1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

এখানে ইতিহাস ফিসফিস করে কথা কয়

 

ছবি  : লেখক 

এখানে ইতিহাস ফিসফিস করে কথা কয়

ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

 

প্রথম দিনের যাত্রা

জীবনের নদী বয়ে নিয়ে যায় ঘটনার স্রোতকে। সব ঘটনাই অতীত হয় কিন্তু সব অতীত ইতিহাস হয় না। ঘটনার ঘনঘটায় যে অতীত থাকে উজ্জ্বল অথবা কলংকিত সেই অতীত ইতিহাসের পাতায় নিজেই দাগ কেটে নেয়। অতীত নিয়ে সাধারণ মানুষ সাধারণত মাথা ঘামায় না। তবে তাকে মাথা ঘামাতে হয় অথবা কৌতূহলী হতে হয় সেই অতীত নিয়ে যাতে থাকে ঘটনার ঘনঘটা। ইতিহাস হয় সেই অতীত যা তার সু কাজ কিংবা কু কাজের জন্যে কখনও নির্মাণ করে একটা সৌধ আবার কখনও বা একটা গভীর দহ। ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দেয়। অতীত দিশা দেয় ভবিষ্যতে চলার সঠিক পথের।                

আমার মত সাধারণ মানুষের কাছে ইতিহাস দর্শন নিতান্ত কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশ্যে। সারা বিশ্বের মত ভারতেও ঐতিহাসিক স্থানের অন্ত নেই। আমাদের এখানে রয়েছে এক কালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। এখানে জীবন এগিয়েছে, সমাজ এগিয়েছে অনেক। কিন্তু ইতিহাসকে মানুষ বিশেষ ঘাঁটায় নি। তাকে একপাশে তার মত করে থাকতে দিয়ে নিজের গতিপথ ঠিক করে নিয়েছে। আর তাই হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, ইমামবাড়া, খোসবাগ, জাফরাগঞ্জ, পলাশীর আমবাগান, মোতিঝিল, কাশিমবাজার, জাহানকোষা কামান, কিরীটেশ্বরী মন্দির, ডাচ সমাধি ক্ষেত্র, নসিপুরের আখড়া, জগৎ শেঠের বাড়ি, কাঠগোলা প্রভৃতি অজস্র দর্শনীয় স্থান আজও ভবিষ্যৎ দর্শকদের জন্যে নিজেদের মত করে ঘুমিয়ে আছে আর ফিসফিস করে নিজেদের কথা বলছে। কৌতূহলী মানুষের কাজ শুধু তার দুয়ারে একবার খট খট করে টোকা দেওয়া।   

শিয়ালদহ থেকে দুপুর বারটা পঞ্চাশ মিনিটে আমাদের লালগোলা প্যাসেঞ্জার ছাড়ল এস ওয়ান রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে আমাদের নিয়ে। আমি আর আমার এডভোকেট বন্ধু। বিকেল পাঁচটায় পৌঁছলাম বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। সেখানকার টুরিষ্ট লজে ঢুকে পড়েছি ছ’টার মধ্যেই। সেদিন তো আর কিছু দেখা সম্ভব নয়। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে আগামী দু’দিনের ট্যুরের জন্যে গাড়ি ঠিক করে নেওয়া গেল।

আজ আর কিছু করার নেই। অগত্যা চা খেয়ে হোটেলের বাইরে বেরোন গেল। এই অঞ্চল আপাতত নাতিশীতোষ্ণ বলা না গেলেও এই শীত উপভোগ্যই লাগছে। শরীরকে ফুলহাতা সোয়েটার বা জ্যাকেট আর টুপির আড়ালে রেখে মন বেশ খুশিতেই ছিল। আমরা হাঁটছিলাম। বড় বড় সরকারি অফিসগুলো এখানে। কারণ এটা মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর। গান্ধী মোড়ের বিরাট বড় পার্কের পাশ দিয়ে ডানদিকে বহরমপুর টেক্সটটাইল কলেজে সরস্বতী পুজো আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন। কিছুটা দেখে বাইরে বেরিয়ে এলুম।

একটা বেশ বড় মিষ্টির দোকানে মালপোয়া, লবঙ্গ লতিকা আর অন্য মিষ্টি খেয়ে পেটের, মনের আর চোখের খিদে মেটানো গেল। এত বিশাল আকারের লবঙ্গ লতিকা আর মালপোয়া আমি আগে কখনও খাই নি। ইতিহাস দর্শনের আগেই এই মিষ্টি দর্শনে বর্তমানে মুখ আর মন দুইই বেশ ভরে গেল। এখানে বিশেষ ভাবে খাবারের দোকানগুলো বেশ বড় আর সুন্দর। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন তো বটেই। দেখে মন বেশ প্রসন্ন হবার কথা।

বহরমপুরে আমাদের অস্থায়ী আবাস ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিজমের এক সুন্দর দারুণ সাজানো গোছানো লজটি। খাবারও এখানে বেশ ভাল। বেরোনর আগে আমরা ডিনারের অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। আজকের রাতের জন্যে ভাত ডাল সবজি আর চিকেন যথেষ্ট ছিল। ডিনারের পর রুমে বসে টিভি দেখে নেওয়া গেল। লোকের সঙ্গে কথা বলা নাকি লেখকের খুব দরকার। শুক্তোর ডাঁটা চিবুতে মানুষের যত কষ্ট মোবাইলে ডাটা ভরতে তার ঠিক ততই আনন্দ।  আনন্দ আমারও ছিল। আর তাই নেপথ্যে থেকে কথা বলার অভ্যাস বজায় রাখতে পেরেছিলুম দিব্বি। বহু বন্ধুর কল্পিত উপস্থিতি (digital presence) টের পাচ্ছিলাম। রাত এগারটা এসে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিল। কাল নটার মধ্যেই বেরোতে হবে।



দ্বিতীয় দিনের যাত্রা

আজ সকালে আমাদের ভ্রমণের আসল পর্ব হল শুরু। আমাদের গাড়ি সাড়ে নটার মধ্যেই চলে এল। গরম ফুলকো লুচি, আলুর তরকারি আর সুস্বাদু দার্জিলিং চা এই ছিল ব্রেকফাস্টের মেনু। গাড়ি নাতিবৃহৎ এক যাত্রা সেরে প্রথম দাঁড়াল মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা কামান দেখাতে। আমাদের প্রথম দর্শনীয় বস্তু।

এই চরম বিস্ময়ের দর্শন মিলল মুর্শিদাবাদে নবাবের তোপখানায় কাটরা মসজিদে যাওয়ার পথে। সামান্য দূরে কাটরা মসজিদ১৬৩৭ সালে দিল্লীর মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে জনার্দন কর্মকার নামে এক বাঙ্গালি কারিগরের হাতে গড়া প্রায় সাড়ে সতের ফুট দীর্ঘ আর তিনফুট ব্যাস বিশিষ্ট এক কামান হল এই জাহানকোষা। এর বিশাল আকার আর বিরাট আর ক্ষমতার জন্যে একে ‘বৃহৎ কামান’ বা ‘গ্রেট গান’, ‘ডেস্ট্রয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ড’, ‘কনকারার অফ দি ইউনিভার্স’, ‘ওয়ার্ল্ড সাবডুয়ার’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। প্রতিবার কামান দাগার জন্যে সতের কিলোগ্রাম বারুদের প্রয়োজন হত এই অতীব দর্শনীয় কামানটিতে।

এরপর চলেছি আমাদের দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থান মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত কাটরা মসজিদ দেখতে। ১৭২৩ থেকে ১৭২৪ সালের মধ্যে মুর্শিদকুলি খানের নির্মিত বিশাল এই মসজিদ স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। খিলেনের ওপর ধারণ করা এটি সম্পূর্ণ ইঁটের তৈরি এই বিস্ময়কর সৌধ। আজকের এই কংক্রিটের যুগে খিলেন শব্দটা আমরা অনেকেই হয়ত ভুলতে বসেছি। তিনশ বছর আগে সিমেন্ট ছিল স্বপ্ন গড়ার উপাদান। ইঁট গাঁথার জন্যে মাঝে মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হত সুরকি যা ইঁটকে মিহি করে গুঁড়ো করেই পাওয়া যেত। খিলেন হল ইঁটের সঙ্গে ইঁট বিশেষ কায়দায় সাজিয়ে কড়ি বরগা ছাড়াই ছাদ তৈরি করা। এই খিলেন যে কত শক্তিশালী হতে পারে মসজিদটিই তার এক চমকপ্রদ নিদর্শন।                  শুধু মসজিদ বা নমাজের স্থান ছাড়াও এটি ছিল একটি মাদ্রাসা বা শিক্ষাকেন্দ্রও। চারকোণা এই মসজিদের চারকোণে চারটি ৭০ ফুট উঁচু আর ২৫ ফুট ব্যস যুক্ত অষ্টভুজাকৃতি মিনার ছিল। দুঃখের বিষয় এর মাত্র দুটি এখন অবশিষ্ট আছে আর যেগুলির সংস্কার চলছে।

দুই তলা বিশিষ্ট ছিল বিশাল এই মসজিদ। দুই তলা মিলিয়ে ৭০০ ছাত্রদের থাকার জন্যে ঘর, রান্নার জন্যে রান্নাঘর ইত্যাদি ছিল। ঘরগুলি ইঁটের খিলেন করা এবং প্রত্যেকটি ২০ ফুট বর্গ মাপের।

প্রায় ২০০০ ব্যক্তির নমাজ পাঠ করার জন্য ২০০০টি চৌকো খাঁজ কাটা দেখার মত আসন তৈরি করা ছিল মসজিদের উপরের তলায় মাঝে বিরাট চত্বরে। এগুলি এখনও অক্ষত দেখতে পাওয়া যায়। চারটি মিনারের ওপর চারটি গম্বুজ ছাড়াও মসজিদের মাঝে একটি বড় গম্বুজ ছিল যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে অবলুপ্ত হয়ে যায়।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে কবরস্থ করা হয়েছে তাঁরই পূর্ব নির্ধারিত আর নির্দেশিত ইচ্ছার নিরিখে কেন্দ্রীয় মসজিদটির মূল ওঠার চোদ্দ ধাপের সিঁড়ির নিচে। জীবনের শেষ দিকে নিজের কৃত কর্মের জন্যে অনুতপ্ত নবাবের ইচ্ছা ছিল তাঁর কবরের ওপর দিয়ে চলে যাবে অসংখ্য মানুষের পদতল। এটি সেই ইচ্ছারই বাস্তবায়ন। ফুলে ফুলে ভরা সেই বিশাল মসজিদ আর তার চত্বর ঘুরে দেখার মত। 

কাটরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে রেল লাইন পেরিয়ে ঠিক ক্রশিং–এর পরেই এক অসম্পূর্ণ মসজিদ। শেষ জীবনে কাটরা মসজিদের আদলে একটি মসজিদ বানানোর পরিকল্পনা করেন মুর্শিদকুলি খাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁ। কিন্তু কাটরা মসজিদের থেকে আকারে অনেক ছোট লম্বায় প্রায় ১৩৫ ফুট আর উচ্চতায় ৪০ ফুট এই মসজিদ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনটি গম্বুজের দুইটি সম্পূর্ণ হলেও মাঝের প্রধান গম্বুজটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আলীবর্দী খাঁর হাতে পরাজিত আর নিহত হন। এইভাবে নবাব বিধ্বংস বা ফৌত হয়ে যাওয়ার কারণে এটিকে ফৌতি মসজিদ বা ফুটি মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়। সরফরাজ খাঁর পরে আর কোনও নবাবই এই মসজিদ সম্পূর্ণ করেন নি। এর অন্য দুটি গম্বুজও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙ্গে পড়ে। মাথায় ফুটো থেকে যাওয়ায় অবশ্য স্থানীয়ভাবে একে ফুটো মসজিদও বলা হয়। তবে এই নামকরণ ইতিহাস সমর্থন করেছে বলে জানা নেই। মসজিদের সামনের সিঁড়িটি একেবারেই ভাঙ্গা তাই পর্যটকদের বেশ অসুবিধে হবে।

আর ভাঙ্গাটাঙ্গা কিছু নয়। এবার যাচ্ছি সুন্দর এক জিনিস দেখতে। কাঠগোলা বাগান আর তার ঠিক মাঝে মার্বেল পাথরে তৈরি আর সুন্দর পুষ্পোদ্যান বেষ্টিত জৈন মন্দির। কাঠগোলা বাগানের বিশাল চত্বরের মধ্যে দর্শনীয় তিনটি জিনিস। একেবারে গোড়াতেই রয়েছে ডানদিকে চিঁড়িয়াখানা আর বাঁ দিকে একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ যা চলে গেছে একেবারে ভাগীরথী নদী পর্যন্ত। আমাদের এখানের হুগলী নদীই কিন্তু মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নামে পরিচিত। এই সুড়ঙ্গ পথটি বহিরাক্রমণ হলে নদীপথে পালাবার জন্যে ব্যবহৃত হত বলে কথিত আছে। 

বিশাল প্রশস্ত বাগানে অন্যান্য বহু ফুলের মধ্যেও গোলাপেরই প্রাধান্য। বাগানে চারদিকে চার ঘোড় সওয়ারের স্ট্যাচু। এই বাগান ছিল নাকি চার ভাইয়ের যাদের সঙ্গে স্বয়ং জগৎ শেঠের খুব দহরম মহরম ছিল। কেউ বলে এরা ছিলেন রত্ন পাথরের ব্যাবসায়ী। আবার কেউ কেউ বলেন এরা ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ী আর তাই থেকেই এর নাম হয়েছে কাঠগোলা বাগান। নামের উৎস হিসেবে কেউ কেউ এখানে নাকি কাঠগোলাপ পাওয়া যেত বলে। এই বাগান সত্যিই মনোরম। মুর্শিদাবাদে এক নাগাড়ে নিদ্রিত, মৃত বা অর্ধমৃত ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে দেখতে ক্লান্ত মানুষের কাছে এই বাগান সত্যিই এক নয়নসুখ।

চিঁড়িয়াখানা বা বাগান ছাড়াও বিরাট এই জায়গায় রয়েছে আরও অনেক কিছু। ভাগীরথী পর্যন্ত গুপ্ত সুড়ঙ্গর কথা তো বলেইছি। আরও তিনটি জিনিস যা আছে তার একটি হল সুরম্য আর সুপ্রশস্ত এক ঝিল। যার মধ্যে মাছের কিলবিল করে খেলা দেখা ছাড়াও বাঁধানো ঘাটে দাঁড়িয়ে জলে সারি সারি হাঁসের চরে বেড়ানোও কম উপভোগ্য নয়।

সরোবরের ঠিক পাশেই সুমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক সুদৃশ্য মিউজিয়াম। দুইতলার এই মিউজিয়ামে অতীতের বহু নিদর্শন, অস্ত্রশস্ত্র, ব্যবহার্য বাসনপত্র ও অন্যান্য জিনিস, মূল্যবান পোশাক ইত্যাদি দেখে তাক লেগে যাবার মত।

সুন্দর ফুলের বাগান ঘেরা সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের জৈন মন্দিরের কথা তো আগেই বলেছি। এর এক পাশে একটি ছোট জলাশয়ে আবার বোটিংও হয়। সব মিলিয়ে কাঠগোলা বাগান আর চিঁড়িয়াখানা ঘুরতে ঘন্টা দুয়েক সময় তো লাগবেই। আরও বেশি সময় দিলে তো আরও ভাল। সারা মুর্শিদাবাদ যেখানে ফিসফিস করে কথা কইছে সেখানে কাঠগোলা বাগান কিন্তু বেশ হেসে হেসে যেন সোচ্চারে অভ্যর্থনা করছে অতিথিদের।

ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকের ছড়াছড়ি। এই সব বিশ্বাসঘাতকেরা শুধু যে কৌতূহলের খোরাক তা নয় ইতিহাসের শিক্ষাও বটে। বিশ্বাসঘাতক না থাকলে হয়ত মানুষের সমাজের কাঠামোটাই অন্যরকম হত। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যও এক বিশ্বাসঘাতকের বাড়ি। ইংরেজদের হাতে সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের অন্যতম এক নায়ক হিসেবে পরিচয় হলেও সেটি জগৎশেঠের একমাত্র পরিচয় ছিল না। ধনকুবের রক্তচোষা এক মহাজন হিসেবেও ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছেন জগৎশেঠ বা মহতাব শেঠ। কাঠগোলা বাগান পেরিয়ে নসিপুরের রাজবাড়ির অনতিদূরে বিরাট এক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হল এই জগৎশেঠের বাড়ি। বর্তমানে বাড়িটি একটি মিউজিয়াম হিসেবে পর্যটকদের দেখান হয়। বাড়ি ছাড়াও রয়েছে গুপ্ত সুড়ঙ্গ, পাতালঘর। ইতিহাস বলে জগৎশেঠ নবাবদের পর্যন্ত টাকা ধার দিতেন। পর্যটকদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে পাতালঘরে তাঁর নিজস্ব টাঁকশাল দেখে যেখানে সোনা রূপোর মুদ্রা তৈরি হত। তার ব্যবহৃত পোশাক, বিছানাপাতি, আসবাবপত্র, গয়না, অস্ত্রশস্ত্র, বন্দুক হাতকামান ইত্যাদি বহু বহু জিনিস।

পাতাল থেকে উঠে এসে দেখা যাবে নানা ফুলে ভর্তি বাগান আর একটি সুরম্য শ্বেত পাথরে মোড়া মন্দির। ইতিহাসে বলে মীরজাফরের পর দ্বিতীয় এক বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তির নাম করা যায় যিনি বাংলায় নবাবী শাসনের পতন আর ইংরেজ শাসনের পত্তন ত্বরান্বিত করেছিলেন তিনি হলেন এই জগৎশেঠ। এমনই এক ধনকুবের যিনি নবাবদের অর্থ ঋণ দিতেন এমন কি অর্থ বা মুদ্রা ছাপানোর পর্যন্ত লিখিত অনুমতি যার ছিল তাঁর জীবনযাত্রা, বিলাসব্যসন ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। এই বাড়ি ভাল করে দেখলে সেই কৌতূহল অনেকটাই পূরণ হতে পারে। জগৎশেঠ ছিলেন এক বিস্ময়। রাজা বা নবাব কিছুই ছিলেন না অথচ তাঁর ভান্ডারে এত অর্থ ছিল যা কোনও নবারেরও ছিল না। আর তার জোরে নবাবদের নিজের হাতের মুঠোয় রাখতেন তিনি। লর্ড ক্লাইভের একটা পোশাক এখানে দেখা যাবে।  আরও কিছু বিস্ময়কর জিনিসের মধ্যে আছে খাবারে বিষ আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যে বিশেষ ধরণের পাত্র। বিস্ময়ের উপাদান হিসেবে আরও আছে তাঁর ব্যবহৃত টাইপ রাইটার, টেলিফোন। তখনকার বিখাত নর্তকী হীরা বাঈ যার উচ্চতা ছিল অসাধারণ আর তা হল ছয় ফুটের ওপর কিন্তু ওজন ছিল মাত্র ৪২ কেজি। তার একটা তৈলচিত্র আছে এখানে। বিস্ময়, কৌতূহল আর হতবাক করার সব উপাদান নিয়ে পর্যটকদের কাছে বেশ সেজেগুজে উপস্থিত এই জগৎশেঠের বাড়ি।                 

বাংলার বাইরে থেকে আসা দেবী সিংহ মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে চাকরি ও আনুগত্য পেয়েছিলেন। তিনি নাকি আরও নানা অসৎ পথে অর্থ রোজগার করতেন। ঠ্যাঙ্গাড়েগিরি, ডাকাতি, লোককে নানাভাবে শোষণ ইত্যাদি ছিল এই অসৎ পথের মধ্যে। আবার তিনি ইংরেজদের গোপনে প্রচুর সাহায্য করতেন নবাবদের বিরুদ্ধে প্রচুর গোপন তথ্য দিয়ে। ইংরেজরা তাঁকে মহারাজা উপাধি দেন এর প্রতিদান স্বরূপ। ইংরেজদের চাটুকারি করে লর্ড ক্লাইভের হাত থেকে এই রাজা উপাধি হস্তগত করেন। ১৭৭৬ সালে লালবাগে নসীপুর স্থানে রাজা দেবী সিংহের উত্তর পুরুষ কীর্তিচাঁদ এই বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এটিই ছিল আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল নসীপুরের রাজবাড়ি। অতীতের বহু নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও  দ্বিতল এই প্রাসাদটিতে কাঠগোলা বাগান, হাজার দুয়ারি, ইত্যাদির মত বিনোদন মিলবে না। এক বিরাট রাজপ্রাসাদের ভগ্নদশার মধ্যে এখানে আছে একটি ফাঁসিঘর যেখানে অবাধ্য প্রজাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হত, আর কিছু দেবদেবী। রামের মন্দির আর রাম লক্ষণ সীতা প্রভৃতির মূর্তি। তবু ইতিহাসের শিক্ষা পেতে এই উপাদানগুলি যথেষ্ট।

রাজবাড়ির অদূরে নসীপুর আখড়া। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত রামানুজ সম্প্রদায়ের সাধুদের এই আখড়া অবশ্যই একটা দেখার মত জিনিস। ঝুলন পূর্ণিমা ও রথযাত্রায় এখানে বিরাট উৎসব হয়। এখানের বিরাট বিস্ময় হল সম্পূর্ণ চাঁদির তৈরি ১৪ ফুট উঁচু বিরাট রথ। চাঁদি হল খাঁটি রূপোর মুদ্রা। এ ছাড়া নানা দেবদেবীর মূর্তি, উৎসবের সময় গুরুজীদের আর শিষ্যদের থাকার জায়গা ইত্যাদি। এটিও ঘুরে দেখতে বেশ ভাল লাগবে। এক নাগাড়ে ঐতিহাসিক স্থান আর কবরখানা দেখতে দেখতে যারা বিষন্ন অথবা ধার্মিক মনোভাবাপন্ন তাদের ক্ষেত্রে এটা একটা ভাল টনিক অবশ্যই।

বর্তমানের মৃত্যু ঘটলে তবেই তো তা ইতিহাস হয়? অতএব এখানে সেকালের বর্তমান শায়িত আছে কবরে কবরে। সেই শয়ে শয়ে কবর শুয়ে আছ জাফরাগঞ্জের মাটিতে। মানে মীর জাফর আলী খান আর তার বংশধরদের বিশাল কবরখানা। প্রধান ফটকটির অবস্থা বড়ই শোচনীয়।  ভেতরের প্রধান কবরগুলির ভালভাবে দেখা গেলেও তার বাইরে রয়েছে অসংখ্য শয়ে শয়ে কবর। সূর্যদেব যখন পশ্চিমদিকে অনেকটা ঢলে পড়বে আর ছায়া তার দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করবে কবরখানার ওপর তখন গা যেন ছমছম করে উঠবে হয়ত কবরে শায়িত অতীতকে ছায়ামূর্তির মত উঠে আসতে দেখে। এই অতীত শুধু ভয়ালই নয় করুণও বটে।

এখানেই দেখা যাবে মুর্শিদকুলি খাঁর মেয়ে আজিমুন্নেসার কবর। যে কবরটি আচ্ছাদিত ছিল এক মসজিদ দিয়ে। মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে ভূমিকম্পে। কিন্তু একটি প্রবেশদ্বার এখনও একটা ভাঙ্গা কোণ নিয়ে অপেক্ষায় আছে ভ্রমনার্থীদের আপ্যায়নের জন্যে। আজিমুন্নেসা বেগমের অতীত এক ভয়ংকর রোমহর্ষকতায় মোড়া। কথিত আছে তিনি নাকি শিশুদের কলিজা খেতে অভ্যস্থ হয়েছিলেন। বহু শিশু এইভাবে মারা যাবার পর তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘কলিজাখাকি বেগম’। এখানেও বাবা মুর্শিদকুলির মতই মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচে কবরস্থ হয়েছে মেয়ে।

চক মসজিদ, ত্রিপোলিয়া গেট, নৌসুরী বানুর সমাধি এসব আছে ছোট বড় অনেক কিছু। নৌসেরি বানু হচ্ছে মুর্শিদকুলির স্ত্রী আর আজিমুন্নেসার মা।

সত্য আর মরীচীকা দিয়ে গড়া হাজার দরজা নিয়ে গড়া মুর্শিদাবাদের সকলের চোখে বিখ্যাত হাজারদুয়ারি না গেলে মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ হয়ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। এই অসম্পূর্ণতা দূর করতে এরপর আমাদের প্রবেশ হাজারদুয়ারিতে। বেলা তিনটের সামান্য আগে ভাগীরথীর তীরে পৌঁছন গেল সেই বিস্ময়ের হাজারদুয়ারিতে। মুর্শিদাবাদ বললেই এক কথায় যার ছবি মনের চোখে ভাসে হাজার দরজাওয়ালা সেই বিখ্যাত। ঢুকব কিন্তু পেটের ভেতরে ছুঁচোরা এতক্ষণ নানা স্থান দেখে বিরক্ত হয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে ছেঁড়া ছিঁড়ি করছে। গঙ্গা বা ভাগীরথী তার ধারে ধারে অসংখ্য ভাতের হোটেলের একটায় ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এল। আগে খাব না আগে ঘুরে আসব সে বিষয়ে দোটানায় ছিলুম। ভেতরে ঘুরতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি লাগে না- ড্রাইভারের এই আশ্বাসে আমরা আগে খেয়েই নিলুম। 

পরিবর্তিত নিয়মে হাজারদুয়ারির ভেতরে মোবাইল কিংবা ক্যামেরা কিছু নিয়ে যাওয়া যায় না।  রীতিমত লাইন দিয়ে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। হাতে আর বিশেষ সময় নেই। এখন বাজে প্রায় পৌনে চারটে। সাড়ে চারটেতে বন্ধ হয়ে যাবার কথা এই সৌধের। আমি মোবাইল গাড়িতে ড্রাইভারের জিম্মায় ছিল। ঢুকে গেলাম ভেতরে। প্রায় ৪২ বছর আগে ১৯৭৬ সালে যখন এসেছিলাম তখন হাজারদুয়ারির মধ্যে হাজার হাজার শুধু দরজাই নয়, খুঁজে পেয়েছিলাম হাজার হাজার বিস্ময়। কিন্তু এখন আর বেশি সময় লাগল না কারণ নিরাপত্তার কারণে তিনতলা সম্পূর্ণ বন্ধ। 

কিছুক্ষণ পরে বন্ধুও দেখে ফিরে এল। চারিদিকে আসন্ন সান্ধ্য প্রকৃতির আভাষ। গঙ্গা বা ভাগীরথীর ওপারে পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তার তেজ হারিয়ে বড় স্নিগ্ধ হয়ে পড়েছে। আমার বিমুগ্ধ মোবাইল ক্যামেরা তাকে গোটা দুই চুমু খেয়ে ফেলল।

চারপাশে অন্ধকা্রের আস্তে আস্তে ঘনত্ব বাড়ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া হাজারদুয়ারি থেকে। পর্যটকরা নেমে আসছে বিরাট চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। স্বপ্নাচ্ছন্ন মাঠ বিভোর করে রেখেছে আমাদের। দৃষ্টি পড়ল উত্তরে্র সাদা রঙের সুবিস্তৃত দ্বিতল ইমামবাড়ার ওপর। ২০৭ মিটার দীর্ঘ এটি ভারতের সবচেয়ে বড় আর ইমামবাড়া। সিরাজউদ্দৌলা প্রথমে কাঠের নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে পুড়ে যাবার পর এটির পুনর্নিমান করা হয়েছিল। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যে শুধু মহরমের সময় খুলে দেওয়া হয়।  এর বিশালত্ব হাঁ করে দেখার মত।

ক্লক টাওয়ার বা ঘড়িঘর, ফুলের বাগান-  হাজারদুয়ারির চত্বরে রয়েছে এমন কিছু মুগ্ধ হওয়ার মত জিনিস। আর রয়েছে সুন্দর মদিনা মসজিদ আর বাচ্চাওয়ালি কামান। সিরাজের মা আমিনা বেগমের প্রতিজ্ঞা ছিল ছেলে নবাব হলে মদিনার মাটি এনে মদিনার আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন। নবাব হবার পরে মায়ের প্রতিজ্ঞার কথা মাথায় রেখে সিরাজ নিজে মদিনার মাটি এনে এই ছোট্ট মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন। অনেক রত্ন দিয়ে এটিকে সাজানো হয়েছিল। এটিও শুধুমাত্র মহরমের সময় খুলে দেওয়া হয়। এটি ছোট হলেও খুব সুন্দর দেখতে এটি মদিনা মসজিদ নামে খ্যাত।  

আর বলা যেতে পারে একটি সুন্দর ও দীর্ঘ কামান যাকে বলে বাচ্চাওয়ালি কামানের কথা। জাহানকোষা কামানের নির্মাতা জনার্দন কর্মকার ১৮ ফুট দীর্ঘ আর সাত হাজার ছশ সাতান্ন কেজি ওজনের এই কামান নির্মাণ করেন যাতে একসঙ্গে আঠারো কেজি বারুদ লাগত।

বাচ্চাওয়ালি কামানের শুধু নামেই নয় কাজেও ছিল এক বিস্ময়। এর তীব্র আওয়াজে একসঙ্গে বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটেছিল এই মর্মন্তুদ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কামান মাত্র একবারই দাগা হয়েছিল। তাই এই কামানকে বাচ্চাওয়ালি কামান বলে আর নবাবের নির্দেশে দ্বিতীয়বার আর এতে বারুদ ভরা হয় নি।

দিগন্তগামী সূর্যটা যেন লজ্জায় লাল হয়ে লুকিয়ে আছে পশ্চিম দিকে একটা গাছের আড়ালে।  এই নয়নাভিরাম দৃশ্য বেশ কয়েকবার ক্যামেরায় বন্দি করা হল। পেছনে তাকিয়ে দেখি অন্ধকারে ঢাকা হাজারদুয়ারি তার ভেতরের ইতিহাসকে নিজের মধ্যে ঢেকে রেখে একটা অদ্ভুত রহস্য-উন্মাদনায় রহস্যময় হাসি হাসছে।  

আমাদের গাড়ি চলল মোতিঝিলের উদ্দেশ্যে। তখনও বুঝিনি মোতিঝিল নিজের মধ্যে এত সৌন্দর্য আর রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। আলীবর্দী খাঁর জামাই নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ এই অপূর্ব অশ্বখুরাকৃতি লেকটি খনন করেছিলেন আর লেকের পাশে এক সুন্দর বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন যা মোতিঝিল প্রাসাদ নামে বিখ্যাত। থরে থরে সাজানো সৌন্দর্য পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

সিরাজের মাসি ঘষেটি বেগমের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই প্রাসাদ আর তাই স্বামী নওয়াজিসের মৃত্যুর পরও এখানে ছিলেন যতদিন না সিরাজ এই প্রাসাদ দখল করে। এই প্রাসাদ দখল করে প্রভূত ধনরত্ন এখান থেকে উদ্ধার করে ভাগীরথীর অপর পাড়ে অনুরূপ একটি প্রাসাদ তৈরি করেন সিরাজ যা হীরাঝিল নামে খ্যাত। মুর্শিদাবাদ থেকে আধ কিলোমিটার দক্ষিণে আর হাজারদুয়ারি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এই সুরম্য প্রাসাদে ওয়ারেন হেস্টিংসও থেকেছেন ১৭৭১ থেকে ১৭৭৩ পর্যন্ত। বিশাল এই প্রাসাদে এমন একটি ঘর ছিল যার কোনও দরজা বা জানলা ছিল না। চারিদিক থেকেই বন্ধ এই ঘরে বেগম নাকি তার সমস্ত মণি মানিক্য সঞ্চিত থাকত বলে সকলের ধারণা ছিল। ৬৫ ফুট লম্বা, ২৩ ফুট চওড়া, ১২ ফুট উঁচু ১৩৩৯ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট এই ঘরের ভেতরের ধনরত্ন বার করার জন্যে মজুরেরা একবার এটিকে ভাঙ্গার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা রক্তবমি করে সব নাকি মারা যায়। সেই থেকে সেই অভিশপ্ত ঘর ভাঙ্গার চেষ্টা আর কেউ করে নি। এটি গল্প কি সত্যি সে বিষয়ে অতিরিক্ত কিছু জানা যায় নি। তবে গাইডের মুখে এই বিবরণ শুনে ভ্রমণার্থীরা রোমাঞ্চিত হবেন এটা সত্যি।

হাওয়া তেমন না থাকায় উপভোগ্য ছিল মোতিঝিলে ঠান্ডা। রাতের অন্ধকারে এই বিশাল ঝিল আমরা তেমন করে দেখতে পাই নি। তাই সকলের কাছে অনুরোধ রাতে আর দিনে দুবার করে এই ঝিল পরিদর্শনে আসুন। আনন্দ অনেক বেশ পাবেন।

শেষ হল আমাদের প্রথম দিনের পরিভ্রমণ। এবার ফিরে চলেছি বহরমপুরে আমাদের টুরিষ্ট লজে। আবার তো কাল সকাল নটাতেই সূচনা হবে আর এক যাত্রার। আজকের মত তাই শুরু হোক বিশ্রামের পালা।  

 


তৃতীয় দিনের যাত্রা

আমাদের আজকের যাত্রা হবে ভাগীরথীর ওপারে। অর্থাৎ কালকের ঠিক উল্টোদিকে। একটু পরে গিয়ে নদীর ব্রিজ পেরিয়ে আমরা আবার সেই একই দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে চলেছি। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। যারা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে যাবেন তারা যেমন সরাসরি মুর্শিদাবাদে গিয়ে নামতে পারেন আবার বহরমপুরেও থাকতে পারেন। মুর্শিদাবাদ বহরমপুরের তুলনায় ছোট শহর। সেখানে সব সুবিধে পাওয়া যায় না। বহরমপুর জেলার সদর শহর আর বেশ বড় শহর। তাই বহরপুরে থেকেও মুর্শিদাবাদ অনায়াসে ঘুরে আসা যায়। যেমন আমরা করেছিলাম। যারা বহরমপুরে থাকবেন তাদের মুর্শিদাবাদ দেখতে যেতে হবে উত্তরে। যেমন আমরা চলেছি। আর যারা মুর্শিদাবাদে থাকবেন তাদের আসতে হবে দক্ষিণে। অর্থাৎ আমাদের ঠিক উলটো দিকে। এই যা পার্থক্য।

হাইওয়ে বেশ ভালই লাগছিল। সুন্দর সুবিস্তৃত ঝকঝকে এক রাস্তা। চারিদিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেবার প্রশস্ত এক পরিসর। উন্মুক্ত প্রকৃতির বুক চিরে যখন কোনও দীর্ঘ পথ বয়ে চলে তখন আমার খুব আনন্দ হয়। আমার মন গাইতে থাকে মুক্তির জয়গান, হারিয়ে যেতে নাই মানা।

এবার চওড়া হাইওয়ে ছেড়ে আমাদের গাড়ি ধরল মাঠের মধ্যে দিয়ে এক সর্পিল সংকীর্ণ পথ। সর্পিল বা সার্পেন্টাইন কথাটা অনেকে শুনেছেন। সাপের চলার আঁকাবাঁকা গতির সঙ্গেও আমাদের সকলেরই পরিচয় আছে অল্পবিস্তর। কিন্তু এই সার্পেন্টাইন শব্দটা যে এত ক্লান্ত, এত বিরক্তি আর এত আশঙ্কার জন্ম দিতে পারে তা এই আঁকাবাঁকা পথটাকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। সরু এবড়ো খেবড়ো রাস্তার দুদিকে খাদ। তার মধ্যে দিয়েই হুস হুস করে বয়ে চলেছে সব গাড়ি। কত ট্রাক্টর মাটি কেটে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিব্বি। কেউ কেটে নিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ বা কাটতে যাচ্ছে। দুই মুখ থেকে আসা গাড়িগুলোকে দেখে ভয় আর বাগ মানছিল না। এই বুঝি একটা গিয়ে পড়ল নিচে মাঠের মধ্যে। আমি ভয়ে ভয়ে চালককে জিজ্ঞেস করি ফেরার সময় আমাদের আবার এই পথ অতিক্রম করতে হবে কিনা। চালক আশ্বস্ত করল, না ফেরা হবে অন্য পথ দিয়ে।

এই নরকযাত্রার যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটল অবশ্য এক সময়। আমরা পৌছঁছলাম কীরিটেশ্বরী মন্দিরে। একান্ন মহাপীঠের একটি। এখানে সতীর মুকুট অর্থাৎ কীরিট পড়েছিল তাই এমন নাম। এখানে মন্দির আর তার ভেতরে পুজো দেওয়া ছাড়া দর্শনীয় তেমন কিছু নেই। দেবী এখানে ‘বিমলা’। এক হাজার বছরের পুরোন এই মন্দির হল মা ‘মহামায়ার’ নিদ্রাস্থল বলে সকলের বিশ্বাস। আর স্থানীয়দের মধ্যে এই মন্দিরের পরিচিতি হল ‘মহিষমর্দিনী’ নামে। ১৪০৫ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই মন্দিরটি উনবিংশ শতকে পুনর্নিমিত হয় লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণের দ্বারা আর এটিই মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। প্রতি বছর পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গল আর শনিবারে এখানে মেলা বসে।

বিস্ময় আমাদের বাকরুদ্ধ আর মোহিত করে দিল যার সৌন্দর্য, বৈভব আর প্রাচুর্যে তা হল বিশাল চত্বর জুড়ে সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের তৈরি বিরাট দহপাড়ার শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের আশ্রম। আম আর বকুল গাছের সবুজ শোভায় আমোদিত যেন এক স্বপ্নকুঞ্জ। কুঞ্জদাস ব্রহ্মচারীর তৈরি নয়ন মনোহর এই আশ্রমে বহু দূরান্তরের ভক্ত সমাগম হয়। পুজোর ভোগের জন্যে এখানে সকাল এগারটার মধ্যে টিকিট কাটতে হয়। এগারটায় এই মন্দিরের বিগ্রহস্থল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিগ্রহ দর্শন আমাদের হয় নি। 

পর পর দুটি মন্দির দর্শনের পর আমরা পৌঁছে গেলাম সুজাউদ্দিনের কবরখানায়। মুর্শিদকুলি খাঁর জামাই ছিলেন সুজাউদ্দিন। তার স্ত্রী ছিল মুর্শিদকুলির মেয়ে আজিমুন্নেসা। সুজাউদ্দীনের কবর দর্শন করে এবার আমরা ঢুকেছি খোসবাগে। এই বিখাত স্থানে যেখানে শায়িত এক বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা। সুজাউদ্দীনের ছেলে সরফরাজের সিপাহশালার ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। পরে যিনি নবাব হয়েছিলেন বাংলার। এই আলীবর্দীর নাতি হলেন সিরাজ।

 


আলীবর্দীর স্বপ্নের স্থান ছিল খোসবাগের প্রথম নাম ছিল খুসবু বাগ। সেখান থেকে খোসবাগ। কথিত আছে এখানে ১০৮ রকমের গোলাপ চাষ করাতেন নবাব আলীবর্দী। তাঁর স্ত্রী সইফুন্নেসা বেগম আর তিন মেয়ে ঘষেটি বেগম, আমিনা বেগম আর মুভিনা বেগমের পরপর সমাধি রয়েছে এখানে। আমিনা বেগম ছিলেন সিরাজের মা আর ঘষেটি বেগম ছিল মাসি যার নাম বা দুর্নাম ইতিহাসে বেশ পাওয়া যায়। ঘষেটি বেগমের কথা আগেও বলেছি মোতিঝিলের গল্প বলার সময়। ঘষেটি বেগমের চক্রান্তেই নাকি নবাব সিরাজ বন্দী হয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব পরাজিত হয়ে এক বিশ্বস্ত ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধারণ করে পালিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন শুধু তার পায়ের জুতো জোড়ার জন্যে। কারণ বেশ পাল্টালেও এগুলি তিনি পাল্টাতে ভুলে যান। নৌকোর মাঝি তাঁকে চিনতে পারে এই জুতোজোড়ার জন্যে আর ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেয়। অবশ্য মীরজাফরের ছেলে মীরণের পরামর্শে ইংরেজরা বহু টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সিরাজকে ধরিয়ে দেবার জন্যে।

বন্দী সিরাজ তাঁর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে প্রায় সতের জন আত্মীয়কে  আনা হলে সিরাজ সমেত সকলকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। খোসবাগে দাদু আলীবর্দীর কবরের কাছেই কবর দেওয়া হয় সিরাজকে। আর একটু দূরে বাকি ১৭ জনকে। খানিক দূরে মাঠের মধ্যে একটি কুয়োতে সমাধি দেওয়া হয় সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়া সেই বিশ্বাসঘাতককেও। তাই খোসবাগের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন বেশী তেমনি তা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও বেশ সমর্থ। একটু দূরেই আছে রেসিডেন্সি সিমেট্রি যাতে আছে তৎকালীন ইংরেজ রাজপুরুষদের কবর।

কাশিমবাজার স্টেশনের অদূরে আছে কাশিমবাজার বড় আর ছোট রাজবাড়ি। কৃষ্ণকান্ত নন্দী ছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে সিরাজ ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি আক্রমণ করলে ওয়ারেন হেস্টিংসকে কৃষ্ণকান্ত নন্দী যিনি কান্তমুদি নামে পরিচিত ছিলেন, নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন আর পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এরপর হেস্টিংস যখন বাংলার গভর্ণর হন তখন দিল্লীর বাদশার কাছে সুপারিশ করে কৃষ্ণকান্তর ছেলে লোকনাথকে মহারাজা করেন আর নাম হয় মহারাজা লোকনাথ রায় বাহাদুর। আস্তে আস্তে এই রাজবাড়ি বিরাট হয়ে যায়। এটি হল কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ি। এর থেকে একটু দূরে আছে ছোট রাজবাড়ি। এই ছোট রাজবাড়িই বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খোলা হয় আর এর মধ্যে একটি মিউজিয়াম সমেত বহু জিনিস দেখার আছে। নিকটেই আছে ডাচদের কবর।

পাতালেশ্বর মন্দিরে ঢোকার মুখেই রাস্তার এপারে শিবের বিরাট ধ্যনমগ্ন এক মূর্তিকে ডাইন গেট পেরিয়ে আমরা বাগান ও মন্দিরে ঢুকলাম। সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরের মন্দিরের ঠিক গায়েই আছে বিশাল পুরোন এক বটগাছ। এর পাশেই বিরাট এক জলাশয়। তার অনেকগুলি ঘাটের একটাকে সতীদাহ ঘাট বলে অভিহিত করা হয় কথিত আছে বহু অতীতে এই ঘাটে সতীদাহ হত। এখন অবশ্য মাছ ধরা হচ্ছে দেখলাম। বিরাট বাগানে নানা ফুল আর এক গোশালা নজরে পড়ল যেখানে আছে সত্তরটি গরু যাদের দুধ এই মন্দির আর আশ্রমের কাজে লাগে। খুব ভাল লাগবে এই ফলে ফুলে ভরা বাগান সমেত মন্দির পরিদর্শন করতে।

এরপর যা সুন্দর লাগল তা হচ্ছে ব্যাসপুরের শিবমন্দির। ১৮১১ সালে পন্ডিত কৃষ্ণনাথ রায় পঞ্চাননের বাবা পন্ডিত রাম কেশব দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেন এই মন্দির। ১৯১৮ সালে রাজা যোগেন্দ্র বাহাদুর রায়ের দ্বারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

আপাতত ভ্রমণ শেষ। কাল ফেরার পালা। তাই গোছানোর পালা তো বটেই। তাই সময় নষ্ট না করে ডাইনিং-এ গিয়ে চিকেন আর ভাত খেয়ে টিভি দেখা আর ঘুম।

 


চতুর্থ দিনের যাত্রা

বহরমপুর থেকে আমাদের গাড়ি ছিল সকাল দশটা পঞ্চাশ। সওয়া তিনটে নাগাদ শিয়ালদহ পৌঁছবে। রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে বসে আমার বন্ধু যখন খরচ খরচার হিসেব নিয়ে ব্যস্ত তখন আমিও ব্যাপৃত ছিলাম আর একটা হিসেব নিয়ে। সেটা হল চাওয়া পাওয়ার হিসেব। এই ভ্রমণে যা চেয়েছি পেয়েছি যেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। শুধু অতীত নয়, নয় শুধু মন খারাপ করা কবরস্থান, সেই সঙ্গে মুর্শিদাবাদে ইতিহাস আছে উজ্জ্বল হয়ে। কবরের গাঢ় নিঃশ্বাস বন্ধ করা অন্ধকারেও আছে ইতিহাসকে জানার আলোর আশ্বাস। 

...(সমাপ্ত)...



No comments:

Post a Comment