1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, April 15, 2023

সুখের প্রত্যাবর্তন

ছবি : ইন্টারনেট


সুখের প্রত্যাবর্তন

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

মফস্বলের নিজের এই একতলা পাকা বাড়িটা কিশোরীবাবু রিটার্মেন্টের পর বানিয়েছেন।তাও প্রায় বার বছর আগেকার ঘটনা।একমাত্র মেয়ে সুমির বিয়ে দিয়েছেন মোটামুটি ধুমধাম করে।সেও প্রায় দশ বছর হয়ে গেল।সুমি ওর স্বামী আর ওদের দুই যমজ সন্তান নিয়ে প্রায় দশ বছর ধরেই ব্যাঙ্গালোর নিবাসী।ওর ছেলেরাও স্কুলে পড়ছে।আগে ছমাসে একবার বাপের বাড়ি আসতো।এসে দিন সাতেক থেকে আবার শিলিগুড়ি শ্বশুরবাড়ী যেতে হতো।

এবার গরমের ছুটিতে জামাইয়ের গলব্লাডার অপেরেশন হওয়ায় ওরা আসতে পারেনি।কিশোরীবাবু এবং সুনীতা দুজনাই খুব মন খারাপ হয়ে গেল।বছরে ওই কটা দিনই তো মেয়ের সাথে দেখা , সেটাও এবার হলো না।ব্যাঙ্গালোরে যাবার কথা সুনীতা একবার বলেছিল বটে তবে তখন ট্রেনের টিকিট কাটার সময় পেরিয়ে গেছে, তারপর সুমির ছোটো ফ্ল্যাটে ওর শ্বাশুড়ি এসেছে, এখন গেলে থাকারও অসুবিধা হতো।

দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা সন্ধ্যার টিভি সিরিয়াল আর ছাদের কটা ফুলের গাছের সেবাযত্ন নিয়েই সময় কাটাচ্ছেন। ফুল ফুটলে তার ছবি তুলে মোবাইলে মেয়েকে হোয়াটস আপ করে দেন।হাড়ের গুঁড়ো আর অন্য কি সার দিয়ে এত বড় গোলাপ ফুটিয়েছেন সেটা নিয়ে রাত্রে মেয়ের সাথে কথা হয়।জীবনে তো কোনো বৈচিত্র নেই যা নিয়ে নিজেদের বা মেয়ের সাথে আলোচনা করতে পারেন।মাঝে মাঝেই একটা হতাশা আসে তবে আবার বিকেলের ছাদে উঠে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মেঘের রং পরিবর্তন দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়।কিংবা ঈশান কোনে কালো মেঘ যখন ধীরে ধীরে দৈত্যের মতো পুরো আকাশ টাকে নিজের কব্জায় করে বিজয়ীর হুঙ্কার দেয় , আকাশ হেরে যাওয়ার অভিমানে টুপ টুপ করে চোখের জল ফেলে গোলাপ গাছের ওপর আর ওনাদের শুকোতে দেওয়া শাড়ি-জামার ওপর তখন দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের অভিমানের সাক্ষী হতে ভালোবাসেন।

কত দিন ভালো করে সুখদুঃখের কথা হয় না দুজনের মধ্যে।কিশোরীবাবু বাজার, খবরের কাগজ, আর মোবাইলের জগৎ নিয়েই থাকা পছন্দ করেন।আর সুনীতা টিভিতে শাড়ির ডিজাইন বা বিভিন্ন রান্নার পদ বা সংবাদ নিয়েই থাকেন।আগে বই পড়ার অভ্যেস থাকলেও টিভির চটকে বা মোবাইলের বহুমুখী প্রতিভার আলোয় বই, ম্যাগাজিন আজ ব্রাত্য হয়েছে। দুজনে দুটো অন্য ঘরে বসেন বা এক ঘরে বসলেও একজন টিভি তো অন্যজন মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন। দাম্পত্য যে একটা শিল্পকলা যা প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করতে হয় তা এই বৃদ্ধ দম্পতি বিস্মৃত হয়েছেন।সময়ের একটা শ্যাওলা দাম্পত্যের ওপর কখন চেপে বসেছে সেটা ওনারা বুঝে উঠতে পারেননি।

কিশোরীবাবু লক্ষ্য করেন মাছের দোকানের পাশে যে বেড়ালটা রোজ ঘুরঘুর করে তার পেটটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে।বাচ্ছা পাড়বে মনে হয়। প্রায় বছর খানেক ধরেই বেড়ালটা ওনার নজরে পড়ছে।লিকলিকে চেহারাটা থেকে ধীরে ধীরে মোটাসোটা হলো উচ্ছিষ্ট মাছ খেয়ে।এবার আবার গর্ভবতী হয়েছে। সুমি যখন প্রেগন্যান্ট হয়েছিল তখন শেষের প্রায় তিনমাস ও বাচ্ছা হবার পর চারমাস কিশোরীবাবুর বাড়িতেই ছিল।উনি প্রায় রোজ জ্যান্ত মাছ কিনে নিয়ে যেতেন সুমির জন্য।অনেকদিন সুমিকে দেখেননি।আজ গর্ভবতী বিড়ালটাকে দেখে হঠাৎই সুমির কথা মনে পড়ে গেলো।একটা কেমন মায়া হলো।মাছওয়ালাকে বললেন দেড়শ গ্রাম পুঁটি দিতে।কিনে একটা প্লাস্টিকের ওপর রেখে বিড়ালটাকে আয় আয় বলে ডাকতে লাগলেন।পশুপাখিরাও ভালোবাসা বুঝতে পারে।বিড়ালটা কিশোরীবাবুর ডানপায়ে নিজের গাটা ঘষে আদুরী হয়ে কপ কপ করে মাছগুলো খেয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ওনার মুখের দিকে চেয়ে বললো ” মিয়াও”।

কিশোরীবাবু এখন সপ্তাহে দুদিনের জায়গায় পাঁচদিন মাছের বাজারে আসেন।এসেই দেড়শ গ্রাম পুঁটি রোজ মাটিতে উবু হয়ে বসে বিড়ালটাকে খাওয়ান।এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি অনুভব করেন উনি যা মোবাইলে, টিভিতে খবরের কাগজে পাওয়া যায় না।বেড়ালটির খাওয়া হয়ে গেলে জিভ দিয়ে নিজের পা চাটা বা জিভটা দিয়ে নিজের ঠোঁট চাটাটা কিশোরীবাবুর দারুন ভালো লাগে।সুমি মাটিতে বসে খাবার শেষ হলে হাত চাটত।অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। যতক্ষন না বেড়ালটি আস্তে আস্তে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে যায় ততক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকেন।

প্রায় দিন দশেক জ্বরে ভুগলেন কিশোরীবাবু।দিন পনেরো পরে আবার বাজারের থলি নিয়ে ছুটলেন মাছের বাজারে।বিড়ালটিকে দেখতে পেলেন না।অস্থির হয়ে নেপালকে বিড়ালটির কথা জিজ্ঞাসা করলেন।নেপাল হেসে জবাব দিলো ” ওই বাজারের শেষে ফলওয়ালার দোকানের পাশের ঝুড়িতে বাচ্চা পেড়েছে , তাও প্রায় দুসপ্তাহ আগে।”

কিশোরীবাবু দৌড়লেন ফলের দোকানের পাশে।কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় চলতে গিয়ে পা পিছলে যাচ্ছিল।কোনোরকমে একটা দোকানের রড ধরে বাঁচলেন। গিয়ে দেখেন মা জননী ঘুমিয়ে আছেন।পাঁচটি সন্তান বুকের দুধ খাচ্ছে।মনটা একটা অনাবিল আনন্দে ভরে গেল।উনি পাশে উবু হয়ে বসে সে দৃশ্য দেখতে লাগলেন।একটু পরে মা জননী চোখ খুলে ঘাড়টা একটু তুলে কিশোরীবাবুকে দেখল।শরীরটা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।বাচ্ছাগুলো খাবারে বাধা দেওয়ায় একটু রুষ্ট হয়ে কুই কুই করে মৃদু প্রতিবাদ শুরু করলো।মা জননী ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে কিশোরীবাবুর পায়জামাতে গাটা ঘষতে ঘষতে মিয়াও মিয়াও বলে দুবার ডেকে উঠলো।যেনো কৈফিয়ত চাইছে এতদিন মেয়েকে না দেখতে আসার জন্য।

সুমি যখন যমজ সন্তান নিয়ে হিমশিম খেত তখন মাঝে মাঝে কপট রাগে বাবাকে বলে উঠতো

” এই দুটো শয়তানকে ধরো তো।”

কিশোরীবাবু মা জননীর সন্তানদের গায়ে একটা আঙ্গুল দিয়ে আদর করতে লাগলেন।ও কোনো বাধা তো দিলোই না বরং কিশোরীবাবুর পায়ের কড়ে আঙ্গুলটা জিভ দিয়ে চাটতে লাগলো। সেদিন মা জননীর ভাগ্যে তিনশ গ্রাম মাছ জুটলো।

এর প্রায় দিন পনেরোর পরের ঘটনা। কিশোরীবাবু যথারীতি বাজারে গিয়ে ঝুড়ির পাশে হাজির হয়ে চমকে উঠলেন।মা জননী কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছেন।পাঁচটির মধ্যে কেবল দুটি বাচ্ছা ঘুমোচ্ছে।উনি আতিপাতি করে পুরো বাজার খুঁজলেন, সব দোকানদারদের বাচ্চাগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন-কেউ কিছু বলতে পারল না। উনি আবার সেইদিনই বিকেলে বাজার গেলেন।বিকালবেলায় এই মাছের বাজার বন্ধ থাকে।শূন্য বাজারে তাড়াতাড়ি ঝুড়ির কাছে গিয়ে দেখলেন, কেবল একটি রুগ্ন বাচ্ছা মিয়াও মিয়াও করে কেঁদে যাচ্ছে।বাকিরা কেউ কোথাও নেই।অনেক খুঁজলেন।মা বা অন্য বাচ্চাকে কোথাও খুঁজে পেলেন না।পরিত্যক্ত বাজারে দু তিনটি রাস্তার ঘেও কুকুর এলাকা দখলের তুমুল লড়াই জুড়েছে।এই বাচ্চাটির এখানে থাকাটা ঠিক হবেনা ভেবেই কিশোরীবাবু পরম যত্নে বেড়াল বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন।

বাড়িতে ঢুকেই সুনীতাকে ডেকে ছানাটির জন্য একটু দুধ দিতে বললেন।প্রায় একবাটি দুধ চুক চুক করে খেয়েই বাচ্চাটি মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লো।সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।আজ একটু পরে আবার ঝড় আসতে পারে। বাইরে সোঁ সোঁ করে হাওয়া বইছে।সুনীতা সব জানালা বন্ধ করে দিলো।ছানাটি প্রায় একঘন্টা ঘুমোনোর পর উঠে দাঁড়িয়ে নতুন আস্থানাটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।টলোমলো পায়ে সোফার কাছে গিয়ে একবার দাঁড়ালো, পিছনে ফিরে চাইলো,তারপর সোফার তলায় সেঁধিয়ে গেল।

রাত্রে একটা পুরোনো পর্দা পাট করে বাচ্চাটার বিছানা পাতা হলো।অপার বিস্ময়ে ও ভয়ে ও নিজের নতুন মালিকদের দেখতে লাগলো।তারপর গুটি গুটি পায়ে এসে সুনীতার পায়ের সাথে সেঁটে শুয়ে পড়লো।নারী ও মাতৃত্রের যে একটা যোগসূত্র আছে তা বোধহয় বিড়ালছানাও বুজতে পারে।

রাতে আলো নিভিয়ে সুনীতা জানালাটা খুলে দিল।বাইরের একঝাঁক জ্যোৎস্না ঘরের মেঝেতে বাচ্চাটার ওপরে এসে পড়েছে।ও পরম নিশ্চিন্তে মেঝেতে শুয়ে আছে।কিশোরীবাবু বহুদিন পরে সুনীতার হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment