1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

অনেকের কাটেনি আঁধার

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

অনেকের কাটেনি আঁধার 

রানা জামান

 

বিবিসির পর আকাশবীণা কলিকাতায় সংবাদটা শুনে ক্যাম্পের সবাই প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষণে খুশিতে লাফ দিয়ে দাঁড়ালেন। হাতের অস্ত্রগুলো নিয়ে বাইরে এসে আকাশের দিকে তাক করে শুরু করলেন ফাঁকা গুলি বর্ষণ।

কোম্পানি কমান্ডার আসাদ নিজে গুলি বর্ষণ থামিয়ে সবাইকে গুলি করা থামাতে বললেন। সঙ্গীরা গুলি বর্ষণ থামিয়ে ওর দিকে তাকালে কমান্ডার আসাদ বললেন, এভাবে গুলি বর্ষণ করতে থাকলে গ্রামের লোকেরা ভয় পেয়ে পালাতে শুরু করবে।

একটু থেমে সাথে সাথে ফের কমান্ডার আসাদ বললেন, আমার মনে হয় এতক্ষণে ওরা পালাতে শুরু করেছে। আমাদের এখনই গ্রামে গিয়ে ওদের থামাতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধারা পাশের গ্রামে এসে দেখেন গ্রামের নিরীহ লোকেরা সত্যই পালাতে শুরু করেছে। গ্রামের লোকদের ডেকে অভয় দেবার জন্য কমান্ডার আসাদ বললেন, আজ পাক হানাদার বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে।দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমাদের আর পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আল বদর আল শামস বাহিনীরর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে না। আপনাদের আর কোন ভয় নেই।

কমান্ডার আসাদের কথা শুনে গ্রামের লোকদের মন থেকে ভয় কেটে মুখ জুড়ে ফুটে উঠলো স্বাধীন হবার স্বস্তি ও আনন্দ। মুক্তিযোদ্ধাগণ গ্রামের লোকদের নিয়ে ফের আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনন্দ করতে লাগলেন।

কোম্পানি কমান্ডার আসাদ গুলি বর্ষণ থামিয়ে বললেন, আমাদের এখনই পুরুড়া হাই স্কুলের পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে হবে। ওরাও এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেনে গেছে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে।

ওরা পালিয়ে যাবার আগেই ওদের আটক করে এক ব্রাশ ফায়ারে শেষ করে দেবো।

কমান্ডার আসাদ মুক্তিযোদ্ধাদের বললেন, হানাদার বাহিনী এই আত্মসমর্পণের কথা শুনেছে কিনা আমাদের জানা নেই। তাই আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে এবং নিরাপদ দূরত্বে থেকে আক্রমণ চালাতে হবে।

গ্রামের লোকদের অপেক্ষা করতে বলে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গেলো পুরুড়া হাই স্কুলে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলো ক্যাম্পের পেছনে। কমান্ডারের ইশারা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শুরু করলেন গুলি বর্ষণ। কিন্তু প্রতিপক্ষ থেকে কোন পাল্টা গুলি বর্ষণ না হওয়ায় কমান্ডার কিছুটা অবাক হয়ে গুলি বর্ষণ থামাতে ইশারা করলেন।

দেখতে পেলেন পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের একটা জানালা দিয়ে একটা একে ফর্টি সেভেন রাইফেলের মাথায় শাদা কাপড় বেঁধে পতাকার মতো নাড়াচ্ছে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ!

শরীরের পেশি ঢিল না দিয়ে কোম্পানি কমান্ডার আসাদ সঙ্গীদের একবার দেখে ক্যাম্পের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠ উচিয়ে বাংলায় বললেন, বুঝলাম তোমরা সারেন্ডার করতে চাচ্ছো। তোমরা সবাই নিজ নিজ আর্মস সহ দুই হাতে মাথার উপর তোলে ধরে একে একে ক্যাম্পের সামনের মাঠে বের হয়ে আসো। রাজাকার আলবদরসহ।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। প্রথমে ক্যাম্প-ইন-চার্জ মেজর সাইফ খান সবার সামনে। একে একে দশটা হায়েনা বেরিয়ে আসার পরে দেশি কুত্তা বের হয়ে এলো তিনটা। সবাই দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। সবগুলো শূয়রের দুই হাত অস্ত্রসহ মাথার উপরে।

মুক্তি বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আসাদ উঁচু গলায় বললেন, আর কেউ আছে ভেতরে?

এক রাজাকার উত্তর দিলো, আর কেউ ভেতরে নাই।

কমান্ডার আসাদ নিচু স্বরে সঙ্গীদের নির্দেশ দিলেন, ফায়ার!

সকল মুক্তিযোদ্ধা শুরু করলেন গুলি বর্ষণ। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনী প্রতিরোধ করার সুযোগই পেলো না।

আশেপাশের গ্রামের লোকজন উল্লাস করতে করতে আসতে লাগলেন স্কুলের মাঠের দিকে। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র বাগিয়ে এগিয়ে এলেন হানাদারদের লাশের দিকে। ওরা অস্ত্র দিয়ে প্রত্যেকটা লাশকে উল্টেপাল্টে দেখলেন-কোনো হায়েনা বেঁচে নেই।

কমান্ডার আসাদ গ্রামের লোকদের বললেন, এই হায়েনাগুলার কবর বাংলার মাটিতে হবে না। আপনারা একটা ঠেলাগাড়ি নিয়া আসেন। লাশগুলো তুলে নদীতে ফেলে দিতে হবে। শকুন শেয়ালে খেলে হায়েনাগুলার উচিত সাজা পূর্ণ হবে। আমরা ক্যাম্পটা তল্লাসি করে দেখি গোলা-বারুদ কী পরিমাণে আছে। এগুলো কারো হাতে পড়তে দেয়া যাবে না।

গ্রামের আগত লোকদের মধ্যে কয়েকজন চলে গেলেন ঠেলাগাড়ি আনতে। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্প তল্লাসিতে গেলেন। একে ফর্টি সেভেন, মর্টার আর কিছু গোলাবারুদ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেলো না। একটা ঘরে খাদ্য-সামগ্রী পাওয়া গেলো কিছু। পাশেই আরেকটি তালাবদ্ধ ঘর।

কমান্ডার আসাদ একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তালা ভাংতে বললে এগিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধাটি হাতের স্টেনগানটা বাগিয়ে। স্টেনগানের বাট দিয়ে তালায় আঘাত করতে যাবেন তখন ভেতরে শব্দ শুনে থেমে গেলেন।

কমান্ডার আসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কী হে জহির? থামলে কেনো?

জহির বললেন, ভেতর থেকে কিসের যেনো শব্দ আসছে। থপ থপ থপ থপ। মনে হয় কেউ যেনো খালি পায়ে হাটছে।

কমান্ডার আসাদ এগিয়ে গেলেন তালাবদ্ধ ঘরের দিকে। জহিরকে সরিয়ে দরজার আরো কাছে গেলেন কমান্ডার আসাদ। দরজায় কান ঠেকিয়ে বললেন, ভেতরে কেউ আছেন? কে?

অনেকগুলো থপ থপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন কমান্ডার আসাদ। এগুলো খালি পায়ে হাঁটার আওয়াজ। দুটো আওয়াজ দরজার কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। একটা নারীকণ্ঠ ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললেন, এই পাক বাহিনীর পা চাটা দেশি কুত্তা! তুই নতুন আইছস নাকি রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার! 

কমান্ডার আসাদ চমকে একটু সরে এলেন পেছনে। ফের দরজার কাছে গিয়ে বললেন, আমরা রাজাকার না, মুক্তিযোদ্ধা। আজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা এই ক্যাম্পের সব হানাদার রাজাকারকে মেরে ফেলেছি। একটু আগে নিশ্চয়ই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনতে পেয়েছেন।


ভেতর থেকে একাধিক নারী সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, সত্যি বলছেন আপনি? পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে? দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে?


আমি সত্যি বলছি। আমি তালা ভেঙ্গে দিচ্ছি, আপনারা বের হয়ে এলে আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন।

নারীকণ্ঠগুলো ভীত স্বরে বললেন, না না! আপনি তালা ভাংবেন না!

কমান্ডার আসাদ বিস্মিত হয়ে বললেন, তালা না ভাংলে আপনারা এই ঘর থেকে বের হবেন কিভাবে?

এবার একজন নারী লজ্জিত কণ্ঠে বললেন, আমাদের গায়ে কোনো কাপড় নেই ভাই।

কথাটা শোনার সাথে সাথে কমান্ডার আসাদ স্তব্দ হয়ে গেলেন। কথাটার মর্ম বুঝতে পরে চোখ দুটো ওর অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠলো। সামলে নিয়ে বললেন, আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। আমি কাপড়ের ব্যবস্থা করছি।আপনার কত জন বোন?

বোনটি বললেন, আমরা পনেরো জন।

ঠিক আছে।

কমান্ডার সঙ্গিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি গ্রামে যাও। শাড়ি লুঙ্গি, ব্লাউজ, ছায়া যা পাও নিয়ে আসো। পনের জনের লাগবে। যাও, কুইক!

মুক্তিযোদ্ধাগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে নিয়ে চলে গেলেন গ্রামে। দশ মিনিটের মধ্যে যা পেয়েছেন কাপড় তাই নিয়ে ছুটে এলেন ক্যাম্পে। কমান্ডার দরজাটা ফাঁক করে কাপড়গুলো গুঁজে দিলেন ভেতরে।

কাপড় পেয়ে নির্যাতিতা মা-বোনেরা বের হয়ে এলেন ঐ ঘর থেকে। কোথায় যাবে এরা এখন? কোথায় যাবে আবার? নিজেদের বাড়ি আছে না? ঐ বাড়িতেই যাবে। ওরা শ্লথ পায়ে নিজ নিজ বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। কারো বাড়ি কাছে, কারো বাড়ি দূরে। কিন্তু সবাই নিজের বাড়ি চিনে।


যার বাড়ি সবচেয়ে কাছে, তিনি গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। নিজকে একবার দেখে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াবেন, তখন বাড়ির ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে গো তুমি?


এইখানে কী করতাছো?


নির্যাতিতা মেয়েটি মাথা তুলে তাকাতেই লোকটি ওকে চিনতে পেরে আঁতকে উঠে বললেন, শেফালি! তুই এইখানে ক্যান আইছস? তুই তো নষ্ট হয়া গেছস!


ভদ্রলোকের কথা শুনে বাড়ির মহিলারা বাড়ির দেউড়ির আড়ালে থেকে শেফালিকে চিনতে পেরেও বড়কর্তার কথা শুনে আর এগুতে সাহস পেলো না-মুখে আঁচলচাপা দিয়ে গুমড়ে কাঁদতে লাগলেন।


শেফালি বাবাকে অনুনয় বিনয় করে পায়ে ধরেও বাড়িতে থাকার অনুমতি পেলো না। নিজ বাড়িতে ঠাঁই না পাওয়া শেফালি শ্লথ পায়ে ফিরে চললেন অজানার পথে। ওর গায়ের শাড়ির আঁচল মুছে নিয়ে যাচ্ছে পেছনের ধূলোবালি।

rana2344@gmail.com

বাংলাদেশ 

No comments:

Post a Comment