ছবি : ইন্টারনেট |
ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে দু-চার কথা
যা আমি জানি
পল্লব পত্রকার
ধর্ম শোষিত মানুষের জীবনে আফিম কিনা তা নিয়ে বিতর্ক
চলতেই পারে। তবে ধর্ম যে বহাল তবিয়তে আছে তা আমাদের মানতেই হবে। পৃথিবীর কিছু মানুষ
(১৫.৫৮%) নিজেদের নাস্তিক বা ধর্মহীন বলে পরিচয় দিলেও এটা সত্যি যে সিংহভাগ মানুষ
এখনও নিজেদের অন্যান্য পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়টাও আঁকড়ে আছেন। কেউ হিন্দু
(১৫.১৬%), কেউ খ্রিস্টান (৩১.১১%), কেউ ইসলাম (২৪.৯%),
কেউ বৌদ্ধ (৬.৬২%) -- আরো বেশ কিছু ধর্মীয় পরিচয়ে গরীয়ান। এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ
মানুষ অলৌকিকত্বে, অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করেন। মনে করেন, সর্বশক্তিমান বিধাতা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। ফলে ধর্মের অস্তিত্ব ভুলে
থেকে সমাজজীবনের কথা আমরা ভাবতেই পারিনা।
আর সংস্কৃতি
তো আমাদের মজ্জায় মজ্জায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অণু-পরমাণুতে। সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কোনো বোধবুদ্ধি- সম্পন্ন মানুষ জীবনে পূর্ণতা
পেতে পারেন না। আরণ্যক জীবন থেকে শুরু করে অতি আধুনিক এই যুগের সর্বক্ষেত্রেই সংস্কৃতির
আধিপত্য। সাহিত্য, শিল্প, অংকন, ভাস্কর্য, নাটক, গান এসব ছাড়া আমরা কি সমাজ কল্পনা করতে পারি! সৃজন-কর্মে সবাই
আমরা পারঙ্গম নই নিশ্চয়ই। কিন্তু এক বা একাধিক বিষয়ের রসাস্বাদনে অনাগ্রহী খুব কম
জনই। পাশ্চাত্য হোক বা প্রাচ্য -- সর্বত্রই এই মানব ঐতিহ্য। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি,
পাবলো পিকাসো, যামিনী রায় অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলালের মতো অঙ্কনশিল্পীদের
বাদ দিয়ে আমরা আমাদের এদেশের বা বিশ্বের ইতিহাস রচনা করতে পারি না। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো,
রামকিঙ্কর বেইজ, সোমনাথ হোড়ের মত ভাস্কর অথবা তানসেন, মোৎসার্টের মতো সঙ্গীতশিল্পী, সফোক্লিস, স্কাইলাস, ইউরিপিদিস, শেক্সপিয়ার, বার্নার্ড শ, কালিদাস, ভবভূতির মতো নাট্যব্যক্তিত্বদের
বাদ দিয়েও আমাদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বৌদ্ধ সহজিয়ারাই
তো রচনা করেছিলেন চর্যাপদ। চৈতন্য ভাব-আন্দোলনের যুগেই সম্ভব হয়েছিল বৈষ্ণব সাহিত্যের
উৎকৃষ্ট সম্ভার। শক্তি সাধনার চূড়ান্ত পর্বে কমলাকান্ত আর রামপ্রসাদের অতুলন ভক্তি
সংগীত। রবীন্দ্রনাথের সৃজন সম্ভারের
উজ্জ্বলতম কীর্তি যে সঙ্গীতমালা তার সিংহভাগও পূজা পর্যায়ের। গীতবিতানে গানের যে তালিকা
সেখানে মোটামুটি ভাবে দেখা যাচ্ছে প্রায় দেড় হাজার গানের মধ্যে পূজা পর্যায়ের ৬১৭;
স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র, আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের যথাক্রমে ৪৬, ৩৯৫, ২৮৩, ১৪০ এবং ২১টি। শুধু কি তাই! কবিগুরুর
অন্যান্য রচনা -- অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সর্বত্রই তাঁর আধ্যাত্মিক বোধ
এবং বুদ্ধির দীপ্ত প্রকাশ।
শুধু গান বা
কবিতা নয়। দেশে দেশে যে সব অজস্র স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি তারও অধিকাংশের প্রেরণা ধর্ম।
সুপ্রাচীন মঠ, মন্দির, মসজিদ এখনও মানুষকে মোহিত করে।
তার দেওয়াল-গাত্রের অংকন গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের। কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট
মন্দির অথবা ভারতবর্ষের খাজুরহো বা কোনার্ক মন্দিরের কথা ইতিহাস কি ভুলতে পারে!
সংস্কৃতির
অন্যতম অঙ্গ যে উৎসব সেটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই। অন্তত ভারতবর্ষে। ত্রিপুরার ঘুড়ি
উৎসব, ডান্ডি দরবার; উড়িষ্যার রথযাত্রা, কোনারক উৎসব; ঝারখান্ড ও বিহারের ছটপুজো, আসমের বিহু, মহারাষ্ট্রের গণেশ চতুর্থী, নাগপঞ্চমী, তামিলনাড়ুর পোঙ্গল, উত্তরপ্রদেশের রামনবমী,
মধ্যপ্রদেশের তানসেন সংগীত উৎসব, গোয়ার কার্নিভাল, পঞ্জাবের বৈশাখী, লোহরি, কেরালার ওনাম এদেশের উৎসবগুলির
মধ্যে অন্যতম প্রধান। কোনও সন্দেহ নেই।
আমাদের বাঙালি
জীবনে দুর্গোৎসবের ভূমিকা অপরিহার্য। এটি যতখানি 'ধর্মীয়' ঠিক ততখানি বা তার চেয়েও বেশী সাংস্কৃতিক। আমরা ফুল-বেলপাতা ধূপ-ধুনো মন্ত্র-তন্ত্রে
যতটা আগ্রহী, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী মূর্তির শিল্পসুষমায়,
আলোর ঝিকিমিকিতে, মন্ডপের নান্দনিকতায়, নতুন গান কবিতা গল্প
উপন্যাসের শারদ সম্ভারে। মানুষের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে।
ঈদ্ল্ ফিতর, ইদুজ্জোহা, ক্রিসমাস ডে-তেও তাই। শুধু মুসলিম
বা খ্রিস্টানদের মধ্যে অনুষ্ঠানগুলি আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। সব ধর্মের বাঙালির মধ্যে
উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী দিনেও পড়বে। উৎসব-কেন্দ্রিক মানুষের সমাবেশ মন্দ
লাগে না। একাকীত্বের অদ্ভুত আঁধারে এই সম্মেলন একান্ত দরকারি। (মহামারীর এই ভয়ঙ্কর
দিনগুলোয় অবশ্যই নয়। নিশ্চয়ই আমরা কোভিড বিধি মেনে চলবো সবাই।)
ধর্ম আর ধর্মান্ধতা
কখনওই এক নয়। লোকে ধর্ম করুন। কিন্তু ধর্মান্ধ যেন না হন। পরকালের কথা ভাবতে ভাবতে
যেন ইহকালের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি বিসর্জন না দেন। শুধু
আত্মচিন্তা, আত্মচর্চাই যেন পেয়ে না বসে আমাদের। সবই পূর্বজন্মের
কর্মের ফল বলে ন্যায়-অন্যায় বোধটা যেন আমরা না হারাই। রাস্তাঘাটে কতজনকেই দেখা যায়
দু-এক টাকার জন্য রিক্সাওলার সাথে লড়াই করছেন। অথচ স্ত্রী সন্তানের জন্য হাজার হাজার
টাকা খরচ করে মুহুর্মুহু জামা জুতা কিনছেন। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিলাসিতা একটু
কমিয়ে কেন আমরা দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবো না! কেন এগুলো ধর্ম এবং সংস্কৃতির অঙ্গ
হবে না! এসবই তো মানবিকতার দায়। মনুষ্যত্বের দায়। সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার কথা পরে
ভাবা যাবে। আপাতত বাড়ির কাজের লোক, কাগজের লোক দুধ দেবার,
জল দেবার লোকগুলোর কথাই ভাবি। তাতেই অনেক কাজ হবে।
ধর্ম যেমন
শুধু পরলোক-সর্বস্ব হবে না, সংস্কৃতিও হবে না শুধু মুনাফা-সর্বস্ব।
এ দুটিরই প্রধান উদ্দেশ্য হবে মানুষের মঙ্গল, মানুষের ভালো। যে ধর্ম
মানুষের হৃদয়কে পাষাণ করে দেয়, সে ধর্ম ধর্মই নয়। তার বিনষ্টি
অবশ্যম্ভাবী। আবার যে সংস্কৃতি শুধুই এন্টারটেইনিং, চটুল, তাৎক্ষণিক প্রয়োজনটুকু মেটায়, কালের বিচারে তার মুল্য কতটুকু!
অতি আধুনিক গান সাহিত্য সম্ভারের কটা সৃষ্টি স্থায়ী ছাপ ফেলছে আমাদের মনে! কটা গল্প
উপন্যাসের নাম আমরা মনে রেখেছি বিগত কয়েক বছরের সাহিত্য পাঠ করে! অবশ্য এই সমস্যা
আজকের নয়, চিরকালের। কালস্রোতে সবই ভেসে যায়। টিকে থাকে হাতে
গোনা মাত্র কয়েকটা!
প্রকৃত ধর্মবোধ
থাকলে সংস্কৃতি বোধটাও পরিণতি পায়। যার ধর্মবোধের ছিটেফোঁটা নেই, সেই তো তারস্বরে মাইক চালিয়ে, ডিজে চালিয়ে দায়িত্ববোধহীন
পুজো-আচ্চা করবে। হসপিটালের পাশ দিয়ে বাজনা বাজিয়ে প্রতিমা ভাসান করতে যাবে! সারা
রাত ধরে হরি সংকীর্তন অথবা 'ইসলামী জলসা' করে মানুষের কান ঝালাপালা করে ছাড়বে! আরও বেশি উৎসাহিত হলেই মন্দির মসজিদ গির্জা
ধুলিস্যাৎ করতে জোট বাঁধবে! বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভাঙবে। ভারতে বাবরি মসজিদ। মানুষ
রক্তস্নান করবে! মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অবমাননা ঘটিয়ে ডেকে আনবে হাড়হিম করা অন্ধকার।
নিশ্চয়ই
আমরা এসব চাইনা। চাই সুস্থ সবল সুন্দর জীবন। সবাই যাতে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারেন
-- সে রকম পরিবেশ। এর জন্য যেমন চাই মানবধর্মে বিশ্বাস, তেমনি চাই সুস্থ সংস্কৃতির
আত্মীকরণ। জীবনবোধের প্রকৃত উন্মেষ। এটা ঘটলেই আমরা বুঝতে পারব, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক। ঐতিহ্যের প্রতি আসবে আমাদের সশ্রদ্ধ আগ্রহ। আসলে ধর্ম ও সংস্কৃতি পাশাপাশি চলে। হাত ধরাধরি
করে চলে। একটাকে বাদ দিয়ে আর একটার অস্তিত্ব প্রায় অসম্ভব। ধর্মহীন সংস্কৃতি যেমন
ঐতিহ্য-বিমুখ, সংস্কৃতিহীন ধর্মও তেমনই কখনও সুফলপ্রসূ নয়। যে ধর্ম
যত বেশি সংস্কৃতিকে আত্মীকরণ করে সে ততো বেশি সজীব, প্রাণবন্ত। এর ব্যত্যয়
ঘটলেই ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা। গোঁড়ামির আনাগোনা। ধর্মান্ধতা। মৌলবাদ।
সংস্কৃতিকে
আত্মীকরণের শিক্ষা আজ তাই সব ধর্মের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। ধর্ম যত সংস্কৃত
হবে ততই আমাদের মঙ্গল। ধর্ম যত সুন্দর হবে, সৃজনশীল হবে ততই মানুষের
হৃদয়ের কাছাকাছি আসবে। তখন মানুষ আর অসহিষ্ণু হবে না। নিয়মতান্ত্রিকতার গড্ডল প্রবাহে
গা ভাসাবে না। শুধু নিজের ধর্মই ভালো, নিজেরাই ভালো অন্য সবাই খারাপ,
খুব খারাপ এই ভাবনায় ক্লেদাক্ত হবে না। তখন রাস্তা জুড়ে নমাজ পড়া এবং পুজো প্যান্ডেল
গড়া দুটোকেই আমরা সমান চোখে দেখব। নিন্দে-প্রশংসা যাই করি না কেন, দুটোরই করব। একদেশদর্শীতা পেয়ে বসবে না আমাদের। নির্মল হৃদয়ে আমরা উপভোগ করব প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের
মাধুর্য। চিত্তের প্রাচুর্যে বিত্তের সমস্ত দীনতা দূর হয়ে যাবে। শাঁখের ধ্বনি আর আজানের
সুর দুটোই সুখশ্রাব্য হয়ে উঠবে। শারদোৎসবে ঢাকের বাজনায় আমরা উদ্বেল হব। মনের আনন্দে
বুক ভরে নেব শিউলির সুবাস। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখব শ্বেতশুভ্র কাশফুলের হিল্লোল।
শুধু নীল আকাশে নয়, মনের আকাশেও ভেসে বেড়াবে সাদা মেঘের অসংখ্য ভেলা। আমরা
পৌঁছে যাব এক স্বপ্ন জগতে, যেখানে একই সঙ্গে মানুষ আধুনিক
এবং আধ্যাত্মিক। শুধু বৈষয়িক উন্নতিতেই নয়, নৈতিক উত্তরণেও সদা সচেষ্ট,
তন্নিষ্ঠ। সুন্দর এবং সহনশীল। পরস্পরকে ভালোবেসে কাছে টেনে পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে
আন্তরিক, আনন্দময়।
No comments:
Post a Comment