1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

গ্রামের মেয়ে

ছবি : ইন্টারনেট

গ্রামের মেয়ে 

উত্তম চক্রবর্তী

চারিদিকে ধান ক্ষেত আর দুরে দুরে অনেক গাছপালা ঘেরা গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে ইভান এই প্রথম বাইরে একা বেরিয়ে  এতো দুরে বাস ভ্রমণের মজা উপভোগ করছিল। ওর বাবা মার সাথে ইভান কলকাতার বাইরে শুধু দুবার দুই জায়গায় গেছিল। একবার জামশেদপুরে মামার বাড়িতে আরেকবার দিঘাতে বেড়াতে। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ওর মা ইভানকে কোনদিন একা কোথাও যেতে দিতেন না। তখন যদিও ইভান মাত্র বারো ক্লাসে পড়ত। কিন্তু এখন ইভান একজন বি কম পাশ করা যুবক আর কলকাতার একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীর পি এর চাকরী করছে। ওর মার ইচ্ছা সামনের বছরে ইভানকে বিয়ে দিয়ে একটা বেশ ছোট খাটো লক্ষ্মীর মত বৌকে ঘরে তোলে।

এদিকে ইভান নিজে কিন্তু ভীষণ মুখচোরা লাজুক প্রকৃতির ছেলে। ইদানিং শুধু চাকরী পাবার পর থেকেই  ওকে বেশ কিছু মেয়ে বা মহিলা সরকারী কর্মী বা  দলের নেত্রীদের সাথে একসাথে কাজ করতে হয়। তাই ইভান আজকাল বেশ স্মার্ট হয়ে উঠছে, মেয়েদের সাথে কথা বলা হাসি ঠাট্টা করায় অভিজ্ঞ হচ্ছে।              

ইভানের গ্রাম খুব ভালো লাগে। যদিও কলকাতায় জন্মে শহরে বড় হয়ে ওঠা ইভান জীবনে কোন দিন গ্রামে যাবার বা থাকবার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেনি। আজ ওর জীবনে এই প্রথম কোন গ্রামে যাবার সুযোগ এসে গেছে। বর্ধমান জেলার কোন এক ঘোর রাজতলা গ্রামে নাকি ওদের আদি  বাড়ি ছিল, এটা ইভান ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে। হয়ত বা সেই গ্রাম্য জীবনের রক্ত ওর বাপ ঠাকুরদা হয়ে এখনও ওর রক্তে বয়ে চলেছে। গ্রামের প্রতি এই টান বোধ হয় তারই টান। ওর ঠাকুরদা ঠাকুমা ছোট বেলাতেই মারা গেছিলেন। কিন্তু ইভান কোনদিনই কাউকে দেখেনি ,ওদের আদি বাড়িতেও কখনো যায় নি।

সেদিন শুক্রবার রাতে ইভানের মা ওকে জানালেন যে গ্রামের বাড়ি থেকে ইভানের বড় জ্যাঠার বিধবা স্ত্রী ওঁকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরা কেউ একবার গ্রামে এসে জেঠির সাথে দেখা করে। ওদের জমি জায়গা নিয়ে নাকি একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে সেখানে। ইভান মার কাছে শুনেছিল যে ওর ঠাকুরদা ছোট ছেলের ওর মায়ের সাথে বিয়ে কোনদিনই মানতে পাড়েন নি। বাবা মাকে কলকাতা বই মেলায় দেখেছিলেন এবং পরে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। মার বাবা রাজি হলেও ঠাকুরদা বা তার বড় ছেলে কেউ সেটা মানেননি। বাবা গ্রামের বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে কলকাতায় এসে মাকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে একটা সামান্য চাকরী নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন।

গ্রামের বাড়িতে এখন শুধু বিধবা বড় জেঠিমা ও তার এক ছেলে সপরিবারে থাকেন ঐ বাড়িতে। বড় জেঠিমা প্রথম থেকেই ইভানের মার সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন। জ্যাঠার ছেলে লেবার লাগিয়ে জমিতে চাষাবাদ করে চলেছেন, অন্য কোন কাজ করেন না। সেই জেঠিমা জানিয়েছেন যে ওদের সম্পত্তি নিয়ে গণ্ডগোল চলছে, ইভান যেন এসে এবার ওর ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায়। না হলে একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে এই পরিবারের। ইভান মার কাছে সব শুনে ঠিক করে সামনের শনিবার ও গ্রামে যাবে ওদের আদি বাড়িতে আর পরদিন সেখান থেকে ফিরে আসবে। সেই অনুযায়ী ইভানের মা পরদিনই একটা চিঠি দিয়ে দিলেন ওর বড়দিকে।

জেঠির চিঠিতে লেখা ছিল যে মেমারি রেল স্টেশন থেকে সাতগাছিয়ার বাসে উঠে প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ডের ঠিক আগের স্টপে নেমে ভ্যান রিক্সায় যেতে হবে সেই ঘোর রাজতলা গ্রামে। ইভান হাওড়া থেকে প্রথমে বর্ধমান লোকালে উঠে মেমারিতে আসে। তারপর বাইরে এসে বাসে চেপেছে। ইভান হাতঘড়িতে দেখল বেলা দশটা বাজে এখন। বাসে লোকজন বেশি ছিলনা। গ্রামের রাস্তার বাসটা বেশ ধীর গতিতে ডিগ ডিগ করতে করতে সব জায়গায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে চলছে।

ধর্মতলা বাস স্টপের আগের স্টপ আসতেই কণ্ডাকটর ওকে ডাকল।  মাত্র চারজন লোক নামল। ইভান ওর ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে দেখে শুধু কয়েকটা চায়ের দোকান ও মিষ্টির দোকান ছাড়া জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। কোন ভ্যান রিকসাও নেই। চারিদিকে ধান ক্ষেত আর একদিকে একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে বাকি তিনজন হাটা লাগিয়েছে। ইভান যখন একা দাঁড়িয়ে ভাবছে এবার ও কী করবে, ঠিক তখনই দেখে একটু দুরে দাঁড়িয়ে একটা কালো রঙের কুকুর ওর দিকে তাকিয়ে সমানে ঘেউ ঘেউ করছে আর ল্যাজ নাড়াচ্ছে। কুকুরটার গলায় সুতো দিয়ে একটা কাগজ বাঁধা দেখা যাচ্ছে।

ইভানের সন্দেহ হল। এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করে দেখে ওর গলার সাথে সুতো দিয়ে বাঁধা একটা চিঠি। ইভান কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে বাংলায় লেখা,” আপনি যদি ইভান বাবু হন তবে এই কুকুরটার পিছন পিছন চলে আসুন। আপনার জেঠিমা বাড়িতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।“ এই ভাবে কুকুরকে দিয়ে ওকে অভ্যর্থনা করে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে ইভান কল্পনাও করতে পারে নি। বুঝতে পারল যে যেই এই কাজটা করেছে সে খুবই বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতী এবং তার নিজের আসবার কোন অসুবিধা আছে বলেই এই পালিত কুকুরটাকে পাঠিয়েছে বাস স্ট্যান্ডে যাতে ইভান ফিরে চলে না যায়। ইভান মুচকি হেসে দেখে কুকুরটা গিয়ে সেই রাস্তার পথে দাঁড়িয়ে ওর জন্যই যেন অপেক্ষা করে কেবল চেঁচাচ্ছে।

ইভান হেসে, ‘ আসছিরে বাবা, দাঁড়া,’ বলে কুকুরটার পিছন পিছন চলতে থাকে। শরৎ কালের মিষ্টি হওয়ায় রোদের তাপ বেশি নেই। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের গ্রুপ মিটিং চলছে যেন, আর দুরে এক জায়গায় একটু কাশবনও দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে গ্রামের ভিতর। প্রায় এক কিলোমিটার দুরে শরতের শুভ্র আকাশের শেষ প্রান্তে গ্রামের বাড়ি ঘর শুরু হয়েছে। ইভানের সামনে ওর গাইড সেই কালো কুকুরটা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে চলেছে সেদিকে। মিনিট দশেক হেঁটে ইভান পৌঁছে গেল গ্রামের ভিতর।

মাটির দেওয়াল দেওয়া ও তার উপর টিনের চাল দেওয়া বেশ বড় পুরানো বাড়ি। চারিদিকে গাছ পালা ও ক্ষেতের মাঝে এই বাড়িতে শুধু ওর জেঠি, তার এক ছেলে, ছেলের বৌ ও ওদের একটা বাচ্চা ছেলে থাকে। জেঠিমা জানালেন যে ওর ছেলের শালি এসেছে মেমারি থেকে, সেই এই চিঠি লিখে ওদের পালিত কুকুর বাঘাকে বাস স্ট্যান্ডে পাঠিয়েছিল কলকাতা থেকে জামাইবাবুর খুড়তুতো ভাইকে নিয়ে আসতে। বাঘা নাকি এভাবে গলায় চিঠি বেঁধে দিলে সোজা গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে যতক্ষণ না অতিথি ওর গলা থেকে সেই চিঠি খুলবে ততক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারপর বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ির সবাই সেটা জানে। এবারও তাই ইভানকে আনবার দায়িত্ব বাঘাকেই দেওয়া হয়।

একটু বাদেই রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দারুণ সুন্দর দেখতে বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে। গায়ের রঙ ফর্সা, স্বাস্থ্য বেশ ভালো ও বড় বড় কাজল টানা চোখ। একটা লাল হলুদ রঙের ছাপা তাঁতের শাড়ি ও ম্যাচিং ব্লাউজ পরা, হাতে চায়ের কাপ সাথে বিস্কুট নিয়ে এসে ইভানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’ কি আপনার কোন অসুবিধা হয় নি তো ? বাঘা আমাকে গিয়ে জানাল যে ও ঠিক লোককেই বাড়ি নিয়ে এসেছে।‘ বলেই মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে। ইভান দ্যাখে মেয়েটির হাসির সময় যেন এক ঝাঁক মুক্তো গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আবার হেসে জেঠিমাকে বলল,’ বাঘা কিন্তু আজ আপনার অতিথিকেও ঠিক চিনতে পেড়েছে।‘

ইভান লক্ষ্য করল মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ ও জলি টাইপের মেয়ে। এবার মুখ ঘুরিয়ে ইভান কে বলল,’ ও ভালো কথা, আমার নাম টুম্পা। মেমারির মেয়ে, বারো ক্লাস পাশ। কালই এসেছি দিদির বাড়ি। আপনি আজ থাকছেন তো ?‘ পিছন থেকে ইভানের বৌদি বলতে বলতে ঢুকলেন ,’ ওমা, থাকবেন মানে ? আজ এই প্রথম এতদূর থেকে নিজেদের বাড়িতে এসেছে, ঠাকুরপোকে আমরা থোরি না আজ যেতে দিচ্ছি। এই নাও ঠাকুরপো, একটু লুচি তরকারী খেয়ে নাও। আমি বাবলুকে পাঠিয়েছি জমিতে, ওর বাবাকে ডেকে আনতে গেছে। এখুনি এসে পড়বে। এই টুম্পা, তুই গামছা নিয়ে ওকে কলতলায় নিয়ে যা, হাতমুখ ধুয়ে আসবে খন।‘ কথাটা বলে ইভানের বৌদি আবার রান্না ঘরে চলে গেল। ইভানকে ইশারায় আসতে বলে টুম্পাও মুচকি হেসে বেরিয়ে চলে যায় উঠোনের দিকে।

ইভানদের গ্রামের একজন উঠতি নেতা ওদের জমির একটা অংশ দখল করে চাষ করতে শুরু করে দিয়েছে। তার দাবি ঐ অংশটা নাকি ইভানের বাবা তার কাছে বিয়ের সময় টাকার দরকারে পঁচিশ হাজার টাকায় বন্ধক রেখেছিলেন। জাঠতুতো দাদা পঞ্চায়েতে অভিযোগ করেছে, কিন্তু তারা ঐ নেতার চাপে কোন ডিসিশন দিতে পারছে না। ইভানের বাবা কিন্তু আসলে কিছুই নেননি, লোকটা কোন রসিদও দেখাতে পারেনি। এদের বোকা বানিয়ে জমিটা জবর দখল করবার মতলব আরকি। ইভান টিফিন খেতে খেতে শুনল ওর ঠাকুরদা নাকি ওদের পঞ্চাশ বিঘা জমির মধ্যে তিরিশ বিঘা বড় ছেলে ও কুড়ি বিঘা জমি ছোট ছেলের নামে লিখে দিয়ে গেছিলেন। ইভানরা কেউ থাকে না। ওর জাঠতুতো দাদা পুরো জমিটাতে চাষ করে সারা বছরে দুবার ফসল তোলে আর তাতেই ওদের সংসার ভালই চলে যায়

ইভানের দাদা নির্মল সান্যাল বেশ শক্ত সমর্থ চেহারার মানুষ হলেও একটু ভিতু প্রকৃতির লোক। ইভান ও নির্মল দুজন দুজনকে এই প্রথম দেখল। দুপুরবেলা বারান্দার মাটির মেঝেতে চাটাই পেতে বসে ভাত খেতে খেতে কথায় কথায় যখন ইভান জানাল যে ও রাজ্যের শ্রম মন্ত্রীর পি এ, তখন নির্মল দারুণ খুশি হয়ে বলে ওঠে,’ ব্যাস, তাহলে ঐ ঘোষাল এবার ভাল জব্দ হবে। ও সরকারী পার্টির নেতা বলে পঞ্চায়েতের উপর খুব দাদা-গিরি করছিল। এবার তোর বাপ এসে গেছে। কী করে তুই আমাদের জমি হরপ করিস এবার দেখব।‘ নির্মল খুব উত্তেজিত হয়েই বলল কথাগুলি। ইভান বুঝতে পারে দাদা ওর মন্ত্রীর কানেকশনটাকে কাজে লাগিয়ে এবার বাজি মাত করতে চায়। বলল,’ তুমি চিন্তা করোনা দাদা, আমি শুধু স্যরের কানে কথাটা তুললেই সব শেষ। ঐ লোকটাকে আগেই পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাবে।‘

নির্মল তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গর্বিত ভাবে বলে ওঠে,’ দেখলে, বাপেরও বাপ আছে। এবার ঐ শয়তানটা খুব জব্দ হবে। তা ইভান তুই এবার কাকিমাকে নিয়ে দেশে ফিরে আয়। এখানেই এই আমাদের টুম্পার মত দেখতে একটা মিষ্টি কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসার কর। সবাই একসাথে থাকার মজাই আলাদা, কি বোলো মা ?’ জেঠিমা মাথা নাড়িয়ে বললেন,’ আমারও সেই একই মত। তুই একদম ঠিক বলেছিস নির্মল।‘  

ইভান দাদার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারে। হাসি মুখে দাদার দিকে একবার আর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে,’ কিন্তু গ্রামে বিয়ে করলে কলকাতা থেকে আসা বর যাত্রীদেরকে রিসিভ করতে কেউ আবার বাঘাকে বাস স্ট্যান্ডে পাঠাবে নাতো ? সেটা আগে একজনকে জিজ্ঞাসা কর তোমরা।‘ টুম্পার গালে সিঁদুরে মেঘের ছোঁয়া লাগে যেন।  লজ্জায় মাথা নিচু করে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ঘরের সবাই হো হো করে হেসে ওঠে ওর পালিয়ে যাওয়া দেখে। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment