![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
লজ্জা
পল্লব পত্রকার
দিনে দিনে জমে ওঠা ক্ষোভের মতো আকাশে ধূসর
মেঘের ছোট-বড় পাহাড়। পশ্চিমে ঢলে পড়া ফ্যাকাশে লাল সূর্য। তাদের সাক্ষী রেখে
নারায়ন বললেন, 'শুনেছ বিশু! এবার ভোটে নাকি কমল বারুই দাঁড়াচ্ছে!'
স্কুলমাঠের ধারে সবুজ ঘাসের গালিচায় নারায়নের পাশে বসেছিল বিশু। বয়সে
নারায়নের চেয়ে অনেকটা ছোট। মাঠে হুটোপুটি করা কচিকাঁচাদের দিকে তাকিয়েছিল আনমনে।
নারায়নের কথায় ঘাড় ঘোরালো। 'সে কি নারানদা! কমলের নামে তো দেয়াল লেখা দেখিনি।'
--
দেয়াল লিখতে আর কতক্ষণ! দু-তিনদিনেই সব
ভরিয়ে দেবে!
--
তা যা বলেছ! এখন তো প্রফেশনাল আর্টিস্ট দিয়ে
সবকিছু করায়!
একটু থেমে নারায়ন বলেন,
'আমাদের বিপ্লব কাল কমলের খবরটা দিল!'
নারায়নের ছেলে বিপ্লব। নারায়নদের পার্টি থেকে সে-ও ভোটে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি করে। স্কুল সার্ভিস কমিশন গড়ে ওঠার আগের বছর
নারায়নের সুপারিশে তার চাকরি। নারায়ন নিজেও এক সময় এই স্কুলে পড়াতেন। বছর
পাঁচেক হল অবসর নিয়েছেন।
--
কমলের টিকিট পেতে এত দেরি হল কেন? ভোটের ডেট তো গত
মাসেই জানিয়ে দিয়েছে! বিশু জানতে চাইল।
--
ওদের পার্টিতে দশটা গোষ্ঠী! হাজার আকচা আকচি!
তাছাড়া কমলের পেটে বিদ্যে বুদ্ধি তেমন কিছু নেই! তাই হয়তো…!
--
কি করে আর থাকবে বলো! মাতাল বাপটা অকালে মরল!
ফাইভ না সিক্স পর্যন্ত পড়ে ছেলেটা হাওড়ার লেদ কারখানায় কাজে লেগে গেল!
নারায়ন এবার কটমট করে বিশুর দিকে তাকালেন। 'তুমিও বুঝি
কমলদের পার্টিতে জয়েন করেছ! তাই কমলের হয়ে ঝোল টানছ!'
--
না না! পাড়ার ছেলে! সবাই জানে! আমিও তাই…!
হেসে ব্যাপারটা সহজ করার চেষ্টা করে বিশু। বুঝতে পারে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে!
গোমড়া মুখে বসে থাকেন নারায়ন।
বৈকালিক আড্ডায় আজ শুধু দুজন। যে কোনও কারণেই হোক অন্য সদস্যরা -- বিমান, সুদীপ্ত, শুকদেব, কেউ আসেননি। তাই
আড্ডা ঠিক জমছে না। নারায়নের মত বিমান,
সুদীপ্ত, শুকদেবও ভালো
চাকরি করতেন। অবসরকালে এককালীন মোটা টাকা পেয়েছেন। সেইসঙ্গে মাসিক পেনশনের
সুবিধা। বিশুর অবস্থা টাই যা ভালো নয়। ছোট যে কারখানায় সে কাজ করত, কিছুদিন হল তা
বন্ধ। তার বউ কাবেরী স্কুলে মিড ডে মিলের রাঁধুনি। নারায়নের দয়াতেই চাকরিটা
হয়েছিল।
বিমানরা অাগে নারায়নদের সমর্থক ছিলেন। এখন আর নেই। বরং তাদের ভুলত্রুটিগুলোর
ব্যাপারে মাঝে মাঝে মুখ খোলেন।
বিশুরও ইচ্ছে করে। কিন্তু সাহস হয়না।
মিনিটখানেক বসে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নারায়ন বলেন, 'কি যুগ এলো! কমল
পঞ্চায়েতে দাঁড়াচ্ছে! জিতে প্রধানও হতে পারে! একটা মুকখুর কথায় এলাকার লোককে
উঠতে বসতে হবে!'
--
মনে রাখবে এটা ঘোর কলি! শিক্ষিত, ভালো মানুষের কি
আর ঠাঁই আছে জগতে!
বিশুর কথার কোনও উত্তর দিলেন না নারায়ন। তাঁকে চুপ করে
থাকতে দেখে বিশু বলে,
'তোমাদের আমলটাই ভালো ছিল নারানদা!'
--
সে আর বুঝছে কজন! এই সেদিন পর্যন্ত পার্টি
অফিসে সারাক্ষণ লোক গমগম করত! এখন সন্ধেবেলা বাতি জ্বালাবারও কেউ নেই!
মিটিং-মিছিলে পাঁচ-সাত জনের বেশি লোক থাকে না! ভোটের কত আগে থেকে বিপ্লবের নাম
ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তো... একটা অলুক্ষণে কথা বলতে গিয়েও
চেপে গেলেন নারায়ন।
সেটা পূরণ করল বিশু। 'না না এবার বোধহয় তোমাদের আর জামানত জব্দ হবে না!' বলেই জিভ কাটল।
আবার বেফাঁস কথা!
তাই আবার মলম লাগানোর চেষ্টা। 'কমলদের অবস্থা মোটেই ভালো নয়,
বুঝলে নারানদা! সব্বাই তো বলাবলি করছে!...'
নারায়নের মুখে আবার কুলুপ।
অগত্যা বিশুও মাঠের দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকল।
হঠাৎ পুরনো একটা ঘটনা বিশুর মনে পড়ে গেল। কাবেরীর মুখেই শোনা।
মাস্টারি করলেও নারায়ন স্কুলে থাকতেন সামান্যই। তাঁদের পার্টির তখন রমরমা।
দুদিন ছাড়া মিটিং মিছিল জমায়েত। লোকজন জড়ো করে কলকাতা ছোটা। নেতাদের বক্তৃতা
শোনা। ছেলেদের পড়াশোনা শিকেয় উঠলেও কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।
বেশিরভাগ দিনের মতো নারায়ন একদিন স্কুলে এসে সই করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন
পার্টির কাজে। বিকেলে ফিরলেন যখন ছুটি হব হব। ঘটনাচক্রে হেডস্যার ছাড়া অন্য
শিক্ষকরাও সেদিন আসতে পারেননি। হেডস্যার একাই সামলাচ্ছিলেন স্কুল। নারায়ন স্কুলে
ঢুকতেই কমল এগিয়ে এসে বলেছিল,
'আপনি ছিলেন না খুব ভালো হয়েছে স্যার! সারাদিন
আমরা মাঠে খেলেছি!' সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন নারায়ন। পরক্ষনেই অবশ্য হাসতে হাসতে
বলেছিলেন, 'ভালো করেছিস! রোজ পড়াশোনা করার দরকার কি!'
সেই কমল আজ নেতা!
হাওড়ার চাকরি ছেড়ে বছর চারেক আগে সে বাড়ির লাগোয়া জমিতে কারখানা করেছে। দু'তিনটে মেশিন
বসিয়ে অর্ডার এনে কয়েকজন লেবারকে নিয়ে কাজ করে। ভালোই তার অায়। বসতবাড়িটা আগে
একতলা ছিল। এখন দুতলা করিয়েছে। গতবছর পাশের গ্রামের একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে
বিয়ে। একটা ফুটফুটে ছেলেও হয়েছে। প্রায়ই তো মোটর সাইকেলে বউ ছেলেকে চড়িয়ে
এদিক ওদিক যায়।
নিজের পরিবার নিয়েই সে শুধু ব্যস্ত থাকেনা। অন্যদেরও সাধ্যমত সাহায্য করে।
পাড়ার কেউ হঠাৎ অসুস্থ,
হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কমলকে
ডাকাডাকি। কারও টানাটানির সংসারে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে না। কমল চাঁদা তুলে
সাহায্য করছে। কেউ মারা গেলে শবদাহ করতে হবে। কমল দলবল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাজির।
তবে মস্তানি, গাজোয়ারি এসব যে তারা করে না,
তা নয়! কদিন আগে গণেশ কয়ালকে গাছে বেঁধে কি
পিটুনিটাই না দিল! গণেশের আলু পেঁয়াজের ব্যবসা। বাজারে ভালোই চলে। কিন্তু কিছুতেই
সে তার বুড়ি মার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে না। বেচারা এর ওর দরজায় হাত পেতে পেট
চালায়। গণেশের অজুহাত,
মা ভালো নয়। বউয়ের সঙ্গে ঠিকঠাক চলতে
পারেনা। বুড়ি একটু মুখরা টাইপের। তাই বলে গর্ভধারিনী মাকে একেবারে বাতিল! সেরকম
হলে মার আলাদা হাঁড়ি করে দিতে হবে! মা যে একেবারে অথর্ব তা তো নয়! নিজেরটুকু
নিজেই ফুটিয়ে নিতে পারে।
মাকে নিয়ে গণেশের বউ দিব্যি এখন চলছে।
গত বছর পঞ্চায়েত থেকে যখন পাড়ার রাস্তা চওড়া করার প্রস্তাব এলো গ্রামের
মিটিংয়ে অনেকেই বেঁকে বসল। কারণ একেবারে রাস্তার ধারে যাদের বাড়ি, প্রত্যেককেই
কিছু না কিছু জমি ছেড়ে দিতে হবে। মাখন মন্ডল তাদেরই একজন। গলা তুলে বলল, 'কি দরকার রাস্তা
চওড়া করার! যেমন চলছে চলুক না! কারোর তো অসুবিধা হচ্ছে না!' কমল সঙ্গে সঙ্গে
তেরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। 'কী আজেবাজে বকছ মাখনকাকা! চিরকাল যা আছে তাই চলবে নাকি! মানুষ উন্নতি করবে না? তুমি তো সারা
জীবন সাইকেল চড়ে কাটিয়ে দিলে! তোমার ব্যাটা তাহলে বাইক কিনেছে কেন? রাস্তা চওড়া
হলে আমরাই শুধু যাতায়াত করব?
তোমরা যাবে না? হঠাৎ কেউ অসুস্থ
হলে ট্যাস্কি ঢোকানো যায় না! ভ্যান রিস্কা এলেও ঝামেলা! আর বর্ষাকালে তো পবলেমের
শেষ থাকে না!'
কমলের ধাতানির চোটে মাখনরা
আর ট্যা ফো করতে পারেনি। রাস্তা চওড়া করার
ব্যবস্থা হয়েছে।
ভোটে কমলরাই জিতল। সন্ধ্যায় ফল বেরোতেই বিশাল করে শোভাযাত্রা। সেইসঙ্গে
রাত্রে মাংস ভাতের ভোজ। ঢুকু ঢুকুর ব্যবস্থা। বিপক্ষ দলেরও দু একজন চোখ কান বুঁজে
বসে পড়ল সেখানে।
বিপ্লবের শুধু জামানত জব্দ হয়নি। হাতেগোনা সে কটা মাত্র ভোট পেয়েছে।
ভোট মিটে যাবার মাসখানেক পর নতুন গ্রাম-সদস্যদের ভোটে কমল উপপ্রধান হল।
স্কুল মাঠের বৈকালিক আড্ডায় সেদিন আলোচনা চলছিল।
--
মানুষ আসলে কাজের লোক চায়, বুঝলে বিমানদা!
শুকদেব বললেন।
--
নিশ্চয়ই! কে কত শিক্ষিত, কি এসে যায়
তাতে! সাধারণ মানুষ দরকার অদরকারে যাকে পাবে,
তাকেই ভোট দেবে। তাঁকে সমর্থন করলেন বিমান।
কথাগুলো যে বিপ্লবকে ঠেস দিয়ে বলা,
সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হল না। কারণ
মাস্টারির পাশাপাশি বিপ্লব প্রচুর পড়াশোনা করে। আর চায়ের দোকানে ফুক ফুক সিগারেট
টানতে টানতে মাঝে মাঝে বাক্যের ফানুস ওড়ায়।
বিমানের কথার প্রতিবাদ করতে গেলেন নারায়ন। মানুষ শুধু রাজনীতি করবে! পড়াশোনা
সংস্কৃতিচর্চা…
সুদীপ্ত বললেন, 'কমলরা লোকের আপদ বিপদে থাকে। তাই হাত উজাড় করে মানুষ তাদের ভোট দিয়েছে।
তোমার দলের ছেলেরা কার উপকারে লেগেছে?'
উপকারের প্রসঙ্গে না গিয়ে নারায়ন বললেন, 'শোনো, ফ্রী অ্যান্ড
ফেয়ার যদি ইলেকশন হতো,
তাহলে এতো কম ভোট আমরা পেতাম না!'
--
চিরকালই একটু আধটু রিগিং টিগিং হয় নারানদা!
তোমাদের আমলেও হয়েছে! শুকদেবের গলায় শ্লেষ।
--
কিন্তু এত বাড়াবাড়ি! আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি
থেকে ভোট দিতে এল! বুথে গিয়ে শুনল,
তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে! ভাবা যায়! ...
নারায়ন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে শুকদেব বললেন, 'কেন! তোমার
মেয়ে এখানে ভোট দেবে কেন?'
--
ওখানকার ভোটার লিস্টে এখনও নাম ওঠেনি, তাই!
শুকদেব বললেন, 'তোমাদের সময় তো বিরোধীরা ভোটে দাঁড়াতেই সাহস পেত না! কেউ দাঁড়ালে বুথে
এজেন্ট দিতে পারত না! সে সব কি ভুলে গেলে?'
আলোচনাটা ক্রমশঃই তেতো হয়ে যাচ্ছে দেখে বিশু এবার মুখ খুলল। 'তোমরা শোনো একটা
ঘটনা। আমার বউ কাল বলছিল। পরশুদিন দুপুর বেলা কমল হঠাৎ স্কুলে হাজির! চোখগুলো
জবাফুলের মতো লাল। নিশ্চয়ই টানটু ফান্টু করেছিল! যাইহোক! একাই এসে চেঁচাতে শুরু
করল। মাস্টাররা সব কোথায় গেল?
এ কি! হেডমাস্টার তুমি একা কেন? অন্যরা কেউ
আসেনি? তোমাদের সই করার খাতাটা দেখি একবার! বলতে বলতে ঢুকে গেল হেডমাস্টারের ঘরে।
টেবিল থেকে খাতা নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল। এই তো সবার সই আছে! তার মানে অন্যরা
কেটে পড়েছে! তাহলে কদিন ধরে যা শুনছি সব সত্যি?
হেডমাস্টার আমতা আমতা করতে লাগলেন। আসলে ছাত্রছাত্রীরা তেমন আসছে না! কিছুদিন
আগে পরীক্ষা শেষ হল! রেজাল্ট বেরল। নতুন ক্লাসে ভর্তি শুরু হয়েছে!
কোনও অজুহাত শুনতে চাই না! আমরা কি সব মরে গেছি নাকি? আরও জোরে
চেঁচাতে থাকল কমল। মাস গেলে গাদা গাদা সব মাইনে পাবে! আর পড়াতে হলেই ওজর-আপত্তি!
আমরা মুকখু বলে কি আমাদের ছেলেমেয়েগুলোও মুকখু থাকবে! কাল যদি দেখি কেলাস হচ্ছে
না, সব কটাকে ধরে আচ্ছাসে কেলাবো ! তারপর হাতে হাতে হারিকেন ধরিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে
দেবো।' এটুকু বলেই হি হি করে হাসতে থাকে বিশু। হাসতে হাসতেই বলে, 'কি হয়েছে জানো!
আজ সাকুল্যে দশ-বারোজন পড়ুয়া ইস্কুল এসেছিল। তাদেরই আলাদা আলাদা কেলাসে বিকেল
পর্যন্ত পড়িয়েছে মাস্টাররা!'
বিশুর সঙ্গেই বিমান,
সুদীপ্ত, শুকদেব হাসতে
লাগলেন। হা হা হা ...
নারায়ন শুধু গোমড়া মুখে।
হঠাৎ বিশুর মনে হল,
এই রে! সে আবার বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে!
বিপ্লব-ই তো ফাঁকিবাজদের শিরোমনি! দুদিন ছাড়া স্কুল কেটে অ্যাকাডেমি, নন্দন, বইমেলা করে
বেড়ায়! নারানদা খুব চটে যাচ্ছেন! চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে! কটমট করে তাকিয়ে আছেন
তার দিকে! ভাবা মাত্রই বিশুর হাসি উবে গেল। কি করা যায়! কি করা যায়! নারানদার
ক্ষতে মলম লাগাতে হবে! এক্ষুনি! কি মলম! কি মলম!
যা ব্বাবা! কোনও মলমের কথাই তো মনে পড়ছে না!
No comments:
Post a Comment