1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

লক্ষ্মীর বন্ধু

ছবি : ইন্টারনেট

লক্ষ্মীর বন্ধু

পিয়ালী সেনগুপ্ত

লক্ষ্মীদের অভাবের সংসারে পুজো এলেও আলাদা করে কোনো উচ্ছাস দেখা যায় না। লক্ষ্মীর বাবা অনেক বছর আগে কাজের খোঁজে ভীনদেশে গিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম চিঠি, টাকা সব পাঠাতেন। বছর ঘুরতেই সেই সব আসা বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ্মী তখন নেহাতই শিশু। কিছুই তেমন বুঝতো না। শুধু মাঝে মধ্যে বাবাকে খুঁজতো আর কাঁদতো। লক্ষ্মীর মা কয়েকবার থানা পুলিশ করেছিল মানুষটার খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু বেশিদিন এইসব চালানোর ক্ষমতা কোথায় ওদের! তারপর সে কয়েক বাড়ি রান্নার কাজ নিলো দুটো পেট চালাতে। এভাবেই চলছে সেই থেকে। লক্ষ্মী এখন গ্রামের সরকারী স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। ওর একটাই লক্ষ্য পড়াশোনা করে একটা ভালো কাজ করে ও ওর মাকে বিশ্রাম দেবে। আর বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করতে হবে না মাকে। কিন্তু সেই দিন আসতে এখনও অনেক দেরি। তার আগে ওকে অনেক লড়াই করতে হবে। তাই ও কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু লেখাপড়া করে যায়। তবুও পুজো আসলেই ওর মনটা হু হু করে ওঠে। সবাই নতুন জামা, নতুন ক্লিপ, চুড়ি, হারের গল্প করে।  সেখানে লক্ষ্মীর শেষ কবে নতুন জামা হয়েছিল তাই ও জানে‌না। 

এবারে ওদের গ্রামে পুজো নিয়ে বিশাল আয়োজন চলছে। রায় বাড়ির দূর্গা পুজোটাই ওদের গ্রামের একমাত্র পুজো। সেই পুজো‌ এবার দু'শো বছরে পা দেবে। রায় বাড়ি থেকে সারা গ্রামের পথঘাট আলোয় সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। বাড়ির বড় ফটকের সামনে কাঙালি ভোজন আর বস্ত্র বিতরণের জন্য বিরাট প্যান্ডেল খাটানো হচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে দানধ্যান। লক্ষ্মীর মাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ওই বাড়ি থেকে কাজের জন্য। লক্ষ্মী তাই ভীষন খুশী। মায়ের সাথে এবার তাহলে ও রায়বাড়িতে যেতে পারবে। 

ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলা উঠে লক্ষ্মী স্নান সেরে সবচেয়ে ভালো যে জামাটা আছে ওটা বের করে পরে নিলো। তারপর মায়ের হাত ধরে গেল রায়বাড়ি। প্রতি বছর দালানের সামনে থেকে ঠাকুর দেখে ফিরে আসে ও। কিন্তু এইবার যেহেতু ওর মা রায়বাড়ির অন্দরে কাজের ডাক পেয়েছে, তাই লক্ষ্মীও ভেতরে গেল মায়ের সাথে। ভেতরে ঢুকে লক্ষ্মী হা হয়ে গেল ‌। এতো বাড়ি নয়। এক্কেবারে প্রাসাদ। কত ঘর আর তাতে কি সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। বাড়ির মেয়েরা একদম রাণীর মতো সেজে ঘুরছে। এর মধ্যেই ওর দেখা হলো ওর‌ই বয়সী একটি মেয়ের সাথে। মেয়েটার নাম অহনা। ও এই বাড়ির বড় ছেলের মেয়ে। কলকাতায় থাকে। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। পুজোয় বাড়ি এসেছে কয়েক দিনের জন্য। অহনার সাথে লক্ষ্মীর বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পুজোর কটা দিন একসাথে ভালোই কাটলো ওদের। কত কি জানতে পারলো লক্ষ্মী ওর কাছ থেকে কলকাতা শহরের বিষয়ে, ওর স্কুলের বিষয়ে। দেখতে দেখতে পুজোর শেষদিন উপস্থিত। বিজয়া সেরে অহনারা পরদিনই ফিরে যাবে কলকাতায়। ওদের দুজনের‌ই মন‌ তাই খুব খারাপ। হঠাৎ অহনা ওর সোনার লকেটটা চেইন থেকে খুলে লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে বলল, "এটা তুই রাখ আমার চিহ্ন হিসেবে। আর তোর গলার লাল পুতির লকেটটা আমায় দে। ওটা আমি আমার কাছে রাখবো।" সেইমতো সেদিন দুই বন্ধু লকেট দেওয়া নেওয়া করলো। পরদিন অহনারা যখন ফিরে গেল, লক্ষ্মী দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছিল। অহনা অনেক খুঁজেও ওকে দেখতে পেলনা। লক্ষ্মী অহনার দেওয়া লকেটটা যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন ওর মায়ের চোখে পড়ে গেল। লকেটটা যে রায়বাড়ির মেয়ের সেটা লক্ষ্মীর মা ভালো করেই বুঝলো। সেদিন খুব মারতে মারতে ওর মা ওকে রায়বাড়িতে নিয়ে গেল। ক্ষমা চেয়ে লকেটটা ফিরিয়ে দিলো যে লক্ষ্মী বাচ্চা মেয়ে বলে না বুঝে ওটা নিয়ে এসেছে। রায় গিন্নী লকেটটা হাতে নিয়ে বললেন, "এখন‌ই চুরি করতে শিখে গেলি! নতুন একটা জামা দিলাম। তাতেও তোর আশ মিটলো না।" এরপর থেকে লক্ষ্মী আর ওর মাকে কেউ কখনও গ্রামে দেখেনি। একদিনের মধ্যে ওরা ভীটে ছেড়ে চলে গেলো। পরের বছর পুজোয় অহনা এসে লক্ষ্মীর খোঁজ করলো, কিন্তু কিছু জানতে পারলো না। 

আজ প্রায় বছর কুড়ি পরে এই পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছে লক্ষ্মীর। রেস্টুরেন্টে উল্টো দিকের টেবিলে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখেই ও চিনতে পেরেছে। ওর হাতে একটা কর্ডের মধ্যে গেঁথে সেই লাল পুতির লকেটটা ব্রেসলেট করে পরা। অহনা কথা রেখেছে। বন্ধুত্বের চিহ্ন সে আজ‌ও বহন করছে। কিন্তু লক্ষ্মী পারেনি। এই সমাজ ওকে পারতে দেয়নি। সেই অপারগতা প্রকাশ করে লক্ষ্মী পারলো না আজ অহনার মুখোমুখি হতে। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment