এক ছাদের নীচের গল্প
তরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
--না! আর একা একা পাহাড়ে নয়।
--বাবা , ভূতের মুখে...।
--উঁহু, ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ।
--কী ভবিষ্যৎ?
--এই যা বললাম। এবার একসঙ্গে...
-- কী বললে?
--এই যা শুনলে
-- সে তো বিয়ের দেড়মাস আগে থেকে প্রিন্সেপ ঘাটের বারান্দায় বসে শুনে আসছি।
--এবার দেখবে।
--বিয়ের আড়াইবছর পর!
--আরে শোনোই না, এবার আমরা সাগরে বর্ষা দেখব।সাতদিন এনজয় করব গঙ্গাসাগরে।এটা আমাদের সেকেন্ড হনি...
--তা ফার্স্ট কোথায় হয়েছিল?
--কেন টিকিয়াপাড়ায়, মন্টুদার বাড়ি। আরে বিয়ের পরে পরেই মনে নেই? মন্টুদার শ্বশুরের শ্রাদ্ধ হল, মন্টুদা দুদিনের জন্য জামতাড়া গেল বাড়িটা আমাদের হাতে ফেলে------ ভুলো কোথাকার।
--হুঁ, বুঝেছি, তা যাচ্ছ কবে?
--গঙ্গাসাগরে, ধর কাল বাদ পরশু কী বল!
--না, পাহাড়ে।
--অক্টো...ধুর, বললাম না একসঙ্গে গঙ্গাসাগরে...
--না।
--বলো, কোথায় যেতে চাও।
--ওঃ মনে হচ্ছে কথাটা খসালেই টিকিট পেড়ে আনবে, রাজস্থান যাব। ইতিহাস দেখব ।
--ইয়ে সোনা হয়েছে কি, জানোই তো আমার ভাঙা-চেয়ারে ম্যানেজারির চাকরি। বোঝোই তো সব, অতো খরচা করে...
--জানি তো বুঝি তো তবে অত মাস্কা লাগানো কথা কেন, দু-আঁটি কেনার ক্ষমতা নেই, চার আঁটির দাম জিগ্যেস করা ---- কোথায় যেতে চাও বলোই না, হুঁঃ যতসব ন্যাকামো ।
এর পর বউ রিমোটের বোতাম টিপে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ওই টেলিভিশনের বাকশক্তি আর দৃষ্টিশক্তি স্তব্ধ করে দেয়। তারপর এককথা দুকথা চোখাচোখি ছোঁড়াছুঁড়ি ভাঙাভাঙি হাতাহাতি----- তারপর একদম চুপ। থমথমে প্রকৃতি। কোনোরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়া। এ ওর দিকে পেছন করে, ও এর দিকে পেছন করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কেউই ঘুমোয় না। এ ওকে জানাতে চায় ঘুমোচ্ছে, ও একে জানাতে চায় ঘুমোচ্ছে।
শুয়ে শুয়ে বউ ভাবেঃ
সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনের আলাপে বিয়ে করা...তখন তো বুঝিনি, বয়সের ঝাঁঝ। লোকটা ঠিক বঁড়শি গিলিয়েছিল। নিজে পরে পাহাড়-ট্রেকিং এ যাবে বলে এখন এলিতেলি জায়গায় ঘুরিয়ে এনে মুখ বন্ধ করার ধান্দা। স্বার্থপর! কী স্বার্থপর! আধমাস ধরে বাবু পাহাড় বিহার করবেন আর আমি বসে বসে বাড়ি পাহারা দেব। আমাকে নিয়ে একটু দূরে যেতে গেলেই পকেটের লক্ষ্মী ঠাকুর গলাছেড়ে কাঁদেন, আর নিজে যে মুঠো মুঠো টাকা পাহাড়ে উড়িয়ে আসছে কই তখন তো লক্ষ্মীঠাকুর ডুকরেও ওঠেন না।
প্রথম দিকে তো বাবুর বানভাসি উচ্ছ্বাস আর অনাবশ্যক ভালোবাসার চোটে অন্ধকার দেখতাম । ভাবতাম এ জিনিস সইলে হয়। জ্যোৎস্না রাতে যেন আলমগিরের বাবা বাদশা শাহজাহান ----"এসময়ে কি ঘুমোনো স্বাস্থ্যকর? চলো চাঁদের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে হাতধরাধরি করে বারান্দায় ইকিড়-মিকিড় খেলি। আমাদের সাতশো কুড়ি স্কোয়্যার-ফুটে ফুটে উঠুক লালকেল্লার ফ্লেভার ।" আর এখন আমি যেন রংচটা বেডকভার বাসনকোসন কিনে ফেললেই হল। আমি তো এমন কিছু দাবি করি না যে চাপে পড়ে যায়। আরে বাবা সংসারটা তো আমারও নাকি, সে দায়িত্বটুকু তো আছে-----বাড়তি পয়সা চাই না, মার্কেটিং! কবে শেষ গিয়েছি সে আজ মনেও পড়ে না। মাসে একটা করে সিনেমা, তাও গত পাঁচমাস বন্ধ। ও কি সেসব বুঝবে কোনোদিন! আমি তো কোনোদিন এসব নিয়ে কোনো অনুযোগ করিনি।আমার যেমন দায়িত্ব আছে সংসারের অবস্থা বুঝে চলার , তোমারও সেটা থাকা উচিত। মুখের তরেও তো কোনোদিন শুনলাম না "চলো আজ রাতের খাবার বাইরে থেকে খেয়ে আসি", তাতেও কিছু মনে করিনি কোনোদিন। ওর সব চাওয়া সাধ্যমতো মিটিয়ে চলেছি কিন্তু এত স্বার্থপর কোনোদিন ভাবতে পারিনি । রোজকার বাজার-হাটের দায়িত্ব তো বিনে পয়সার বাজার সরকার মানে আমার হাতে দিয়ে তো বাবু ঝাড়া হাত-পা। অফিস করছেন বলে কথা। আবার অফিস ফেরত বোড়কের চায়ের দোকানে অন্তত ঘন্টা আড়াই হাজিরা না দিলে চা হজম হয় না। কাজ কম নাকি। তবে সপ্তাহে দুদিন মাছ নিয়ে আসেন তার মধ্যে একদিন চুনোমাছ আর অন্যদিন সদ্য শৈশব-পেরোনো রুই মৃগেল একটু দরাজ হলে কাতলা কেটে এনে "কাটামাছ আনলুম" বলে ফেলে দেন রান্নাঘরের সিঙ্ক এ। আর দুমাসে একবার মাংস, বিলাসিতা বলতে এইটুকুই। কিছু বলতে গেলেই উপদেশ ভরতি প্যান্ডোরার বাকসো খুলে যাবে ---- "ছোটো মাছের কত্ত গুণ তা যদি জানতে, দেহে কান্তি আনে, হাড়ে ক্যালসিয়ামের বন্যা বইয়ে দেয়, চোখের দৃষ্টি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন করে তোলে।আর শাকপাতা তরকারি খাওয়া খুবই দরকারি কারণ টকসিন, শরীরে টকসিন জমতে দেয় না, মাংসটাংস টকসিনের ডিপো।" যদি নিজের সুখ-স্বার্থই বড়ো হয় তবে বিয়ে করলেই বা কেন! অভাব যদি এতই তবে ফি-বছর পাহাড়ে টাকা ছড়ানো কেন? আবার বন্ধুদের দোহাই পেড়ে বলবে "সিন্টু মিন্টু ঝিন্টু পলাশ অনিল এদের বাড়ির লোক কত কালচার্ড, ট্রেকিং এর মর্ম বোঝে----- তুমি একটু বুঝতে চাও না গো।" ধাস্টামো যতসব। ওরা সরকারি চাকুরে, তোমার মতো কেউ ভাঙা-চেয়ারের ম্যানেজার নয়। তাও যদি দেখতাম ভ্রমণকাহিনি ছাপা হচ্ছে বা ভিডিয়োতে তোলা ভ্রমণের ওপর ডকুমেন্টারি চ্যানেলে চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে---ধম্মের ষাঁড় কোথাকার ।
জেরবার হয়ে গিয়েছি। দেখি আর কিছুদিন তারপর বিটলের ছোটোপিসে পিন্টু উকিলকে দিয়েই ডিভোর্সের মামলা করব।আমার মাসতুতো বোন পিংপং এর পাহাড়ে ট্রেক করার খুব সখ, দরকার বুঝলে ওর সঙ্গে বিয়ে দেব আর আমি হব বড়ো শালী
ওপাশ ফিরে বর ভাবেঃ
কেন যে মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনের আলাপে ভালো লাগল আর ছেচল্লিশ দিনের মাথায় সংসারী হলাম! আসলে ভালোলাগা ভালোবাসা ঝুটা বাকোয়াস। দুদিনের মায়া-মোহ----বড়োই প্রপঞ্চময়, তিনদিনের দিন দরকচা মারা পটলের মতো জাবনার গামলায় খড় আর ভেলিগুড়ের সঙ্গে মিশে যায়। তখন মনে হত ঝিলামের চোখেই যেন ভূস্বর্গকে অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করব। কারণে অকারণে কাব্যের জোয়ার বয়ে যেত--- আমি তোমার কানহাইয়ালাল
তুমি আমার রাই
নদীর ঘাটে বসে চলো
নোনতা বাদাম খাই
প্রতিভার সুনামি দেখে ঝিলাম কিমাম দেওয়া পানের মতো খিলখিল করে নেশাধরানো গলায় বলত “চালাও মেরি কানহাইয়ালাল , চালিয়ে যাও। রবিঠাকুরের পর তোমার নোবেল পাওয়া হয়ে গেল ধরে নাও।" বেশ কাটছিল , বিয়ের পরও বছর দেড়েক হাসি ঠাট্টায় মজা করে কাটল কিন্তু কবে যে সম্পর্কটা মিয়োঁনো পাঁপড়ভাজা হয়ে গেল টেরও পেলুম না। অথচ আমার সমস্ত কিছু ওকে খোলাখুলি বলেই নিয়েছিলাম । আর ও কনে-দেখা আলোর মতো মিষ্টি করে হেসেছিল। আর বলেছিল “সবার কি সবকিছু হয়? নাইবা থাকল বড়ো চাকরি, মনটা বড়ো হলেই হল।"
কী উদাত্ত আহ্বান! প্রথম প্রথম আমার পর্বত ভ্রমণোপাখ্যান শুনতে শুনতে রাত কাবার করে ফেলত। কী আগ্রহ! আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গলগল করে কথকতা করে যেতাম । কিন্তু তারপর যে কী হল! এই বেড়ানোটাকে ও সহ্যই করতে পারে না এখন। এই পবিত্র ভ্রমণ নাকি পয়সা খসাবার একমাত্র রাস্তা। অথচ সামর্থমতো ওর সখ-আহ্লাদ মেটাতে ত্রুটি রাখি না। ইচ্ছেমতো কেনাকাটাতে কোনো বাধা দিই না। হ্যাঁ, সবসময় হয়তো সিনেমা থিয়েটার দেখা আগের মতো হয়ে ওঠে না, আর সেটাই অভিযোগের তির হয়ে আমার দিকে উঁচিয়ে থাকে সবসময়।কতবার বলেছি তুমিও ট্রেকিং এ চলো, “না, ওসব আমার ভালোলাগে না, শুনতে ভালোলাগে । তার চেয়ে চলো ইতিহাস নগরী বেড়িয়ে আসি দিল্লি-আগরা-লখনউ।" আসলে পর্বত-অভিযানের যেকোনো রকম বিপরীত শিবিরে থাকবেই। বুঝতেই চায় না পাহাড় ট্রেকিং ছাড়া আমার আর কোনো নেশা নেই। সারাবছর কোম্পানির দাসত্ব করে এই নেশাটাই বছরে একবার উপভোগ করি--- সাদা বরফের ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় আপাদমস্তক ভিজে তরতাজা হয়ে উঠি। বছরভর কাজে উৎসাহ পাই সেটা ও বুঝতেই চায় না। কতই বা খরচা হয়, আর হলই বা, নিজে রোজগার করছি, সখ মেটাব না! ট্রেকিং এ যাওয়ার আগে ওর কথা ভেবেই তো ছোটোখাটো কোনো ট্যুর একসঙ্গে করে আসি। না, চলবে না--- মোট কথা ট্রেকিং আমায় বন্ধ করতে হবে। এখন তো আমার সমস্ত কাজেই ব্যাগড়া আর সন্দেহ---এই তো সেদিন পাড়ার মোড়ের নতুন জুতোর দোকান পদশ্রী থেকে একজোড়া কোলাপুরী চটি কিনে যেইনা বাড়িতে পা দিয়েছি অমনি ওৎ-পাতা বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল “উঃ নতুন জুতো মশমশিয়ে কোন চুলোয় যাবে শুনি, তিনজোড়া চটি থাকতে আবার একজোড়া সৌখিন চটি! প্রাণে একেবারে সখের ফুলঝুরি জ্বলছে। আর আমার জন্য কিছু আনতে বললেই মানিব্যাগ হেঁচকি তোলে।" গতবার তো পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার আগে বলেছিল একটা রিয়েল ডায়ামন্ড পেনডেন্ট চাই। ভাবা যায়!
কতবার বলেছি পাড়ায় রমলা বউদি-কমলা বউদি-বিমলা বউদি-লিলি-মিলি-নীলি-শিলি একশো এক বউদি মিলে 'মারকাটারি' সমাজসেবার ক্লাব খুলেছে, মেমবারশিপ নিয়ে নাও। বছরে তিন চারবার বেড়ানোর প্রোগ্র্যাম করে, আর পিকনিকের তো অন্ত নেই। তাতেও বলে “না, ওখানে পিএনপিসি হয়। তাছাড়া স্ট্যাটাস রাখা যাবে না, যা ভাঙা-চেয়ারের ম্যানেজারি তোমার ।” কোনো-না-কোনো ভাবে ঠুকবেই। এই তো গত পরশু পিসতুতো ভাই ঘেঁটুর সামনে কী অপমানটাই না করল। অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘেঁটু সোফায় আধশোয়া হয়ে চকাস চকাস করে কষামাংস চাখছে আর টিভিতে কার্টুন ফিল্ম দেখছে।বললাম , কিরে কী খাচ্ছিস, গন্ধে একেবারে পাড়া ম ম করছে? এক মাইল দূর থেকে জিভে জল ঝরছে, তোর বউদি কী বানিয়েছে রে আজ? সিম্পল প্রশ্ন। ওমা, ঘেঁটু উত্তর দেওয়ার আগেই আমার রূপবতী বিদূষী বউ বলে উঠল, “তোমার যে অমন চারপেয়ে বৈশিষ্ট্য আছে তা তো জানতাম না।" ঘেঁটুর দিকে চাইতেই ও লাট-খাওয়া লক্কাপায়রার মতো হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, “যাও দেখি আর দাঁড়িয়ে না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসো।”
ডিসিশন পাক্কা । ডিভোর্স।
এরপর ঘুমিয়ে পড়ে দুজন। সকাল হয়। বউ ঘুম থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করে দেয়। বর ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলায়।
বউ বলে, এই নাও চা রেডি।
বর বলে, হ্যাঁ দাও। মাছের থলেটা সামনে রেখো।
বাজার থেকে ফিরে বর বাসি লুঙ্গি কাচে, শুকোতে দেয়, দাড়ি কামায়, গায়ে সামান্য তেল মাখে, স্নান করতে যায় ---বউএর রান্না প্রায় শেষের দিকে। স্নান সেরে বউএর তৈরি রান্না খেয়ে বর অফিসে বেরোয়। সন্ধেবেলা বর বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সোফায় বসে।
বউ বলে, চা খাবে?
বর বলে, হ্যাঁ।
তারপর একসঙ্গে বসে চা খেতে খেতে রিমোট দিয়ে টিভি চালিয়ে বর বলে, কথা আছে।
বউ ভ্রূ কুঞ্চিত করে।
বর বলে, না, এবার আর একা একা পাহাড়ে...
No comments:
Post a Comment