1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

চিকিৎসকের রোজনামচা (১) : অমানিশার অমানুষ


 

অমানিশার অমানুষ

ডাঃ সৌভিক ব্যানার্জী

ল্পটা শুরু করার আগে নিজের একটা ভূমিকা না দিলে রোজনামচার বিশেষত্বটা ঠিক বোঝানো যাবে না। হয়তো অনেকেই বুঝেছেন আমার জীবিকাটা ঠিক কি। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। পেশার তাগিদে আমায় সারাদিন অসংখ্য মানুষের ও তাদের জীবনের সাথে ওঠাবসা করতে হয়। তাদের জীবনের না পাওয়ার গল্প, সুখ দুঃখের গল্পের অংশীদার হতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু গল্প মনে দাগ কেটে যায়, মাঝে মাঝে চমকেও উঠি। তাই ভাবলাম সেই গল্পগুলো আপনাদেরকেও শোনাই। তবে বলাই বাহুল্য গল্পকারের পরিচয় সঠিক হলেও গল্পের স্থান কাল পাত্র কিন্তু পরিবর্তিত থাকবে। সেটা কিন্তু আমার পেশাগত কারণেই কারণ ডাক্তারি পাশ করার সময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে সকল রোগীদের পরিচয় গোপন রাখবো। তাই সুরার পাত্রে লিকার চা ঢেলে গল্প শোনানোর পালা শুরু করলাম।

চেম্বারে আসার সময় যথারীতি স্কুটার টা স্টার্ট নিচ্ছিলো না। সেল্ফ মেরে মেরে হতোদ্যম হয়ে শেষমেশ কিক দিয়ে স্টার্ট হলো আমার পক্ষীরাজ।  আজ চেম্বার সেরে ফেরার পথে একবার গ্যারেজে যেতেই হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যেতেই দেখি বাপরে বাপ বাজারে কি ভিড়। আর যতো ভিড় ওই ফলের দোকানে। কি ব্যাপার! আমার মা ও দেখি ফলের দোকানে। আমায় দেখেই হঠাৎ হাত টা বাড়ালো। " দশটা টাকা দে তো, খুচরো ফুরিয়ে গেছে।" তারপর ফলওয়ালার দিকে তাকিয়ে "ওরে আমার ফলগুলো অন্যদের সাথে মেশাস না।" সে না হয় দিচ্ছি কিন্তু ফল মিষ্টি কেনার আয়োজন টা কেন সেটাই বুঝছিনা। যাই হোক মানিব্যাগ খুলে টাকাটা বের করতে না করতেই ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে "স্যার তাড়াতাড়ি আসুন, অনেকগুলো জমে গেছে, চেল্লামেল্লি করছে।" আসছি বলে ফোনটা কেটে স্কুটার স্টার্ট দিলাম।

চেম্বারে ঢুকে এসিটা চালিয়ে মিঠুন কে বললাম "হ্যাঁ রে এসিটাও চালিয়ে রাখিস নি। এক এক করে রোগী পাঠা।" যা: মা কে জিজ্ঞেসই করা হলোনা যে আজকের আয়োজন টা কেন। যাক গে বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে নেব। "ডাক্তার বাবু আসতে পারি"... রোজকার মতো চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করলাম। প্রায় দুঘন্টা পরে মনটা হঠাৎ চা চা করে উঠলো। মিঠুনকে চা আনতে পাঠাই, "এই নে টাকা, সবার জন্য চা নিয়ে আয়, আর আমার টায় চিনি ছাড়া"। মিঠুন চা নিয়ে আসার পর চা খেতে খেতে মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ টা খুললাম। বন্ধুদের গ্রুপে একটা পোস্ট করতে যাবো এমন সময় মিঠুন ঘরে ঢুকে এলো, " স্যার একটা হোমকল আছে, কি বলবো?" চা খেতে খেতে আড় চোখে তাকালাম, "কি হয়েছে কিছু জানিয়েছেন?" "না স্যার, বাড়ির লোককে পাঠিয়ে দিই ভেতরে আপনি কথা বলে নিন" সম্মতি পেয়ে মিঠুন চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি আমার চেয়ার ঘুরিয়ে বসলাম। দেখেছেন কথা বলতে বলতে মিঠুনের পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। মিঠুন আমার অ্যাসিসটেন্ট, আমার সব পেশেন্টদের নাম লেখা থেকে শুরু করে খোঁজ খবর নেওয়া সব কাজই করে। আর রোগীর পরিবারও ওকে বেশ পছন্দ করে। "ভিতরে আসতে পারি" খুব ভারী গলায় একজন পুরুষ কন্ঠস্বর।

সাদা পাঞ্জাবী পাজামা পরা লম্বা একজন ভদ্রলোক, কপালে লম্বা লাল তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষমালা, হাতে অনেকগুলো লাল সুতা, একমুখ দাড়ি, মাথায় ঝাকড়া চুলের বাহার মানে একজন সাধক পুরুষ বলতে যেরকম টা বোঝায় ঠিক সেরকম। আমি আসতে বলায় উনি চেম্বারের ভিতর এসে একটা চেয়ার টেনে আমার টেবিলে হাত রেখে শিরদাঁড়া সোজা করে আমার চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করলেন, "আমার মা খুব অসুস্থ ডাক্তারবাবু। আপনাকে একবার দেখতে যেতে হবে। চেম্বারে নিয়ে আসার মতো পরিস্থিতি নেই।" পরিস্থিতিটা কতোটা জটিল সেটা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও একটা আন্দাজ করতে পারছি। "আপনার মায়ের বয়স কতো?" আমি একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন "এই ধরে নিন আসির উপরে। সঠিক বয়সটা আমি সত্যি বলতে কি জানিনা।" বুঝলাম, এখন বাইরে আর কয়েকজন রোগী বসে আছেন তাই উনাকে বললাম "চেম্বার শেষ করে যাচ্ছি। আপনি ঠিকানা টা লিখে দিয়ে যান মিঠুনের কাছে সাথে আপনার ফোন নাম্বারটা।" ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন "অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আমি ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে যাচ্ছি, আপনি শুধু আসার আগে একটু জানিয়ে দেবেন যে আপনি আসছেন। আমি নিচে নেমে আসবো। আমার বাড়ি হেমন্ত মিষ্টির দোকানের গলিতে।" আমি হেমন্ত মিষ্টির দোকানটা আগে থেকেই চিনতাম। ওখানকার জলভরা তালশাঁস,,,  উমমম, ভাবলেই জিভে জল আসে। "হেমন্ত মিষ্টির দোকান মানে কি বরানগরের হেমন্ত সুইটস?" ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করাতেই উনি সম্মতিসূচক হাসি দিলেন। "আমি চলে যাবো, নিশ্চিন্ত হয়ে যান। জায়গাটা আমার চেনা, শুধু আপনার ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে যান, আমি ওখানে গিয়ে ফোন করে দেব। আপনি নিচে নেমে আসবেন তখন।" ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। আর আমি আবার বাকি রোগীদের চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

চেম্বার শেষ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমি চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম আর মিঠুন সাইকেল নিয়ে আমায় টাটা করে চলে গেলো ওর বাড়ির দিকে। আমি স্কুটার টা নিয়ে ঘুরে গেলাম বরানগরের দিকে, গন্তব্য হেমন্ত সুইটস। নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে ফোন করলাম ভদ্রলোককে। "ডাক্তারবাবু এগিয়ে আসুন সোজা। দেখুন মায়ের মন্দিরের উল্টোদিকের বাড়িটা।" আমি একটু সামনের দিকে এগিয়ে এলাম। দেখলাম এক বড়ো মন্দির আর তার ভিতরে শ্মশানকালী। মন্দিরে অসম্ভব ভিড় আর তার সামনে অজস্র মানুষ কেউ ধূপ হাতে বা কেউ মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। লাল জবায় মোড়া পুরো মন্দির প্রাংগন আর চারিদিকে ধূপের ধোঁয়া। অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ। "ডাক্তারবাবু এদিকে আসুন, উপরে তাকান,, এই যে। একতলায়।" উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখি এক বিশাল দালানবাড়ী। আমি স্কুটারটা ভিতরে ঢুকিয়ে দাঁড় করালাম। চেম্বারের ব্যাগটা নিয়ে উঠলাম উপরে। "ডাক্তারবাবু এই যে এদিকে আসুন।" আমি সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে  বেঁকে গেলাম। একটা পুরোনো দিনের বাড়ি, বিশাল দালান, জানালায় খিড়কি আর বিশাল উঁচু উঁচু ঘর, কড়িকাঠের ছাদ। একটা বড় ঘরে একটা পালংক আর তাতে একজন শীর্ণকায় বয়স্ক মহিলা শুয়ে আছেন, পাশে অক্সিজেনের সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিন, একজন সিস্টার আমায় দাঁড়িয়ে উঠে সম্মান জানিয়ে বললেন "আসুন স্যার।" আমি এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসলাম পালংকের যেখানে রোগী শুয়ে আছেন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক বলে উঠলেন "আমার মা শয্যাশায়ী দীর্ঘ তিন বছর। মাথায় রক্ত জমে গেছিলো। ডাক্তারবাবুরা তখন বলেছিলেন আর বেশিদিন নয় কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় এখনো আছেন উনি। রোজ মৃত্যুঞ্জয়ী জবা মাথায় ঠেকানো হয়। এই কয়েক দিন হলো খুব জ্বর। আজ কৌশিকী অমাবস্যা। মন্দিরে পূজাপাঠ করবো কিন্তু মায়ের শরীরের যা অবস্থা এখনো নামতে পারিনি।" মাসিমার শীর্ণকায় শরীর, নাকে অক্সিজেনের নল এবং খাবার যাওয়ার রাইলস টিউব, ক্যাথেটার করা আছে প্রস্রাবের জন্য যাতে প্রস্রাব জমে নাই আর চেতনা নাই বললেই চলে, চোখ বোজা শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা লক্ষ্যণীয় পাঁজরে। আমি আমার সবরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভদ্রলোককে বললাম "অসুখ টা কিন্তু গুরুতর। ব্লাড প্রেসার খুব কম, পালস্ খুব স্লো, দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ৭০%, গায়ে অসম্ভব তাপ। ডাক্তারী ভাষায় আমরা বলি উনার সেপ্টিসিমিয়া হচ্ছে যেটার কারণ কোনোখানে লুকানো একটা ইনফেকশন। " ভদ্রলোক সবটা খুব মন দিয়ে শুনলেন। তারপর খুব চিন্তাস্বরে আমায় বললেন "তাহলে কি করা যায় বলুন তো।" আমি উনাকে মাসিমাকে হসপিটালে ভর্তির পরামর্শ দিলাম। উনি হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বললেন "হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে সেটা কোনো অসুবিধের নয় কিন্তু আজ রাত্রে তো কোনোভাবেই সেটা সম্ভব না। আজ কৌশিকী অমাবস্যা, মাকালীর পূজা ছেড়ে দিয়ে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। আগামীকাল সকাল ১১টায় অমাবস্যা ছেড়ে যাবে। তারপর মা কে ভর্তি করা যাবে।" এই বক্তব্য শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলাম রোগীর দিকে। আমার স্যার আমায় বলতেন অচৈতন্য রোগীর যন্ত্রণা অনুভব করে চিকিৎসা করবে। আমি রোগীর যন্ত্রণার আগে রোগীর পরিবারের মানসিকতা দেখে খুব যন্ত্রণাক্লিষ্ট। হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর আমি বললাম "আপনি বুঝতে পারছেন না দাদা, মাসিমাতো আজ থেকে নয় বহূদিন ধরে রোগে শয্যাশায়ী। কিন্তু আপনি আজ আমায় ডাকলেন কেন, কারণ আপনিও জানেন মাসিমার হালটা রোজকার দিনের মতো নয়। সকাল থেকে প্রস্রাব হয়নি, অক্সিজেন কমে গেছে, প্রেসার পালস্ দুটোই কম, উনার শারীরিক হালটা ক্রমশ খারাপতর হতে লেগেছে। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন বাড়ি কখনওই হাসপাতালে রূপান্তরিত হতে পারে না। উনার আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য দরকার এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি।" ভদ্রলোক আবারও চুপ, যাক আমি আস্বস্ত হলাম যে উনি হয়ত বুঝতে পেরেছেন। চিকিৎসার সঠিক দিশায় এবার মাসিমাকে আনা যাবে। কিন্তু ঠিক তখনই আমায় ভদ্রলোক বললেন "কি মনে হচ্ছে, কাল সকাল ১১টা পর্যন্ত টানা যাবে? অমাবস্যা চলাকালীন আমি মা কে ভর্তিও করাবো না আর গায়ে ছুঁচও ফোটাতে দেবো না। তাতে যদি উনি মারাও যান তাতেও কোনো দু:খ নেই। যদি মায়ের আত্মা উঠতেই হয় অমাবস্যার রাত্রে তাহলে আমার বাড়ি থেকেই উঠুক, জয় মা,,, মা গো।"

কাল অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছি। হোম কল টা করে সোজা চলে গেছিলাম কুটিঘাটে। এক কাপ চা নিয়ে গঙ্গা  নদীর দিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিলাম। আমার পাশে একটা কালো কুকুর বিস্কুট খাওয়ার লোভে লেজ নাড়িয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। অমাবস্যার রাত্রি আর যাই হোক কুকুরের খিদে মেটাতে পারেনি। শুধু মানুষের মনের ভিতর কুসংস্কার টা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতার মতো একটা এত্ত বড় শহরে এখনো এই ধরনের মানুষ বাস করেন সেটা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। স্বাধীনতার ৭৫বছর পেরিয়ে গেলো কিন্তু এখনো মানুষের মনের জরা কাটলোনা। এখনো মৃত্যুঞ্জয়ী ফুল, ঝাড়ফুঁক, অমাবস্যার মতো অপবিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে মানুষ। ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে নতুন জীবন দেওয়া হলেও মানুষের সংস্কারকে অপবিজ্ঞানের রোগ থেকে বের করা যায় নি। আমি জানিনা শেষমেশ মাসিমা ইহলোকের মায়ার বাঁধনে আটকে পড়লেন কিনা, কিন্তু আমি তান্ত্রিক মহল থেকে একরাশ হতাশাজনক মন নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম। কথায় বলে মা গঙ্গা  সকল দু:খ, গ্লানি ধুয়ে দেয়। তাই কুটিঘাটের গংগায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরতেই মা বললো "প্রসাদ রাখা আছে তাকের উপর, আজ অমাবস্যার পূজা ছিলো, খেয়ে নিস।" মায়ের দিকে কটমট করে চেয়ে আমি বললাম "প্রসাদ আমি খাবো না, তুমি খেয়ে নাও।" শুনেই মা চেল্লাতে শুরু করলো, "মায়ের প্রসাদ খাবি না, তোর কি স্পর্ধা, জানিস কত মানত  করি তোর জন্য মায়ের কাছে। দিনদিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে।" আমি মনে মনে আমার মা কে বললাম, ঠিকই বলেছো মা, আমি অমানিশার অমানুষ।

...(সমাপ্ত)...

3 comments:

  1. Bastob jibon thek tule dhore6en sir darun.... Asa kri erkm ro golpo pbo...

    ReplyDelete