1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

ওয়াং- কার- ওয়াই এর ভুবন

ছবি : ইন্টারনেট

ওয়াং- কার- ওয়াই এর ভুবন

ইমন ভট্টাচার্য

শহর থেকে একটু দূরে এলে মনে হয়, শহরের কলজেটাকে অনুভব করা যায়। বিরাট আয়োজন, বিচিত্র মানুষ আর বিচিত্র তার লীলাখেলা। কতকত মানুষকে গিলে নিচ্ছে এই শহর, আবার উগরেও দিচ্ছে। কত হয়ে ওঠা, কত স্খলন, কত হারিয়ে যাওয়া, ফের বেড়ে ওঠার বিচিত্র ইতিহাস এই শহরের বুকে লেখা আছে। কত স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা, স্বপ্নের পূরণ, স্বপ্নের হতাশা, কত অভিমান নিয়ে কত মানুষের বেঁচে থাকা। শহর যেন চরিত্রের ভাণ্ডার, অভিজ্ঞতার আড়ত।

এরকমই কিছু শহুরে মানুষ, তাদের বিচিত্র জীবনপদ্ধতি, টানাপোড়েন আমরা দেখতে পাই ওয়াং ওয়াইয়ের সিনেমায়। হংকং শহর এবং তার চরিত্রকে কেন্দ্র করে ঝাঁ চকচকে কিছু মূল্যবান সিনেমা তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেই।

আমরা দেখলাম ‘ফলেন অ্যাঞ্জেলস্‌’। স্বর্গচ্যুত, কক্ষচ্যুত কিছু অভিশাপগ্রস্থ মানুষ। কেউ পেশাদার খুনির মাইনে করা পার্টনার, কেউবা বোবা-কালা স্টোরকিপার। অথচ প্রাণবন্ততায় তারা দীপ্ত। নির্লিপ্ততায় তারা বিষণ্ণ। যেভাবে তাদের আস্তানার পাশ দিয়ে একের পর এক ট্রেন চলে যায়, সেভাবেই উত্তেজনাবহুল একের পর দিন কেটে যায় তাদের। শহর সরবরাহ করে এই উত্তেজনা। যেখানে শহরচারী জাঁতাকলের ইঁদুরের মতো ওই উত্তেজনাটা তার খাদ্য। এক পেশাদার খুনি, খুনের জায়গা ও শিকারের ব্যাপারে সমস্ত প্ল্যান ও তথ্য সরবরাহের জন্য নিয়োগ করে এক তন্বী সুন্দরীকে। পরস্পরের কাছে না থেকেও এক যৌথ জীবন যাপন করে তারা।

একই টেরেসে তারা থাকে একজন সকালের একজন সন্ধ্যের শিফ্‌টে। ছেলেটির ফেলে যাওয়া আবর্জনায় নানা সূত্র পায় মেয়েটি। হারিয়ে যাওয়া খাম, পুরোনো ডায়েরির টুকরো, নানা বস্তু। এইসব থেকে সে ছেলেটির জীবন কাহিনীর একটি আকার গড়ে তুলতে থাকে। মেয়েটি সকালে গিয়ে দেখে এসেছে একটি বার বা ক্যাফে। তার  ডিটেল নকশা সে ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দেয়। রাতে গিয়ে ছেলেটি সেই জায়গাটি সাফ করে আসে গুলিবর্ষণে।

অত্যন্ত অসহায়ভাবে সে প্রেমে পড়ে ছেলেটির এই সতর্কবার্তা জেনেও যে পার্টনারের সঙ্গে আবেগগত সম্পর্ক কাম্য নয়। কাম্য নয় জেনেও কামনা করে সে, সেই পথহারা নক্ষত্র।

এই কামনার পথ করুণ, নৃশংস। সে বর্ণনায় আর যাব না। তবু এই ইচ্ছের কুঁড়ি মুকুলেই দমিত হয়। তার পার্টনারকে সে হারিয়ে ফেলে। একটি বোতাম শেষ সূত্র হিসেবে রেখে দেয় ছেলেটি, মেয়েটি আসে সেই শেষ স্মারকের সন্ধানে। এই গল্পের এখানেই শেষ হয়, কিন্তু সিনেমা শেষ হয় না।

এক প্রাণবন্ত মূক ও বধির যুবককে দেখি আসরে নামতে। সারাদিন সিগারেট খায়, ফূর্তিতে থাকে, ব্যবসা দেখে। নানান মজার হরকত যেন একটা রিলিফ নিয়ে আসে। খুশিয়াল ছেলেটিকে দেখে এতক্ষণের হানাহানি যেন কিছুক্ষণ ভুলে থাকে দর্শক। সে তার বাবাকে এক নাগাড়ে ভিডিও করতে থাকে। জন্মদিনে সেই ভিডিও দেখতে দেখতে তার বাবাও মজা পান।

অথবা দেখি একটি মেয়েকে যার চুল ব্লন্ড। জিজ্ঞেস করলে বলে এরকম সে করেছে যাতে একবার দেখলে কেউ ভুলে না যায় তার জন্য।

এইরকম উজ্জ্বল নশ্বরতা ও পংক্তিতে আমরা চমকে উঠি। শেষে প্রথম মেয়েটি যখন প্রায় মদ্যপ অবস্থায় দ্বিতীয় ছেলেটির মোটরবাইকে উঠে পড়ে এবং জানায় যে, ওই কিছুক্ষণের জন্য একটা ভরসার কাঁধ এবং সান্নিধ্যের উষ্ণতা তার ভালো লেগেছিল তখন অদ্ভুত এক মনকেমনে বুক ভরে যেতে থাকে। এই তাহলে আমরা! এত নশ্বর, অসহায় ও একইসঙ্গে জীবনলিপ্সু! এখানেই ওয়াং-কার-ওয়াই একজন প্রথম শ্রেণীর পরিচালক। জীবনকে তিনি দেখান ব্যবচ্ছেদ করে, চিরে চিরে তার সঙ্গে শেষবেলার আকাশের মতো কিছু আলোকরেখাও তিনি এঁকে যান। জীবন যেরকম।

ওয়াং-কার-ওয়াই এর বেশিরভাগ সিনেমাতেই এক গতি আছে কিন্তু শেষ গতি মানুষের একলা হওয়া। এই হংকং যেন কলকাতারই মত তিলোত্তমা, এক শিকারী ফুল, যা আস্তে আস্তে হজম করে সবাইকে।

‘ফলেন অ্যাঞ্জেলস্‌’-এর খুনি বা খুনির সহকারী বা চুংকিং এক্সপ্রেসের চরিত্ররা সকলেই যেন সময়ের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাঁচতে পারে কি পারেনা!

একটা একটা করে স্টেশন পেরোচ্ছে, বন্ধুদের হাত খসে খসে পড়ছে। পরিচিতের আগমন কমে যাচ্ছে, এক দূরগামী যন্ত্রণার টিকিট ধরিয়ে সকলকেই ট্রেনে সওয়ার করানো হয়েছে।

সামনে আর একটা স্টেশন। তার নিভু নিভু বাতি এবং প্ল্যাটফর্ম দেখা যাচ্ছে। কে নেমে যাবে, কেউ জানে না।

“ডেস অফ বিয়িং ওয়াইল্ড” সিনেমার প্রথম থেকেই এক মনকেমনের সুর। যেভাবে ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে, কথোপকথন এগোতে থাকে, তার সঙ্গে মিশে থাকে ডিটেলের কারুকাজ। যে যুবক নায়ক ক্যাসানোভার জীবনযাপন করে এবং একের পর এক মেয়েকে হস্তগত করতে থাকে, একসময় দেখে তার জীবনে স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবু সে জীবন নিয়ে লড়ে যায়। ফলে আপাত লঘু প্রেমের অনেকক্ষেত্রে নিরাবেগ প্রেমের মুহূর্তগুলিও স্মৃতির পরশে অসাধারণ আলোকময় হয়ে হীরেমানিকের মত জ্বলে ওঠে। এর শেষ কোথায়? ভাবি আমরা। নশ্বরতম প্রেম শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার আবেগ হয়ে ওঠে। প্রেম ও জীবন উভয়ই নশ্বর, তাই একাকার হয়ে যায়।

নায়কের আপরাইট জৌলুসপূর্ণ চেহারাটি শেষে আর এক থাকে না। এক আশ্চর্য মুহূর্তশালা তৈরি করে সিনেমাটি উধাও হয়ে যায়।

ঝকঝকে পরাক্রমী এক বাজার। টাকা পকেটে থাকলে কোনো সুখ, কোনো স্বাচ্ছন্দ্য হাতের বাইরে নয়। এ অবস্থায় মানুষ অনেকটা ফ্লোটিং যাযাবর। ভোগের চূড়া থেকে চূড়ায় গমন ছাড়া অন্য কোনো ব্যাসন নেই। ফিউডাল রাজাদের তাও মৃগয়ায় যাওয়া ছিল, এক্ষেত্রে নারীশিকারই একমাত্র মৃগয়া, নারীদের ক্ষেত্রে এর উল্টো।

কাজেই এ যেন উত্তরাধুনিক সিনেমার পটে এক নব্য শঙ্করবাদ। যেখানে মোহ থেকে মুক্তিই একমাত্র কাম্য বা অভিলক্ষ্য। শঙ্করের লক্ষ্য ছিল ব্যাক্তির মুক্তি, ব্যাক্তির আত্মস্থ হওয়া। অন্যদিকে ক্যাপিটালিজমের লক্ষ্য হল ব্যাক্তিকে আরও ভঙ্গুর ও নেশাতুর করে তোলা।

উত্তরাধুনিক লব্জে এই যাযাবরবৃত্তি হল নোম্যাডিসম্‌ যেখানে ব্যক্তি কোনো তাত্ত্বিক প্রস্থানে আশ্রয় পাচ্ছে না তাই সে এক ধূসর নো- ম্যান্‌সল্যাণ্ডের বাসিন্দা, নোম্যাড।

কিন্তু রাইজোমের মত কিছু সূত্র তাও তাকে অতীতের দিকে ধরে রাখে। আলোচ্য সিনেমাগুলিতে তাও নেই। তা’ই সময়ের সাপেক্ষে এই যাযাবর বা ভবঘুরেবৃত্তি, শেষ পর্যন্ত ব্যাক্তির নিয়তি, সে পাচ্ছে না তার আত্মার আবাস। নিজেকে দেখে সার্থক হয় এমন কোন আয়না।

যে প্রবণতাটির কথা বললাম, সেই প্রবণতাটি সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে 2046 নামে একটি সিনেমায়। প্রোটাগনিস্ট একজন লেখক। বেশ রগরগে রহস্যগল্প লিখে তার জীবিকা চলে। লেখালেখির জন্য তিনি বেছে নেন এক যাযাবর জীবন। তা’ই নিয়েই গল্প।

এক দীর্ঘ অভিযাত্রা এই লেখকের জীবন। একের পর এক সম্পর্ক তার গেছে আর এসেছে। জীবনটাকেও সেইভাবেই নিয়েছে সে। পদ্মপাতায় জল।

মূলতঃ রগরগে উপন্যাস লিখেই তার কিছু খ্যাতি হয়েছে। জীবনটাকে সে হোটেল থেকে হোটেল স্থানান্তর করে বেড়ায়। একটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সে দাবী মেনে নিতে পারে না। শারীরিকতার পর সে তাকে অন্য চোখে দেখে। ফয়সালা হয়নি সেই সম্পর্কের। অভিমান নিয়ে মেয়েটি চলে যায়।

আরেকটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। খাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা বন্ধু হয়ে ওঠে। মেয়েটি হয় লেখকের এডিটর। তারই প্রেরণায় সে রগরগে উপন্যাস ছেড়ে মার্শাল আর্ট নভেল লিখতে থাকে।

সিনেমাগুলির মূলস্তর এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। এবার আর একটু ভিতরে নামা যাক। ‘অ্যাশেস্‌ অফ টাইম’-এর গল্পটাই আলাদা। এক পোড়ো বিস্তৃত জায়গা যেন শ্মশানক্ষেত্রের মত একা। অনেকগুলি গ্রামের সন্ধিক্ষণের এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে একজন। সে হল সলিসিটার, মুশকিল আসা। তিন চারটে গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তার কাছে আসে সমস্যার সমাধানের জন্য। বেশ গুছিয়ে বসেছে সে। কিন্তু সে এক হৃতরাজ্য যুবরাজ। নিজের সমস্যার হয়ত সে কোনও সমাধান খুঁজে পায়নি।

এক পুরুষবেশী নারীযোদ্ধাকে সে কথা দিয়েছিল তার বোনকে সে বিয়ে করবে কিন্তু আসলে মেয়েটির কোন বোন ছিল না। সে বুঝেছিল তার সামনে এক পুরুষবেশী নারী। সেই বুঝেই সে কথা দিয়েছিল। এই ঘটনার জের বহুদূর যায়। মেয়েটি এক বিকারগ্রস্থ দ্বৈতসত্ত্বা লাভ করে।

অবশেষে এক মিলনরাত্রির শেষে সে চিরতরে চলে যায়। ফেরৎ আসে না। বহুদূর থেকে এক নারীযোদ্ধার খবর কিংবদন্তীর মত বাতাসে ভাসে, সবাইকে যে যুদ্ধে আহ্বান করে, নিজেকে প্রচার করে ‘ডিফিট সিকিং ওয়ারিয়র’ বলে।

মুস্কিল আসানের প্রেম ছিল এক আশ্চর্য নারীর সঙ্গে। চিরন্তনী প্রতিমা যেন। তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার সব কারণ থাকা সত্ত্বেও সে তাকে বিয়ে করেনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি- এই উহ্য কথাটুকু সে শুনতে চেয়েছিল। বিয়ে হয় তার দাদার সঙ্গে। তারপরই তার সব ছেড়ে চলে আসা। এরপরের সমস্ত সময় তার কাছে সময়ের ভস্ম, সময়ের ছাই। মূল যা হবার, আগে হয়ে গেছে।

তাই মানুষের সম্পর্ক থেকে সম্পর্কে গমন, নির্লিপ্ততা, ক্যাসানোভা বা ফেম-ফ্যাতাল হয়ে ওঠা। সবকিছুরই সাথে প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায় একটি শব্দ- প্রেম। তার আর কোনও উত্তর মেলে না। প্রশ্নটি পরিচালক আমাদের ভুলিয়ে দিতে চান না।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment