1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বিনু

 

ছবি  : ইন্টারনেট

বিনু

নুজহাত  ইসলাম  নৌশিন

          বিনুর রাগ লাগছে। ভয়াবহ রাগ, কিন্তু প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। সভ্য সমাজে থাকার অনেক ঝামেলা। মুখের উপর ফটাফট কথা বললে বেয়াদব তকমা শোনা লাগে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা কিছু না বললে আরো পেয়ে বসবে। আর কথাটা বলতে গিয়েই  নীল রঙের দোতলা বাড়িতে একটা ছোটখাটো কালবৈশাখী হয়ে গেলো।

   –দেখেছিস? তোর মেয়ে মুখে মুখে তর্ক করে। আমি খারাপটা কি বলেছি, এ্যা।

নীলুফা বেগম বিনুর নানিকে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন না। এই মহিলা প্রত্যেকটা কথার শেষে এ্যা  জাতীয় প্রশ্নবোধক ঝুলিয়ে রাখে। নিজের মা বলে কিছু বলতেও পারেন না কঠিন করে। কিন্তু নাতনির  সাথে এ কেমন ব্যবহার!

   বিনু কথাটা এমন ভাবে বলতে চায়নি। কিন্তু মাসের এই কয়েকটা দিন কারো ভালো কথা ও অসহ্য রকম লাগে। মনে হয়, আমায় একটু একা থাকতে দাও। সব সময় তো তোমাদের বকবকানি শুনছিই – কিন্তু কপাল খারাপ ,এই সময় অকারণ ফালতু কথা গুলো আরো বেশি শুনতে হয়।  আজ একটু আগে যেমন শুনলো আর সহ্য করতে না পেরে উত্তর দেওয়ায় একটা ঝামেলা হল ।

    সুন্দর সকালটা যেন ছুরির  ফলা দিয়ে কেউ  কেটে দিয়েছে। তীব্র ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙার পর দেখল যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।  সাদা ফুল তোলা বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। তার মানে অনেকক্ষণ হল ঘটনাটা ঘটেছে। প্রথম কয়েকটা দিন ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে থাকে বিনুর ।

  আচ্ছা সবার বেলায় কি ব্যথার তীব্রতা এমন থাকে – ভাবতে ভাবতে তলপেটে হাত দিয়ে চেপে ধরল। নাহ্, বাড়াবাড়ি রকম লাগছে। আশেপাশে কেউ নেই যে একটা হুট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি এনে দিবে। নিজে এই কাজটা করতে গেলে রান্নাঘর অবধি যাওয়া লাগবে, আর  বাকিদের চোখে পড়বে ।

     সকাল নয়টার দিকে আজহার সাহেব – বিনুর বাবা সোফার রুমে খবরের কাগজটা উল্টে – পাল্টে দেখেন।  রান্নাঘরে যেতে হলে এখন বিনুকে তার বাবার সামনে দিয়ে যেতে হবে। জামার পিছনে দাগ নিয়ে যাওয়া – অস্বস্তি কর। আবার এই শীতের সকালে গোসল করা আরেক কাণ্ড – তাতেও তো গরম পানি লাগছেই।

   সাতপাঁচ ভেবে বিনু বিছানাতেই পড়ে রইল। তার মায়ের তো এক বার এই ঘরে উঁকি দেওয়ার কথা – আসবে নিশ্চয়ই।  

  আসল। তবে বিনুর মা নয়। বিনুর নানি। তসবি পড়তে পড়তে বিনুর রুমে ঢুকে যেই বিছানায় বসে ছিলেন, তার কিছুক্ষণ পর  কাক চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুললেন।  

  ‘ আহহা- বিছানাটা নষ্ট করে দিলি। সেদিন মাত্র সাদা চাদরটা বিছানো হয়েছে। ছিঃ,ছিঃ – নাপাক। তুই  তো এখন নাপাক। আর আমি এই বিছানায় বসে পড়লাম। আল্লাহ, এখন কি হবে – ‘

  বিনুর মাথায় খুন চড়ে গেল। সকাল থেকে ব্যথা, তারপর আবার এসব কথা। তাও নিজের মায়ের মার মুখে। তার কাছে বিছানার চাদরটাই বড় হয়ে গেল! 

 বিনু রাগ সামলাতে না পেরে শোয়া থেকে বসে পড়ল। কেবল এই কথাটাই বলল, ‘ আপনার কি কখনো এসব হয়নি! নারীত্ব নিয়ে তো সন্দেহে পড়ে গেলাম। ‘ শুধু এই কথাটাই হাসির ছলে বলেছে রাগ সামলে।  তারপরই শুরু হয়ে গেল – “এ্যাঁ,  তোর মেয়ে আমায় এসব কী বলল নীলু! আমি নাকি নারী না! তোদের তাহলে পেটে ধরল কে নীলু! মাইয়া মানুষ বেশি শিক্ষিত করলে এমনই হয়। নাপাক বলতেই  ছ্যাঁত করে উঠল। নাপাক কে তো নাপাকই বলমু। হাজার বার নাপাক। আহা, আহা – আমায় আবার গোসল করা লাগবে – ‘’বলে গজ গজ করে চলে গেলেন।

 আর বিনু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

 

   ভয়াবহ কান্না পাচ্ছে বিনুর।  সকালের ঝামেলাটা তার মা সামলে নিয়েছে। কিন্তু মন থেকে নাপাক  এই শব্দটা দূর করতে পারছে না। দুই হাজার একুশ সালেও এমন কথা শুনতে হল।নারী  শরীরের স্বাভাবিক একটা নিয়ম  নিয়ে - আর আরেক প্রায় বৃদ্ধা হয়ে যাওয়া নানি এমন কথা বলতে পারল চিৎকার করে!  বাসায় বাবা, ভাই ওরা শুনে কি ভেবেছে কে জানে। হুহু করে কান্নার ঢেউ  আসছে।

   প্রতিবারই এমন কিছু না কিছু ঝামেলা হয় পিরিয়ড এর সময়টাতে। এই মনটা ভালো থাকে কিছুক্ষণ পরেই কোথা থেকে একদলা মেঘ মনে ভর করে মনে।  সব বিষে বিষাদময় লাগে। অথচ পিরিয়ড নিয়ে টিভি বিজ্ঞাপন গুলোতে দেখা যায় মেয়েরা কত চিলি মুডে থাকে।  এর কতটা সত্যি কে জানে – বিনু শুধু জানে তার এই সময় ভয়াবহ একলা লাগে আর কান্না পায় । একটা চাপা রাগ কোথা থেকে এসে মাসের কয়েকটা দিন বিনুকে মরিয়া করে তোলে।

   

   ‘তোমার কি হয়েছে বলবে? ‘

ভার্সিটিতে যাওয়ার পথে বিনুর পাশে হেঁটে রাতুল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

বিনু ভেতরে ভেতরে দ্বিধায় মরে যাচ্ছে। কি বলবে!  কেন তার এই মন খারাপ রাতুল জানতে চাইছে। অবশ্য জানতে চাওয়ার কারণ আছে।  গত দুই দিন ধরে বিনু ভার্সিটিতে আসেনি, রাতুলের কোনো কল ধরেনি। এক বার ধরে ও অকারণ রাগ দেখিয়ে কেটে দিয়েছে।

রাতুল শুধু অবাক হয়েছে। বিনু খুব ঠান্ডা, সে খুব কমই রাগ দেখায়। অথচ সেদিন বলল,’ কেন আমায় বিরক্ত করছো। ‘ এই কথাটাই রাতুলকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।  

  ‘কি হলো, চুপ কেনো?  বলো। ‘

বিনু আমতা আমতা করে নিচু স্বরে বলল, ‘ আমার শরীরটা ভালো ছিল না।  সরি।‘

‘আহ্,কি হয়েছে তাই তো জানতে চাইছি। আমি কি সত্যি তোমায় বিরক্ত করেছিলাম? ‘

‘সরি – বললাম তো। ‘

‘আমায় বলতে কি অসুবিধা! কি এমন হয়েছিল যে – আমায় বললে বিরক্ত করছি। অথচ তুমি কেন ক্লাসে আসোনি তাই জানতে চেয়েছিলাম – ‘ মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো রাতুলের।

    বিনু মনে মনে ভাবল । কি সমস্যা বলতে – এটা তো কোনো ছোঁয়াছে রোগ না যে গোপন করে রাখা লাগবে।  

 হাঁটার গতি থামিয়ে বিনু বলল, ‘পিরিয়ড।‘

‘আরে সেকেন্ড পিরিয়ড এখনো শুরু হয়নি তো। শাহানা ম্যামের ক্লাস দশটা কুড়িতে তো। ‘

‘গাধা, মেয়েদের মাসে মাসে হয় যেটা সেটার কথা বলছি।পিরিয়ড। ‘

  রাতুল কিছুক্ষণ চুপ করে হেসে বলল, ‘ এটা নিয়ে এত অস্বস্তি পাওয়ার কি আছে? ফোনে একটা টেক্সট করলেই পারতে। খামোখা কতগুলো ধমক খেলাম। ভাবলাম ব্রেকআপ বুঝি করে দাও। তোমার ভালো লাগাটা শুধু জানাও – খারাপ লাগাটা আজ ও জানাতে শেখলে না।  আমি তো তোমার সহযোগী হতে চাই। ‘

  বিনু ইতস্তত করে বলল, ‘ না, মানে। নানি এসময় বলে নাপাক, এই সেই।তুমি আবার কি ভাবো –‘

রাতুল একগাল হেসে বলল,  ‘ তোমার নানিকে বলে দিও এই হিসেব করলে সারা পৃথিবীর মানুষই নাপাক। প্রকৃতির ডাকে সাড়া তো তোমার নানিকেও দিতে হয়।বর্জ্য গুলো তো আমাদের শরীরই বহন করে তাই না! ‘

  বিনু হেসে দিল।  হাসলে বিনুর গালে ডাবল টোল খায়। আজ পিরিয়ডের চতুর্থ দিন । ব্যথাকে চাপিয়ে কি একটা সুখ ভর করছে। রাতুল তাকে বুঝতে পেরেছে।

  ‘আমি কি মহারানীর হাতটা ধরতে পারি। ‘

কোনো কথা না বলে চুপচাপ বিনু হাতটা বাড়িয়ে দিল। একেই বলে বোধহয় সুখের মতো অসুখ।

noushinnozhat@gmail.com

No comments:

Post a Comment