1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

পরমেশ্বর

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

পরমেশ্বর

শাশ্বতী মুন্সী

  প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় খাটে শোয়া কিশোরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে বিশাখা। দু'দিন ধরে জ্বরে ভুগতে থাকা রোগাটে শরীর যেন বিছানায় নেতিয়ে পড়েছে। তাপমাত্রা ১০২-১০৪ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে! প্যারাসিটামল খাইয়ে এবং ক্রমাগত জলপটি দিয়েও অবস্থার হেরফের হচ্ছে না হওয়ায় আশঙ্কার মেঘ ঘনাচ্ছে তার মনে।

 বাইরে থেকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে একটু থমকে দাঁড়ায় সঞ্জীব। উদ্বিগ্ন স্বরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল,

 -" মিতুর জ্বর কি আরো বাড়ল? "

 -" হ্যাঁ, গা পুড়ে যাচ্ছে.. আগে তবু একটু আধটু সাড়া দিচ্ছিল, এখন যে তাও দিচ্ছে না.. দুদিন পেটে সলিড কিছু পড়েনি, তাই হরলিক্স করে এনে খাওয়াতে গিয়েই দেখি.."

   বিশাখার কথা মাঝপথে থেমে গেল, খাটে বসে বোনের কপালে, গায়ে স্পর্শ করতে যেন গরম চাটুতে হাত দেওয়ার মতো ছ্যাঁকা লাগল সঞ্জীবের! বোনের শারীরিক অবস্থার অবনতি তার মনকেও শঙ্কান্বিত করে তুলেছে! তাই এতক্ষন হন্যে হয়ে ডাক্তার খোঁজ করছিল, কিন্তু সংক্রমণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকার বেশিরভাগ ডাক্তাররের চেম্বারে তালা ঝুলছে। কেউ কেউ আবার দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যা কয়েকজন মাত্র রোগী দেখছেন। অনেক অনুনয় সত্ত্বেও তাঁরা কেউ রোগী দেখতে বাড়ি আসতে রাজি হননি। উপরন্তু পরিস্থিতি এমন যে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে! বিশেষত, মিতুর জ্বরের লক্ষণ ভাইরাস জনিত রোগের প্রাথমিক উপসর্গ কিনা, সে ব্যাপার নিশ্চিত না জেনে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভোগান্তির শেষ থাকবে না..

  স্ত্রীর সজল চোখের দৃশ্যত ছোঁয়ায় সঞ্জীবের চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল। মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে বোনই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন. তাই বোনকে এভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর যে কষ্টে উথাল পাথাল করছে..সস্নেহে মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল, যে কোনো উপায়ে তোকে সুস্থ করে তুলব..

 আলগোছে চোখের কোনা মুছে উঠে দাঁড়াল সঞ্জীব।

 " যেরকম জলপটি দিচ্ছিলে, দিতে থাকো.. আমি  ডাক্তারের খোঁজে বেরোলাম.. " স্ত্রীকে বলে ডান দিকের দেওয়ালে পাশাপাশি টাঙানো বাবা-মায়ের ছবি প্রণাম করে বেরিয়ে গেল সে।

কথায় বলে, মন থেকে কারোর জন্য আরোগ্য কামনা করলে ঈশ্বরও বুঝি তখন সদয় হন।

    স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে ছোট্ট পরিবার সঞ্জীবের। বাবা-মায়ের অবর্তমানে মিতু তার সবচেয়ে কাছের আপনজন। অভিভাবকহীন বোনের প্রতি যাবতীয় কর্তব্য করতে একজন দায়িত্বশীল দাদার ভূমিকা পালনে অবিচল রয়েছে সে। বিয়ের পরেও সেই অবস্থানের এতটুকু নড়চড় হয়নি। বরং নিজের পছন্দে আনা জীবনসঙ্গিনীর হৃদয়ে মিতুর প্রতি মমত্ববোধ, ওকে আগলে রাখার স্নেহময়ী স্বভাব সাংসারিক শান্তি দিয়েছে সঞ্জীবের মনে।

  একটি বেসরকারি ব্যাংকে তিন বছর কর্মজীবন কাটানোর পরে এই প্রথমবার বদলির অর্ডার আসে সঞ্জীবের। ওই ব্যাংকের নীলগঞ্জ শাখায় জয়েন করেছে মাস দুয়েক আগে। আধা-গ্রাম, আধা-মফঃস্বল এই নতুন জায়গায় এসে তেমন চেনা পরিচিতি হয়নি, এর মধ্যে বোনের অসুস্থতা ঘোরতর সমস্যায় ফেলেছে তাকে।

   মে মাসের মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণ যেন অগ্নি বর্ষণ করছে ধরিত্রীর ওপরে। প্রখর রোদের তপ্ত আবহাওয়ার উপুর্যপরি লকডাউনে জারি হওয়া নিষেধের দরুন পথচলতি মানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর। শুধু তালাবন্ধ দোকানের চাতালে গুটি কয়েক কুকুর বসে রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কতদূরে চলে এসেছে খেয়াল নেই সঞ্জীবের। হঠাৎ ওর সন্ধানী চোখ জনশুন্য রাস্তায় এক স্থানীয় লোকের দেখা পায়। দ্রুত হেঁটে লোকটির কাছে গিয়ে সংক্ষেপে ডাক্তার খোঁজের কারণ জানাতে সে বলে,

-" আরে দাদা, এই অঞ্চলের ধন্বন্তরি ডাক্তারবাবু থাকতে আপনার বোন বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাচ্ছে..!"

 -" ধন্বন্তরি", সঞ্জীব বিস্মিত!

 -" হ্যাঁ, উনি যে একালের সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি মশাই.. ওনার চিকিৎসায় সুফল পায়নি এমন রোগী এ তল্লাটে পাবেন না.."

  লোকটির আপ্তবাক্যে খানিকটা বিশ্বাসের সঞ্চার হল সঞ্জীবের মনে।

 এরপর কথা না বাড়িয়ে হতবাক সঞ্জীবকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার বাবুর ঠিকানার পথে রওনা দেয় লোকটি। আধ ঘন্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যায় তারা। একতলা বাড়ির মাঝ দালানে পাতা বেঞ্চে বসা লোকজনের ভিড় বুঝিয়ে দিলো ওরা সবাই রোগী। এবং দালান সংলগ্ন ঘরটি ডাক্তার পরমব্রত চৌধুরীর চেম্বার। সঞ্জীবকে বাইরে দাঁড়াতে বলে লোকটি ভেতরে যায় ডাক্তার বাবুর সঙ্গে কথা বলতে। ক্ষণকাল পরে দরজার পর্দা ফাঁক করে হাতের ইশারায় ওকে ঢুকতে বললে, একবুক আশা নিয়ে চেম্বার ঢোকে সে। দ্যাখে, আয়তকার টেবিলের ওপ্রান্তে চেয়ারে বসে আছেন সুঠাম দেহে, পরিচ্ছন্ন বেশভূষার, কাঁচা পাকা চুলের সৌম্যদর্শন এক ব্যক্তি, যার পরিচয় আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইনি অঞ্চলের ধন্বন্তরি-নামা ডাক্তারবাবু।

  ধীর, স্থির ভাবে চিন্তাগ্রস্ত সঞ্জীবের মুখে রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে জেনে আর এক মুহূর্ত নষ্ট করা সমীচীন মনে করেন না তিনি। বাইরে অপেক্ষারত রোগীদের কাছে বিনীত ভাবে কিছুক্ষণ সময় চেয়ে নিয়ে সঞ্জীবের সাথে বেরিয়ে পড়লেন।

    পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনে কৃত MD ডিগ্রিধারী ডক্টর চৌধুরীর কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল কলকাতার হাসপাতালে। কিন্তু পরে বাবার স্বপ্নপূরণ করতে এবং সদিচ্ছায় গ্রামের দুস্থ, অসহায়,গরিব মানুষদের সুষ্ঠ চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য করার সংকল্পে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের কর্মভার গ্রহণ করেন। প্রথম ৫-৬ বছর সরকারের অধীনে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজস্ব হাসপাতাল খুলবেন। এই সাধু উদ্যোগে পাশে পেয়েছিলেন এলাকার সহৃদয় এক ব্যক্তিকে।বাবার সঞ্চিত অর্থে এবং স্ব-উপার্জনের মিলিত মূলধনে কুড়িটি শয্যার হাসপাতাল খুলে বসেন ওই ব্যক্তির অব্যবহৃত বাড়িতে। শহর থেকে কিনে আনেন ডাক্তারির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। খান আটেক মোটামুটি শিক্ষিতা তথা আগ্রহী গ্রাম্য মেয়েকে নার্সিং এর প্রশিক্ষণ দিয়ে নিযুক্ত করেন সেবিকা পদে। সাধারণ মানুষের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করতে উদ্যমী এবং দরদী মনোভাবাপন্ন চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারবাবু অল্প দিনেই এলাকাবাসীর হৃদয়ে ধন্বন্তরি-সম ঈশ্বররর আসনে অধিষ্ঠিত হন। স্বনামধন্য এই মানুষটি লোকমুখে ভূষিত হয়ে যান " পরমেশ্বর " অভিধায়।

  বিগত ৩২ বছর ধরে অঞ্চলের বাসিন্দাদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে আসছেন নিরলস। এমনকি সংকটজনক পরিস্থিতিতে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে রোজ অন্তত ২০০ জন রোগী দেখে চলেছেন দিনে-রাতে।

  ভাড়া বাড়িতে সঞ্জীবের বোন মিতুলকে দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর কপালে।অভিজ্ঞ চোখে রোগীর অবস্থা ভালো না বুঝে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে নেন। তারপর থেকে টানা পাঁচ দিনের অক্লান্ত শ্রুশুষায় রোগীর দৈহিক অবস্থা সুস্থতার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। শঙ্কার  মেঘ কেটে স্বস্তির হাসি ফোটে সঞ্জীব-বিশাখার মুখে। কেননা মিতুলের জ্বর জনিত লক্ষণের ভয়কে দূর করে নেগেটিভ আসে টেস্টের রিপোর্ট.. 

  গোটা সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়ে মিতু খানিকটা সুস্থ হয়। বোনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার আগে কৃতজ্ঞ স্বরে ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলে না সঞ্জীব-বিশাখা। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে পা ছুঁয়ে প্রণাম জানায় বাস্তবের মাটিতে চাক্ষুষ করা রুপোলি পর্দার " অগ্নিশ্বর "কে।

সমাপ্ত

                        

উত্তরপাড়া
saswati.munshi1987@gmail.com
                                                                     

No comments:

Post a Comment