1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

শিউলি

ছবি : ইন্টারনেট

শিউলি

দেবেশ মজুমদার

শিউলি ফুলের গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। আর ভালো লাগে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। স্কুল যেদিন ছুটি থাকে গাছের নিচে বসে আমি গল্পের বই পড়ি। গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে আমি একদম মায়ের কোলের মত আরাম পাই। গাছটার সাথে আমি কত কথা বলি। বাবা আমাকে আজ খুব বকেছে। আজ ইস্কুলে রিংকির সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। স্কুলে অঙ্কে কম নাম্বার পাওয়ার জন্য আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। এবার স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হয়েছি। স্কুলের আমার একটা বন্ধু আমাকে প্রপোজ করেছে। আমি জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চান্স পেয়েছি। কোন ডিপার্টমেন্টে ঢোকা যায়? মেকানিকাল ল্যাব এত কঠিন কেন? বাবা যে ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে কেমন হাবলু ধরনের। এমন অনেক কতশত কথা শিউলি গাছটা জানে! আসলে আমি মায়ের সাথে কথা বলি। শিউলি গাছটার মধ্যে আমি আমার মা’কে খুঁজে পাই।

শিউলি গাছটা আমার মা লাগিয়েছিল। বাড়ির সামনে সদর দরজায় ঠিক পাশে। বাবা বলেছিল সদর দরজার পাশে গাছটা বসিয়েছো দেখবে বসন্তকালে এত পাতা পড়বে যে তুমি ঝাঁট দিয়েও পরিষ্কার রাখতে পারবে না। আর বলেছিল যে শিউলি গাছ কিন্তু বেশ বড় আর ঝোড় মতন হয়। উঠোনে রোদ পড়বে না। তোমার কাপড় আর আচার শুকনো করা যাবে না। এমনি অনেক গভীর সমস্যার কথা বলেছিল বাবা। মা হেসে বলেছিল আমার মেয়ে শিউলি তাই আরেকটা শিউলিকে আনলাম। দেখবে ওরা দুজন মিলে রূপ রস আর গন্ধে আমার ঘর ভরিয়ে রাখবে।

মায়ের মায়া মায়া ফর্সা মুখটা শিশুসুলভ সারল্যে ভরা। ঘন কালো চুলগুলো দেখে কেউ বুঝতো না তাঁর শিউলির মতো এতবড় একটা মেয়ে আছে। অবশ্য তখন আমার নিজেকে যতটা বড় মনে হতো তার চেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। শিউলি গাছটার খসখসে বাকলে হাত রেখে আমি ওপরে তাকাই। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে আমার চোখে মুখে।

“গাছটা কত বড় হয়ে গেছে তাই না বাবা?”, আমি বুঝতে পারি যে আমার পেছনে বাবা এসে দাঁড়িয়েছে। বাবার উপস্থিতিতে একটা সুন্দর গন্ধ পাই আমি। বাবার শরীর থেকে বেরিয়ে আসে সেই গন্ধ তাই চোখে না দেখেও বাবাকে আমি চিনতে পারি।

“গাছের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছ এবার ভেতরে চলো মা। স্নান করে নাও। সবাই অপেক্ষা করছে। দেরি করো না একদম!” বাবার একটানা বলে চলা কথাগুলো আমাকে কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। গাছের ছালে রাখা আমার মেহেদী পরানো হাত দুটো দেখলাম। শিউলি গাছটাকে ছেড়ে যেতে হবে কালকেই। খুব মন খারাপ করছিল। সেই ক্লাস সেভেনে ক্যানসারে মা মারা যাবার পর থেকে আমার মনে হয় শিউলি গাছটা মা হয়ে আমাকে আদর করে। বিয়ের সাজেই শিউলি গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াই আমি। গাছটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল আমি মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অজস্র শিউলি ফুল পড়ে আছে উঠোনময়। শিউলি ফুলের গন্ধে মাখামাখি হয়ে আছে সারা বাড়ি।  উঠোনে ঝড়ে পড়া একটা শিউলি ফুল হাতে নিয়ে বাবার দিকে তাকালাম আমি। বাবা কি বুঝতে পারে আমি কেনো এত ভালোবাসি গাছটাকে?

সময়টা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। এখন আমি অন্য বাড়িতে। অচেনা একটা ঘরে বসে আছি আড়ষ্ট হয়ে। আচমকা একটা চেনা সুবাস আমার মাথা এলোমেলো করে দিল। খোলা জানলাটা দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম একটা শিউলি গাছ। গাছটা দেখে মনে হল, মা আমাকে ছেড়ে যাবে না কোনদিন।

বুক ভরে শিউলির সুবাস নিতে নিতে ঘর থেকে উঠোনে বেরিয়ে এলাম আমি। কী সুন্দর নীল আকাশ। পেঁজা তুলোর পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের ভেলা সারা নীলাকাশ জুড়ে।

 ...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment