1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

ভাঙাগড়া

ছবি  : ইন্টারনেট 

 ভাঙাগড়া

 সন্দীপ ঘোষ


দক্ষিণের ব্যালকনির একপাশে একটি চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসলেন সত্তরোর্ধ বিধবা মণিমালা  | বিগত পাঁচ বছর ধরে একাই এই বাড়িটিতে বাস করছেন |  তবে মাঝে মাঝে এসে থাকে বোনঝি রূপা | প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাড়ি | প্রতিটি দেওয়াল, পিলারে ভালোবাসার চিহ্ন খুঁজে পান মণিমালা  | কোথাও ফেটে যাওয়া নেই, কিম্বা পলেস্তারা খসে পড়া নেই, নেই রড বেরিয়ে ভেঙে  যাওয়া ছাদের অংশ | বাড়িটি অনেক খরচ ক'রে প্রাণঢালা ভালোবাসায় এই দোতলা বাড়িটি গড়ে তুলেছেন অধ্যাপক স্বামী সীতাংশু সামন্ত | স্ত্রী মণিমালা আপত্তি করেছেন, শোনেন নি | শুধু বলতেন ;

------ 'গঠনমূলক কোনো কাজে অপার ভালোবাসা প্রয়োজন, আর ভালোবাসলে খরচ তো একটু হবেই তাই না ! এই যেমন, তোমায় আমি খুব ভালোবাসি, আর তোমায় আমার ঘরের লক্ষ্মী করার জন্য বিয়ের আগে বেশ খরচ করেছি | তবেই না লক্ষ্মী এসেছে আমার ঘরে |'

------ 'থাক থাক, অনেক হয়েছে আর আদিখ্যেতা করতে হবে না |' আদুরে গলায় জানিয়েছেন মণিমালা | এসব অনেক আগের কথা |

     ছেলেমেয়ে দুটো প্রতিষ্ঠিত, সংসারী- যে যার নিজের কর্মস্থলে থাকে | ওদের বাবা বেঁচে থাকতে প্রায়ই দেখতে আসত | বাড়িটা যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠত | হৈ-হট্টগোল, চিত্কার-চেঁচামেচি, নাতি-নাতনিদের আবদার----- এসবের মাঝে কখন যে দিন পার হয়ে যেত বুঝতেই পারতেন না মণিমালা  | স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে এখন আর কেউ তেমন ভাবে আসেনা | এলেও সেই প্রাণের ফোয়ারা নেই | জীবনটাকে যেন মনে হয় শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো একটা বস্তু | হয়ত, ওদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার জায়গায় কোথাও খামতি ছিল, নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসার জায়গাটা আত্মস্বার্থে ডুবেছিল | তাই হয়ত সন্তানদের প্রতি মাতৃত্বের যে নাড়ীর টান, ওদের হৃদয়ে অনুভূতির সঞ্চার ঘটায়নি | সীতাংশু বার বার বলতেন;

-----  "ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে তো ওদের সুখ-দুঃখ,ভালো-মন্দের দিকটা আমাদের খেয়াল রাখা ভীষণ দরকার |"

না সে সব তোয়াক্কা করেন নি মণিমালা , আত্মীয়স্বজন, পার্টি, নানা- অনুষ্ঠানে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সারাটাদিন পার করে দিতেন |  এসব ভাবতে ভাবতে দু'চোখের কোন চিক্ চিক্ করে ওঠে তাঁর |


       বিকেল গড়িয়ে গোধূলীর পূর্ব মুহূর্তে 'মাসি-মাসি' ডাকে চোখ মুছতে মুছতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান মণিমালা |

--------"রূপা, তোর হয়ে গেছে মা ? চলে যাচ্ছিস ?"

--------" হ্যাঁ মাসি, আজকে দুধওয়ালা আসেনি | রুটি-তড়কা বানিয়েছি, টেবিলে রাখা আছে খেয়ে নিও |"


রূপা মণিমালার ছোটবোন বনমালার মেয়ে | রূপার বাবা জীবিত , তবে মা মারা যান রূপার বিয়ের ঠিক দু'বছরের মাথায় | রূপাদের পরিবারে কোনোদিনই স্বচ্ছলতা ছিল না | আর  একপ্রকার অভাবের কারণেই তার পড়াশুনা আটকে যায় | শুধু তাই নয় গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব বেশি হওয়ায়  এবং যোগাযোগ তেমন না থাকায়  স্কুলের গন্ডি পেরোয় নি সে | কয়েক বিঘা জমিতে চাষ আবাদ করে রূপা'র মা-বাবার সংসার টেনেটুনে চলে যেত | ধীরে ধীরে রূপাও বিয়ের বয়স পার করে ফেলে | হন্যে হয়ে পাত্র খোঁজাখুজি শুরু করে রূপার বাবা | কিন্তু না ! কিন্তু সবক্ষেত্রেই রূপার উপযুক্ত পাত্র পেলেও বরপণ হিসেবে মোটাটাকা দাবী করে বসে পাত্রপক্ষ | অভাবে বিয়ে আটকে যায় | কিন্তু সেই সময় পাশে এসে দাঁড়ান রূপার মেসোমশাই সীতাংশু | তিনি তার ছেলেবেলার বন্ধু 'অখিলেশ পাল'-এর ছোট ছেলে 'তপন'-এর সঙ্গে রূপার বিবাহের বন্দোবস্ত করেন | কিন্তু এতে একেবারে সন্মতি ছিল না মণিমালার | তার শুধু এক কথা ;

------ ওরা ওদেরটা বুঝুক না ! তোমার এত কিসের দায় ?"

সীতাংশু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, তারপর শান্ত গলায় স্মিতহাস্যে বলেন;

-------" সকল মানবজাতির এই ধরাধামে একটাই তো কাজ, প্রকৃতি ও তার জীবকুলের সেবা করা | এটা তো আমার একটা ক্ষুদ্ৰ প্রচেষ্টা মাত্র | আর এমন সুযোগ হাতছাড়া করা কি চলে ? কী বলো ?" 

------- "অনেকদিন ধরে দেখে আসছি তোমার সবকিছুতেই কীরকম যেন একটা  বাড়াবাড়ি ! ভাল্ লাগে না আমার | বন্ধ করো এসব |" অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে একনাগাড়ে কথাগলো বলে ফেলেন মণিমালা | তবে মণিমালা ভালোমতই বোঝেন তার এই নিষেধাজ্ঞা কোনোদিন ধোপে টিকে নি আর আজও টিকবে না | বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল রূপার, পেশায় অনলাইন বিজনেসম্যান তপনের সঙ্গে | তার কী উপহার দেওয়া হবে এই নিয়েও মণিমালা ও সীতাংশু'র মধ্য একপ্রস্থ ঠান্ডা লড়াই হয় | কিছুতেই কোনো দামী বস্তু প্রেজেন্ট করতে চান না মণিমালা | সীতাংশু ঠিক তার বিপরীত | শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত অমীমাংসিত থেকে যায় | আর সেইসময় সস্ত্রীক দু'জনেই ছিলেন বাড়িতে | বিয়ের ঠিক আগেরদিন রাত্রে দু'জনের কারোমুখে কোনো কথা নেই | ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা কিম্বা আড়চোখে দেখা ইত্যাদি কান্ডকারখানা নিঃশব্দে- নীরবে করে চলেছেন | সীতাংশু মুচকি হাসি হেসে শুয়ে পড়লেন চুপচাপ | তিনি তার স্ত্রীকে বেশ বোঝেন | মণিমালার ধৈর্য্য আর কতক্ষণ ! সীতাংশুই ঠিক-- মণিমালা আর চুপচাপ থাকতে না পেরে গলাটা একটু ভারী করে বললেন; ------" কই বললে না তো কি ঠিক করলে ?"

সীতাংশু যা ভেবেছিলেন , ঠিক তাই ঘটল, উঠে বসে বললেন নির্লিপ্ত ভাবে ;

-------" কী বলতো,  কি ঠিক করতে হবে ?"

তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন মণিমালা | ঝাঁঝিয়ে বললেন ;

-------"ন্যাকামো হচ্ছে না ! রূপার বিয়ের প্রেজেন্টেশন নিয়ে কথা বলছি |"

------" ওহ্ হো , এই দ্যাখো , আমি না সত্যিই ভূলে গেছি | আচ্ছা বেশ বেশ, তা তুমি কি ঠিক করেছো তাই বলোনা শুনি |"

--------" আমি একটা শাড়ি কিনেছি , রূপাকে দেব |"

মনে মনে ভাবলেন-- শুধু একটা শাড়ি ! অবশ্য এর থেকে আর বেশি কী--বা আশা করা যায় মণিমালার কাছে |

--------" কত দাম ?"

স্ত্রীর চটজলদি জবাব;

---------" বারশো টাকা |"

--------"বারো'শ্----শ টাকা !" বিস্মিত হন সীতাংশু ! এটা তিনি একদমই আশা করেন নি | তারপর ধীর গলায় আরো বলেন;

------- "মনে করো, রূপা তোমার আর একটা  মেয়ে | তার প্রতি তোমার একটা দায়িত্ব আছে | অবশ্য দায়িত্ববোধ অন্তরেরই মূল্যবান এক রত্ন | দামী রত্ন কি আর সহজে মেলে , কি বলো ?" 

মণিমালা ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতো আঘাতটা পেয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না | গর্জে ওঠে বললেন ;

-------" তা যাও না, রূপাদের বাড়িতেই যাও | তোমার যত রকমের সেন্টিমেন্ট আছে দেখাবে | তোমার অনেক নাম হবে, সুনাম হবে লোকে তোমাকে ধন্য ধন্য করবে | আরো কত কি হবে !"

--------"না, বলছিলাম যে, বোনঝির বিয়ে বলে কথা, সামান্য বারো'শ টাকার শাড়িতে কি হবে ? এর থেকে আরো ভালো কিছু দেওয়া যেতে পারে |"

না সেদিন আর কোনো কথা হয়নি | যে যার শুয়ে পড়েন |


রূপার বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দু'জনেই | সীতাংশু'র হাতে ওটা কি ? অনেকক্ষণ থেকে দেখছেন আর ভাবছেন | জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না | কিন্তু জানতে তো হবেই | কিছুক্ষণ উসখুস করার পর জানতে চাওয়ার আগেই সীতাংশু বলেন;

-------" চলো মণি, রূপার হাতে গিফট্ দিয়ে আসি |" হাত ধরে টেনে নিয়ে যান রূপার ঘরে | বিয়ের পিঁড়িতে বসার ঠিক কিছুক্ষণ আগের ঘটনা | ছোট্ট প্যাকিং করা দুটিবক্স দেখিয়ে বলেন ;

------"এটাতে আছে সোনার কানের দুল, আর এটাতে আছে গলার হার, নে মা, এগুলো তোর জন্য |"

মণিমালা সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে, আর চোখের ভাষা দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন | রূপার দৃষ্টি এড়ায়নি | সঙ্গে সঙ্গে সে বলে ; 

-------"থাক না মেসোমশাই |"

-------" না মা, এ তো তোকে নিতেই হবে | এ তো তোর মাসী-মেসোমশায়ের আশীর্বাদ |"

প্রণাম করে রূপা | সে তার বান্ধবীদের সামনে বিচলিত বোধ করে | মনে মনে কষ্ট পায় | কোথা থেকে যেন একটা অভিমানের পাহাড় তার মাথার উপরে চেপে বসে |


মৃত্যুর আগে মেসোমশাইকে  কথা দিয়েছে , মাসীর খেয়াল সে রাখবে |  মেসোমশায়ের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় খুব নিষ্ঠাভরে তার কর্তব্য  করে চলেছে | মণিমালা আজ উপলব্ধি করতে পেরেছেন | মেয়েটা অভিমানী মনে তার অন্তরের দূরত্বটাকে সামলে চলেছে |


    সদরগেটে একতা ঠুং করে আওয়াজ হতেই রূপা বলে;

-------"ঐ, বাহাদুরকাকা এলো বোধ হয় |"

বাড়ির পাহাদার হিসেবে এই বাহাদুরকে নিয়োগ করেছেন সীতাংশুবাবু | খুব ভালোমানুষ, বিশ্বস্ত | প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠ অনেক আগেই অতিক্রম করেছেন | পৌঁছেছেন বার্ধ্যক্যের প্রবেশদ্বারে | ভিতরে যাওয়া শুধুমাত্র খানিকটা সময়ের অপেক্ষা | কেউ কেউ তাকে  ডাকে বাহাদুরকাকা  বলে |   অনেকদিন হোল এই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে উঠেছেন তিনি | প্রতিদিন এই সময়ে তার আগমন ঘটে | বাড়িটিকে বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন | খুব সমীহ করেন মণিমালাকে | মণিমালা লক্ষ্য করতেন তার স্বামীর প্রতি যেরূপ ঐকান্তিক একাত্বতা আছে অর্থাত্ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আন্তরিকতার মাত্রা যতটা উঁচু মানের, তাঁর প্রতি দূরত্ব যেন ঠিক ততটাই | না- না তিনি মহিলা বলে নন | মণিমালা মনে মনে নিজেকেই দায়ী করেন | তাঁর ব্যৰ্থতা তাঁর আন্তরিকতার অভাব, প্রাধান্য শুধু আত্মকেন্দ্রিকতায় |


সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে রূপার মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী তিয়াসা-- "ও দিদা , ও দিদা" বলে উঠে এসে মণিমালাকে জড়িয়ে ধরে | মনের সমস্ত মলিনতা একনিমেষে উধাও হয়ে যায় তাঁর | পরমসুখ অনুভব করেন | আর ভুল করেন নি তিনি | তিয়াসার শিশু বয়স থেকেই অপার স্নেহ-ভালোবাসা- আন্তরিকতায় ভরিয়ে রেখেছেন | তিয়াসার পাঁচবছরের বড় দাদা 'সুজন' এই বাড়িতে বার বার এলেও  মা রূপার সঙ্গে প্রয়োজন সেরে ফিরে যায় | কখনও না ডাকলে নিজে থেকে কাছে এসেছে, মনে করতে পারেন না মণিমালা | সুজনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা তার শিশু বয়স থেকেই | সুজনকেও স্নেহ করেন, খুব ভালোবাসেন | কিন্তু তিয়াসার ক্ষেত্রে মা-মেয়ের সম্পর্কের গভীরতাকে মনে করিয়ে দেয় |


                                 **সমাপ্ত**

                 

sghoshkabi@gmail.com

বাঁকুড়া

No comments:

Post a Comment