1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

জয়পুর যাত্রাবিভ্রাট

ছবি  : ইন্টারনেট

জয়পুর যাত্রাবিভ্রাট

অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

      আমি আর আমার কলেজের সতীর্থ অভিমন্যু সেন চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজস্থানের আজমেরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক পেয়েছিলাম। কয়েক মাস আগে থেকেই জোর কদমে প্রস্তুতি চলছিল তার জন্য। যাইহোক, বিমান যাত্রার জন্য সুলভ মূল্যে টিকিট পাওয়ার লক্ষ্যে আগেভাগে টিকিট কেটে ফেললাম। অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি সমাগত৷ আমরা সাধ্যমত নিজেদের গুছিয়ে রওনা দিলাম কলকাতা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। বলে রাখা ভালো, আমি যদিও আগে বেশ কয়েক-বার বিমান-যাত্রা সম্পন্ন করেছি, কিন্তু আমার বন্ধুটির এটি প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই একজন অভিজ্ঞ যাত্রী হিসেবে আমার অনভিজ্ঞ বন্ধুটিকে বিমান-যাত্রার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও ব্যাবহার-বিধি সম্পর্কে আগেভাগেই সচেতন করেছিলাম। যাইহোক, বিশেষ কোন অসুবিধা ছাড়াই আমরা বসে গেলাম উড়োজাহাজে। পরের দুই আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব দিল্লী, তারপর সেখান থেকে জয়পুরের কানেক্টিং ফ্লাইট। ফ্লাইট টেক-অফ্ করতে অযথা গড়িমসি করতে থাকায়, অভিমন্যু আমায় বলল,

-“ভাই, দিল্লীর ফ্লাইটটার টাইম কটায় আছে? মিস হয়ে যাবে না তো?”

 আমি আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলে উঠলাম,

-“ডোন্ট্ ওয়ারী মাই ফ্রেন্ড্, এভরিথিং উইল‌ বি অল রাইট্!”

তারপর বিমান আকাশমুখী হল৷ আমি আর অভিমন্যু উইন্ডো-সিটের থেকে বাইরে মেঘমুলুকে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকলাম। অভিমন্যু বলে উঠল,

-“কি চমৎকার দেখ্! মনে হচ্ছে একদল পাগড়িধারী বর্গী, কোথায় যেন সদলবলে এগিয়ে চলেছে।”

–“ওয়াও! হোয়াট্ এ ওয়ান্ডারফুল ইমাজিনেশন!” আমি বললাম । 

সময়ের খেয়াল ছিল না আমাদের দুজনেরই। কিন্তু দিল্লীতে অবতরণের সময় ঘড়িতে চোখ পড়তেই তা কপালে উঠল। পরের উড়ানের সময় আর মাত্র ২৫ মিনিট পর। তড়িঘড়ি নামার উদ্দেশ্যে এয়ারহোস্টেসকে তলব করলাম। তখনই বুঝতে পারলাম, পাশের বৃদ্ধ অবাঙালি ভদ্রলোক যিনি এতক্ষণ খুবই শান্তভাবে বসেছিলেন, তিনি জয়পুরযাত্রী। তিনি খানিক বিব্রত হয়ে আমাকে বললেন,

-“মনে হয়, এরা এয়ারলাইন্স্ থেকে আমাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করবে ।”

এই আশ্বাসটুকুই তখন বিশ্বাস তৈরীর খড়কুটো। তারপর এয়ারহোস্টেস-এর কথা মতো আমরা দুজনেই প্লেন থেকে রীতিমতো হন্তদন্ত হয়ে নামলাম, সঙ্গে দেখলাম সেই সহযাত্রী বৃদ্ধ লোকটিকে। খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম, আমাদের সাথে আর একজন আছেন, তাই হয়ত এ-যাত্রায় সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, তারপর যা হলো, তা আমাদের প্রত্যাশার আাঁকিবুকিতে একেবারেই ছিল না। নীচে গ্রাউন্ডস্টাফ যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি একজন কম বয়সী বাঙালী ভদ্রমহিলা। আমাদের তিন জনকে দেখে কিঞ্চিত হাসিমুখে বললেন,

-“আসুন স্যার! একটু তাড়াতাড়ি, নইলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে ৷”

তারপর....তারপর আর কি, রীতিমতো দৌড়ে অন্য টার্মিনালের দিকে অগ্রসর হলাম। মাঝে-মধ্যে পিছন ফিরে দেখি বৃদ্ধ মানুষটিও বেশ জোরে পা চালিয়ে আসছেন৷ কোনোক্রমে, আমি ও অভিমন্যু একসাথে এক্সপ্রেস সিকিউরিটী চেক করিয়ে দৌড়ালাম ডিপার্চার গেটের দিকে। সিকিউরিটী অফিসারটি খানিকক্ষণ কঠোর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার জিজ্ঞাসা করলেন,

-“ক্যা হুয়া? আপলোগ ইতনা লেট্ হুয়ে ক্যায়সে?”

যাইহোক ওনাকে বুঝাবার মতো সময় আমাদের ছিল না। তারপর যখন গেটে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম তিন জন স্টাফ নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মগ্ন। আমি বললাম,

-“হ্যালো আমাদের জয়পুর ফ্লাইটটা?”

তখন সে চমকে উঠে বলল,

-“আপকা নাম, স্যার?"

আমি বললাম, “পরিতোষ মুখোপাধ্যায় ৷”

সে খানিকটা থেমে মৃদুহেসে বলল, “সরি স্যার, দ্য ফ্লাইট ইজ্ রেডি ফর ডিপার্চার, গেট্স্ ক্লোজ্ড্ ।”

বৃদ্ধ ভদ্রলোক যিনি এতক্ষণ আমাদের সাথেই ছিলেন, তিনি এবার মাথায় হাত দিয়ে সামনের একটি সিটে ধপ্ করে বসে পড়লেন,

-“এ কি শাস্তি! ইটস্ ইয়োর ফল্ট ।”

এটা শোনার পর স্টাফটি খানিকক্ষণ উদাসীন হয়ে বোধ হয় ভাবলেন, এ আর এমন কী? অভিমন্যু প্রায় ভেঙে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,

-“ধুর্ ! এত পড়াশুনা করার পর শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটাই দিতে পারব না ।”

আমি কাঁচুমাচু হয়ে আবার সেই উদাসীন কর্মরত ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম,

-“ক্যান ইউ গিভ আস্ অ্যানাদার ফ্লাইট ?”

সে মাথা নাড়িয়ে বলল,

-“দ্য নেক্সট ফ্লাইট ইজ্ এট 10:30 পি.এম.।”

মানে আরো দশ ঘন্টা পর। আমি খানিকটা হতোদ্যম হয়ে অভিমন্যুর পাশে বসে পড়লাম। মনে মনে বললাম,

-“আমাদের রাজস্থান যাত্রাটা আর বোধ হয় রমণীয় রইলো না ।”

তবে একটা বিষয় ঠিক যে এরকম কোণঠাসা অবস্থায় আমার মধ্যে একটা অতিলৌকিক শক্তির আলোড়ন তৈরি হয়, যা প্রতিকূল পরিস্থিতিকে যেভাবেই হোক নিজের আয়ত্তে আনতে সাহায্য করে৷ এবারও তাই হল৷ আমার মস্তিষ্কের অতীব সক্রিয় তন্ত্রীটি সংকেত পাঠাল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার মনমরা বন্ধুটিকে কোনো রকমে চাঙ্গা করে দ্রুত দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম, সোজা প্রিপেড ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে৷ সেখানে আমাদের বরাতে জুটল এক ট্যাক্সি-চালক সর্দারজী৷ তাকে বললাম,

-“গুরুগ্রাম রেলস্টেশন, কিতনা লেঙ্গে?”

সে বলল,

-“৭০০ রুপাইয়া ! আধা-ঘন্টেমে পৌঁছা দেঙ্গে ৷”

আমি বললাম,

-“চলিয়ে জলদি!”

অভিমন্যু কিছুটা হতবাক ও বিভ্রান্ত হয়ে আমার সাথে ট্যাক্সিতে চেপে বসল৷ আমি বললাম,

-“গুরুগ্রাম থেকে জনশতাব্দী একসপ্রেস আরও ৪৫ মিনিট পর ছাড়বে, টিকিট বুক্ করে ফেলেছি। ৬ ঘণ্টায় আজমেরে পৌঁছাবে৷”

আমার কথা শুনে অভিমন্যুর ধড়ে  যেন প্রাণ এল। সে চিৎকৃত উচ্ছাসে ফুকরে উঠল,

-“জয় মা। আমাদের আজমেরে পৌঁছে দে মা ।” 

আমাদের কথোপকথন শুনে সর্দারজী হাঁক পাড়লেন,

-“ঘাবড়া মত বেটা, হামলোগ সময় সে পেহলেই স্টেশন পৌঁছ যায়েঙ্গে ।”

ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল ট্যাক্সিটি আর আমরা পৌঁছে গেলাম গুরুগ্রাম স্টেশন। ট্রেন তখনও আসেনি৷ সর্দারজীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা প্ল্যাটফর্মের দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগোলাম৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এল, আমরা চেপে বসলাম৷ আজমেরের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল। আমাদের দেখে হোটেলের রিসেপসনিস্ট খানিক হিন্দি ও রাজস্থানি মিশিয়ে বলল,

“স্যার, আপ্ লোগ কাফি থকে হুয়ে লগ রহে হ্যায়৷ জলদি যাকে আরাম কিজিয়ে ৷”

আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের রুমের দিকে এগোলাম কারণ পরের দিন তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ; তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে খুব সকাল সকাল বেরোতে হবে যে৷ যাইহোক, এই যাত্রা বিভ্রাট আমার ও অভিমন্যুর জীবনে একটি অনন্য আস্বাদে রয়ে গেল ৷

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment