1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

আমার একলা লাগে ভারী

ছবি : ইন্টারনেট

আমার একলা লাগে ভারী

তরুণ প্রামানিক   


শীতে অলস দুপুরের সীমান্ত পেরিয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে নিঃশব্দে। ঝুপ করে নামা সেই হিম অন্ধকার যেন দিক্চক্রবালে আলোর আলতো আভা মুছে দেয়। জাদুকরের মায়াবী স্পর্শে ঝরাপাতার ঝরঝর ধারার মতো কুহেলির সাদা আস্তরণে ঢেকে যায় আদিগন্ত। গ্রাম্য জীবনে দিনান্তের ব্যস্ততা থমকে আসে।   

তেমনি এক শীতের প্রাক সন্ধ্যার বিকালে, গ্রামের সীমান্ত লাগোয়া কেটে নেওয়া ধানের বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে, খোটাতে বাধা বিনু একাকী দাঁড়িয়ে। তার প্রশস্ত মায়াবী চোখ পড়ে রয়েছে বাড়ির পানে। সন্ধ্যার বিনবিনে মশারা ভিড় করছে তার গায়ে। ঘন ঘন দুই কান নাড়িয়ে সেই অস্বস্তিকে ঢাকছে সে।

বিকালের খেলা শেষে, ধুলো মেখে ছেলের দল ফিরে চলেছে বাড়ির দিকে। কতগুলো পায়রা মাটিতে মিশে থাকা ধান খুঁজে খুঁজে খাচ্ছে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত। মৌমাছি ফুলের শেষ মধুটি খেয়ে উড়ে চলেছে মৌচাকে। সন্ধ্যা নামছে। আকাশে পাখির দল কলরব করতে করতে বাসায় ফিরছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নামার চেয়েও অধিক দ্রুততায়। যাত্রা পথ দেখে মনে হয়, রাতের গন্তব্য নির্ধারিত তাদের। মাঠের আল বেয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে গঞ্জ থেকে ফেরা গুটি কয়েক মানুষ, অন্ধ গোসাঁই বাড়ির দিকে চলেছে তার ছেলের হাত ধরে।

একমাত্র বিনুই একা রয়ে গেছে এই সুবিশাল প্রান্তরের মাঝখানে একাকী ! সেই সকাল থেকে কচি কচি সবুজ টাটকা ঘাস খেয়ে ভালোই পেট ভরেছে। সামনে যে তাজা ঘাস গুলো মাথা উঁচিয়ে আছে, সেগুলো ও খেতে ইচ্ছা করছে তার কিন্তু সন্ধ্যা যে হয়ে গেল, কুসুমযে এখনো তাকে নিতে এলো না ! সে বাঁশের খোটার চারপাশে ঘুরে এসে একটা বৃত্ত পূর্ণ করে জোর গলায় আওয়াজ করলো, ম্যাএএএ !    

পশ্চিমাকাশে শেষ বিকেলে অস্তরাগের রক্তিম আভাটুকু মুছে যাচ্ছে সন্ধ্যার নীলচে অন্ধকারে ঘোলাটে মেঘের আশ্রয়ে। এই খোলা মাঠের শেষে বড় বড় মেহগনি গাছে ঘেরা যে সবুজ গ্রাম্য রেখা দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট, সেদিকে এগিয়ে গিয়েই ডানহাতে একটা পুকুরপাড়, ওদিকে দিয়েই যেতে হয় বাড়ি।

তার গলায় দড়ি বাধা না থাকলে সে নিজেই দৌড়ে চলে যেতে পারতো ওপথে। অতি উৎসাহী হয়ে এগোতে গেলে, খোটাতে বাধা পেয়ে গলায় টান লাগে তার। হতোদ্যম হয়ে বসে পরে বিনু।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে কুসুমের কড়া ধমক খেয়েও সামনে ঘাস দেখলেই বিনু ছিঁড়ে খেতে চায়, পেটে খিদে না থাকলেও। যতটুকু খেয়ে নেওয়া যায় আর কি ! কিন্তু আজ সামনে এত সতেজ ঘাস থাকতেও একটুও খেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়ির কাছে গিয়ে কুসুম গলা থেকে দড়িটা খুলে দিলে সে পিছন পায়ের উপর জোরদিয়ে অদ্ভুত আহ্লাদে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে কুসুমকে পিছনে ফেলে তার বেড়ার ঘরে ঢুকে যায়। পরম স্নেহে কুসুম গায়ে হাত বুলিয়ে একটা মশার ধুপ জ্বালিয়ে দেয়। পরম মমতা মাখানো অপত্য স্নেহে শীতের থেকে বাঁচাতে গায়ে চাপিয়ে দেয় একটা চটের বস্তা। উদ্ধত দুটি শিঙে মাখিয়ে দেয় তেল। কুসুম গায়ে হাত বোলালে, সে আনন্দে মাথা নেড়ে নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। বিনু সারা রাত ধরে বসে বসে লেজ নাড়িয়ে মাছি তারায় আর তাজা সবুজ ঘাসগুলোকে পেট থেকে মুখে এনে তৃপ্তির জাবর কাটে। বেড়ার সেই ঘুপচি কুঁড়ে ঘর এই সুবিশাল খোলা আকাশের থেকেও অনেক বড়, অনেক প্রশান্তির। সেখানে কুসুমের মমতা আছে, তার শক্ত হাতের নিরাপত্তা আছে। কিন্তু এখনো কুসুমের তো কোনো খোঁজ নেই! সেকি তাকে ভুলে গেল নিয়ে যেতে! ভেসে থাকা অন্ধকার ভেদ করে তার দৃষ্টি ওই নির্দিষ্ট দিকে, সারি সারি মেহগনির গাছের গ্রাম ছায়ার দৃশ্যপটের ওই ধু ধু প্রান্তরে। তার সেই দৃষ্টি ,অপেক্ষা আর শূন্যতার হাহাকার রাতের অন্ধকারকে ছাপিয়ে আরো প্রকট হয়ে উঠলো।

তার হঠাৎ মনে হলো কয়েক জোড়া জ্বলন্ত লোলুপ চোখ যেন ঘিরে ধরে জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে তার দিকে। হ্যা, তাই তো ! মুখ থেকে একটা আক্রোশ ভড়া শব্দ করে ক্রমে এগিয়ে আসছে তারা। খুব ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালো বিনু। চতুর্দিকে একবার গোলকরে ঘুরে ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালো সে। মনে মনে খুব ভয় পেলেও বুঝতে দিলো না ওই হিংস্র চতুষ্পদীদের। সামনের দুই পা পিছনে টেনে মাটিতে ঘষে ধুলো উড়লো, খাড়া সিং উঁচিয়ে রুখে গেল। ঠিক যেভাবে সেদিন কুসুম রুখে গেছিলো তার স্বামী গনেশের দিকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়দিলো হিংস্র ওই চতুষ্পদী গুলো। বিনুর অস্থিরতা কমল না, সে গলা ছেড়ে আরো জোরে ডাক দিল ম্যাএএএ। তার এই ডাক নিকষ অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে তার কাছেই ফিরে এল। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কুয়াশা দুধের সরের মতো জমে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

কুসুমের ছোটো ছেলেটার খুব অসুখ। গ্রামের ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। শহরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। সে অনেক খরচ। দিনমজুর গনেশ এত টাকা পাবে কোথা থেকে! তাই বিনুকে দেখাতে সেদিন সে জাফর কসাইকে বাড়িতে ডেকে এনেছিল চুপি চুপি। কুসুম বাড়িতে ছিলোনা তখন। কি ভয়ানক চেহারা তার। তোবড়ানো মুখে একটা জর্দা পান চিবাচ্ছিলো সে। ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা, সেদিকটাতে একটা কালো ক্রাচ এর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখছিলো বিনুকে। গায়ে তেলচিটে ছেঁড়া ফুলহাতা জামা। পরনের লুঙ্গিতে ছিটকে আসা তাজা রক্তের দাগ। তার হাতে ধরে থাকা দড়িতে বাধা ছিল বিনুর মতো আরো দুটি নিরীহ তাজা প্রাণ। মায়াবী চোখের নিস্পলক চাউনি আর তাদের চঞ্চল আর্ত চিৎকার বিনুর মনকে খান খান করে দিচ্ছিলো।

সহসা কোথা থেকে ছুটে এলো কুসুম। গনেশের দিকে রুখে গেল, হাতে একটা কাটারি। রণমূর্তি কুসুমের সে রূপ দেখে জাফর কসাই মানে মানে সরে পড়লো। তবে যাওয়ার আগে গনেশ কে উঠানের একধারে টেনে নিয়ে কানে কানে কি যেন বলে চলে গেল সে সেদিনের মতো। বিনুকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কাঁদছিলো অভাগীর মতো। কি গভীর এক সর্বনাশা অসহায়ত্ব বার বার হের যাচ্ছিলো দ্বিধাহীন মমতার আতিশায্যের কাছে। 

অস্থির চিত্তে অনবরত গোল হয়ে ঘুরতে থাকে বিনু।এখনো কেন কুসুম আসছে না, এত দেরি তো সে কোনো দিন করে না। তবে কি তার ছেলেটার আবার শরীর খারাপ করলো খুব! হঠাৎ কোথায় যেন মর্মর ধ্বনি শুনতে পেল। পায়ের নিচে পড়ে শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ। বিনু কান খাড়া করে তাকালো। কুসুম আসলো বুঝি ! নিষ্পলক ! তাকিয়েই থাকল। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। কয়েক মুহূর্ত কাটলো এই ভাবে, সহসা সে যেন মানুষের সারা পেলো, দেখলো কে যেন এদিকেই আসছে, কুয়াশার চাদর কেটে। হ্যা, ওই তো, ওই তো, কুসুম ! কিন্তু অন্ধকারের চাদর ওই ছায়ামূর্তির শরীর থেকে খসে পড়তেই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ! একি ! কুসুম কই ! এতো সেই জাফর কসাই ! মুখে বিজয়ের ক্রুর হাসি, বুকের ভিতরটা কেমন তোলপাড় হয়ে উঠলো বিনুর। তার খেয়াল হলো আজ তাকে মাঠে বাঁধতে এসে, ফেরার সময় কুসুম আঁচলের খুট দিয়ে দুচোখ মুছতে মুছতে কি যেন বলতে বলতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বিনুর দিকে। এই জমাট বাধা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে বিনু, আরো একবার তার অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে, পূর্ণ শক্তি দিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠলো ম্যাএএএএএ !!!!   

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment