1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই

ছবি : ইন্টারনেট 

এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই

আরিফুল হাসান

      গ্রামের পরে বটগাছ। বটগাছে কেউ থাকে না। তবুও লোকেরা বলে, মামু থাহে। দুরন্ত বাচ্চারা তা মানে না। তারা ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে বটগাছের কাছে চলে যায়। বাড়ি আসলে মা তাদেরকে আগুন দিয়ে সেঁকে। সারা গায়ে থুপ থুপ দেয়। মনে মনে দোয়াদরূদ পড়ে; কোনো কুনজর যেনো না লাগে। কেউ কেউ বটগাছের নিচ দিয়ে আসার সময় অজ্ঞান হয়ে যায়। নির্জন দুপুরের একাকীত্ব আর প্রায় অর্ধেকমাইল বিস্তৃত সবুজের মোহ তাদেরকে বেভুলা করে দেয়। তারা উলটপালট বলতে থাকে। তখন গুনিন আসে, কবিরাজ আসে। জিন তাড়ানোর পায়তারা চলে। নাকের মধ্যে শুকনা মরিচ পোড়া দিয়ে ধোঁয়া দেয়, মুমুর্ষু আরও মুমুর্ষু হয়ে উঠে। অপারগত নাম বলে, কেউ একজনের নাম বলে সে। গুনিন আরও জোরে ধমক দেয়, কোনখান থাইকা আইছিস? রোগি আবারও কথা বলে না। গুনিন রোগির কড়ে আঙুলে চেপে ধরে বলে, বল বল, না হইলে দিলাম! তখন গুনিন একহাতে ছুড়ি দিয়ে মাটিতে দাগ কাটে। ছোড়াটাকে আগুনের মধ্যে ঝলসায়। লাল টকটকে ছোড়াটা দেখে রোগি বলে উঠে, কু’কাফ।

এখানে কোথায় থাকস? রোগী আবারও কথা বলে না। গুনিন দাঁতে দাঁত কড়মড় করতে থাকে। আশপাশের আরও চারপাঁচজন তখন রোগিকে জাপটে ধরে। রোগির শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। রোগি কথা বলে না। গুণিন সরষের তেলে শুকনা মরিচ ফেলে গরম করে। গরম তেল ঢুকিয়ে দেয় রোগির নাক দিয়ে। রোগি বলে উঠেÑ কইতাছি, কইতাছি। ক। Ñগুণিন বলে। রোগি একটু ধাতস্ত হবার জন্য সময় নেয়। গুণিন ধমকে উঠে, ক কইতাছি, কই থাকস এখানে? রোগি আধো আধো উত্তর দেয়, বট গাছে।

তারপর হয়তো বেশ কদিন লোকটির দেখা পাওয়া যায় না। ছেলে ছোকড়ারা আবার সেই গাছের নিচে যায় । একদিন হয়তো রহিমের ছেলে শাজাহান লাশ হয়ে পড়ে থাকে বটগাছের নিচে। গ্রামের মানুষেরা হাহাকার করে উঠে, মামু নিয়া গেছে! আবার ডাক পড়ে গুণিনের। গুণিন এসে ধুন ধরে বসে থাকে। লাশ সরায় না। গ্রামের লোকজন বটগাছের গোড়া থেকে মৃত ছেলেটিকে আনতে ভয় পায়। তারা মনে করে মামুর আহার তারা আনবে কীভাবে? দুপুর গড়িয়ে যায়, লাশটিতে মাছি বসতে শুরু করে। গ্রামবাসী গুণিনকে অনুরোধ করে; গুণিন কথা বলে না। সে নিশ্চুপ হয়ে বটগাছ থেকে অদূরে বসে থাকে। রহিম, যে ছেলের বাপ, সে এসে গুণিনের পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে। গুণিন মুখ তোলে চায় না। রহিমের বউ আবেদা বারবার মুর্ছা যায়, গুণিনের মন গলে না। সন্ধা নেমে আসছে প্রায়, এ রকম সময়ে গুণিন বলে, এই লাশ আনা যাবে না। গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গুণিন উঠে চলে যায়। গ্রামের মানুষেরা যে যার ঘরে চলে যেতে থাকে। ভয়ডরের তোয়াক্কা না করে রহিম ছুটে বটগাছের দিকে। গ্রামের কয়েকজন যুবক তাকে ধরে ফেলে। টেনে হিচড়ে তাকে ও তার বৌকে বাড়িতে এনে দিয়ে যায়।

সেদিন যাকে শয়তানে ধরেছিলো তার নাম হয়তো ছিলো মুজাহিদ। মুজাহিদ জিনের আছরে উল্টাপাল্টা কতো কথা বলছিলো। গুণিন তাকে নাকে শুকনো মরিচ দিয়ে সুস্থ্য করে ফেলে ঠিকই। কিন্তু তাকে আর বেশকিছু দিন দেখা যায় না। লোকেরা বলে, যেই আকতা-কুকতা কইছে, হয়তো শরমে বাইর অইতাছে না। আবার কেউ কেউ বলে, নারে, শর্মের কি আছে? হেইতে কি হুঁশে আছিলোনি? তার কথায় মুরব্বিরা সাঁয় দেয়, হ, হ। সব জিনে কইছে। মুজাহিদ আসলে কিচ্চু কয় নাই।

মুজাহিদের জিন ছাড়াতে গুণিনের সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম হয়েছিলো। উপস্থিত লোকেরা বলে, এই জীবনে এত গাউরা জিন দেহি নাই। এমুন তেরার তেরা, পিছার বাড়ি খাইল, জুতার কামুড় খাইল, তবুও শালার পুতের যাওনের নাম নাই। থু থু করে লোকটি তার বুকে থুথু দেয়, মামুরে গালি দিয়ালাইছি, আল্লা আল্লা, মাফ করো। তার সুরে আরেকজন সুর মিলায়, তোবা, তোবা; তোবা কর, তোবা কর। আরেকজন, যে অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বাস করে, সে বললো, মামুডা লুইচ্চাও আছিলো! তার কথায় সবাই তারদিকে ঘুরে তাকায়।

সেদিন মুজাহিদের জিন ছাড়ানোর একপর্যায়ে জিন বলেছিলো, সে রহিমের বৌ আবেদাকে ভালোবাসে। এই কথা বলার পর সবথেকে কমবয়সী বালকটিও লজ্জা পেয়ে মুখ লাল করে থাকে। গুণিন কষে এক থাপ্পর মারে মুজাহিদের গালে। পাঁচ আঙুলের ঝোক লাল হয়ে ফুটে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই মুজাহিদের জ্ঞান চলে যায়। সে মূর্ছা গিয়ে পড়ে থাকে। গুণিন বলে, যায় নাই, ভ্যাক ধরছে। সে মুজাহিদের পায়ের তলায় জালি বেত দিয়ে বাড়ি মারে। গালি দিয়ে লাফিয়ে উঠে মুজাহিদ। গুণিন বলে, কইসিলাম না! বজ্জাৎ জিন, জাতে চাড়াল। ধরলে যাইতে চায় না। অর চৌখ পড়ছে রহিমের বৌয়ের দিকে, বলে গুণিন আবারো সরিষার তেলে মরিচ গরম করে। এবার আর মুজাহিদ জিনটাকে অথবা জিনটা মুজাহিদকে ধরে রাখতে পারে না। পাশের একটি আমগাছের ডাল হরহর করে ভেঙে মামু চলে যায়।

মুজাহিদ আর রহিম সম্পর্কে ফুফাতো মামাতো ভাই। মুজাহিদের বাবা গ্রামেই বিয়ে করে তছুরুদ্দি মৃধার মেয়েকে। মামার বাড়ি যেতে আসতে মুজাহিদের চোখ পড়ে রহিমের বৌ আবেদার উপর। এক বাচ্চার মা, তবুও রূপের নহর যেনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে। মুজাহিদ চোখ ফেরাতে পারে না, মন ফেরাতে পারে না। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় এ কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারে না। দিনে দিনে সে নিজের সংসারের প্রতি বিমুখ হতে থাকে।

রাত্রি তখন আটটা। রহিমের ঘরে দানাপানি নেই। গ্রামের কয়েকজন রহিমকে, রহিমের বৌকে সান্তনা দিয়ে চলে যায়। প্রতিবেশিরা তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। খাবার যায় না রহিমের মুখে। রহিমের বৌ আবেদা ঘন ঘন মুর্ছা যেতে থাকে। রাত বাড়ে। প্রতিবেশিরাও একসময় সান্তনা দিয়ে চলে যায়। ঘরে পড়ে থাকে মুষড়ে পড়া রহিমের বৌ ও রহিম। রহিম কি করে সান্তনা দিবে বৌকে বুঝে পায় না। তারও একমাত্র সন্তান, নিজের বুক ফেটে যাচ্ছে! কানতে কানতে একসময় সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের মতো কিছু একটাতে ডুবে যায়।

রহিমের বৌ জেগে উঠে। গুণিন বলেছিলো, এই লাশ আনলে হগল গেরাম ধ্বংস অইয়া যাইবো। রহিমের বৌয়ের কথাটি মনে পড়ে। সে নিজের কানে শুনেছে কথাটি, তবুও তার মনে হয় গুণিন মিথ্যে বলেছে। অথবা হয়তো সে মনে মনে ভাবে, ধ্বংস অইলে অউক, আমি আমার পোলার লাশ চাই।

রাতের অন্ধকার ভেদ করে চলছে আবেদা। সন্তানহারা সন্তাপে, শোকের পাথার বুকে নিয়ে, নির্ভয় অকুতোভয় চলছে আবেদা। যেনো উন্মাদ, যার কোনো প্রাণের মায়া নেই। যেনো ঝড়, যার কোনো বিরামচিহ্ন নেই। যেনো নক্ষত্রপতন, যে মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে ব্ল্যাকহোলে। গ্রামের পথমাড়িয়ে দ্রুতপদে চলছে আবেদা। অন্ধকারে চলতে চলতে হোঁচট খাচ্ছে কখনো কখনো। কখনো কাটায় লেগে ফিনফিনে শাড়িটি ফ্যাৎ করে ছিড়ে যাচ্ছে। আবার কখনো বা কাঁদাজলে পড়ে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। তবুও রাত নিশাচর; সেই অকুল অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে আবেদা পৌঁছে যাচ্ছে বটগাছটির কাছে।

বটগাছটির গোড়াতে দুটো মানুষ শাজাহানের লাশটিকে মাদুরে প্যাঁচাতে থাকে। দুঃসাহসী হলেও কেমন যেনো ভয় ভয় লাগতে থাকে তাদের। আশপাশে শেয়াল ডাকছে, খাটাস ডাকছে। লোক দু’জন তারাতারি করতে গিয়ে বার বার বিলম্ব করে ফেলছে। এমন সময় তারা দেখতে পায় কে যেনো এলোকেশী এগিয়ে আসছে বটগাছটির দিকে। মাঠের অন্ধকারে ছিন্নভিন্ন জলকাঁদা মাখা নারীমুর্তিটি দেখে তারা দু’জন ভয় পেয়ে যায়। প্রাণের ভয়ে অতঃপর তারা দৌড়াতে শুরু করে। আবেদা এসে ঝড়াক্রান্ত পাখির মতো শাজাহানের লাশ বুকের ভেতর টেনে নেয়। অন্ধকারে সে দেখতে পায়, দুটি পরিচিত অবয়ব দৌঁড়ে পালাচ্ছে।

...(সমাপ্ত)...

1 comment:

  1. ধন্যবাদ প্রিয়নবী বইসই

    ReplyDelete