1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

ঝুলবারান্দা ও একটি গল্প

 ঝুলবারান্দা ও একটি গল্প

তরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

এক

“রাতের সর-ভাঙা ভোর অদ্ভুত মন ভালো-করা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। কাকডাকা ভোরবেলায় যখন একটা দুটো তিনটে এমনি করে একে একে পাখিরা গান গেয়ে ওঠে তখন মনে হয় জীবনে দুঃখ যন্ত্রণা বলে কিছুই নেই, এই নিষ্কলূষ ভোরের রূপ চোখ দিয়ে নয় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপভোগ করতে হয়। কী বল মধু?” দোতলার ঝুলবারান্দায় এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে টিপয়-এর সামনে পেতে রাখা নির্দিষ্ট চেয়ারে আরাম করে বসেন সুলোচন সেন। পূর্বদিক খোলা বারান্দায় ভোরের নরম আলো ওঁর মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে আলগোছে। ঘরের কাজ গোছাতে গোছাতে মধুমতী মৃদু হেসে বলেন, “চা বসিয়েছি।” 

ভদ্রলোক ডার্ক গ্লাসের চশমাটা চোখে পরতে পরতে মাথা নেড়ে বললেন, “আসলে শহরতলীর নিজস্ব একটা ফ্লেভার আছে।”

রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকান ঝাঁপ খুলেছে বোধহয়। এসময়ে রেডিয়োতে প্রভাতী অনুষ্ঠান শোনা যায় ওই চায়ের দোকানেই। দু-একজন লোকের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গুটিকয়েক ভদ্রলোক প্রাতর্ভ্রমণ করতে বেরিয়ে চায়ের দোকানের সামনে আড্ডা বসায়। রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে রাজাউজির মারেন আরকি। টুকরো কিছু আলাপ শোনা যাচ্ছে। দোকানটা একশো মিটারের মধ্যেই হবে কিন্তু বারান্দা থেকে দেখা যায় না অথচ কথাবার্তা কানে আসে--  

- মশাই কাগজ পড়ব কী, যতসব খুনোখুনির খবর। এই তো সেদিন ডাইনি অপবাদে খুন হয়ে গেল এক যুবতী, মানুষের বিবেচনা বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।

- কেন গত পরশুর খবরে পড়লাম, টিভিতেও চার-পাঁচটা লিডিং নিউজ চ্যানেলও খবরটা করেছে, একটা বছর দশেকের ছেলেকে চোর অপবাদ দিয়ে প্রকাশ্য স্থানে আধমরা করল জনতা…

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও পড়েছি, পরে জানা যায় ছেলেটি নাকি কথা বলতে বা শুনতে পারত না। কিছুই পাওয়া যায়নি ওর থেকে। কী ইনহিউম্যান ব্যাপার বলুন তো।

- এ তো ক্ষমাহীন ভুল। মানবিক মূল্যবোধের ক্রম-অবনমন ঘটে চলেছে। 

-কাকে বিশ্বাস করবেন? কেউ তলিয়ে ভাবে না, মানে ভাবতে চায় না। যার যা মনে হচ্ছে বলে দিচ্ছে, করে দিচ্ছে।

- ধ্যুস বিশ্বাস শব্দটাই কেমন যেন ফিকে হতে হতে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। কী রাজনীতি, কী সমাজ, 

  কী পরিবার। আর এখন অপবাদ তো সর্বত্র। জেনে না-জেনে ইচ্ছাকৃতভাবে লোক ক্ষেপিয়ে… 

  কই হে এক পাত্তর চা দাও বাবা সুরেন। এখনই যা দার্জিলিং টি পাব। একটু বেলা হলেই তো গজের চা। এলাচ মিশিয়ে ফুটের পর ফুট দিয়ে চা এর ভুষ্টিনাশ করবি।

- এই দেখো, খিটুদা অবিশ্বাস আমাদের মনে সবসময়। একটু আগেই তলিয়ে ভাবা নিয়ে কথা বলছিল বলরাম। তোমার আমার করোর মধ্যেই সেই যুক্তিবোধ কাজ করে না। আমরা আমাদের প্রয়োজনে মানবিক হওয়ার ভান করি আর সুযোগ পেলেই অপরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ করতেও ছাড়ি না। তা সে নিজের স্বার্থসিদ্ধ করতেই হোক কিংবা নিছক মজা কুড়োতেই হোক।

তুমি কী করে জানলে যে সকালের এই চা পাতা আমার বেলা পর্যন্ত চলে? শোনো আমার কাছে 

হাজার টাকা কেজির চা-পাতাও আছে। ওই যে সরকারদের বাড়ি কিনেছে এক স্বামীস্ত্রী, নতুন এসেছেন। সেই দিদিমনি পিওর দার্জিলিং চা  কেনেন। 

-এই দ্যাখো, চাটছিস কেন। তা কবে এলেন ওঁরা। জানতেই পারলাম না। সরকারদা-দের চলে যাওয়াটাই জানলাম এই গেল হপ্তায়। ভদ্রমহিলা তো টিচার কিন্তু ভদ্রলোক কী করেন জানিস?

- না, তবে অসুস্থ বলেই মনে হল। তুমি তো কমিটির সেক্রেটারি খিটুদা, পাড়া থেকে প্রতিবেশী চলে যাচ্ছে খবর রাখো না, নতুন প্রতিবেশী এসেছে সে খবরও পাওনি। ভরসা করবে কেন পড়ার লোক। যাও নিজে গিয়ে তত্ব-তালাশ করে এসো।

- বেশ ঝাঁঝ। আদাটা একটু বেশিই দিয়েছে সুরেন। এক চুমুকেই বোঝা যাচ্ছে। কী বলিস বলরাম!

- সকালের এমন চা মেজাজ আনে। সুরেন এই রকম চা আমাদের জন্য...

সুলোচন মিটিমিটি হাসেন এইসব রোজনামচা  

শুনতে শুনতে। মধুমতী একপেয়ালা চা আর গুটিকয়েক বিস্কিট সামনের টিপয়ে রেখে দিয়ে মুচকি হেসে বলেন, “আর কিছু…”

সুলোচন মধুমতীর ডানহাতখানা খপ করে ধরে বলেন, “একটা চেয়ার নিয়ে এখানে বোসোনা। একসঙ্গে চা খাই।” মধুমতী মুখখানা সুলোচনের আরও কাছে এনে হাসতে হাসতে মৃদুস্বরে বলেন, “হুঁ, বসব বইকি, দেশ ভ্রমণে এসেছি কিনা, কত গোছগাছ বাকি জানো! পাঁচদিন হয়ে গেল এসেছি। সৃষ্টির জিনিসপত্র ছড়িয়ে, বাড়িটাতো গোছাতে হবে নাকি, কাজ কম!” 

হাতবাড়িয়ে চায়ের পেয়ালা নিয়ে সুলোচন বললেন, “তাহলে গিটারটা আর বইপত্র এনে এখানে রাখো।” চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে লম্বা সুরে সুলোচন বললেন “আহ! এ কো…ন্‌ সকাল—” 

দিন পাঁচেকের সংসার এবাড়িতে। হালে কেনা অথচ পুরোনো কিন্তু পরিপাটি এই দোতলা বাড়িটা বেশ খোলামেলা। প্রতি তলে পুব দক্ষিণ খোলা বড়ো বড়ো দুখানা ঘর, একটা ডাইনিং স্পেস আর একটা কলঘর। তবে বিশেষ আকর্ষণ দোতলার পূর্বদিকে লম্বা খোলা ঝুলবারান্দাটা, বসে আরাম করেই দিন রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। এসে থেকে এই বারান্দাটা ছাড়তে নারাজ সুলোচন। আশেপাশে প্রতিবেশীদের বাড়িঘর বেশ ভালোই, তবে ফাঁকা ফাঁকা, কোলকাতার মতো গা-ঘেঁষা নয়। নিরিবিলি, কোলাহল তেমন নেই দুচারটে সাইকেলের ঘন্টি আর মোটর সাইকেলের হর্নের শব্দ ছাড়া। পনেরো ফুট রাস্তার এপারে ওপারে বাড়ি। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেও একই রকমের ঝুলবারান্দা-অলা বাড়ি, এই এলাকায় ঝুলবারান্দা একটা রীতি বলা চলে। সুলোচন চায়ের শেষ চুমুক দিয়ে বেশ একটা তৃপ্তিসূচক ‘আ!’ শব্দ করে পেয়ালাটা টিপয়েতে রেখে একটা তারানা গুনগুন করতে থাকেন। মধুমতী গিটার আর প্রয়োজনীয় খাতাপত্র রেখে, চায়ের পেয়ালা নিয়ে ভেতরে চলে যান। এমন সময়ে সামনের বাড়ির দোতলার বারান্দার দরজা খোলার শব্দে অধ্যাপকের মুখ সেদিকে ঘুরে যায়। বেশ মিষ্টি গন্ধ সঙ্গে নিয়ে বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে মোহনা বারান্দায় কাচা রাতপোশাক মেলতে আসে। গন্ধটা বোধহয় বডি স্প্রে-র হবে, সুলোচন হঠাৎ খুব জোরেই শ্বাস নিয়ে অনুচ্চ স্বরেই বলেন “বা!কী অপূর্ব জুঁই ফুলের সুগন্ধ। তাও এই অসময়ে। তুমি রেডি হও আমি যাচ্ছি।” তারানাটা গুনগুন করতে থাকেন সুলোচন সেন। মুখে নিপাট ভদ্রলোকের হাসি।

   উলটো দিকের বারান্দা থেকে মোহনা সুলোচনের ওই কথা শুনতে পায় আর চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় তারপর ঘৃণা মিশ্রিত মুখ করে সপাট ঘুরে বারান্দা থেকে ঘরে চলে যায়। সজোরে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে উঠে ওবাড়ির বারান্দার দিকে মুখ ঘোরান ভদ্রলোক। কিন্তু ততক্ষণে তাঁকে সুর-ছন্দ বেঁধে ফেলেছে পাকে পাকে। মধুমতী ভেতর থেকে নাতিউচ্চ স্বরে বললেন, “বাবুকে কাব্যে পেয়েছে দেখছি, চলো কাগজ-কলম নিয়ে আমিও রেডি”--

এরপর ভদ্রলোক সামনের দিকে পা ছড়িয়ে হাতদুটোকে জড়ো করে সামনের দিকে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে গুনগুন থামিয়ে স্বরচিত কবিতার কয়েক লাইন ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেনঃ

   জুঁইফুলেরই গন্ধে ভরা

    মন-মাতানো সাতসকাল

    মুক্ত পাখি বাঁধছে রাখী

    দিল-দরিয়ায় ওড়াও পাল    

    রোদ উঠেছে ফুল ফুটেছে

    সুজ্জিমামা হাসছে ওই

    হাসি-কান্নার দোলনা চড়ে

    জীবন যেন জমেই দই…

দুই

মোহনার কানদুটোতে কে যেন শুকনো লঙ্কাবাটা মাখিয়ে দিয়েছে। চোখে জল এসে গিয়েছে তীব্র অপমানে। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে এঘর-ওঘর। আজ লোকেশন দেখতে যাওয়ার কথা, ভোর ভোর তৈরি হয়েও নিয়েছে। খসড়া চিত্রনাট্যও মোটামুটি তৈরি। তাপস আর বিপাশা এলে একটু ট্রিটমেন্ট নিয়ে আলোচনা করেই ওরা বেরিয়ে পড়বে—দিনপাঁচেক হল ভদ্রলোক এপাড়ায় এসেছেন আর এরই মধ্যেই এত বড়ো সাহস। এতদিন বিরক্তি বিরক্তি একটা ভাব ছিল কিন্তু আজ সবকিছুর বাঁধ ছাপিয়ে গিয়েছে। এসপার ওসপার একটা কিছু করতেই হবে আজ। মোহনার মনে আন্দোলন চলতে থাকে-- লোকটা করেটা কী, কে আছে ওর সঙ্গে, সরকার জ্যাঠাদের আত্মীয় নাকি নতুন কেউ বাড়িটা কিনেছে? এপাড়ায় এল কবে? সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। অমন নিপাট ভদ্রলোকের পোশাকে চোখে সবসময় কালো চশমা, তাও সই, কিন্তু দিন নেই রাত নেই ওই বারান্দায় বসে এবাড়ির দিকে চোখ পেতে বসে থাকা। কাঁহাতক সহ্য হয় এই অসভ্যতা। ঘর থেকে বারান্দাতে বেরোনো প্রায় বন্ধ হতে বসেছে এমনকি বারান্দা লাগোয়া শোওয়ার ঘরের জানলা খোলাও মহা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ধেবেলা যে একটু খোলামেলা হয়ে বসে বা শুয়ে যে রিল্যাক্স করবে তার জো নেই। বারান্দায় বসা তো দূরের কথা পোশাক মেলতে যাবে, হাঁ করে সামনের বাড়ি থেকে একজোড়া চোখ নজর রেখে চলেছে। বাইরে গেলে বা ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময়ই যা ঘরের জানলা খুলে যেতে পারে, না-হলে হাওয়াবাতাস লাগবে কী করে ঘরে। শুধু কী তাই বাড়ি থেকে বেরোবে তখনও সেই লোকটা ওপর থেকে নিপাট ভালোমানুষির হাসি বিলোনো মুখ করে দেখবে, বাড়ি ঢুকবে তখনও সে বারান্দায়। দিনের আঠেরো ঘণ্টাই বোধহয় বারান্দায় কাটে লোকটার। 

গত পরশু সন্ধেবেলা মোহনা সবে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেছে। গরমও পড়েছিল সেদিন বেশ। স্নান সেরে নাইটি পরে বারান্দার দিকের জানলাটা প্রতিদিনের মতো খুলে পর্দা টেনে সরিয়ে দিয়েছিল। দরজাটাও খুলে রেখেছিল। বাইরের ভিজে ভিজে হাওয়া ঘরে খেলছে। মনে হল কোথাও একটু বৃষ্টি হয়েছে। বেশ লাগছে। ঘরে হালকা আলো জ্বেলে চেয়ারটা দরজার কাছাকাছি টেনে রিল্যাক্স করে একটু ঢিলেঢালা হয়ে ব'সে সেন্টার টেবিলে পা তুলে দেয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল মায়ের ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ওবাড়ির বারান্দা থেকে ভদ্রলোক রেলিং থেকে ঝুঁকে বড়ো বড়ো চোখে হাঁ কপরে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে ধরা আছে কালো সানগ্লাসটা। মুখে বলে চলেছেন শিকার ধরা পড়েছে, পড়েছেই। ঘরের ভেতর থেকে কেউ কিছু বলছে মনে হল কিন্তু বোঝা গেল না, কেবল ভদ্রলোক বলে চলেছেন “আমার ইন্দ্রিয় সজাগ, ফাঁদে পড়েছে বুঝতে পারছি”। হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল মোহনার ওই দৃশ্য দেখে আর কথা শুনে। কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তারপর দ্রুত দরজা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে নীচে। খেতে খেতে মাকে শুধু বলল, “বাবা কবে আসছে মা?”

-এখনও দিন দশেক দেরি, কেন?

- সামনের বাড়ির লোকেদের চেন?

- তেমন আলাপ হয়নি কেন বলতো?

-না এমনি। বাবার কনফারেন্স তাড়াতাড়ি শেষ হলে…

মোহনা মাকে কিছু জানাতে চায় না। জানিয়েও লাভ হবে না, একে বাবা বাইরে তার ওপর এই উটকো ঝঞ্ঝাট টেনশন বাড়িয়ে দেবে। 

আজ সকালের ঘটনাটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। অস্থির মস্তিষ্ক বুঝতে চায় না কী করা উচিত। মোহনাও ব্যতিক্রম নয়। একবার শোবার ঘরের চাদর ঠিক করছে। নয়তো স্টাডিতে টেবিলের ওপর রাখা বইগুলো মুছছে, পেনস্ট্যান্ড থেকে পেন নিয়ে খসড়া চিত্রনাট্যের উদ্দেশ্যহীন অনাবশ্যক কিছু সংশোধন করছে, কখনো-বা দেওয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো এদিক ওদিক নাড়িয়ে দিচ্ছে সেট করবার অছিলায়। ফোনটা আসতেই মোহনার ঘোর লাগা ভাবটা কেটে যায়। ফোন ধরে প্রয়োজন অতিরিক্ত স্বরে বলে, “বিপাশা কোথায় তোরা, রেইকিতে যাবি তো নাকি।” ওপ্রান্ত থেকে কিছু উত্তর আসে। মোহনা নরম হয়ে ফোন নামিয়ে রাখে টেবলে। তারপর চেয়ারে বসে কানের দুপাসে হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। ঘরে কিন্তু সুলোচনবাবুর গান ও হালকা গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। 

নির্মেঘ উজ্জ্বল আশ্বিনের সকাল, ভদ্রলোকের স্ফূর্তি যেন বেড়ে গিয়েছে। অনুচ্চ অথচ সুরে কখনও তারানা আবার কখনও নিজের রচিত পদ্যের সুরারোপ করে গেয়ে চলেছেন। মোহনাদের বাড়িতে ওর বয়সি একটি ছেলে আর একটি মেয়ে গেট খুলে ঢোকে। বেল বাজায়। দরজা খুলে দিলে। হইহই করে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। সুলোচনবাবু গান থামিয়ে সেদিকে মুখ তুলে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেন কিন্তু তার আগেই ওরা ঢুকে যায়। মোহনা দোতলার বারান্দা থেকে একঝলক ভদ্রলোককে দেখেই ত্বরিৎগতিতে ঘরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ভদ্রলোক নিজের গানে আবার মশগুল হয়ে পড়েন। এখানেই মোহনার ধন্দ কাটতে চায় না, লোকটা ভালো লোক নাকি খারাপ, সৎ প্রতিবেশী নাকি অসৎ… ইতোমধ্যে বিপাশা আর তাপস ওপরে চলে এসেছে। মোহনা ওদের ঘরে বসায়। 

তিন

তাপস দরজার পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, “রেইকি পরে হবে আগে কনসেপ্ট আর ট্রিটমেন্ট শোনা যাক।” বিপাশাও সম্মতি জানাল। মোহনা টেবল থেকে খসড়া চিত্রনাট্যের খাতা নিয়ে জানলার দিকে পিছন করে মোড়ায় বসে আর বিপাশা জানলার দিকে মুখ করে অর্থাৎ ওদের দুজনের দিকে মুখ করে একটা বেতের চেয়ারে বসল। মাঝখানে বেতের সেন্টার টেবল। মোহনা পড়তে শুরু করে। মা নিঃশব্দে এসে চা আর স্ন্যাক্স সমেত একটা ট্রে সেন্টার টেবলে রেখে যান। বাকি দুজন খুব মন দিয়ে মোহনার কথা শুনতে থাকে। নিস্তব্ধ ঘর মোহনার পরিশীলিত কণ্ঠস্বর আর আবহে সিলিং ফ্যানের নিজস্ব শব্দ। তবে দূর থেকে ভেসে আসা ভদ্রলোকের গিটার-ধ্বনি এবং সকালের গানের সুরটাও বেশ মানানসই অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি করেছে। মোহনার কথা থামলে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বন্ধুটি বলে, “ফলস ব্লেম। তাই তো?”

বিপাশা বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলে, “পরশুর কাগজেই তো ঘটনাটা…”

মোহনা স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে একটু শ্রাগ করে বলে, 

“বার্নিং ইস্যু, এটা ভেবে দেখিস।”

চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে ছেলেটি বলে, 

“বটেই তো তবে আর একটু ঘষামাজা করা দরকার। লোকেশন কোনো সমস্যা নয়।গল্পটা দাঁড়াল 

এইরকম—”তাপস দাঁড়িয়ে পড়ে এবং গল্পের আখ্যানকাঠামো চিত্রনাট্যের উপযোগী করে বিবৃত 

করতে থাকেঃ

“ওই মহিলার চিৎকারে দেখতে দেখতে ভিড় জমে যায়। একটা দশ-বারো বছরের শিশুর আবক্ষ ছবি পর্দায় দেখা যাবে। ওর চোখেমুখে ভীষণ ভয়-পাওয়া ভাব। আবার জনতার উন্মত্ত দৃশ্য আর এরই মাঝে ভদ্রমহিলার চোখ খুঁজে নেয় শিশুটিকে। ভিড়ের মধ্যে নানান মন্তব্য ভেসে আসে অবশেষে ভদ্রমহিলার চোখে চোর হিসেবে ধরা পড়ে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়ানো শিশুটি। ছেলেটা ভয়ে পালাতে যায় আর ধেয়ে আসা জনতার স্রোতে ঢাকা পড়ে, কপালে জোটে বেদম বাংলা মার আর অশ্রাব্য বাক্যবাণ।ভদ্রমহিলা শিশুটির স্বীকারক্তি আদায় করতে মরীয়া। সেই মরীয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে রক্তাক্ত কলেবরে অচেতন হয়ে পড়ে যায় শিশুটি। খুব কাছ থেকে ফ্রেম করতে হবে রাস্তায় পড়ে থাকার দৃশ্য। কিন্ত তারপর...!” তাপসের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ঘোরে দুই সতীর্থের মুখের ওপর। সে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা বুকর‌্যাকে দুটো বইয়ের মাঝে আটকে থাকাএকটা আইডেনটিটি কার্ড লক্ষ করে এগিয়ে গেল আর কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “ফলস ব্লেম এস্ট্যাবলিশ করতে গেলে একটা আইডেনটিটি তো প্রুফ করতে হবে।না হলে ছবির উদ্দেশ্য বলে কিছু থাকবে না, নিউজ রিল হয়ে যাবে। ইস্যু যতই বার্নিং হোক ফিনিশিং-এ একটা মেসেজ বা পাঞ্চ থাকতেই হবে যা দর্শকের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করবে।”বিপাশা তাপসের ধরে থাকা কার্ডটা দেখে বলে, “মোহনা শেষটা যদি এমন হয় ছেলেটির জামা-প্যান্ট হাতড়ে কোনো একটা পকেট থেকে গলায় ঝুলিয়ে রাখার মতো আই-কার্ড পাওয়া গেল…”

“আর সেই কার্ডে লেখা থাকবে একটি অনাথ আশ্রমের নাম, ছেলেটির নাম এবং সে যে মূক-বধির সেই কথাটাও। হয়তো কোনো কারণে সে হোম থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।” মোহনা বেশ স্বাভাবিক।তাপসের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল, “কিরে ঠিক আছে?”তাপস মুচকি হেসে সেই আইডেনটিটি কার্ডটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, “আর একটু টাচ, রাস্তায় এসে হকচকিয়ে গিয়েছিল, ফিরতে পারছিল না। যেখানে তার প্রাপ্য ছিল স্নেহপূর্ণ সাহায্য, সেখানে জুটল অমানুষিক নির্যাতন। মাতৃস্থানীয় ওই ভদ্রমহিলা যিনি হার চুরির মিথ্যে সন্দেহে ওই অবোধ শিশুর সঙ্গে যে আচরণ করলেন তাতে তার মনে মা তথা মহিলাদের প্রতি প্রত্যক্ষভাবে ভীতি এবং পরোক্ষভাবে নারী-বিদ্বেষীর প্রভাব পড়তে পারে, এরকমটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ওই আশ্রমের প্রধানের বক্তব্যের মাধ্যমে।”মোহনা বিমর্ষ মুখে বলে, “সেটা আবার কীভাবে?”“সে তোমরা একটু ভাবো।” তাপস মৃদু হেসে ঘর থেকে ওপরের বারান্দায় চলে আসে। ওর মনে হয় এখান থেকে রোদঝলমলে আকাশের গভীর নীল অদ্ভুতভাবে চোখের ওপর সমুদ্রের মায়াকাজল পরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।দূর নীলের গভীরে একটা চিল আর তার ছানা যেন দূর সমুদ্রে মাছধরার নৌকোর মতো ঢেউয়ের মাথায় মাথায় কী মসৃণ গতিতে ভেসে চলেছে। সময় তাদের অখণ্ড, আকাশের বুকে ভেসে চলাটাই যেন একমাত্র কাজ। তাপসের মনে এক প্রশান্তি, অবশেষে ডিপ্লোমা ফিল্ম বানানোর জুতসই বিষয় পাওয়া গিয়েছে। এখন কাজ হলবিষয়ের সুন্দর প্রযোজনা। তাপস বারান্দা থেকে খেয়াল করে সুলোচনবাবুকে। সৌম্যদর্শন মধ্য চল্লিশের ভদ্রলোক কিন্তু দেখে মনে হবে তিরিশের কোটাতেই আটকে আছেন। কালো রোদচশমা ভদ্রলোকের গ্ল্যামার যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। এবাড়ির বারান্দার একেবারে মুখোমুখি বাড়িটার বারান্দায় বসে ভদ্রলোক গুণগুণ করে কোনো একটি গানের তারানা বা অংশবিশেষ গেয়ে চলেছেন। যেমন সুন্দর সুর তেমনই ওঁর মনোযোগ। কখনও এপাসের বারান্দার দিকে তাকিয়ে কখনো-বা সামনের রাস্তার দিকে মুখ তুলে, আবার কখনও ওঁর কোলের দিকে মুখ নামিয়ে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ভদ্রলোক কোলের ওপর পেতে রাখা সাদা কাগজে হাত বুলিয়ে কিছু একটা করছেন আর গেয়ে চলেছেন অথচ একই সঙ্গে দুটো কাজই যে গভীর মনোযোগ দিয়ে করছেন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাপস ঘরে চলে আসে। ঘর নিস্তব্ধ। ভেবে চলেছে দুই বন্ধু। চেয়ারে বসতে বসতে তাপস বলে, “ভাবা হল?” মোহনা বলল, “তেমন দানা বাঁধছে না।”বিপাশা বলল, “তুইই বল।তোর আইডিয়া বরাবরই আপ টু দ্য মার্ক।”

তাপস হেসে ফেলে। বলে “আবার ছেলে

ভোলানো কথা। আচ্ছা শোন, ছেলেটার লাইফ সেভার হিসেবে আর একজন ভদ্রমহিলা এলেন, বিপাশা এই চরিত্রটা তুই করিস এবং অচেতন ছেলেটিকে কোলে নিয়ে রাস্তার ওপরই বসে পড়লেন। আগেই এসট্যাবলিশ হয়ে গিয়েছে আই-কার্ড। এবার ভদ্রমহিলা ওই হার চুরি যাওয়া 

মহিলার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখবেন—এবার কী বলবেন আপনি? 

আর তখনই ওই মহিলার রিঅ্যাকশন শট নেওয়া হবে ক্লোজে। ওঁর মুখ থেকে ক্রোধ উধাও বদলে 

চোখ দুটো জলে টলটল করছে দেখা যাবে। অফ ভয়জে শোনা যাবে একটি দৃঢ়প্রত্যয়ী পুরুষ কণ্ঠ, সংস্থার প্রধান অবিশ্যি সেক্রেটারি বা সচিব বলাই ভালো। সংলাপগুলো নোট কর একজন। সচিবমশায়ের সংলাপ হল— 

আপনার মহার্ঘ সোনার হার খোয়া গিয়েছে। সত্যিই দুঃখের কিন্তু মিথ্যে সন্দেহের বশে এই নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ আর মান এই দুটো কি ওই জড়বস্তুর চেয়ে কমদামি বলে মনে হয় আপনার? আই-কার্ড তো সেজন্যই দেওয়া যাতে এইধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা শিশুরা রাস্তা হারিয়ে  ফেললে, সহৃদয় মানুষজন তাদেরকে সঠিক  ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। 

সেক্রেটারির সংলাপের প্রথম বাক্যের পর শট চেঞ্জ হবে। লং শটে দেখানো হবে ভিড়ের মধ্যে থেকে ভদ্রলোক বেরিয়ে আসছেন সংলাপ বলতে বলতে। আর জনতার ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছে।”

বিপাশা আর মোহনার মুখ আনন্দে ঝকমক করছে। ওদের দুজনেরই মুখ দেখে মনে হয়েছে এর থেকে ভালো এন্ডিং আর কিছুতে হতে পারে না। মোহনা বলে “মারভেলাস এরপরই এন্ড কার্ড পড়ে যাবে তাইতো!”


চার

তাপস ওবাড়ির ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলতে থাকে, “আই-কার্ড আমাদের একটা পাঞ্চলাইন আর কনক্লুশন পার্টে তো একটা সুন্দর টিউন দিতে হবে।” তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলে, “শুধু এন্ডকার্ড পাঞ্চ করলেই হবে মানানসই আবহ থাকতে হবে না! বাই দ্য বাই, মোহনা তোদের সামনের বাড়ির বারান্দায় যে ভদ্রলোক বসে আছেন উনি একটা তারানা গুনগুন করছিলেন, ইনফ্যাক্ট এখনও করছেন, গিটারেও বাজাচ্ছেন।সেইসঙ্গে একটা গানের সুরও সুন্দর করে গাইছেন, খেয়াল কর বিপাশা, ওঁর সঙ্গে কি তোর পরিচয় আছে মোহনা? ওই তারানা কিংবা গানের সুর কিন্তু আমরা বাঁশি বা চেলোতে ব্যবহার করতে পারি অবশ্যই ওঁর অনুমতি নিয়ে। হ্যাঁ-রে মোহনা ওই ভদ্রলোক গান-বাজনা নিয়েই থাকেন নাকি, মানে কী করেন বাই প্রফেশন?”বারান্দার দিকে একঝলক তাকিয়েই মোহনা দৃঢ় স্বরে বলে, “না কখনও না।”

বিপাশা—কেন?

মোহনা—এরা পাঁচদিন হল এখানে গোটা বাড়িটা ভাড়া নিয়ে রয়েছে। লোকটা অদ্ভুত, বিকৃত। বাড়িতে আর কে আছে জানি না তবে মহিলার পোশাক শুকোতে দেখেছি।

বিপাশা—তো! তাতে কী?

মোহনা—কী করেন জানা নেই তবে গত পরশু থেকে বিশেষভাবে লক্ষ করছি লোকটা এবাড়ির 

দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা দিন নেই রাত নেই ডার্ক সানগ্লাস পরে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে। নানা রকম অ্যাক্টিভিটি করলেও লোকটার চোখদুটো যেন সর্বক্ষণ আমায় অনুসরণ করছে। হয়তো এসে থেকে এই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে। যখনই বারান্দায় যাব দেখি লোকটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা বসে, হয় চায়েরকাপ হাতে নয়তো কোনো কাগজ কিংবা গিটার হাতে নিয়ে। 

বিপাশা— কোনো মিস বিহেভ-টিহেভ…

মোহনা— না সেসব না, কোনো কথাই বলেননি ভদ্রলোক। তবে বাড়ি থেকে বেরোতে, বাড়ি ফিরতে, বারান্দায় দাঁড়াতে এমনকি ঘরে পোশাক পাল্টানোর সময় যদি দেখা যায় কেউ নজর রাখছে তাও প্রকাশ্যে, কেমন অস্বস্তিকর ব্যাপার তোরাই বল!মানুষটার সাজপোশাক দেখে সত্যিইবোঝা যায় না মনে কী আছে? প্রথম দুদিন অতটা গুরুত্ব দিইনি আর গতকাল তো সাংঘাতিক ব্যাপার। মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে লোকটা।

মোহনা গতকাল সন্ধের ঘটনা আর আজ সকালের ঘটনা ডিটেইলে বন্ধুদের বলে। ওই যে গানের কথা তাপস বলছিল তার উৎস যে তাকেই কেন্দ্র করে সেটাও জানায় তাপস এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। ও মন দিয়ে মোহনার কথা শুনছিল। মোহনা যে ভয় পেয়েছে খুব তা ওর কথায় বোঝা যাচ্ছে। না হলে একবার ভদ্রলোক একবার লোকটা এরকম সম্বোধন করত না। ভাষা প্রয়োগে মোহনা খুব কনসাস। জানলার পর্দা হাওয়ায় উড়ছে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাপস ওবাড়ির বারান্দায় ভদ্রলোককে দেখবার চেষ্টা করে। দেখে সাদা কাগজ বা বইয়ের ওপর আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা করছেন ভদ্রলোক। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে নটার ঘণ্টা বাজতেই তাপস উঠে দাঁড়ায় বলে, “এখন চল, লোকেশন দেখে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমরা সবাই বসব। কোথাও একটা খটকা আছে।”


পাঁচ

সুলোচন সেন বারান্দায় বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে আরাম করে কোলের ওপরে রাখা সাদা কাগজে খুব মন দিয়ে হাত বোলাচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে গান শুনতে শুনতে খাতার পাতায় হাতের আঙুল ক্যাজুয়ালি নেড়ে চলেছেন তালের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে। মধুমতী বারান্দায় জলখাবারের ট্রে নিয়ে এলে সুলোচনবাবু মুখ তুললেন সেদিকে। তারপর হেডফোন কান থেকে খুলে বললেন, “সামনেটায় বোসো দিকি একটু। সারাক্ষণ খালি কাজই করে যাচ্ছ।” মধুমতী ট্রে-টা তেপায়াতে রেখে ভদ্রলোকের নাকটা টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরেও এলেন মিনিটখানেকের মধ্যে। একটা মোড়া হাতে করে। ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসলেন। ভদ্রলোক ততক্ষণে একটা খাবারের প্লেট হাতে তুলে 

নিয়েছেন। “কতদিন পর একসঙ্গে জলখাবার খাচ্ছি বলো মধু?” সুলোচন পরিহাসের ছলে বললেন।“হুঁ, এখন কয়েকদিন এমন রুটিনই চলবে।” মধুমতী নিজের প্লেট হাতে নিতে নিতে বললেন।“চিঁড়ের পোলাও সত্যিই দুর্দান্ত বানাও তুমি। গন্ধে খিদে খিদে পাচ্ছিল।” সুলোচনবাবু শিশুর মতো বলে ওঠেন।

মধুমতীর চোখে কেমন যেন মায়ায় ভরে গেল। ঠিক যেমন মায়ের কাছে শিশু আবদার করলে হয়। মুখে বললেন, “ডাক্তারের অ্যপয়েন্টমেন্ট ডেটটা মনে আছে তো সামনের মাসের সাত তারিখে, একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখো। আমি তো পাশে আছিই।” 

সুলোচন খেতে খেতে মাথা নাড়লেন। মধুমতী চামচ করে পোলাও মুখে তুলতে গিয়ে যেন হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ মনে পড়ে গিয়েছে, এমনটা ভেবে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “শোনো না বলছিলাম কি আমরা তো কয়েকদিন হল এসেছি এখনও কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে পরিচয় হয়নি, ভাবছি দুদিন বাদে, আর একটু গুছিয়ে নিয়ে, আশপাশের বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের সন্ধেতে চা খাওয়ার নেমন্তন্ন করলে কেমন হয়। না মানে পরিচয় হয়ে থাকাটা কিন্তু অনেক কাজের হবে। তুমি কী বল?” মধুমতী পোলাও ভরা চামচটা মুখে ভরে সুলোচনের সম্মতির অপেক্ষা করেন।

“বেশ তো আলাপ-পর্ব করা যাবে, ভালোই হবে, আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে তুমি কাজে জয়েন করছ কবে?” চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক বললেন।

“তোমার ডাক্তার দেখানোর পর। আছে এখনও দিন পনেরো সময় হাতে।” মধুমতী মৃদু হেসে বললেন। এরপর ওদের নানা খুঁটিনাটি সংসারের গল্প চলতেই থাকত, খাওয়াদাওয়াও দীর্ঘসূত্রী হত যদি না ইলেকট্রনিক ঘড়ি দশখানা ঘণ্টা বাজিয়ে সতর্ক করত। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে মধু। গোছানোর কাজ ঢের বাকি, এতটুকু সময় নষ্ট করা চলবে না। সুলোচনের অবিশ্যি খাওয়া আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ফাইন দার্জিলিং চায়ে কয়েক চুমুক দিয়েও ফেলেছেন চা-বিলাসী সুলোচন। প্রতিবারই চুমুক দিয়ে সুলোচন বলেন, আহা, এমন চা ছাড়া আড্ডা জমে না। কী চা বানিয়েছ মধু। এখনও তার অন্যথা হল না। মধুমতী হেসে বাঁচেন না কেননা সুলোচনের কাছেই ওঁর চা বানানোর হাতে খড়ি। প্রথম প্রথম তো মধুমতীর দুধ দিয়ে ফুটিয়ে গাদা চিনি ঢেলে চা রান্না করতেন, কিন্তু সুলোচন কড়া শিক্ষক হলেও খুবই সহিষ্ণু। ধৈর্যের সঙ্গে সেই চা খেতেন এবং তারিফও করতেন, তারপর আলোচনা করতেন চায়ের গুণাগুণ, তারপর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন চা পাতার রকম, হেন রকমের চা নেই যা সুলোচনের সংগ্রহে নেই। যখন যেমনটা পান করতে ইচ্ছে হয়, তখন তেমনটা নির্দিষ্ট নিয়মেই তৈরি করে দিতে হয় মধুমতীকে। । এবার চায়ের কাপ হাতে দুজনে চুমুক দিতে যাবে কলিং বেল বেজে ওঠে। মধুমতী উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে দেখতে পায় সামনের বাড়ির মেয়েটিকে সঙ্গে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। নিঃশব্দে সুলোচনের কাছে ফিরে এসে মৃদুস্বরে বললেন, “সামনের বাড়ির প্রতিবেশিনী আর তার বন্ধু বান্ধবী।” ইশারায় বাঁ-হাতের তিনখানা আঙুল তুলে দেখালেন। ডানহাতে ধরা কাপ থেকে চা মুখে ঢেলে ত্বরিৎ গতিতে নীচের দিকে নেমে গেলেন। ভদ্রলোক একটু উৎকর্ণ হলেন বটে তবে মধুমতী ওদের ‘আসুন, আসুন প্লিজ’ বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এটা কনফার্ম করে কানে তুলে নিলেন হেডফোন আর পেপারওয়ার্কে ডুবে গেলেন। মুখে যথারীতি কোনো-না-কোনো সুরে গুনগুনানি চলছে বলাই বাহুল্য।


ছয়

মধুমতী অত্যন্ত নম্রভাবে ও ভদ্রতার সঙ্গে ওদের ভেতরে ডাকলেন। তারপর কিছুটা কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “নীচের তলায় ভদ্রভাবে বসা যায় না, জিনিসপত্রে বোঝাই, তারচেয়ে বরং ওপরে চলুন।” বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। মোহনা বেশ অসহিষ্ণু হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাপস ওর হাত চেপে ধরে ইশারায় ওপরে যেতে বলাতে ওরা মধুমতীকে নিঃশব্দে অনুসরণ করল। মধুমতীর তা চোখ এড়াল না। দোতলার সিটিংরুমে মধুমতী ওদের নিয়ে এসে জোড়হাতে নমস্কার করে নিজের নাম জানিয়ে পরিচয় দেন তারপর বসতে অনুরোধ করেন। তাপস ঠিকঠাক প্রতি-নমস্কার জানালেও বাকিরা ভাবলেসহীন হয়ে দায়সারা গোছের প্রতি-নমস্কার জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে তাপস সোফার একপাশে বসে পড়েছে আর ঘরের ভেতরের সজ্জা দেখে বেশ অবাকও হয়ে গিয়েছে। ঘরের মাঝখানে বসবার জন্য সোফাসেট আর সেন্টার টেবল। ঘরের দক্ষিণদিকে দুটো বড়ো বড়ো জানলা আর পূর্বদিকে বারান্দায় যাওয়ার দরজা। অফুরন্ত আলো হাওয়া। আর উত্তর দিকের জানলা বন্ধ, সেখানে গোটাচারেক লাইব্রেরি সাইজের বুক-র‌্যাকে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে বই। তাপস মুগ্ধ হয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বোলায়। মধুমতী আবার স্মিত হেসে বলেন, “আপনারা বসুন-না প্লিজ। আমি চা আনছি।”

এবার মোহনা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই উষ্মা প্রকাশ করে বলল, “দরকার পড়বে না, আমরা এখানে চা খেতে বা খোশগল্প করতে আসিনি। একটা কাজে এসেছি, মিটে গেলেই চলে যাব।” তাপস আর বিপাশা মোহনার এই আচরণে চমকেই ওঠে তা নয়, রীতিমতো বিব্রত বোধ করে তাপস। বিপাশা যদিও বান্ধবীকে সঙ্গ দিতে ওর হাত চেপে ধরে। তারপর সোফায় এসে দুজনে বসে। 

অথচ মধুমতীর মুখে সেই হাসিটি আটকে আছে মৃদুকণ্ঠে বললেন, “আমরা দিন পাঁচেকের সদ্য বাসিন্দা আলাপ-পর্বের শুরুটা চা দিয়ে হলেই শুভ।” মধুমতী রান্নাঘরের দিকে চলে যান । 

তাপস একদৃষ্টিতে সামনের কোনো বস্তুর দিকে তাকায়। মুখের এক্সপ্রেশনে তা বোঝা যায়। তাপস সামনের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। 


বিপাশা ঘরের চারদিকে চোখ বোলায় ক্যাজুয়ালি। বিপাশার মুগ্ধ দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় ঘরকন্নার সাজসজ্জার ওপর। মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এমন রুচিশীল এবং পরিপাটি বাড়ির লোক অমন হীন মনের হতে পারে! 

 আসবাবপত্র, শো-পিস, দেওয়ালে ঝোলানো ছবি বা ওয়ালহ্যাঙিং ইত্যাদির কোনোটাই সাদামাটা নয়। রীতিমতো সংস্কৃতিবান পরিবারের প্রতিভূ এই বাড়ির বাসিন্দারা একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কি কোথাও ভুল হচ্ছে তাদের! আবার ভাবে এমন সাজানো তো পয়সা থাকলেই লোকদেখানো করে থাকে অনেকে। অথচ ভদ্রমহিলার কথা বলবার ধরন দেখে মনে হল উচ্চশিক্ষিতা আর রুচিসম্পন্ন মহিলা। অবিশ্যি ভদ্রলোক এখনও অগোচরেই আছেন। একবার মোহনার দিকে আড়চোখে দেখে নেয় বিপাশা। ও খরদৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে। বলা যেতে পারে কিছুই দেখছে না। বিপাশা দেখে তাপস খুব মন দিয়ে বুকসেলফে থরেথরে সাজানো বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। 

বেশিরভাগ বই উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত। কিছু আছে হার্ডবাউন্ড বই, থিসিস পেপার বলেই মনে হল তাপসের।

সেলফের পাশে লম্বা টেবল। সেখানে পাতা আছে কাচের বাক্সের মতো শোকেস আর তার ভেতরে আছে নানা রকম মেডেল। তাপস দেখতে থাকে সেসব। মেডেল সাজানো শোকেসের পাশেই হলুদ মলাটের পেপার ব্যাক বই। তাপস সেটা তুলে নিয়ে দেখতে থাকে। ভ্রূকুটি গভীর হয় তারপর মুখে ফুটে ওঠে হাসি। বইটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে সোফার দিকে এগিয়ে আসে।

 মধুমতী খুব নরম স্বরে বলেন, "এসব আমার হাজব্যান্ডের বইপত্র, আপনারা বসুননা প্লিজ।" 

মুখে মৃদু হাসি নিয়ে চার কাপ চা সমেত ট্রে

সেন্টার টেবলে রাখেন।তাপস বই হাতে সোফায় এসে বসে। বিপাশাও মোহনার পাশে গিয়ে বসে।

দিনের প্রায় মধ্যভাগে ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ঝড়ের আগে থমকে যাওয়া প্রকৃতির মতো। মধুমতীর মুখে সেই স্মিত হাসি বিস্ময়ে মাখা।                 

তাপস চায়ে হালকা করে চুমুক দিতে দিতে বইটা 

উলটে পালটে দেখতে থাকে ।

বিপাশা নিরবতা ভেঙে একটু গলা খাকারি দিয়ে মোহনাকে দেখিয়ে মধুমতীর উদ্দেশে বলল, "দেখুন আমার এই বান্ধবী মোহনা খুব একটা স্বস্তিতে নেই কাজেই চা আমরা খেতে আসিনি।"

মধুমতী: কেন, মানে স্বস্তিতে নেই কেন?

মোহনা: আপনার হাজব্যান্ড, বারান্দায় সবসময় যিনি থাকেন, উনিই তো…

মধুমতী: হ্যাঁ আমার স্বামী। কিন্তু কী হয়েছে?

বিপাশা: একজন মেয়ে হয়ে বুঝতে পারছেন না, সারাক্ষণ যদি একটা বাড়ির দিকে কোনো সমর্থ লোক তাকিয়ে বসে থাকে তবে সে বাড়ির মেয়ের পক্ষে কতটা অপমানজনক, অস্বস্তিকর তো বটেই।

মধুমতী: ইদানিং গানের ওপর ঝোঁকটা…মানুষটা গান ভালোবাসে। সারাদিন …


বিপাশা আর মোহনা একে অপরের দিকে তাকায়।

বিপাশা মধুমতীকে থামিয়ে বেশ ঝাঁঝালো স্বরেই বলে, "বারান্দায় পরের বাড়ির দিকে চোখ রেখে বসে থাকেন উনি।আপনি এটা সমর্থন করেন!শেম শেম!" 

মধুমতী কিছু বলতে যেতেই মোহনা আসরে নামে।

হুমকির সুরে সে বলে, "শুনুন এক সপ্তাহও হয়নি প্রতিবেশী হয়েছেন, পাড়ায় যদি বলি ফের তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।"

মধুমতী মাথা নীচু করে থাকেন, ফরসা মুখে লালচে আভা আড়াল করতেই বোধহয়। একটু পরে ধীরে ধীরে মাথা তোলেন, মুখে সেই স্মিত হাসি। তাপস বইএর পাতা ওল্টাতে থাকে। 

মধুমতী অনুচ্চ স্বরে বলেন, "উনি কোলকাতার একটা কলেজে বোটানির অধ্যাপক ছিলেন…"

মোহনা: ছিলেন, এখন আর নন?

মধুমতী: না, আসলে…

বিপাশা: সেখানেও কি কোনো ডার্টি গেম…

মধুমতী: প্লিজ শুনুন আগে, অপবাদ এখনই দেবেন না…

তাপস বই থেকে মুখ না তুলেই বন্ধুদের উদ্দেশে বলেন, "বোধহয় তোদের কোনো ভুল হচ্ছে, উনি কী বলতে চাইছেন শোন।" তারপর মধুমতীর দিকে ফিরে বলে, "আপনি বরং দাদাকে ডাকুন একবার।" 

মোহনা: ওঁর ওটাই প্রাপ্য…আর এই যে আপনি কোথায় লুকোলেন...

"মধু অতিথিদের চা দিয়েছ?" বারান্দা থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলেন সুলোচন।

বিপাশা ধরে ফেলেছি এইরকম একটা ভাব নিয়ে শ্লেষ মেশানো স্বরে বলল, "এইতো এবার খোলোস ছেড়ে সামনে আসুন তো, নাকি ফেস করতে দমে কুলোচ্ছে না!" 

মোহনা ঈষৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, "কী রে তাপস একেবারে বেকুব বনে গেলি দেখছি। প্রতিবাদ করতে এসে মিইয়ে গেলি যে, কিছু বলবার নেই তোর।"

তাপস বইটা পাশে রেখে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে স্মিত হেসে বলে, "বেকুব বনে যাওয়ার সময় পালাচ্ছে না। আপাতত আমি বেকুব বনে যাইনি এইটা তোদের হলপ করে বলতে পারি।"


সাত

বারান্দার দিকে খোলা দরজায় একটা ছায়া দেখা যায়। "চা খুব উপকারী জানেন। বন্ধু পাতাতে", সুলোচন কথা বলতে বলতে দরজার ফ্রেমের দুপাশে দুহাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ান, বাঁহাতে খাতার মতো কিছু ধরা আছে, "তর্কে-বিতর্কে মজলিশ বসাতে—যাকে বলে চায়ের কাপে তুফান।" কথাটা বলেই নিজের খুশিতেই হা হা করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক।            

মধুমতী দ্রুত উঠে যেতে যেতে বলেন, "হুট করে উঠে পড়লে যে!"

মধুমতী ভদ্রলোকের বাঁ-বাহু ধরে নিয়ে আসেন।

হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক বলতে থাকেন, "আরে পাঁচদিন তো ঢের, দুদিনে পর আপন হয় আর এ তো ঘর! হা হা… ইয়ে মধু সোফাটা যেন কোন্‌দিকে!"

মধুমতী সোফায় বসাতে বসাতে বলেন, "কেন এই তো বলছিলে পাঁচদিন ঢের…"                   

ভদ্রলোক সোফায় আরাম করে বসেন। হাতের খাতাপত্র পাশে রাখেন। তাপস একটু সরে জায়গা করে দিলে ভদ্রলোক বলেন, "আহা ঠিক আছে আপনি আরাম করে বসুন ভাই। তবে চা বোধহয় জুড়িয়ে জল। ভালোলাগবে না। মধু ওঁদের জন্য নতুন করে চা আর গরম কিছু…"

বিপাশা বিস্মিত এবং মোহনার চোখের জ্বলন্ত ক্রোধ নিমেষে জলধারার রূপ নিয়েছে ।


তাপস পাশে রাখা বইটা সোফা থেকে তুলে সেন্টার টেবলে রাখতে রাখতে বলে, "তোদের কিন্তু আগেই সতর্ক করেছিলাম কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ম্যাডাম, নতুন করে আর চা করতে হবে না।

তাপস একটা কাপ তুলে নেয়। ধীরে ধীরে ওরা দুজনও যন্ত্রের মতো দুটো কাপ তুলে নেয়। 

চা শেষ করে কাপটা টেবলে রেখে, টেবল থেকে তাপস বইটা তুলে মোহনার দিকে বাড়িয়ে দেয়। মোহনা বইটা হাতে নিয়ে কভারপেজ দেখে বুঝতে পারে সেটা ব্রেইল শেখার বই । বিপাশাও কেমন থমকে গিয়ে মোহনার সঙ্গে বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে যেন মুখ লুকোনোর এর থেকে ভালো উপায় এই মুহূর্তে আর নেই। মধুমতী খালি কাপ সমেত করলে নিয়ে উঠে যান। বেলা সাড়ে এগারোটায় অধ্যাপকের সিটিং রুমে নিরলস নিগূঢ় নীরবতা বিরাজ করছে। কেবল সিলিং ফ্যানের একটানা ঘ্যানঘ্যানে শব্দ প্রমাণ করে চলেছে এটা জীবন্ত মানুষের বসবাসের স্থান। নিস্তব্ধতা ভেঙে তাপস অধ্যাপকের উদ্দেশে বলে- এবার বলুন তো স্যার কীভাবে মানে আপনার …"

অধ্যাপক তাপসের কথা মাঝপথে থামিয়ে বলেন, "manchineel tree নাম শুনেছেন? ইউএসএ-র ফ্লোরিডা এবং আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। একটা গবেষণার প্রয়োজনে মেতে হয়েছিল। ছোট্ট একটা ভুলের জন্য গণ্ডগোল হয়ে গেল। বিষাক্ত এই ফুলগাছের রস ভুলক্রমে চোখে লেগে যায়। ফলস্বরূপ দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ চলে যায়।   

এখন কাজ বাড়ল, লুই ব্রেইলের তৈরি করা ভাষা শিখতে হচ্ছে। " 

মধুমতী ছবির বই নিয়ে আসেন। সেখানে নানা ধরনের গাছের ছবি, সেই ভয়ংকর গাছের ছবিটা দুপাতা জুড়ে দেখা যায়।  

বিপাশা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে অস্ফুটে বলে ওঠে, "চিকিৎসায় ঠিক হবে না !"

মধুমতী স্মিত হেসে বলেন, "সে চেষ্টা চলছে। দেখা যাক ঠাকুরের কী ইচ্ছা।"

তাপস বলে, "আর সংগীত চর্চা!"

অধ্যাপক বলেন, "গান বরাবরই ভালোবাসতাম, এখন তো অখণ্ড অবসর। কলেজ থেকে মেডিকেল লিভ নেওয়া আছে। একটু ধাতস্থ না হলে… আবার মধুও এখানকার একটা স্কুলে এডুকেশন পড়ায় তাই ঠিক করলাম এখানেই থেকে যাই।" 

অধ্যাপক এবার সুউচ্চ স্বর এবং সুললিত ভাষায় গল্পে ডুবে যান। সবসময় চোখ গাঢ় রোদচশমা দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে ভুল বোঝাবুঝি যে বেড়ে গিয়েছে একথা যেমন মানলেন, তেমনি জানালেন যেকোনো মাত্রার আলোক চোখে পড়লে তাঁর যন্ত্রণার কথা। তাঁর গবেষণার ধরন আর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে চলল রোমহর্ষক আলোচনা। সকলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বাধ্য ছাত্রছাত্রীর মতো ভাষণ শুনছে। এমনকি মধুমতীও।

মধুমতী এবার মোহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, "দেখুন মোহনা, সুলোচনের যেসব কথা আপনার অশ্লীল বলে মনে হয়েছে, সেসব আমার উদ্দেশে বলা। আমার সেটা খারাপ মনে হয়নি কারণ স্থান কাল আর পাত্র ভেদে কথার ভাব রস এবং অর্থ এর আমূল রদবদল ঘটে। এখন বারান্দাই ওর জগৎ । খোলা হাওয়া আর প্রকৃতির শব্দ ওঁর ভারাক্রান্ত মনটাকে সতেজ রাখে। খেয়াল করে দেখবেন আমাদের সকালের চা জলখাবার আর বিকেলের চা টিফিন সবই বারান্দায়। এমনকি ওঁর সঙ্গী গিটারটাও বারান্দায় এক কোনায় রাখা থাকে যাতে ইচ্ছে হলে বা একা একা লাগলে যন্ত্রটা বাজিয়ে আনন্দ পেতে পারেন। আসলে উনি লিখতে পারেন না এখন তাই ওঁর মনে গান বা কবিতা এলে আমিই খাতা-কলম হাতে বসে যাই। শুধু কবিতা কেন, অদ্ভুত কোনো ঘটনা কানে এলেও জোরে জোরেই আমাকে শোনান, এই দিন-দুই আগেই একটা সাপ ব্যঙ ধরেছিল তাদের শব্দ শুনে আমাকে লাইভ ঘটনার বিবরণ শোনাচ্ছিলেন। সেই বিবরণ অন্যকেউ শুনলে খারাপ অর্থ করতেই পারেন। আসলে চোখ এমনই একটা মূল্যবান অঙ্গ তার হঠাৎ হানি কেবল বেদনাদায়ক নয় মানসিক স্থিতিশীলতাও বিঘ্নিত হয় । আবার দুপুর-শেষে একজন ব্রেইল শিক্ষক আসেন, উনিও বারান্দায় বসতে পছন্দ করেন। উনি যে লেসনগুলো দিয়ে যান, সুলোচন সেসব প্র্যাকটিস করেন বারান্দায় বসে।"

মোহনা উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে অধ্যাপক সেনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর দু-হাত দিয়ে ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই সুলোচন কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করেন। মুখে বলেন, আহা! থাক থাক আপনার কী নাম?"

"আমাকে মার্জনা করতে পারবেন স্যার? আমি সামনের বাড়িতে থাকি, মোহনা। ক্ষমা চাইবার ভাষা নেই স্যার।" মোহনা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

অধ্যাপক সেন একটু হেসে বলেন, দেখুন ভুল হতেই পারে। তবে কিছু কিছু ভুলের মাসুল জীবন দিয়ে গুণতে হয়। সামান্য ভুল সিদ্ধান্তে যেমন অঙ্গহানি হয় যা আমার হয়েছে, তেমনি সম্পর্কও নষ্ট হয়, যা হতে যাচ্ছিল। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বড়োই পুণ্যের জানেন তো!"

 তাপস হাসি হাসি মুখে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব করে বলে, "স্যার আপনার গুনগুনিয়ে ওঠা তারানাটা আমরা কি ব্যবহার করতে পারি? আমাদের একটা শর্ট ফিলমের জন্য? আমরা ফিলম নিয়ে পড়াশোনা করি।"

অধ্যাপক বলেন, "বা! তোমরা সব ফিলম মেকিং এর ছাত্র? নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে," একটু রহস্য করে আবার বলেন, "তবে কেবল‌ আমার অনুমতিতে হবে কি! আমার সবকিছুই তো মধুর অনুমোদন সাপেক্ষে। ওর একটা মতামতের মর্যাদা না থাকলে কী করে হবে, মধু আমার লেখক, গান বা কবিতার প্রথম শ্রোতা, ঠিক ভুলের পরামর্শদাতা, তাই ওর অনুমতি নেওয়া আবশ্যক।" বলেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উচ্চৈস্বরে হেসে উঠলেন।  

মধুমতীর স্মিত হাসি মাখা মুখে এক প্রতিমাসুলভ ব্যক্তিত্ব অন্যদের মুগ্ধ করে রাখে। মুখে বলেন, "তোমাদের ছবির বিষয়টা কী?"

বিপাশা লজ্জাবনত মুখে বলে,"আমাদের ছবির বিষয়টাও ভুল বুঝে অসহায় মানুষকে আঘাত করা।"

মোহনা ধীরস্বরে মাথা নীচু করে বলে, "আমরাও সেই প্রমাদ গুণলাম প্র্যাক্টিক্যালি। মানুষকে বিচার করা সত্যিই কঠিন। কত সূক্ষ্ম বিচারবোধ আর অভিজ্ঞতা থাকা দরকার… "

 "আর সময়টা বললি না তো, একজন মানুষকে বুঝতে গেলে সময় দিতে হয় পরিবেশ আর প্রকৃতিকে বুঝতে হয়, নাহলে সবই বৃথা…আমাদের ছবির বিষয়টাও তো তাই।" তাপস মোহনার কথা কেড়ে নিয়ে বলে।

দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোখানা ঘণ্টা জানিয়ে দেয় মধ্যদুপুর আগত। ওরা সকলে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মেতে থাকে। এক ফালি জানলা গলে একটা নিখাদ নির্মেঘ নীলবর্ণের আকাশ ঘরে ঢুকে পড়ে। ঠিক যেমন ঝুল-বারান্দা থেকে অনুভূত হয়, তখন হয়তো অধ্যাপক সেন একরাশ প্রশান্তি নিয়ে সকালে রচনা করা গানটি সবার মধ্যে থেকেই গুনগুন করে গাইতে থাকেন। তা হয়তো কেউ শুনতে পেল কিংবা পেল না...

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment