1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

ক্যালিম্পং এর গেস্ট হাউস

ছবি : ইন্টারনেট

ক্যালিম্পং এর গেস্ট হাউসে
দীপক মজুমদার

ঘটনাটা ঘটেছিল প্রায় বছর পাঁচেক আগে। সদ্য চাকরি থেকে অবসর হয়েছে। চাকরির জীবনে বিশেষ করে শেষের দিকটায় প্রচন্ড কাজের চাপে লম্বা ছুটি পাওয়া যেতো না তাই বেড়াতে যাওয়া খুব একটা হয়ে ওঠেনি। কাছেই এক প্রতিবেশী ঘোষবাবু তারও ঐ একই রকম অবস্থা। আমার থেকে বছর দুয়েক আগেই রিটায়ারমেন্ট হলেও একা একা আর তার বেরিয়ে ওঠা হয়নি। যাই হোক দুজনে মানে নিজের নিজের স্ত্রীদের নিয়ে চার জনে জম্পেশ একটা প্ল্যান করে ফেললাম। দিন দশেকের সময় নিয়ে নর্থ বেঙ্গলের ডুয়ার্সের বেশ কটা জঙ্গল ঘোরা হবে। মাঝে দুদিন ক্যালিম্পং। না এর মধ্যে দার্জিলিং থাকছেনা। ওটা পরের বার হবে। সেই মত বিভিন্ন জায়গায় গেষ্ট হাউস বুক করা হয়ে গেল। দিন পনেরোর অপেক্ষা করার পর আমরা দুই পরিবারের চারজন একদিন ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে নর্থ বেঙ্গল গামী একটা ট্রেনে চেপে বসলাম।

ভোরের দিকে এন জি পি স্টেশনে নেমে আধঘন্টা মত অপেক্ষা করতে হলো। গাড়ি বুক করা ছিল আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন সান্তালখোলা পৌঁছে দিল। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা অল্প খানিকটা প্রায় সমতল জায়গায় কুয়াশায় ঘেরা ছোট ছোট কটেজ। চারিদিকে ঘন জঙ্গল আর নেমে আসা মেঘ পরিবেশটা মোহময় করে তুলেছে। একটু বেলা গড়াতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে ,ঝিঁঝিঁ পোকার নানারকম শব্দ  নাগাড়ে বেজে পরিবেশটা আরও রহস্যময় করে তুলেছে। পাহাড়ের নিচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রায় অন্ধকার টিমটিমে আলোয়  ঝিঁঝি পোকাদের নানা সুরের এই কনসার্ট উপভোগ করছি। এইভাবেই সময় বাড়ার সাথে সাথে অন্ধকার ও ঠান্ডা দুইই বেড়ে চলেছে। রাত্রের খাবারও রেডি । খাওয়া সেরে পরিস্কার ধবধবে সাদা বিছানায় আশ্রয় নিলাম। কাল আমাদের গন্তব্য ক্যালিম্পং।

সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তৈরি হলেও বাধ সাধলো প্রকৃতি। ভোর থেকেই আকাশ গোমরা করে আছে আর তার সাথেই ঝমঝমে বৃষ্টি। পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে বৃষ্টি তার রুপই আলাদা। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলাম আমাদের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। গেস্ট হাউস বুক করা আছে যেমন করে হোক পৌঁছোতে হবেই। দূর্যোগ একটু কমতেই আমরা গাড়ি নিয়ে এগোতে শুরু করলাম। পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠেছে, খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে যাচ্ছি, সোঁদা মাটির গন্ধ আর জঙ্গলের গন্ধ দুয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে। এ এক অন্যরকম মাদকতা। জঙ্গল ছাড়িয়ে লোকালয় দেখে একটা রেস্তোরায় দুপুরের খাওয়া সেরে আবার এগোলাম। পাহাড়ী রাস্তার ঘুরপাকে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমাদের গাড়ি থামল ক্যালিম্পং এর গেস্ট হাউসের সামনে। সূর্য প্রায় ডুবতে চলেছে, গোধুলির আবছা আলোয় এক স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে ইংরেজ আমলে তৈরী হওয়া কোন বৃটিশ সাহবের বাড়ি। সামনের দিকটা  খানিকটা  ফাঁকা থাকলেও ঘন পাইন গাছের জঙ্গল বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে। এক ভৌতিক পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় শতবর্ষের প্রাচীন  এই বাড়িটাই আমাদের  গেস্ট হাউস। ক্যালিম্পং এ এইরকম পুরানো সাহেব কুঠিগুলো নিয়ে অনেক ভৌতিক গল্প প্রচারিত আছে। সেইসব ভৌতিক গল্পের কথা যখন ভাবছি তখনই প্রায়ান্ধকার বাড়ি থেকে একজন গোর্খা মানুষ বেড়িয়ে এসে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। নিজেদের নাম ও বুকিং এর কাগজপত্র দেখানোতেই খুব সাদরে অভ্যর্থনা জানালো।
‘কি ব্যাপার এতো অন্ধকার কেন? গেস্ট হাউসে আলো কই?’
  ‘মৌসম ইতনা খারাব সাবজী, দিনভর বিজলী চলি গেই। কোনও চিন্তা নেহি ইমারজেন্সি লাইট হ্যায়। রাত্রে বিজলী আসতেও পারে।‘
মনটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠলো। এ কোথায় এলাম কে জানে। ঘোষ বউদি সাধারন অবস্থাতেই একটু ভীতু প্রকৃতির। তার ওপর এই রকম এক ভৌতিক পরিস্থিতিতে আরও যেন ঘাবড়ে গেছে।

আমিই অভয় দিয়ে মন শক্ত করার জন্যে বললাম ‘এত ভাববেন না। এক্ষনি আলো এসে যাবে। আর এ হলো ট্যুরিস্ট প্লেস। ট্যুরিস্টদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয় সেদিকে এখানকার সবাই তৎপর।‘
               ‘কি জানি, আপনারা বলছেন যখন ভালো হলেই ভালো।‘
ইতিমধ্যেই সেই গোর্খা মাঝবয়েসি লোকটি বিনম্র ভাবে হাত কচলাতে কচলাতে একটা ট্রেতে চার কাপ চা আর খানকতক বিস্কুট নিয়ে হাজির।
               ‘সাবজী আমার নাম পদম গুরুং, এই গেস্ট হাউসের সবাইকে আমি দেখাশোনা করি। দরকার হলেই আমায় ডাকবেন।‘
               ‘গেস্ট হাউসে আর কতজন আছে গুরুং যাদিকে তুমি দেখাশোনা করছো’
               ‘বেশি নাই সাবজী, এখন তো অফসিজন চলছে। নিচে একটা ফেমিলি ছিল একটু আগে তারা বেড়িয়ে গেল। নিজেদের গাড়ি চালিয়েই.....’
               ‘এই সন্ধ্যে বেলায় চলে গেল?’ উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম।
কথাটা এড়িয়ে পদম বলে উঠলো ‘আপনাদের এই দুটো ঘর, সবকিছু রেডি আছে। আপনাদের কিছু স্ন্যাক্স লাগলে বলবেন, চটপট গরম গরম বানিয়ে দিই।’
পেঁয়াজ পকোড়ার অর্ডার দিয়ে আমরা যে যার পছন্দমতো ঘর দখল করে নিলাম। ঘরের ব্যাপারে ঘোষ বউদির আবার এটু বায় আছে। এই ঘরের চাদরটা যেন কেমন,  জানলাটা মনে হচ্ছে ভালো করে লাগছেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই রকম মানুষ অবশ্য জীবনের সর্বস্তরেই মেলে, কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিতে হয়। ঘর দুটি কিন্তু বেশ বড়ো। ইংরেজ আমলের পুরনো আসবাবপত্র। দেওয়ালে কাঞ্চনজঙ্গার বরফে ঢাকা ছবি। এখন অবশ্য অনেকটাই আবছা হয়ে গেছে। নিচে ফটোগ্রাফার হিসেবে কোনও এক ইংরেজ সাহেবের নাম লেখা। যাই হোক দুদিকে দুটো ঘর মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে সাজানো গোছানো লবি। বড় বড় কটা জানলা। সকালে নিশ্চয়ই এদিকে কাঞ্চনজঙ্গা দেখা যাবে।  আমরা তিন তলায় আছি। দোতলায় বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে কিচেন,  ডাইনিং স্পেস, স্টোর রুম ইত্যাদী। একতলার কয়েকটা রুম গেস্টদের জন্যে বরাদ্দ।

আমরা চারজনেই একটু ফ্রেস হয়ে লবিতে সোফায় বসে পেঁয়াজ পকোড়া সহযোগে নানারকম গল্পে মেতে উঠেছি। মাঝেমধ্যে এই গেস্ট হাউস, এই নির্জন অন্ধকার বা বিভিন্ন বইয়ে পড়া ক্যালিম্পং এর ভৌতিক গল্পের কথাও উঠে আসছে। হঠাৎই আলো জ্বলে উঠে আমাদের তাৎক্ষণিক আস্বস্ত করলেও দুমিনিট পর আবার চলে যাওয়ায় অন্ধকার যেন আরও বেশি করে গ্রাস করে ফেললো। চারিদিকে নিঝুম অন্ধকার আর তারই সঙ্গে পাশের জঙ্গলে নাগাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ক্রমাগত শব্দ ও রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটে উরে যাওয়ার শব্দ। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঘোষ বউদি একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে জিঙ্গেস করে
‘আপনাদের কিছু মনে হচ্ছে না?’
‘কি ব্যাপারে?’
‘না এই মরা সাহেবের বাংলো, এই অন্ধকার, তার ওপর আবার আমরা এই চারজন ছাড়া এতবড়ো বাংলোয় কেউ না থাকা.....’
‘এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, এরকম হতেই পারে। আর তাছাড়া এসব নিয়ে যত ভাববেন ভয় তত পেয়ে বসবে।‘
‘আপনারা কোনও কিছুরই গুরুত্ব...’
কথাটা শেষ করার আগেই পদম গুরুং ধীর পায়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে ‘সাবজী ডিনার রেডি,আপনারা কি এখন খাবেন?’
আমরা প্রায় সবাই বলে উঠলাম ‘এত তাড়াতাড়ি !

               ‘কি আইটেম করেছো গুরুংজী।‘

               ‘চিকেন কারী, পরোটা আর ফুলগোবী সাবজী।‘

না খেলেও নাম শুনেই ‘বাঃ বাঃ‘ বলে তারিফ করলাম। পদম খুব একটা খুশি হলো কিনা বুঝতে পারলাম না। একটু নরম সুরেই বললো ‘আমি ডাইনিং টেবিলে আপনাদের সব খাবার ঢাকা রেখে দিচ্ছি, সময় মতো খেয়ে নেবেন, কোনও অসুবিধে হবেন না।‘
               ‘মানে তুমি কোথায় যাবে?’
করুন স্বরে পদম উত্তর দেয় ‘সাবজী আমার জেনানা বহুত বিমার আছে, আমি গিয়ে রান্না করে ওকে খেতে দেবো, দাবাই দেবো।‘
               ‘ তার মানে এই অন্ধকারের মাঝে এত বড় বাড়িতে আমরা একা থাকবো!’
আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে ঘোষ বউদি ও আমার অর্ধাঙ্গিনী দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো,
               ‘সারারাত কেউ থাকবে না, যদি কিছু হয় আমরা কি করবো?’
               ‘কোনও চিন্তা করবেন না মাইজী, এখানে কোনও ভয় নেই। আমার মোবাইল নম্বরটা রেখে দিন, যদি দরকার হয় ফোন করবেন। কাছেই আমার বাড়ি কোনও চিন্তা নেই। আমি সকালে এসে আপনাদের মর্নিং টি দিয়ে দেবে।‘
               ‘আর চাবি’
               ‘ ওসব বিলকুল ভাববেন না সাবজী, আমি পিছনের ছোটা দরওজা দিয়ে আসা যওয়া করি। আমার কাছে চাবি থকে, কেউ জানেনা।‘
এই অবস্থায় বাধ্য হয়েই আর কথা না বাড়িয়ে রাজী হতে হলো। ঘোষ বউদির মুখটা থমথমে হয়ে গেল তা দেখে ঘোষ বাবুও অভয় দিয়ে বললো, ‘তুমি কেন এত ভয়ভয় করছো! আমরা তো সবাই আছি, বেশি চিন্তা না করে চলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ি। তেমন তেমন হলে পদমকে ফোন করে ডেকে নেব।‘

হয়তো কিছুটা আস্বস্ত হলো। সবাই এর মনকে ঘোরাবার জন্যে আগামীকালের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলাম। আলোচনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিচে ডাইনিং থেকে ঝন ঝন করে আওয়াজ হতেই তাড়াতাড়ি টর্চটা হাতে নিয়ে এগিয়ে দেখি কিছু বাসনপত্র মেঝেয় পড়ে আছে,আর টর্চের আলোয় স্পস্ট দেখতে পেলাম একটা কুচকুচে কালো বেড়ালের উজ্জল দুটি চোখ। আমার দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই জানলার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। হয়তো রোজই আসে, এটা ওর চেনা জায়গা। কিম্বা আজকের এই পরিস্থিতিতে তার উপস্থিতি জানান দিতে এলো।

ঘোষ বউদি জিজ্ঞেস করে ‘কিসের শব্দ হলো বুঝতে পারলেন কিছু?’ ‘বিড়াল টিড়াল হবে।‘ বেশি কৌতুহল না বাড়িয়ে সবাইকে ডাক দিয়ে খাবারের সদ্বব্যবহার করতে শুরু করে দিলাম। চিকেন টা যা দারুণ বানিয়েছে তাতে পদমের ওপর সব অভিযোগ চলে গেলো।

               খাওয়া সেরে পরস্পরকে গুড নাইট করে যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম। সারাদিনের ধকল আর বেশ ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে শোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি। দরজায় জোর ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘোষবাবু উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাকছে.....
               ‘কি ব্যাপার এত রাতে, কোনও বিপদ হলো নাকি?’
               ‘হ্যাঁ বিপদ তো বটেই।‘
               ‘মানে?’
               “মিনু (বলা হয়নি, ঘোষ বউদির নাম মিনু) কেমন যেন করছে, শিগ্রি আসুন আপনারা দুজনেই।’
আর বেশি প্রশ্ন না করেই আমরা দুজনায় ওনাদের ঘরে ঢুকে দেখি ঘোষ বউদি বিহ্বল দৃস্টিতে ভয়ার্ত ভাবে আমাদের দিকে আছে। আমরা সকলেই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে কারনটা জানতে চাইছি। একগ্লাস জল ঢকঢক করে খেলো, কিছুটা বিছানায় পড়লো, কিছুটা গলায় গেলো। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো
‘আমি বলেছিলাম না?’
‘কি?’
‘ভুত।‘
‘মানে, কোথায়?’
‘কোথায় আবার! এইখানে এই ঘরে।‘
‘ঠিক বলছেন?’
গলার স্বর এবার আর একটু বাড়িয়ে বললো ‘তবে কি বানিয়ে বলছি? খসখস শব্দ শুনেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আবছা আলোয় স্পস্ট দেখতে পেলাম একটা মেয়ে সাদা গাউন পরে আাস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে । তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলে বসলো। দেখুন এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।..’
               ‘আপনি মুখটা দেখতে পেলেন?’ আমার স্ত্রী প্রশ্ন করে।
               ‘না, একটা সাদা স্কার্প দিয়ে মাথাটা আর মুখের অর্ধেকটা ঢাকা ছিল। আমি আগেই বলেছিলাম এটা ভুতুরে বাংলো। এখানে ভুত আছে, রাত্রে আসা যাওয়া করে। আপনি তখন বিড়ালের কথা বলছিলেন না! ওসব কিছু না, আসলে ওরাই।‘
জানলা দরজা তো সব ভালো করে বন্ধই ছিল, তাহলে এলো কোন দিকে। ভুতেদের আসা যাওয়ার জন্যে অবশ্য জানলা দরজার দরকার হয় না।
               ঘোষ বউদি একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন ‘একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতেই বিদ্যুতের ঝলকের মতো ছটায় সব অন্ধকার গেলো।‘
ঘোষ বাবু বললেন ‘গোঁ গোঁ শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ধাক্কা দিয়ে স্বাভাবিক না হওয়াতে আপনাদের ডাকতে বাধ্য হলাম।‘
               ‘না না ওরকম কেন বলছেন, এটাই তো করা উচিৎ। উনি খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন।‘
               ‘ভয় পাবো না? চোখের সামনে জল জ্যান্ত ভুত ঘোরাঘুরি করছে।‘
               ‘যাকগে আর দুঃশ্চিন্তা না করে বাকি সময়টা ঘুমিয়ে পড়ুন। নাকি ভোর তো প্রায় হয়েই এলো চলুন জানালা খুলে কাঞ্চনজঙ্গা দেখার চেষ্টা করি।‘
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠলেও, আকাশ মেঘলা। বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্গা আমাদের দেখা হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পদম এসে গিয়েছে। গুডমর্নিং জানিয়ে জানতে চাইলো ‘রাতে কোনও প্রবলেম হয়নি তো মাইজী।‘
               ‘হয়নি আবার, তোমার মাইজী বলা দেখাচ্ছি আগে চা লে আও।’ ঘোষ বউদির আক্রমনে পদম ঘাবড়ে গিয়ে সাথে সাথে ‘জী মাইজী’ বলে চা বানাতে গেল। আমার স্ত্রী বললো ‘পদমটা খুবই নিষ্ঠাবান , ঠিক ভোর বেলায় চলে এসেছে।‘
               ‘নিকুচি করেছে নিষ্ঠার, ও জানতো সব কিছু চেপে গেছে।‘
ইতিমধ্যে পদমের চা চলে এসেছে। গরম চায়ে চুমক দিতে দিতে ওকে জেরা করে জানতে পারলাম যে তার বাবাও এই গেষ্ট হাউসের কেয়ার টেকার হিসেবে কাজ করতো।  বাবার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছে তারই কিছুটা বর্ণনা করে। এক ইংরেজ সাহেব, ডগলাস, খুব সখ করে এই বাড়ি বানিয়েছিলো।  এত বড় বাড়ি হলেও খুব সুন্দরী বউ আর একমাত্র ছেলে নিয়ে মোট তিনজনই থাকতো, আর দেখভালের জন্যে সবসময় চার পাঁচ জন লোক মজুত থকতো। এই এলাকায় তখন এত ঘরবাড়ি ছিল না, চারদিকে  জঙ্গল মাঝে মাঝে কিছু কিছু বাড়ি আর এইসব বস্তি। জন্তু জানোয়ার থাকতো , সন্ধ্যে হলেই কোনও ভরসা ছিল না। চিতা বাঘ,ভালু, ভেড়িয়া ঘুড়ে ফিরে বেড়াতো। একদিন ছোটা সাহেবকে একটা চিতা জঙ্গলে নিয়ে গেলো। বহুত খোঁজাখোঁজি করেও লাশ পাওয়া গেলনা। মেমসাহেবের খুব মন মন খারাপ । একদিন মারা গেল।
‘মারা গেল, কি করে?’
‘কি বলবো মাইজী একদিন ঐ ঘরে গলায় রসি ঝুলে....’
‘বলো কি?’
‘আমি বাবার কাছে শুনেছি। তারপর সাহেব এই কোঠি বিক্রি করে বিলাত চলে গেলো। আরও অনেক বছর পর আাবার বিক্রি হলো আর এই গেস্ট হাউস তৈয়ারী হলো। তবে ভয়ের কিছু নাই। কারও কোনও বিপদ হয়নি।‘
ঘোষ বউদিই বলে উঠলো ‘এখনো তুমি বলছো ভয়ের কিছু নেই। আমরা আর এখানে থাকবো না। খুব জোর কালকে প্রাণে বেঁচে গেছি, আর নয়।‘
‘কিছু হয়েছে মাইজী?’
‘আর তোমার জেনে কাজ নেই, সেই মেমসাহেব কালরাত্রে... আমরা আর থাকবো না।‘
অগত্যা, যত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানে দুদিনের প্রোগ্রাম সেরে পরের দিন ছিল লাভা, সেখানেই ফোন করে কোনও ক্রমে ম্যানেজ করে এই গেস্ট হাউস ছেড়ে চললাম লাভা।
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment