরিশ্রম ,লেখকদের পিছনে লেগে থেকে ভালো লেখা আদায় করা,আর কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা সব মিলিয়ে অক্ষরপ্রেমী বাংলার এক নম্বর মাসিক পত্রিকা ,সে কাটতির দিক দিয়েই হোক বা সাহিত্যগুনের দিক দিয়েই হোক শব্দের খেলা,নতুন কাগজের গন্ধ,প্রুফ দেখার ,নামী লেখকদের পিছনে দৌড়ানোর খাটনি খাটতে খাটতে কখন যেবছরের পর বছর পার হয়ে গেলো,কখন যে চুলে পাক ধরে গেলো বুঝতেও পারেনি শমীকআজ একবার নিজেকে আয়নায় দেখার ইচ্ছে হোলো,পরমুহূর্তেই ভাবলো থাক্ নতুন করে কিই বা দেখার আছে বয়সের ছাপ পরা মুখটা ছাড়া?আসল জীবন তো সে তমলুকেই ফেলে এসেছে!

মনি,কতদিন পরে দেখা হোলো রেকেমন আছিস বল?আয় ভিতরে আয়দরজা খুলে শমীক বলেযদিও সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে মঈনুদ্দিন বা ছোটোবেলার মনি বলে কষ্টই হচ্ছেকোথায় সেই ধবধবে   ফর্সা গায়ের রং ,উজ্জ্বল একজোড়া চোখ?সময় সব কিছুই কেড়ে নিয়েছে মনিরতোবড়ানো গাল,থুতনিতে অবিন্যস্ত দাড়ি,একজন ক্ষয়াটে চেহারার বিধ্বস্ত লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেশুধু মৃদু আতরের গন্ধ জানান দিচ্ছে মনির অস্তিত্বঅবস্থা ওদের পড়ে গেছিলো বহু বহুদিন আগেই কানে এসেছিলো,তাই বলে মনিকে এরকম দেখবে ভাবেনি শমীক

চেহারা দেখেই তো বুঝতে পারছিস কেমন আছি !”

কি খাবি বল ,আগে চা আনতে বলিআজ দুপুরের খাবার খেয়ে যাবি একেবারেঅবশ্য আরও খুশী হবো যদি থেকে যাস

দাঁড়া দাঁড়া ,খাবার সময় এখন নেই রে ,চা বল শুধু একটু কাজেই এসেছি,কলকাতায় তো চেনাশোনা সে রকম কেউ নেই,তোর সাথেও বহুদিন যোগাযোগ নেইএনায়েতের বাবা আমাদের এক দুর সম্পর্কের আত্মীয় ,তাই ওদের ওখানে ওঠা এনায়েতের কাছে হঠাৎই তোর ঠিকানা আর ফোন নং পেলামকলকাতায় তুই চলে এলি,নাম করলি সব খবরই একটু আধটু পেয়েছিতোকে বলতেও লজ্জা লাগছে ,তোদের ব্যাপারটা নিয়ে বাড়িতে একটা অন্তর্কলহ শুরু হয়েছিলোসেই সুযোগে চাচারা একরকম জোর করেই  বাড়ি ব্যাবসা ভাগাভাগি করে আমাদের পথে বসিয়ে দিলোআব্বু তো এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে মারাই  গেলেন কিছুদিনের মধ্যেইসত্যি বলছি এতোদিন পরে তোর কাছে দরকারে আসতে কাল থেকেই কেমন যেনো সংকোচ হচ্ছিলোভাবছিলাম তুই হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই বদলে গেছিস চিনতে পারবি কি না,পাত্তা দিবি কি না এইসব  দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনের মধ্যে নিয়ে ফোন করেছিলাম

না রে আমি তোদের শুভেচ্ছায় যাই হই না কেনো তোর কাছে সেইচাতক ভাই’- রয়ে গেছি যদিও সেইচাতককলকাতায় এসে হারিয়ে গেছেএখন আমার ধ্যান জ্ঞান সব এই পত্রিকাটিতা কি দরকার বলছিলি?”

আর বলিস না নুরীর খুব বিপদআজকেই সন্ধেতে ওর একটা জরুরি অপারেশন হবে বাইপাশে রুবির পাশেমাদার কেয়ারনার্সিংহোমে মেয়েলি রোগ ,অনেকদিনের পোষা তমলুকে দেখিয়েছিলাম,সেই ডাক্তারবাবুই এখানে অপারেশন করবেনসমস্যা হচ্ছে রক্ত লাগবে চার বোতল,দু বোতল যোগাড় হয়েছে আমরাই দিয়েছি,গ্রুপটা রেয়ার বি নেগেটিভ তো ,পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তেহয়তো জানিস না আমাদের ভাগাভাগির পরেও নুরী আমাদের কাছে থেকেই পড়াশুনো করতোতারপর তমলুকের এক প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক  স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি পায়ভালোই চলছিলো ,কিন্তু

কয়েক বছর পর থেকেই রক্তাল্পতায় ভুগতে শুরু করলোপ্রথম প্রথম গা করেনি,তোর তো অনেক জানাশোনা দ্যাখ না যদি পারিস এই শেষ দুবছর খুব ভুগছিলো

ঠিক আছে দাঁড়া আমার পরিচিত একজনকে ফোন করে দিচ্ছি সব বিষয়ে খুব দক্ষতুই ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবেতা নুরীর স্বামী ছেলে মেয়েরা কোথায়?এনায়েতের বাড়িতে?”

বিয়ে করলে তবে তো স্বামী,ছেলে মেয়ে!অনেক বলে কয়েও বিয়ে করতে রাজি হয়নি

শমীক দুচারটে ফোন করে এদিক ওদিক ,তারপর বলেশোন তোকে একটা ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিচ্ছি,রীতেশ হালদার নাম আমার খুব পরিচিত একটা ভলান্টারি ব্লাড ডোনার এ্যসোশিয়েশনের সম্পাদক, বললো হয়ে যাবে কখন লাগবে?”

বিকেল চারটার মধ্যে জমা দিতে বলেছেঅপারেশন সন্ধে সাতটায়নার্সিংহোমও চেষ্টা করেছে কিন্তু কাল সকালের আগে পাবেনা

ঠিক আছে আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তোকে রীতেশের কাছে নিয়ে যাবে তোর জন্য অপেক্ষা করবেকিছু টিফিন করে বেরিয়ে পড়আর নার্সিংহোম পৌঁছে গাড়িটা পাঠিয়ে দিস,আমি আটটার মধ্যে হাজির হয়ে যাবোআর একটা কথা রাতে আমার সাথে আমার বাড়িতে ফিরবি ,জমিয়ে আড্ডা মারা যাবেকত কথা জমা হয়ে আছে বল তো?সব ঠিক হয়ে যাবে ,চিন্তা করিস না

তুই একটুও পাল্টাসনি চাতক ভাইঠিক আছে তুই আয় নার্সিংহোমে,ভালোয় ভালোয় অপারেশন হয়ে গেলে তোর বাড়িতেই থাকবো আজ রাতেতোর পরিবারের সাথে তো দেখাই করতে পারলাম না

নিজেকে,পত্রিকাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে বিয়ের আর সময় পেলাম কই?যাক্ সে সব কথা রাতে হবে,তুই খেয়ে বের তাড়াতাড়ি

মনি একটা অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শমীকের দিকে,শমীক দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল

মনি অনেকক্ষন হল চলে গেছেশমীক ধীরে সুস্থে উঠে আলমারির লকারটা খুললো,একটা বিবর্ণ ডায়েরির মধ্য থেকে ততোধিক বিবর্ণ একটা ক্ষয়ে যাওয়া, ফেটে যাওয়া হলদেটে কাগজ বের করলোলেখাটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও এখনও বোঝা যায়,সম্ভবত রক্ত দিয়ে লেখা সেই চিরাচরিত শব্দবন্ধতোমাকে ভালোবাসিসতেরো বছরের নুরীর লেখাযদিও তখন সে চাতকের মত অপেক্ষা করতো এই কথাটা ওর মুখ থেকে শোনার জন্য ,কিন্তু এর বেশি এগানোর সাহস দুজনের কারোরই হয়নিতারপর তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে কাপুরুষের মতো পালিয়েই এলো কলকাতায়দুফোঁটা রক্ত দিয়ে যে তখন চিঠি লিখেছিলো আজ তার বাঁচার জন্য চার বোতল রক্তের দরকার ,সেই জন্য এতো দৌড়ঝাঁপ

সেদিন দুফোঁটা রক্তকে অস্বীকার করতে পেরেছিলো শমীক,আজ চার বোতল রক্তকে অস্বীকার করতে পারলো কৈ?ভালোবাসার থেকেও কি জীবন বড়?

iamdebananda@gmail.com


2 comments: