1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

ফেরিঘাট

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

ফেরিঘাট

সনৎ ঘোষ


এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে প্রেম!

নটা ছয়ের পাশকুড়া লোকালে শিবাশিষের সঙ্গে রোজ দেখা হয় মেয়েটার। মাঝারি গড়নে চল্লিশোর্ধ বয়স, শাড়ির সাথে ম্যাচ করা ব্লাউজ। কোঁকড়ানো এক রাশ কালো চুলে বাঁ দিকে এক পেশে সিথি, মাগুরে রঙ দুহাতে দুটো বালা চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, এছাড়া সাজগোজ বিশেষ নেই, কাঁধে ব্যাগ।

নলপুর স্টেশনে ট্রেনটা থামলেই শিবাশিষের চোখ চলে যায় প্ল্যাটফর্মের লেডিস কম্পার্টমেন্টের দিকে।

 এখান থেকেই ওঠেন মহিলা। জানলার ফাঁক দিয়ে তার ওঠা লক্ষ্য করে শিবাশিষ। হাওড়া স্টেশনে নেমে,

 কখনো এক ঝলক দেখা সামান্য চোখাচখি তারপর হারিয়ে যায় ভিড়ে। ফেরার সময় আর দেখা হয় না। এভাবেই কেটে যায় মাস, বছর।শিবাশিষের মনে কেমন করে যেন মহিলার প্রতি একটা ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায়।

 ইদানিং শিবাশিষ আয়নার সামনে অনকক্ষণ দাঁড়ায়। ভেঙে গেছে চেহারা, অনেকটাই পাক ধরেছে চুলে।শরীর জুড়ে বয়সের ছাপ স্পষ্ট।বয়স যায় কেন যে প্রেমের অনুভূতি যায় না! কয়েক মাস স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশ সজাগ সে। ব্যাবহার করতে শুরু করেছে বিজ্ঞাপনী ক্রিম , ফ্রেস ওয়াস থেকে হেয়ার ওয়েল।

তার এই হঠাৎ পরিবর্তন অফিস কলিগদের কছে কখনো কখনো বিস্ময়, আবার কখনো হাসি মজার বিষয় হয়ে ওঠে। রসিকতায় কেউ বলে, বয়স কমে গেছে গুরু, এক ধাক্কায় কুড়ি। দাস বাবু চশমা নাকের ওপর তুলে বলে , শিবাশিষ তোমার ব্যাপারটা কি বলতো! শিবাশিষ কারো কথাই গায়ে মাখে না। হেসে ম্যানেজ করে প্রসঙ্গ পালটায় ।একটা বেসরকারি সংস্থায় ফিল্ড ম্যানেজার হিসেবেই কাজ করতো এতোদিন। রিটায়ার্ড মেন্টেরেড এর আগে হঠাৎই এই প্রমোশন, আজ বহরমপুর তো কাল বসিরহাট ঘুরে বেড়িয়েছে।এখন থিতু হয়েছে পার্কসার্কাসের এই অফিসে একাউন্ট সেকশনের ক্লার্ক। বেড়েছে অফিসিয়াল কাজের চাপ। আর এই কাজের চাপের মধ্যে ও শিবাশিষ কেমন উদাশিন।ঐ নিত্যযাত্রী মহিলা আর ন টা ছয়ের পাশকুড়া লোকাল বদলে দিয়েছে তাকে। অফিস যাওয়ার ঐ ট্রেনটা না ধরে , পরের ট্রেনেও অনায়াসে অফিসে পৌঁছানো যায়। এক অমোঘ আকর্ষণ ঐ ট্রেনটায় ।নলপুর স্টেশনে ট্রেনটা থামলেই জানলা দিয়ে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস তার ঘামে ভেজা শরীরটা ঠান্ডা করে দিয়ে গেল।ভাসতে থাকে মহিলার মায়াবী মুখের ছবিটা। মাঝে মাঝেই ভাবনায় ডুবে যায় সে, কি বলবে এটাকে, ভালোবাসা, ভালোলাগা, নাকি প্রেম!নাকি নির্ভরতা, একটা অবলম্বন এই রকম একটা বয়সে এসে! অনেক সঙশয় আর ভাবনা ।

 সম্প্রতি ঐ সহযাত্রীর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে সে।

 দেখা হয় কথা হয় না।

 আগস্টের শেষ, বৃষ্টির কারণে শিবাশিষে সেদিন অফিস থেকে বের হতে দেরি ই হল। দেরি হল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেতেও , তার ওপর ট্রেন লেট থিক থিক করছে ভিড়। না আজ আর বেশি তাড়াহুড়ো করে না শিবাশিষ। দেরি তো হয়েইছে । ভিড়ে ঠাসা হয়ে পরপর দুটো ট্রেন স্টেশন ছাড়লো । পরবর্তী মেচেদা

 লোকালটা তুলনামূলক অনেকটাই খালি।আর সেখানেই শিবাশিষের চোখ কাকে যেন খুজছে!

 হঠাৎ ই ট্রেনে উঠতে গিয়ে চোখ আটকে যায় তার।

 হুঁ , সেই তো। ফেরার ট্রেনে এই প্রথম দেখা। মহিলা নিত্যযাত্রী লেডিস কম্পার্টমেন্টে পৌঁছানোর আগেই শিবাশিষ সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,

 আপনি কি রোজ এই ট্রেনেই ফেরেন!

 মহিলা মৃদু হেসে বলে, না। আজ দেরি হয়ে গেছে।

 বৃষ্টির জন্য ই আটকে গেছিলাম।

 শিবাশিষ বলে আমার ও একই অবস্থা।পর মুহুর্তে বলে , চলুন জেনারেল কম্পার্টমেন্টটা একরকম ফাঁকা। এখানেই ওঠা যাক। মহিলা আপত্তি করে না।

 আজ পাশাপাশি সিটে দুজন।ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা হয় , একসময় দুলে ওঠে ট্রেন।ভিড় করে অনেক কথা।হলোও কিছু কথা। শিবাশিষ জানলো নিত‌্য যাত্রী মহিলার নাম অনিমা।

 অনিমা আপনমনে বলে এই বৃষ্টি যেন থামতেই চায় না। শেষ লঞ্চটা পেলে হয়!

 কোথায় থাকেন আপনি? শিবাশিষ জিজ্ঞেস করে।

 বাটানগর, নলপু্রে নেমে লঞ্চ ধরি।

 শিবাশিষ এরপর নিজেই বলে, আমাকে মেচেদা নামতে হয়। ওখান থেকে আটো বা টোটোয় মিনিট পনেরো।

 আপনার শেষ লঞ্চটা কটায় যেন!

 অনিমা বলে, ন টা পনেরো।

 শিবাশিষ মোবাইলে সময়টা দেখে, বলে পেয়ে যাবেন আশা করি, এখন আট টা পয়ত্রিশ।

 কথায় কথায় জানতে পারে শিবাশিষ। অনিমার স্থায়ি কোন অফিস নেই। নেই স্থায়ি কোন কাজ ও ।যখন যেখানে কাজের ডাক পায় সেখানেই যায়।এখন যেমন শিয়ালদার এক ফ্লাটে , এক বৃদ্ধার পরিচর্যায় সে। সকাল এগারোটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি।পরের জন এসে গেলে বেরিয়ে পড়ে। পরিচারিকার কাজ। ট্রেনটা আবাদা স্টেশন গ্যালোপিন হয়ে যাচ্ছে।

 অনিমা এবার নামার প্রস্তুতি নেয়। গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় শিবাশিষ ও। একসময় আসছি বলে প্ল্যাটফর্মে নেমে যায় অনিমা। হর্ণ দিয়ে ট্রেনটা ছাড়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল অনিমা।ট্রেন আবার চলতে শুরু করলে, শিবাশিষ হাত নেড়ে বলে বাড়ি ফিরে একটা ফোন করতে, মাথা হেলিয়ে অনিমা দ্রুত হেঁটে খেয়াঘাটের পথে।

 সম্পর্ক এগোলো আর এক ধাপ। এরপর থেকে প্রায়দিন এক সাথে আসা যাওয়া। কখনো অপেক্ষা,

 ফোনাফুনি , কোথাও বা অল্প সময়ের অবসর যাপন।

 আপনি থেকে তুমি। পছন্দ মান অভিমান সব মিলে মিশে কখন যেন একাকার হয়ে গেছে।

 দু বছরে সম্পর্কে গভীরতা বেড়েছে। মনের অনেক যন্ত্রনা, কষ্টগুলো এখন আর কষ্ট মনে হয় না। সবকিছু বেশ প্রাণোচ্ছল, তবু মন যেন চায় আরো কিছু। মনের আর দোষ কি! অজান্তেই অনিমার ওপর অধিকার ফলায় শিবাশিষ।অনিমাও শিবাশিষের ওপর। কিন্তু এতো সবের মধ্যে ও কোথাও যেন একটা সংশয়, একটা দ্বিধা, একটা দ্বন্দ্ব, মাঝে মাঝেই ভাবুক করে তোলে অনিমাকে।

 অনিমাকে আনমনা দেখে শিবাশিষ জিজ্ঞেস করে ,কি এতো ভাবো বলোতো!একটু আগে ও তো কত কথা বললে।

 অনিমা এড়িয়ে যায়, ও কিছু না।

 কিছু না মানে , কিছু তো একটা বটে।শিবাশিষ নাছোড়।আজ আমি ও তোমায় কিছু বলতে চাই।

 সঙ্গে সঙ্গে অনিমা বলে হাঁ, বলো শিবাশিষ বলো।

 এসো , আজ আমরা আমাদের না বলা কথাগুলো বলি।যে গুলো আড়ালে আছে, অথচ বলতে হবে বলা দরকার।

বাঁধানো ঘাটের চাতালে বসে দুজন । অনিমার হাতটা শিবাশিষের শক্ত মুঠোর ভেতর।অনিমা অবার ও চুপচাপ।শিবাশিষ তাড়া দেয় , কই বলো কিছু।

 শিবাশিষের মুঠোর ভেতর থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চায় অনিমা। অনেকটা নিরবতার পর অনিমা বলে, আমাদের বোধহয় এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। সম্পর্কটা এই আসা যাওয়ার মধ্যেই থাক। ঘাটের পাশ দিয়ে একটা ডিঙা নৌকা দাঁড় টেনে চলে যাচ্ছে, শিবাশিষ তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।একসময় বলে কারণটা বলবে অনিমা। আসলে থামতে চাই আমি ও , কিন্তু পারছি কই!

আমি যে ঐ বয়ে চলা ডিঙার মতো।

 আজ ওরা পরস্পরের কাছে নিজেদের অতীতের মুখোমুখি হয়।অনিমা স্বামী পরিত্যক্তা, তা প্রায় দশ বছর। শুনেছে ভিন রাজ্যে গিয়ে নতুন সংসার পেতেছে আবার।কোন যোগাযোগ নেই আর, তখন একমাত্র মেয়ে মঞ্জুর বয়স ন য়।সেই থেকে অনিমার মঞ্জু কে নিয়ে বাঁচার লড়াই চলছে আজো। মঞ্জু সায়েন্স গ্ৰাজুয়েট, নিজের চেষ্টায় চালায় কোচিং সেন্টার।আর চিন্তার বিষয়টা হল এই সম্পর্কটা মেয়ে জানতে পেরে গেছে।

 শিবাশিষ বলে তার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বছর সাতেক।

 এক ছেলে তন্ময়কে নিয়েই তার সংসার।ছেলে এইচ এস পাশ করে এক বিস্কুট কোম্পানির ক্লার্ক। দুজনে সকালে বেরিয়ে যাই আবার রাতে দেখা হয়।ছেলে কোন কিছু এই সম্পর্কের ব্যাপারে বুঝতে পেরেছে কিনা বলতে পারবো না।

 কথাগুলো কঠোর বলেই বোধহয় এতদিন না বলা ছিল, অনিমা বলে ওঠে।একসময় নিরবতা কাটিয়ে

 শিবাশিষ বলে ওঠে, আচ্ছা অনিমা আমাদের অতীত সমস্ত দ্বিধা, সংশয়, ভয় কাটিয়ে পারি নাকি বাকি জীবনটা নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে!

 চলো অনিমা এই বাস্তব সত্যিটা নিয়ে আজ আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের সামনে দাঁড়াই।

দাঁড়াতেই হয়, মুখোমুখি না হয়ে উপায় দেখে না কেউ ই।অনিমা শিবাশিষের সম্পর্কে বাধা হয় না মঞ্জু , তন্ময় কেউ ই । ওরা উৎসাহিত বেশ।মেনে নিচ্ছে এই সম্পর্ক। ওরা ই আজ বাবা মা র ভুমিকায়, অনিমা শিবাশিষকে নতুন রূপে দেখতে চায়।

 পড়ন্ত বৈশাখে, বিকেলের ফেরিঘাট।ভাটির টানে লাল সিঁদুরের টিপ পরে বয়ে চলেছে রূপনারায়ন। 

শিবাশিষ , অনিমাক নিয়ে ফিরে যাচ্ছে চব্বিশ পরগনা, তার পৈত্রিক ভিটেয়।

 জেটিঘাটে ভিড়েছে ওপারে যাওয়ার লঞ্চ। ছেলে মেয়েরা তাদের বাবা মাকে নতুন রূপে পাঠিয়ে দিচ্ছে, নতুন এক জীবনে।এখন আর ওদের একা একা মনে হবে না। অনেকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে চারজন । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একটা বিচ্ছেদ, আনন্দ, ভালোলাগা ও,মঞ্জু তন্ময় মোবাইলে ছবি তোলে কয়েকটা। একসময় বাবা মা র ব্যাগপত্র তুলে দেয়, লঞ্চের সিটে পাশাপাশি বসিয়ে প্রণাম সারে। বাবা মা র চোখে জল। লঞ্চ ছাড়ার সিটি বেজে ওঠে। জেটিতে এসে দাঁড়ায় তন্ময়, মঞ্জু। দ্বিতীয় সিটি দিয়ে

 ছেড়ে যাচ্ছে লঞ্চ।জলে উঠেছে ঢেউ। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ওরা জেটিঘাটে। লঞ্চটা ছোট হতে হতে

 আবছা হয়ে আসে।এক সময় মঞ্জুর হাতটা শক্ত করে ধরে তন্ময়। তারপর বলে ওঠে চলো মঞ্জু , আমরাও

 ওদের মতোই হারিয়ে যাই।

                                                                           ...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment