1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

কল্লোল যুগের বিস্মৃত মণীশ ঘটক ( যুবনাশ্ব)

ছবি  : ইন্টারনেট 
কল্লোল যুগের বিস্মৃত মণীশ ঘটক  ( যুবনাশ্ব)    
তুষার ভট্টাচাৰ্য
''আরে কে ও স্যাঙাৎ যুবনাশ্ব না ? শালা তোমার আমলের আর কেউ বেঁচে নেই এই অধম ছাড়া।'' 
'মান্ধাতার বাবার আমল' স্মৃতিকথা গ্রন্থে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন কল্লোল যুগের প্রথম মশালচি কবি মণীশ ঘটক ( যুবনাশ্ব - ১৯০২---১৯৭৯ )। একজন শক্তিশালী কবি হিসেবে, কল্লোল যুগের প্রথম সারির কবি হিসেবে পরিচিতি থাকা সত্বেও তিনি একালের বাংলা সাহিত্যের  বিশাল আঙিনায় বিস্মৃত হয়ে গেলেন ।
তাঁর কন্যা প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী 'বর্তিকা' পত্রিকার একটি সংখ্যা ' মণীশ ঘটক' সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন ।
তাঁর জন্মশতবর্ষে বহরমপুরের দু'একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিল মণীশ ঘটক সংখ্যা । এরপরে মণীশ ঘটককে নিয়ে কোথাও তেমন করে প্রাসঙ্গিক আলোচনা আদৌ হয়নি । তাঁর উপরে প্রচারের আলোও তেমন করে আর পড়েনি ।
                     লেখকদের প্রসঙ্গে  একদা রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সি গোর্কি বলেছিলেন -  'লেখক হচ্ছেন তাঁর দেশের ও শ্রেণীর ভাবপ্রবণ মুখপাত্র । তাঁদের চোখ, কান ও হৃদয় তিনি । লেখক হচ্ছেন তাঁর সমকালের কণ্ঠস্বর'।
                               কল্লোল যুগের কবি মণীশ ঘটককে বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, তাঁর সমস্ত কবিতা, উপন্যাস, স্মৃতি কথা এবং আত্মজীবনীতে সমকালীন সময়ের অর্থাৎ কালের কণ্ঠস্বর , উচ্চারণের একটি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায় ।তিনি তাঁর সময়কে ,পারিপার্শ্বিককে অবহেলা করতে পারেননি।যদিও তিনি আদ্যন্ত রোম্যান্টিক মেজাজের ছিলেন ।কিন্তু তাঁর কবিতায় যখন ধ্বনিত হয় -
   'চোখ বুজলে সব দেখতে পাওয়ার
    ক্ষমতা কেড়ে নিও না ;
    বন্ধ চোখের পাতার তলায়
    মনের দরজা যেন খোলা থাকে।'
এখানে কবির আর্তি, সামগ্রিকভাবে সমস্ত মানুষের আর্তি হিসেবে পরিগণিত হয় ।এখানে তিনি রোম্যান্টিক মেজাজের কবি নন, তিনি সাধারণ মানুষের কবি হয়ে ওঠেন এক লহমায় । যে ক'জন সাহসী যুবক লেখক, কবির দল আজ থেকে কয়েক দশক আগে , গতানুগতিকতার গন্ডীর বাইরে গিয়ে ভিন্নতর মূল্যবোধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্যতর প্রবাহে বাংলা সাহিত্যকে বইয়ে দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মণীশ ঘটক ।
                                 গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথার মধ্যে দিয়ে তিনি গদ্য সাহিত্যে যেমন নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়েছেন, ঠিক তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের মূল্যবোধের বহুমুখী অবক্ষয় বা ভাঙনের প্রেক্ষিতে কাব্যসাহিত্যেও তিনি একটি স্বতন্ত্র সুর বা কণ্ঠস্বরের পরিচয় স্পষ্ট করে রেখে গেছেন । বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্য বিলাসকে ,তিনি একেবারে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে দেবার যে প্রয়াস সমগ্র লেখনীর মাধ্যমে নিয়েছিলেন, ত্রিশের দশকে , তা পটল ডাঙার পাঁচালীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ।পরবর্তী জীবনেও সেই ধারা অব্যাহত তাঁর সমস্ত লেখায় ফুটে উঠেছে ।
                    বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের নীচতা ,ক্ষুদ্রতা, ভীরুতা, লোভ, খর্বতা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আবিল পরিবেশে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ , মননকে ভিতর থেকে কুরে কুরে ধ্বংস করছিল তখনই মণীশ ঘটক তাঁর নির্মোহ ঋজুতার সঙ্গে অপ্রিয় সত্যভাষণের মাধ্যমে সেগুলিকে উন্মোচিত করে দিচ্ছিলেন এবং নির্মম ব্যঙ্গের কশাঘাতে পিউরিটান  মানসিকতা স্বর্বস্ব বাঙালি মধ্যবিত্তের ছোট হয়ে আসা মনের গন্ডীকে ভেঙে চুরমার করে দিতে বরাবর  সচেষ্ট ছিলেন  তিনি ।
               যদিও কবি মণীশ ঘটক কখনও জীবনের প্রতি আশাবাদ হারাননি ।তাঁর কবিতায় ( একটি বিশাল গাছ, অকুণ্ঠ প্রেম, আগুন ওদের প্রাণ, দুঃখী দরিদ্র দুর্বল, রক্তবীজ, বাঘের ছানা, যা ইচ্ছে তাই, অনর্গল রক্তপাত, যদ্দিন না, আত্ম সমীক্ষা, কী করেছ যাও বলে, যুবনাশ্ব না ? ) প্রেম, প্রকৃতি এবং জীবনের প্রতি অকুণ্ঠ আশা, প্রত্যয় ফুটে উঠেছে বিভিন্ন চিত্রকল্প এবং রূপকের আড়ালে ।

   দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সচেতন মননের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ।১৯৬৭ সালে তিনি শাসকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লিখলেন 'জন্মাষ্টমী' কবিতা । গদি সর্বস্বতার মোহের বিরুদ্ধে তাঁর সতর্ক উচ্চারণ  - ' যুদ্ধ হোক যুদ্ধ হোক',  ভন্ড সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার  লেখনী - 'স্বাধীনতা', 'পাপীকেও ঘৃণা করো', 'দোস্ত তাদের জাগাও', 'এদের চিনে রাখো' , 'ঘোড়সওয়ার' , 'গৃহ নেই' , 'এসেছে লগ্ন' প্রভৃতি কবিতার মধ্যে দিয়ে একজন সমাজ সচেতন কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর একটি আলাদা স্বতন্ত্ররূপ প্রকাশ পেয়েছে ।
বস্তুত, দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের আর্থ- সামাজিক টানাপোড়েনের পটভূমিকায় বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগের সূচনা । কল্লোল যুগের অধিকাংশ লেখকই ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন ।কল্লোল যুগের লেখকদের  লেখনীতে রোম্যান্টিকতার অনাবশ্যক বিলাস ছিলনা। তাই তাঁদের লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।ত্তর বাঙালি সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের চালচিত্রই নিপুন কলমে  ফুটে উঠেছে ।
           মণীশ ঘটক কল্লোল যুগের প্রথম মশালচি  হিসেবে তাঁর লেখার টানটা ছিল নিচুতলার মানুষের জীবনের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার দিকে ।তাঁর 'পটলডাঙার পাঁচালীর' সচেতন সাহিত্যায়ন সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যে নিসন্দেহে পথিকৃৎ এর ভূমিকা নিয়েছে ।
               মণীশ ঘটকের গল্প, উপন্যাস, স্মৃতি কথায় ছড়িয়ে আছে তিনটি ভিন্নমুখী ধারা ।একদিকে পটলডাঙা - কলকাতার ভিখারী গুন্ডা, বস্তিবাসীদের আন্ডার ওয়ার্ল্ড,যার ছবি তিনি এঁকেছেন অবক্ষয়ী জীবনের প্রতি সমমর্মী দুঃখবোধ থেকে ।
এর বিপরীতে কলকাতার বাঙালি অভিজাত সমাজের ছবি তিনি তুলে ধরেছেন যেখানে মানবিকতার লেশ মাত্র নেই ।আছে শুধু অর্থের আস্ফালন ।ত্রিশ- চল্লিশের দশকে বাঙালি অভিজাত ধনী সমাজের দেশজ সংস্কৃতির মূল প্রবাহ ও মূল্যবোধ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে করতে একধরনের কৃত্তিমতার খোলসে নিজেদের গন্ডীবদ্ধ ও অবরুদ্ধ করার প্রক্রিয়াকে তীব্র ব্যঙ্গ, বিদ্রূপে কশাঘাত করেছেন মণীশ ঘটক ।
তাঁর স্মৃতিমূলক আত্ম জৈবনিক গ্রন্থ  ' মান্ধাতার বাবার আমল' এ মণীশ ঘটকের লেখার তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনচরিত এবং তার সঙ্গে বাংলার রূপকথা, লোককথার আবেগ উদ্ভাসিত যন্ত্রণার বাস্তব আখ্যানপর্ব ।
'কনখল' উপন্যাসটি এই তৃতীয় ধারার উজ্জ্বল নিদর্শন, এই উপন্যাসে লোক সমাজের অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি যা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার কথা বলে, যাতে মানুষের জীবনের শুদ্ধতার এক অপরিসীম আলোক সন্ধান রয়েছে, যা কিনা মেকি নাগরিক জীবনের সম্পূর্ণ বাইরে এসে, বাল্যজীবনের নির্মল কোমলতার স্মৃতিবিলাসের কাব্যিক মেজাজে 'কনখল ' উপন্যাস  হয়ে উঠেছে লোকায়ত জীবনের এক অপূর্ব আখ্যানপর্ব । যেখানে মানুষ কখনও মনুষ্যত্ব হারায় না । এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই  বেঁচে থাকার কথা বলে ।
            প্রসঙ্গত, মণীশ ঘটকের সমস্ত লেখনীতেই ছিল তারুণ্যের স্পর্ধা ও দীপ্তির মাধুর্য । সমকালের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে ছিল তাঁর কবিতায়, স্মৃতিকথায় ।ছদ্মনাম যুবনাশ্বর লেখনী ছিল ব্যঙ্গ বিদ্রূপে ভরা ,সমাজের বিভিন্ন অবক্ষয়, কৃত্তিম উন্নাসিকতা, মেকি অনুশাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র কশাঘাত ।
                              অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় , বর্তমানকালের বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা কবি লেখক মণীশ ঘটকের নাম তেমন করে জানেন না । তিনি বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অনালোচিতই থেকে গেলেন ।কল্লোল যুগে যাঁরা অগ্রণী কবি সাহিত্যিক  ছিলেন, তাঁদের কারও থেকে মণীশ ঘটকের প্রতিভা কম ছিল না ।আসলে তিনি তেমন করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচার পাননি । এই আধুনিক প্রচারসর্বস্ব যুগে তেমনভাবে  প্রচার না পেলে  সাহিত্যের পাঠকরা জানবেন কীভাবে কল্লোল যুগের শক্তিমান কবি মণীশ ঘটকের লেখালেখির অন্তর্লীন জগতের কথা !
বাংলা সাহিত্যে কত প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক সামান্য প্রচারের আলো না পেয়ে হারিয়ে গিয়েছে তার হিসেব আর কে রাখে । 
গ্রন্থ সূত্র : শিলালিপি  (কাব্য গ্রন্থ ),পটল ডাঙার পাঁচালী ( গল্প গ্রন্থ ),কনখল ( উপন্যাস ), বিদূষীবাক ( কাব্য গ্রন্থ ),নামায়ন  ( কবিতা গ্রন্থ ),যুবনাশ্বের নেরুদা ( অনুবাদ গ্রন্থ ),এক চক্রা ( কবিতা গ্রন্থ ) এবং মান্ধাতার বাবার আমল ( স্মৃতি কথা )।
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment