1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

দিল্লী অন্তর্জাল রহস্য

দিল্লী অন্তর্জাল রহস্য
অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

সন্ধ্যা ৫ টার হাওড়া-নিউ দিল্লী রাজধানী এক্সপ্রেস নিউ দিল্লী রেল স্টেশনে এই ঢুকল। ট্রেনের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে নামল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের এক যুবক। হাতে একটি ছোট্ট ট্রলি ব্যাগ, পিঠে একটি ল্যাপটপ ব্যাক্-প্যাক্। পরণে ছিম্-ছাম্ টি-শার্ট, জ্যাকেট ও জিন্সের প্যান্ট। চোখে রঙীন রোদ-চশমা, মাথায় একটি নীল রঙের টুপি। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল সে।

একটু ফ্ল্যাশ্-ব্যাকে যাওয়া যাক। যুবকটির নাম সূর্য্য বোস। বাড়ি হেদুয়ায়। সাধারণ্যে পরিচিত বাংলা পত্রিকা ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির টুকি-টাকি’র অফিসে সে এক সামান্য চাকুরে। দিল্লীতে এসেছে এই ম্যাগাজিনের কভার থিমের জন্য। করোনা অতিমারীর সময় ভারতীয় জীববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থানের একটি ল্যাবরেটরী থেকে রোগের মহামূল্যবান প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন বাঙালী বিজ্ঞানী দূর্বাদল দে, ওরফে ডি.ডি. । তাঁরই সেই কালজয়ী আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটের উপর একটি আকর্ষণীয় কভার স্টোরি লিখবে সূর্য্য। 

যাইহোক, সেদিন জনবহুল নিউ দিল্লী রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে সে অ্যাপ্-ক্যাব্ বুক্ করে সোজা পৌঁছে গেল দক্ষিণ দিল্লীর জিয়া সরাই নামের একটি স্থানে। এই এলাকাটিতেই সেই জীববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থান। ভারতীয় রাজধানীর খুবই ব্যস্ত এই এলাকাটি স্বভাবতঃই একজন সাধারণ বাঙালীর বোধ-বুদ্ধি তালগোল পাকাতে পারে। সেই হাজারো অলি-গলির মধ্যে সূর্য্যরও দিক্-ভ্রম ঘটল। কোথায় কোন বাঁক নিতে হবে ভাবতে ভাবতে তার গন্তব্য গুলিয়ে গেল। তবে শেষপর্যন্ত একে-ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে পৌঁছে গেলো ‘ভিমানী প্রপারটিসের’ একটা ছোট অফিসে। এখানেই সে সস্তায় একটি ঘর, মাসখানেকের জন্য সংরক্ষিত করতে কোলকাতা থেকে যোগাযোগ করেছিল। অফিসে ঢুকেই আলাপ হল জনৈক জস্প্রীত ভিমানী, ওরফে জস্সির সঙ্গে। জস্সির কথামত তাকে গলির একপ্রান্তে সুন্দরলাল দোব্রিয়ালের বাড়ীর একটি ছোট্ট কামরা: রান্নাঘর ও চানঘর-সহ, সূর্য্যকে ভাড়া দেওয়া হল। যে ছেলেটি সূর্য্যকে সেই ভাড়াবাড়ীতে নিয়ে গেল, তার হাব্-ভাব্ ও কথাবার্তা রাস্তার বকাটে ছোঁড়ার মতো। অবশ্য সূর্য্য মনে মনে ঠিক করে এসেছিল যে, মাসখানেকের মধ্যে কাজ গুটিয়ে তাকে আবার ফিরতে হবে কোলকাতায়; তাই সেই সময়টুকুর জন্য এই থাকার জায়গাটা ও পারিপার্শ্বিক লোকজন নিয়ে বেশী মাথা ঘামাবার প্রয়োজন তার ছিল না। তাই সেই বকাটে ছোঁড়াটিকে যথাশীঘ্র সম্ভব বিদেয় করে, সে তার নতুন থাকবার জায়গাটির সবকিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে নিল। ঘরের একমাত্র জানালাটি খুলে নিচে উঁকি মারতেই, অদূরেই তার চোখে পড়ল সব্জী-মান্ডী ও আরো কাছাকাছিতে একটি মাংসের দোকান। মনে মনে তক্ষুনি তার মনে ভাবনার উদয় হল: সপ্তাহান্তে কষা মাংস আর পোলাও রাঁধবে; আর এটা রাঁধায় সে তার স্ত্রী মৈত্রেয়ীর থেকেও বেশী পারদর্শী।

যাইহোক, এরপর যখন সে ঘরের সব জিনিসপত্র মনোমতো জায়গায় গুছিয়ে রাখছে, ঠিক সেই সময় তার দরজায় খুব জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। সে দ্রুত দরজা খুলে খানিক অপ্রস্তুতের মধ্যে পড়ল। কারণ দরজায় দাঁড়িয়ে বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের এক ভদ্রলোক ও তাঁর  সঙ্গে এক ভিখিরীগোছের বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের যুবক। 

ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, "নমস্তে বাঙ্গালী বাবু! ম্যায় সুন্দরলাল দোব্রিয়াল। ইঁহাকা মোকান-মালিক।” 

তখন সূর্য্য কোনক্রমে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, "ও! নমস্তে- সব খ্যারিয়ত?" 

সুন্দরলাল বললেন, "হাঁ বিলকুল! আপ থোরা থকে হুয়ে হ্যায়। আরাম কিজিয়ে।" 

তারপর সঙ্গে থাকা সেই যুবককে দেখিয়ে বললেন, “ইয়ে ইস্ বিল্ডিং কা কেয়ারটেকার কাম্ ঝাড়ুদার: ছত্রধর পাল। কুছই দিন পেহলে ইধর আয়া হ্যায়। বহুত দুঃখী আদমি হ্যায়, ইসি লিয়ে ম্যায়নে ইসে কামপে রাখ লিয়া। অগর কিসি চিসকা জরুরত হো, তো ইসে বোলনা।" 

এরপর সুন্দরলাল ও তাঁর সহচর দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। অবশ্য প্রথম সাক্ষাতে বাড়ীওয়ালার কথাবার্তার ধরণ সূর্য্যকে খুশী করতে পারল না। সূর্য্য আবার ভাবল এই অল্প কয়দিনের জন্য বাড়ীতে কাজকর্মের লোক রাখার আবশ্যকতা নেই। 

পরের দিন সকালে সূর্য্য যথারীতি হাঁটা দিল ভারতীয় জীববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থানের উদ্দেশ্যে। গুগল ম্যাপ্স দেখতে দেখতে অলিগলি পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেল এবং তারপর যাবতীয় সিকিউরিটি চেকিং করিয়ে স্বনামধন্য প্রফেসর দূর্বাদল দে, ওরফে ডি.ডি. -র অফিসে তার সমাগম৷ ইতিপূর্বেই ইমেলের মাধ্যমে সে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ স্থির করেছিল। সূর্য্যর সময়ানুবর্তিতা দেখে প্রফেসর খুব আনন্দিত হলেন এবং সূর্য্যকে তাঁর করোনা অতিমারীর টিকা উদ্ভাবনের কাহিনী সংক্ষিপ্তাকারে বললেন। সূর্য্যও সমস্ত তথ্যাদি তার ছোট নোটবুকটিতে লিখে ফেলল। 

এরপর ডি.ডি. ওখানকার ডিরেক্টরকে বলে সেখানে আসা যাওয়ার মাস-খানেকের পাস্ সূর্য্যর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "আপনার স্টোরিটা যত সুদূরপ্রসারী হবে, ততই আমার ল্যাবরেটরীর ও গবেষণার পক্ষে শুভ।" 

সূর্য্য সঙ্গে সঙ্গে হালকা ঘাড় নাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ! আমি সেই চেষ্টাই করব।"

তারপর কাজ মিটিয়ে সন্ধ্যানাগাদ সূর্য্য ফিরে এল তার জিয়া সরাইয়ের আস্তানায় ৷ একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর যেই তার চোখের দুইপাতা এক হতে যাবে, আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই একটা লোক লাফিয়ে ঝাড়ু নিয়ে তার ঘরে ঢুকে গেল। সূর্য্য বুঝতে পারল, এ সেই ছত্রধর পাল: গতকাল সকালে বাড়ীওয়ালা যাকে সঙ্গে করে তার কাছে নিয়ে এসেছিলেন । তার এই অসময় আগমনে সূর্য্য ভয়ানক বিরক্ত হলেও ছত্রধরের চোখের দিকে চেয়ে তার একটু মায়া হল অবিশ্যি। 

ছত্রধর বলল, "ক্যায়সে হো মেরে ভাই। ম্যায় তুমাহরা রুম সাফ্ করুঙ্গা; হপ্তে মে একবার, শ’ রুপাইয়া লুঙ্গা।" সূর্য্য কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানাল, "ও.কে. ঠিক হ্যায়।”

যাইহোক এভাবে কিছুদিন চলল বেশ। সূর্য্যও তার কভার স্টোরির কাজ বেশ কিছুটা এগিয়ে ফেলল। একদিন সে প্রফেসর ডি.ডি.-কে অনুরোধ জানাল "স্যার! পাশের ল্যাবরেটরির প্রফেসর গণপতি রমনের সঙ্গে সাক্ষাতের খুবই ইচ্ছা। তিনি কতিপয় জীবনদায়ী ড্রাগ তৈরীর জন্য দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন।" 

শুনে প্রফেসর ডি.ডি. খানিকটা ইতস্তত: করে ঢোঁক গিলে বললেন, "হ্যাঁ! নো ডাউট গণপতি ইস্ এ গ্রেট সায়েনটিস্ট। কিন্তু বর্তমানে ওর ল্যাবে কিছু প্রবলেম হয়েছিল। বেশ কিছু পেপার ফেরৎ নিতে হয়েছে; ভুয়ো ডেটা ছিল বলে।" তবে সূর্য্যকে তিনি আশ্বস্ত করলেন, অবশ্যই গণপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করাবেন। 

খুব শীঘ্রই সূর্য্যর সঙ্গে প্রফেসর গণপতি রমনের মোলাকাৎ হল। প্রাথমিক কথাবার্তার প্রেক্ষিতে সূর্য্যর ভদ্রলোককে নিতান্তই রগচটা বলে মনে হল। তিনি সূর্য্যকে বলতে থাকলেন, "আরে ভাই! আমরা কিছুই নয়। থিঙ্ক অ্যাবাউট প্রফেসর এ.স. রয়। ওঁর কাজের কাছে আমার কাজ কিছুই নয়। পেপারস অর অ্যাকোলেডস মিন নাথিং।" সূর্য্য এরই মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে ল্যাবরেটরীর এপাশ ওপাশ দেখে নিতে থাকল। এবার হঠাৎ আগমন ঘটল মাথায় পাগড়ি-পরিহিত দীর্ঘকায় এক শিখ যুবকের। 

তাকে দেখামাত্রই প্রফেসর খানিকটা জোরগলায় বলে উঠলেন, "ওয়ে হানি! ইয়ে ভাইসাব্ কো থোরা ল্যাব ঘুমাও।" হানি সিংয়ের উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছফুটের কাছাকছি হলেও গলার আওয়াজটা একেবারে চাপা। সে সূর্য্যকে ল্যাবের যন্ত্রাদি ঘুরিয়ে দেখাতে থাকল। কিন্তু এই ল্যাব পরিদর্শনের মধ্যেই সূর্য্যের চোখে পড়ল কিছু জিনিস, যার জন্যই সে আসলে দিল্লী এসেছে। সে আদতে যে কে, তা কিন্তু ক্রমশঃ প্রকাশ্য ৷

সেদিন যে সূর্য্যর চোখে ঠিক কী পড়েছিল এবং তার জন্য সে পরের কয়েকদিন কেন খুবই রাত্রি পর্যন্ত জীববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থানে থাকতে লাগল, তা একটা রহস্যের উদ্রেক করে নিশ্চয়ই ৷ এরকমই একদিন সূর্য্য লক্ষ্য করল, বিজ্ঞান সংস্থানের অন্য সব ল্যাবরেটরীর আলো নিভে গেলেও প্রফেসর রমনের ল্যাবে তখনও খুব মৃদু একটি আলোর দিশা পাওয়া যাচ্ছিল। রাত্রি দেড়টার সময় কে বা কারা তখনও কাজ করছিল? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আশায় সে কাছাকাছি একটা অন্ধকার জায়গায় ঘাপটি মেরেছিল। সে দেখল কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ল্যাব থেকে খুব দ্রুত এক দীর্ঘকায় যুবক বেরিয়ে গেল। তার হাতে একটি মাঝারি হ্যান্ডব্যাগ, কিন্তু মুখে কম্বল জড়ানো। অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সূর্য্য তার পিছু নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনের লোকটি সেটি বুঝতে পেরে সে তার চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। লোকটি ভবনের সিসিটিভি-বিহীন স্থানগুলো দিয়ে সর্পিলগতিতে চলতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজ্ঞান সংস্থানের পিছনের দিকের ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে সূর্য্যর দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যেতে থাকল। সূর্য্যও ইতিমধ্যে তার চলার গতি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সে এবার দৌড়তে শুরু করল ৷ তার কোমরের কাছ থেকে বের করে নিল তার স্প্রিংফিল্ড আরমরি অপেরটর বন্দূকটি। হ্যাঁ! এতক্ষনে হয়তো পাঠক বুঝেছেন যে, সে আর কেউই নয়: লালবাজার পুলিশের  অ্যান্টি-নার্কোটিক্স বিভাগের  আন্ডারকভার এজেন্ট। দিল্লীতে ড্রাগচক্রের মাথাকে ধরাই তার আসার আসল উদ্দেশ্য। যাইহোক, পলাতক ব্যক্তিটি তখন ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে ঢুকে পড়েছে জিয়া সরাইয়ের সেই জিলিপির প্যাঁচের মতো বিভ্রান্তিকর অলিগলিগুলোতে। এরকমই একটা বাঁকে এসে সূর্য্য লোকটিকে হারিয়ে ফেলল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কেউ একটা অতর্কিতে পিছন থেকে এসে তার মাথায় সজোরে বাড়ি মারল। সূর্য্য বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল ও তার হাতের বন্দূকটি ছিটকে গেল।

এরপর যখন সূর্য্যর হুঁশ ফিরল, তখন সে অজানা গোপন এক ডেরায়। সে দ্রুত উঠে পড়ল এবং বুঝতে পারল তার মাথায় আঘাত লাগার পর তার শুশ্রুষা করে মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে৷ সেই বড় হলঘরটির এককোণে কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে। বোধহয় মাছভাজা হবে। বুঝতে পারল সেই ঘরের অধিবাসী আশেপাশেই রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আবির্ভাব ৷ কিন্তু একী? এ তো দাঁড়িগোঁফহীন ছত্রধর পাল। সূর্য্য চমকে উঠল। 

ছত্রধর একগাল হেসে বলল, "হ্যালো সূর্য্যবাবু! আমি এজেন্ট শিবাজী চট্টোপাধ্যায়। তোমার মিশনে সহকারী হিসাবে আমাকে লালবাজার থেকে পাঠানো হয়েছে। কাল তোমার কাছাকাছি আমিই ছিলাম। তোমার ওপর অতর্কিতে হামলা করল ওই লোকটা…..আমিই তারপর তোমাকে বাঁচিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। এই নাও তোমার আগ্নেয়াস্ত্র, পরে কাজে লাগবে। বল, এখন কী চা খাবে?" 

সূর্য্য মুচকি হেসে বলল, "হাঁ! ম্যায় চায় পিউঙ্গা।" তারপর দুজন একসাথে উচ্চৈস্বরে হেসে উঠল।

সূর্য্য ও শিবাজী শলা পরামর্শ করে নিল এরপরে তাদের পরিকল্পনা কী হতে চলেছে। তারা এখন এক নয় দুই, দলে ভারী হয়েছে। সূর্য্য গতকাল রাত্রির ঘটনার সময় লক্ষ্য করেছিল একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ৷ যে লোকটির সে পিছু নিয়েছিল তার হাঁটার ভঙ্গী ও পায়ের জুতোটা বড়ই অদ্ভুত। সহজভাবে বলতে গেলে একজন মাঝারি উচ্চতার ব্যক্তি যেন পায়ে রণপা লাগিয়ে চম্পট দিচ্ছে। ব্যাপরটা রীতিমতো গোলমেলে মনে হলেও, সূর্য্যর সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হল, যখন সে তার মাথার চোট সারিয়ে জিয়া সরাইয়ের ভাড়াবাড়ীতে দুদিন পর ফিরে গেল। ফেরার পথে জস্প্রীত ওরফে জস্সির সঙ্গে দেখা। 

জস্সি কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে বলল, "ক্যায়া বাঙ্গালী বাবু! কহিঁ গ্যায়েথে ক্যায়া? দো-তিন দিন সে দেখা নেহি আপকো!" 

সূর্য্য বলল, "হাঁ কুছ কাম থা।” 

এর মধ্যেই সূর্য্যর চোখ গিয়ে পড়ল হঠাৎ জস্সির পায়ের দিকে৷ সে এবার নিশ্চিত হল। কারণ জস্সির পায়ে কোনো কিছু চেপে বাঁধার দাগ। তার বুঝতে বাকী রইল না এই জস্সি বাবাজীই সেদিন রাত্রে প্রফেসর গণপতি রমনের ল্যাবরেটরী থেকে মুখে কম্বল চাপা দিয়ে বের হয়েছিল এবং তাকেই সে ধাওয়া করেছিল। পায়ে এক বিশেষ জুতোর মধ্যে সাপোর্ট দিয়ে সে তার মাঝারি উচ্চতাকে বাড়িয়ে সাড়ে ছ-ফিট উচ্চতার অতিকায় দানবে পরিণত হয়েছিল সেদিন রাত্রে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সূর্য্য প্রথমদিন গণপতি রমনের ল্যাবে কিছু লেবেলহীন যৌগ সঞ্চিত দেখেছিল; তখনই তার কাছে প্রাথমিক তদন্তের যে সূত্র ছিল তা প্রতিপন্ন হয়। সেগুলো হল কতগুলো নিষিদ্ধ যৌগ, যা ঐ ল্যাবে বানানো হয়। ঐ নিষিদ্ধ ড্রাগগুলি নিয়েই আন্তর্জাতিক তথা দেশীয় বাজারে ছড়িয়ে দেয় জস্সি। তাই তাকে এবং প্রফেসর গণপতি রমনকে হাতেনাতে প্রমাণসহ ধরতে পারলেই এই কেসের একটা সুরাহা সূর্য্য করতে পারবে ৷

এবার গল্পের ক্লাইম্যাক্স। পরের দিন সকালে গণপতি রমন ও তাঁর সহযোগী জস্সির পর্দাফাঁস করার উদ্দেশ্যে সূর্য্য সবরকম প্রস্তুতি নিল। শিবাজীবাবুকে বলে দিল, উনি যেন হউজ খাস থানার ও. সি. ও তাঁর  পুলিশবাহিনীকে নিয়ে খুবই সন্তর্পণে কাছাকাছি একটা কিউবিকলে প্রতীক্ষা করেন তার ইশারার। এরপর সে তার সেই স্বাভাবিক পোশাক-আশাক পরে ম্যাগজিনের কভার স্টোরির লেখক সূর্য্য হিসেবে ঢুকল জীববিজ্ঞান গবেষণা সংস্থানে। তবে এবার তার গতিপথ পরিবর্তন করে সোজা গিয়ে উপস্থিত হল প্রফেসর গণপতি রমনের অফিসে। প্রফেসর রমন তাকে দেখে একটু হতচকিত হলেও ভেতর আসতে বললেন। সূর্য্য বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে সোজা উপস্থিত হল ল্যাবরেটরীর সেই প্রান্তে, যেখানে নিষিদ্ধ যৌগগুলি সে আগে দেখেছিল। স্বভাবত:ই সেইগুলি ইতিমধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে ঐ স্থানে সে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারল, এ কিসের আঘ্রাণ? 

প্রফেসর বিচলিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, "হোয়াট…হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?” 

সূর্য্যর চোখটা জ্বলে উঠল, সে বলল, “আই অ্যাম ডুয়িং মাই জব। আই আ্যম ইন সার্চ অফ সাম প্রহিবিটেড ড্রাগ্স কেপ্ট ইন দিস ল্যাবরেটরী।" 

প্রফেসর এতে রীতিমতো উৎকণ্ঠিত হয়ে হানির নাম ধরে বারবার ডাকাডাকি শুরু করলেন। হানি ল্যাবের অন্য এক প্রান্ত থেকে দ্রুতগতিতে এসে সূর্য্যের উপর রাসায়নিক চামচ নিয়ে হামলা করতে গেল। সূর্য্য বিদ্যুৎগতিতে নিজের শরীরকে স্প্রিংয়ের মতো বেঁকিয়ে নিয়ে মার্বেলের মেঝেতে হড়কে গিয়ে সোজা হানির পায়ের গোড়ালিতে পদাঘাত করল; এতে হানি চিৎ হয়ে পড়ল ও তার পায়ের রহস্যময় জুতো ও বিশেষ সাপোর্ট তার দীর্ঘকায় শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল। সূর্য্য এবার বেশ জোরে সিটি মারায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শিবাজী বাবু পাশের কিউবিকল থেকে ও.সি. ও পুলিশসহ সেখানে দৌড়ে উপস্থিত হলেন। প্রফেসর গণপতি রমন ও জস্সি, ওরফে হানি, ওরফে জসপ্রীত ভিমানীকে গ্রেপ্তার করা গেল। এরপর সূর্য্য প্রচন্ড রাগের সঙ্গে জস্সি বাবাজীর দাড়ি-গোঁফ ও পাগড়ি টেনে খুলতে গেলে জস্সি ব্যথার্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। শিবাজীবাবু এসে তাকে সপাটে এক চড় মেরে চুপ করালেন। প্রফেসর গণপতি এসব দেখে একেবারে থ’ হয়ে গেছিলেন ৷ 

এবার কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলে উঠলেন, “বিশ্বাস করুন এসবের আমি একবর্ণও জানি না। এটা পুরোপুরি হানির কুকর্ম, আমি এসবের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়।" 

সূর্য্য বলল, “সে বিচার নয় আদালতে হবে। তবে এই সব বড় বড় সিন্থেসিসের পরিকল্পনা যে আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত, তা একজন শিশুও বলতে পারে।" 

এরপর ও.সি. সাহেব সূর্য্য ও শিবাজীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, "আপনারা যে কোলকাতার সূত্র ধরে দিল্লীতে এই ড্রাগপাচার চক্রের মাথাকে হাতেনাতে ধরলেন, এটার জন্য আপনারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সম্মান ও পুরস্কার অবশ্যই পাবেন বইকি।" 

সূর্য্য শুনে হেসে বিনীতভাবে বলল, "আরে না না। আপততঃ আমাদের কাজ কোলকাতায় ফিরে গিয়ে লালবাজারে কেস সমাপ্তির রিপোর্ট পেশ করা। ও.কে. চললাম, গুড বাই স্যার।" পুলিশ গণপতি ও জস্সিকে টানতে টানতে সংস্থানের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেল আর গোটা বিজ্ঞান সংস্থানের আপামর জনতা তাদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপে ভর্ৎসনা জানাল৷

সূর্য্যর মিশন সাফল্যমন্ডিত হল। বড় আন্তর্জাতিক ড্রাগ-চক্রের পর্দাফাঁস হল তার ও শিবাজী বাবুর পারদর্শিতায়৷ সূর্য্য আবার সেই নিউ দিল্লী-হাওড়া রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে বাড়ী ফিরে গেল। বাড়ী ফিরতেই স্ত্রী মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করল, “কী তোমার ম্যাগাজিনের কভার স্টোরি হল?" 

সূর্য্য মৃদু হেসে বলল, "হ্যাঁ। তথ্যসংগ্রহ সব হয়ে গেছে। এবার শুধু লিখে ফেলতে হবে।" 

তারপর ট্রেনযাত্রার ধকল কাটিয়ে তরতাজা হয়ে সূর্য্য তার স্ত্রীকে সঙ্গে করে মধ্যাহ্ন-ভোজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল: আজ তাদের মেনুতে রয়েছে কষা মাংস আর পোলাও৷

...(সমাপ্ত)...

1 comment:

  1. Listen to the read out of the above story in my YouTube Channel in the following link:
    https://www.youtube.com/watch?v=ukidFKpvvZk&t=14s

    ReplyDelete