![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
অধমোত্তম
রানা জামান
ই-মেইলে বদলির পত্রটা রিজভি চৌধুরীকে বিস্মিত করলেও হতাশ করে নি। ঢাকায় ওর আর ভালো লাগছিলো না। রংপুরও ওর অনেক পছন্দের শহর। শীতে সতর্ক থাকতে হবে। পত্রটার একটা ছাপানো কপি বের করে অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে ডেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বললেন। পরক্ষণে অফিসের সবাই ছুটে এসে আফসোস করতে লাগলো।
রিজভি চৌধুরী সবাইকে থামিয়ে বললেন, আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে প্রমোশন নিয়ে বদলি হবো। আমার কপালটাই মন্দ, এবারও সুপারসিটেড হলাম!
অফিসের সবাইকে বিদায় দিয়ে
বাসায় জানালে বিদিশা নেয়ামত বললেন, এই বদলি
ক্যান্সেলের ব্যবস্থা করো।
রিজভি চৌধুরী বললেন, আমাকে একজন ঠেলা দিয়েছে! কাজেই তদবির করে লাভ হবে না!
তাহলে তোমাকে একা যেতে হবে রংপুর!
তথাস্তু!
বেশ ঘটা করেই বিদায় অনুষ্ঠান হলো রিজভি চৌধুরীর। ছয় দিন বিশ্রাম। ছয় দিন ও বাসায় কাটালো দুই ছেলেমেয়ের সাথে।
মেয়েটা বড়। বয়স এগারো বছর। নাম অরুণিমা নেয়ামত চৌধুরী। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। ছোটটা ছেলে। বয়স পাঁচ বছর। নাম অদৃশ হেমায়েত চৌধুরী। অ আ বলার সাথে বই-খাতা ছিড়ছে।
আজ ভোরে রওয়ানা দিয়ে রিজভি চৌধুরী সন্ধ্যায় পৌঁছালেন রংপুরে। অফিসে একটা রেস্টরুম আছে। বাইরে ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবে। অফিস প্রধান হলে এই সুবিধা পাওয়া যায়!
খবর পেয়ে রাতেই অফিসের সবাই রিজভির সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য চলে এলো। নারী সহকর্মীও আছে অফিসে। একজনের প্রতি দৃষ্টি আটকে গেলো ওঁর; কিন্তু ও বুঝতে দিলেন না কাউকে। নামসহ পরিচিতি জেনে নিলেন। ঐ নারী সহকর্মীর নাম সুনন্দা; ওর ব্যক্তিগত সহকারী। নামটা শুনে হতাশ হয়ে এমন নাম রাখার কারণ জেনে হলো চমৎকৃতও।
রিজভি চৌধুরী ওকে প্রশ্ন করতেই প্রায় সবাই জবাব দিলো, সুনন্দা হিন্দু না স্যার, মুসলমান!
বিরক্ত হয়ে সবাইকে একবার দেখে কিছুটা রুক্ষ স্বরে রিজভি চৌধুরী বললেন, আপনারা সবসময়ই কি এভাবে একজনের প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন?
সবাই থতমত খেলো প্রশ্ন শুনে। কেউ কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করলো।
রিজভি চৌধুরী বললেন,
এটা আনকার্টেয়িস! যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে,
সে-ই জবাব দেবে। কথাটা মনে রাখবেন। এবার
সুনন্দা বলেন, আপনি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও
আপনার বাবা-মা কেনো হিন্দু নাম রাখলেন?
বেশ সপ্রতিভভাবেই জবাব দিলো সুনন্দা। বললো, এটা হিন্দু নাম না স্যার, বাংলা নাম! আমরা মুসলমান হওয়ায় আরবি নাম রাখতেই অভ্যস্ত, আর হিন্দুরা নাম রাখছে খাঁটি বাংলায়। তাই আমার বাবা-মা আমাদের সকলের নাম বাংলায় রেখেছেন।
বাহ! বাঙালি মুসলমানেরা
এভাবে ভাবে কিনা জানি না! আপনারা কয় ভাইবোন? সবার নাম বলুন মিজ সুনন্দা!
সুনন্দা রিজভিকে একবার দেখে বললো, আমরা তিন ভাইবোন। দুই ভাই বড়, আর আমি কনিষ্ঠা। দুই ভাই-এর নাম পঙ্কজ ও শৈবাল।
পদের কারণে সুনন্দাকে রিজভি চৌধুরীর কাছাকাছি থাকতেই হচ্ছে- ওর সৌন্দর্য ও বাংলা নাম রিজভির আরো কাছে নিয়ে এলো। উপরন্তু অবিবাহিত থাকায় রিজভির মনে একটা নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগতে শুরু করলো। ওর নেয়া সুগন্ধ চেপে গায়ের ঘ্রাণ নেবার নিষিদ্ধ ইচ্ছেটা অবসরে বেশ বিরক্ত করতে থাকায় আনমনা হতে থাকলেন রিজভি। ভুলে যেতে থাকলেন নিয়মিত ঢাকা ফোন করার। কিন্তু রিজভি চৌধুরী ভুলতে চাইলে কী হবে, বিদিশা নেয়ামত চৌধুরী ঐ সুযোগ দেবেন কেনো? বিদিশা অফিস সময়ে ফোনকল দেন-ই, রাতেও ঘুমুতে যাবার আগে ফোন দিয়ে নাওয়া-খাওয়া-দাওয়া ও স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে থাকলেন। প্রথম সপ্তাহের অন্তে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে কথা বলে রিজভি চৌধুরীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে দুপুরের মধ্যে রওয়ানা না দিলে ঢাকা পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। দুপুর গড়িয়ে যাবার পরেও রিজভি চৌধুরী অফিসে থাকায় ভর্ৎসনা করতে গেলে যা বললেন তাতে স্রেফ বোবা হয়ে গেলেন বিদিশা। এদিকটা মাথায়ই আসেনি! সন্ধ্যার পরে বিমান আসে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায়। আধাঘণ্টার ভ্রমণ।
রংপুরে অফিস ভালোই চলতে লাগলো রিজভি চৌধুরীর। নিয়মিত কাজ হিসেবেই সুনন্দা ওঁর কাছে আসা-যাওয়া করছে। এরপরেও ওর প্রতি বসের বিশেষ দৃষ্টি আছে, তা অফিসের সবাই বুঝতে পারছে।
এক সপ্তাহ পরে সুনন্দার জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে রিজভির দৃষ্টি দেখে ওর বান্ধবীরা বেশ ঠাট্টা করলেও সুনন্দা গা করে নি। অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই চলে গেলেও রুবিনা রয়ে গেলো। শ্রান্ত দু'জন বসে আছে ড্রয়িংরুমে।
রুবিনা বললো, তোর বসটা কিন্তু দেখতে বেশ স্মার্ট!
সুনন্দা ঠোঁট উল্টে বললো, দুই সন্তানের পিতা না হলে ভেবে দেখতাম!
তো কী হয়েছে, এখনো ট্রাই করতে পারিস!
আরে নাহ! কী যে বলছিস তুই রুবি!
তখন সুনন্দার মাতা মাধুরী ভেতরে ঢুকে বললেন, গিফ্টগুলো না খুলে কী নিয়া কথা বলছিস তোরা?
সুনন্দা বলার আগেই রুবিনা বললো, সুনন্দার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলাম খালা!
যদ্দুর জানি ওর কোনো প্রেম নাই। তুমি কি কোনো ছেলে দেখেছো?
রুবিনা সুনন্দার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, ও রাজি থাকলে লাইন লেগে যেতো ছেলেদের! আজকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একজনকে পছন্দ হয়েছে। আমার বিশ্বাস ওরও সুনন্দাকে পছন্দ!
তাহলে তুমি ঘটকালি শুরু করে দাও। সফল হলে তোমাকে একটা জামদানি শাড়ি দেবো!
সুনন্দা বললো, রুবিনার ঠাট্টাও তুমি বুঝতে পারছো না মা!
মাধুরী অবাক হয়ে বললেন, সত্যি তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছো রুবিনা?
ঠাট্টা না খালা, সিরিয়াসলি বলছি। তবে সমস্যা আছে একটা, বিরাট সমস্যা।
মাধুরী ওদের মুখোমুখি একটা সোফায় বসে জানতে চাইলেন, কী সমস্যা?
লোকটা দুই সন্তানের পিতা।
স্ত্রী মারা গেছে, না জীবিত আছে?
জীবিত।
তাহলে ব্যাপারটা ঠাট্টা হয়ে গেলো না রুবিনা?
ইসলাম ধর্মে চারটা পর্যন্ত বিয়ের এপ্রুভাল আছে খালা।
তাও ঠিক। লোকটা কে?
সুনন্দার বস।
তুমি ঘটকালি করতে পারো রুবিনা যদি সু'র আপত্তি না থাকে!
রুবিনা নেমে পড়লো মাঠে। প্রথমদিন সুনন্দার সাথে অফিসে গিয়ে রিজভি চৌধুরীর সাথে পরিচিত হয়ে এলো। এরপরে পরপর কয়েকদিন অফিসে গিয়ে সুনন্দার সাথে কথা বলার ছলে রিজভির সাথে কথা বললো। এক সপ্তাহ পরে রিজভি ও সুনন্দাকে বাসায় দাওয়াত করলো রুবনা। খাওয়ার টেবিলে বা ড্রয়িংরুমে বিয়ে সংক্রান্ত কোনো কথাই বললো না রুবিনা।
এই ঘটনার তিনদিন পরে কোনো
ছুটি ছাড়াই সুনন্দা অফিসে এলো না। আধাঘণ্টা পরে রিজভি চৌধুরী ফোনকল করতে যাবেন তখন
উৎফুল্ল চেহারা নিয়ে রুবিনা চেম্বারে ঢুকলে বেশ অবাক হলেন রিজভি।
সুনন্দার আজ অফিসে না আসার ব্যাপারে রুবিনা কিছু জানে কিনা রিজভি চৌধুরী জানতে চাইলে রুবিনা হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললো, হঠাৎ করেই আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে। আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই খবরটা দিতে আসলাম!
সংবাদটা শুনে একটা হোচট
খেলেন রিজভি চৌধুরী। মুচকি হাসিটা ওঁর মুখ বিকৃতির মতো দেখালো।
রিজভি চৌধুরী আনমনা হয়ে গেছে বুঝতে পেরে রুবিনা স্মিত হাসলেও কিছু বললো না। এটা অপেক্ষা করার মূহুর্ত! সে তাকিয়ে থাকলো দেয়াল ঘড়িটার দিকে। এক মিনিট পার হলে বললো, স্যার কি কিছু ভাবছেন?
রিজভি সম্বিত ফিরে চমকে উঠে বললেন, না মানে.. এতো তাড়াতাড়ি সমন্ধ চলে এলো সুনন্দার!
ভালো পাত্র সবসময় পাওয়া যায় না স্যার। তাছাড়া দেখতে এলেই সমন্ধ পাকা হয়ে যায় না!
তা ঠিক।
আপনার কি খারাপ লাগছে স্যার?
নাহ! আমার খারাপ লাগবে কেনো!
রুবিনা রিজভির দিকে একটু ঝুকে নিম্নস্বরে বললো, সুনন্দার বিয়ে হয়ে গেলে আপনার সত্যই খারাপ লাগবে না স্যার?
ঐদিন বিকেলে রিজভি চৌধুরী ও সুনন্দাকে মাহিগঞ্জ রাজবাড়ির সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা গেলো। রিজভির চেহারায় বিষন্নতা না থাকলেও একটা প্রতানের ছায়া দেখা যাচ্ছে। নিজকে আড়ালে রেখে রুবিনা ওদের পারস্পরিক সাড়া প্রত্যক্ষ করছে।
সুনন্দা মুখ টিপে হেসে বললো, এখন খুশি স্যার?
রিজভি গাল ফোলা রেখে বললেন, স্যার বললে কথা বলবো না!
দুঃখিত! আর স্যার বলবো না! এখন খুশি রিজভি?
ভী-ষ-ণ!
রিজভি চৌধুরী ডান হাত বাড়িয়ে সুনন্দার একটা হাত ধরতে গেলে সুনন্দা একটু দূরে সরে বসে বললো, উহু!
কী হলো?
বিয়ের আগে নো টাচ!
কেনো?
তোমার বৌ বাচ্চা আছে। বিয়ে হবে কিনা নিশ্চিত না! কাজেই নো এসুরেন্স অব ম্যারেজ, নো টাচ!
সন্ধ্যার পরে ড্রয়িংরুমে বসে দুই ছেলেমেয়ের সাথে টেলিভিশন দেখার পাশাপাশি চা পান করছিলেন বিদিশা হেমায়েত। তখন কলবেল বাজলে অরুণিমা ছুটে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে বাবাকে দেখে খুশিতে লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে বললো, মা, বাবা আসছে!
বিদিশা নেয়ামত দাঁড়িয়ে বললেন, ভালোই চমক দিলে মিস্টার রিজভি! তোমার সারপ্রাইজ এরাইভালে ছেলেমেয়ে দুটো খুব খুশি হয়েছে।
রিজভি বললেন, তুমি সারপ্রাইজড হও নাই?
উত্তরে বিদিশা নেয়ামত ভালোবাসার হাসি হাসলেন। আধাঘণ্টার মধ্যে চারজন বের হলো বাইরে। উদ্দেশ্য: ঘুরাফেরা করে রাতের খাবার খাবে একটা বড় রেস্টুরেন্টে। পরিচিত একটা রেন্ট-এ-কার থেকে একটা কার ভাড়া নিয়েছেন। রাতে লং-ড্রাইভে যেতে হলে ঢাকা-মাওয়া সড়কের চেয়ে উত্তম আর কোন সড়ক হতে পারে! আশি কিলোমিটারের উর্ধে কার ছুটে চলছে। একসময় কারের ব্রেক ফেল হলে ড্রাইভার দরজা খুলে লাফ দিলো বাইরে। ড্রাইভার বিহীন গাড়ি রাস্তা ছেড়ে একটা গাছের সাথে জোরে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো।
সিটিভিতে দূর্ঘটনা দেখতে পেয়ে এ্যাম্বুলেন্সসহ হাইওয়ে পুলিশ চলে এলো ঘটনাস্থলে। চারজনকে মারাত্মক আহত অবস্থায় ভর্তি করা হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বাঁচানো গেলো না তিনজনকে।
একমাস পরে বাম হাত স্লিং-এ ঝুলিয়ে রিজভি চৌধুরী অফিসে গেলেন। একমাস হাসপাতালে থাকাকালে সুনন্দাসহ অফিসের সবাই এসে সমবেদনা দেখিয়ে গেছে। চেম্বারে বসে সবার সাথে সৌজন্য বিনিময় করে রিজভি চলে এলেন রেস্টরুমে। একটু পরে সুনন্দা এলেও মুখে হাসি না দেখে বিস্মিত হলেন রিজভি চৌধুরী। বললেন, তোমার হাত ধরার পথের বাঁধা দূর হয়ে গেছে চিরতরে, তারপরও তোমার মুখে হাসি নাই কেনো সু?
সুনন্দা শুকনো কণ্ঠে বললো, আপনাকে দেখে আমার খুব আশ্চর্য লাগছে স্যার!
সুনন্দার সম্বোধন পাল্টে
যাওয়ায় বিস্মিত হয়ে বললেন রিজভি, তোমার কী হয়েছে
সু? আপনি বলছো! স্যার বলছো!
সুনন্দা বললো, আপনি যতো নিষ্ঠুর ততো বোকা!
মানে?
আমি আপনার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। আমি সুন্দরী হওয়ায় আমাকে পাবার জন্য দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে দূর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করালেন!
বাহ! তুমি খুব বুদ্ধিমতি!
আমাকে বিয়ে করার পরে আরেক
অফিসে বদলি হলে ঐ অফিসের সুন্দরী পি-এ এর প্রেমে পড়ে আমাকে খুন করবেন না, এর গ্যারান্টি কে দেবে!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment