1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

দূষিত তাজমহল

দূষিত তাজমহল 

দেবানন্দ মুখোপাধ্যায় 

শহরের বুকে ঠিক নয়,একটু দুরে যেখানে শহর থেকে বেরিয়ে একটা রাস্তা কলকাতার দিকে যাবার বাইপাশে গিয়ে মিশেছে ,সে জায়গাটাতে এক সময় গভীর জঙ্গল ছিলো ,কুকুর শেয়াল ডাকতো ।সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা ।তারপর বাইপাশের কলেবর বৃদ্ধি হতে শুরু করলো টু লেন থেকে ফোর লেন তার থেকে সিক্স লেন—সময়ের দাবীতে ।আর যা হয় ,রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতই জনসংখ্যার ঢেউ এই শহরেও আছড়ে পরেছিলো ।ফলে যা হয় ,বাইপাশের গাছগুলো নির্বিচারে কেটে গড়ে উঠেছিলো নয়া বসত ।তাও নয় নয় করে দশ বছর হয়ে গেলো ।গোটা ষাটেক বাড়ি নিয়ে আপাততঃ সে বসতের নাম “শ্বেত কপোত” ।আরও বাড়ির বীজ বোনা হচ্ছে অর্থাৎ ভিত কাটা চলছে ,সে কথা থাক্ ওতো সব জায়গাতেই চলছ ,ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে ।

এই “শ্বেত কপোত”নামটার একটা কারন আছে ।মোটামুটি স্বচ্ছল কয়েকটি পরিবার যখন এখানে বাড়ি করতে শুরু করে তখনই তারা একটা কমিটি তৈরী করে ,যেমন আর পাঁচটা পাড়ায় হয়,এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সব বাড়ির রংই সাদা রাখবে ,হয়েছিলোও তাই ।পরবর্তী পর্যায়ে যারা যারা বাড়ি করেছিলো ,তারাও আর অন্যথা করেনি,তা তাদের মনের মধ্যে যাই থাক না কেনো ।তারাও কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলো ।ফলে শহরের লোকজন ,বাইপাশ দিয়ে যাতায়াত করা লোকজনের মধ্যে অচিরেই এই সাদা দ্বীপের মতো শ্বেত কপোত একটা আলাদা মর্যাদা আদায় করে নিয়েছিলো ।

তা সেই শ্বেত কপোত নামক পাড়ায় পুজো থেকে শুরু করে কোনো পরিবারের অনুষ্ঠান সব কিছুতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ।কারোর বিপদে পাশে দাঁড়ানো থেকে কারোর ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়ে সাধ্যমত ।

তা আজ এই পাড়ার আদি বাসিন্দা অধীর সেনের মেয়ের বিয়ে ।অধীরবাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর তিনেক হোলো ।মা মরা মেয়ের বিয়েতে তাই কোনো কর্পণ্য করছেন না ।তাই আজ সকাল থেকেই কমিউনিটি হল সরগরম ।পাড়ার সবার খাওয়া থেকে শুরু করে আড্ডা সবই এইখানে ।অধীরবাবু কয়েক বছর হোলো একটা ফার্মাসিউটিকাল কম্পানির রিজিওনাল ডিরেক্টর পদ থেকে অবসর গ্রহন করেছেন ,মেয়ে গার্গী কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভারতের একটা নামকরা রং কম্পানির কলকাতা হেড অফিসে তিন বছর কর্মরতা ।

কাজের সূত্রেই তার আলাপ কলকাতার এক নামকরা রংএর ডিলার বিশাখ দাসের সাথে ।এম বি এ করা স্মার্ট চেহারার বিশাখকে প্রথম দর্শনেই ভলো লেগেছিল গার্গীর ,কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি ,বলা ভালো কাস্টমার কম্পানির লোকের সম্পর্ক সংক্রান্ত সম্পর্কটাই বাধা হয়ে ছিলো ।বিশাখের পরিবারও বেশ বনেদী ।কলকাতার নামকরা মূলত বাড়িঘর ফ্ল্যাট তৈরীর ক্ষেত্রে যে কজন প্রথম সারির বিল্ডারের নাম আলোচিত হয় বি ডি বিল্ডার্স তার মধ্যে অন্যতম ।এ হেন বি ডি বিল্ডার্সের কর্ণধার বাসুদেব দাস বিশাখের বাবা ।

তা এ হেন লোকের পুত্র যখন এম বি এ করে এসে বাবার কাছে প্রস্তাব দিলো আলাদা করে রংএর ব্যবসা করার বাসুদেব বাবু আপত্তি তো করলেনই না বরং উৎসাহই দিলেন। বাপ ব্যাটার সেই দূরদর্শিতার ফলে আজ তাদের দুটো ব্যবসাই রমরম করে চলছে ।তা সেই সূত্রেই একদিন আলাপ হোলো দুজনের ,মানে বিশাখ আর গার্গীর ।পরথম দর্শনটা শেষ দর্শন হয়ে যায় অনেক সময়ে যেহেতু দুজনে ব্যাস্ত মানুষ ,তবে এ ক্ষেত্রে তা তো হোলোইনা বরং দুজনের প্রতি দুজনের আকর্ষন দিন দিন বেড়ে চললো ।কোনো বাড়িরই আপত্তির কোনো সুযোগই ছিলোনা ,কাজে কাজেই দুই বাড়ির সম্মতিতে চার হাত এক হওয়ার দিন অচিরেই ঠিক হয়ে গেলো ।

আজ সেই দিন ।

সকাল থেকেই কমিউনিটি হলে সাজো সাজো রব ,সন্ধ্যাবেলাতে তো হল নানান রংএর আলোয় সেজে উঠলো ।দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেনো চাঁদে লোয় ফুটে ওঠা এক তাজমহল ।বাইপাস দিয়ে যাতায়াত রা লোকজনেরা এক লহমা জন্য হলেও দাঁড়িয়ে ছলো ,আর অতি উৎসাহীরা মোবাইলে ছবও তুলে নিলো ।বিয়েবাড়ি ভালোভাবেই কেটে গেলো ,তিনদিন ধরে পাড়ায় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো ।

প্রায় বছর ঘুরতে চললো ।গার্গীরা এর মধ্যে বেশ কয়েকবার এসেছিলো ।আজও এসেছে ,বিশাখের কি একটা সার্ভের ব্যাপারে শহরের ড়িলারের সাথে  একটা মিটিং ছিলো দুপুরে ।তা মেয়ে জামাইকে নিয়ে অধীর সেন  রাতে খাবার টেবিলে বসেছেন ।নানান ধরনের কথাবার্তা চলছে তিনজনের মধ্যে ।একথা সেকথার পর বিশাখ বললো “বাবা আপনার কি মনে হয়না পৃথিবীতে দূষন ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে ?”

জামাইএর কথায় একটু আশ্চর্যই হলেন অধীরবাবু ।মনোভাব গোপন করেই বললেন “তা তো বটেই ।চারিদিকে এতো প্লাস্টিক ব্যবহার ,এতো ধুলোবালি ,।আমাদের এখানকার কথাই ধরোনা যখন প্রথম এসেছিলা তখন যতো খোলামেলা লাগতো এখন কি আর লাগে?আসলে মানুষ বাড়ছে ,মানুষের সভ্যতা বাড়ছে,চাহিদাও বাড়ছে ।এ সবের সাথে পাল্লা দিয়ে দূষনও বাড়ছে ।“

“তা ঠিক ।এই ধরুন না আমাদের গর্বের তাজমহল ।পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি ,তা এমন শুভ্র এক সৌধ দেখা যাচ্ছে পাশের দূষিত যমুনার জলে জন্মানো এক ধরনের পোকার জন্য সবুজাভ হয়ে যাচ্ছিল ২০১৬র এক রপোর্টে দেখা গেছে ।এ ছাড়া কাছাকাছি থাকা কলকারখানার ধোঁয়াতে কিছুটা ধূসরও হয়ে যাচ্ছিলো ।এই নিয়ে দেশে অনেক হৈচৈও হয়েছিলো ,খবরের কাগজে অনেক লেখালেখিও হয়েছিলো ,আপনি নিশ্চয়ই জানেন।“

“হ্যাঁ পড়েছিলাম ।তারপর তো আশেপাশের অনেক কলকারখানা সরকার বন্ধও করে দিয়েছে ।আর ২০১৯ সালে মূল গেটে দুটো বড় এয়ার পিউরিফায়ার মেশিনও বসানো হয়েছে ।“

“আপনি তো আমার থেকেও বেশী জানেন দেখছি বাবা ।তা যা বলছিলাম যদি কিছু মনে না করেন তো বলি ।“

“তুমি বলবে, এতে মনে করার কি আছে ,বলো কি বলতে চাও ।“

না ,মানে দেখুন বাবা ওসব দূষন নিয়ন্ত্রন তো সরকারের কাজ ।তবে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের তরফে সচেতন হলেও সরকারকে এ ব্যাপারে অনেকটা সাহায্য করা হয় ।ধরুন যেখানে সেখানে আবর্জনা না ফেলা ,প্লাস্টিক ব্যবহার না করা ইত্যাদি ।তা দৃশ্যদূষন বলেও একটা কথা আছে ,এই তাজমহলের কথাই ধরুন ।প্রধানত রংটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলেই তো এতো হৈচৈ ।“

“তা ঠিক ।তবে শুধু তো তা নয় ,টিকে থাকার মেয়াদও কমছে সাথে সাথে ।“

“সেটাও ঠিক ।তবে কথাতেই তো আছে পহেলে দর্শনধারী…”

কথা থামিয়ে অধীরবাবু বলেন “বিশাখ আমর মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাইছো ।“

গার্গী বলে “বাবাকে কথাটা বলোনা ।আমাকে বলে বলে কান ফুটো করে দিলে ।“

অধীরবাবু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে ,কি এমন কথা যা বলতে বিশাখ এতো কিন্তু কিন্তু করছে ।“যা বলার নিঃশঙ্কোচে বলে ফেলো ।“

“বাবা তাজমহলের কথাতো বললাম,ঠিক সেই রকম আপনাদের পাড়ার বাড়িগুলোর কথা ভেবে দেখেছেন?আমি আসতে আসতেই লক্ষ্য করছিলাম অধিকাংশ বাড়িতেই একটা কেমন যেন কালচে ছাপ পড়েছে,হতেই পারে এদিকে এতো কলকারখানা ।কত আর বছর বছর রং করাবেন বাড়ির ?আমি শুধু আপনার কথা বলছিনা পাড়ার সব বাড়ির  কথাই বলছি  ।আজকের দিনে সাদা রংটা একটা বিলাসিতা মাত্র ।একবার অন্য রং করে দেখুন ,বছরের পর বছর আর হাত দিতে হবেনা যতই দূষনের আক্রমন হোক বাইরে থেকে বোঝাই যাবে না ।“ও তাহলে এই ব্যাপার ?মনে মনে ভাবলেন অধীরবাবু । গার্গী এবার মুখ খোলে “বুঝলে বাবা আসলে আজকে ওদের যে মিটিংটা হোলো তার মুল এজেন্ডাই ছিলো পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একমাত্র আমাদের এই জেলা শহরে আমাদের রং বিক্রি সবচেয়ে কম ।তা কথায় বলেনা চ্যারিটি বিগিনস্ এ্যট হোম ।তা আমাদের বাড়িটা দিয়েই শুরু হোকনা ।সত্যিই বাড়িটা কেমন কালচে মেরে গেছে ।আমি কথাটা বলতে পারিনি এতোদিন ,পাড়ার ফিলিংসটা তো জানি ।বিশাখই আমাকে বলতে বললো ।সত্যি বলতে কি সাদার যুগ আর নেই ,কত হরেক রকম রং বেরিয়েছে আজকাল ।আমি ক্যাটালগও এবার নিয়ে এসেছি ,এতোদিন তো দরকার হয়নি ।দেখবে ?”

“কিন্তু গার্গী তুই তো জানিস আমাদের পাড়া কমিটির কথা ।আমরাই তো ঠিক করেছিলাম…..”

বিশাখ বলে “সে তো অনেকদিন আগের কথা ।এখন সময়ের সাথে চলতে হবে তো বাবা ।না চারিদিকের এতো দূষন ,লড়াই করবেন কি ভাবে?আর আপনি তো কমিটির সম্পাদক ,আপনি বিষয়টা বুঝিয়ে বললে সবাই মেনে নেবে ।আমরা পরশু চলে যাবো ।কাল একটা মিটিং ডেকে কথাটা ফাইনা করে নিন ,যে যার পছন্দমতো রং করুক না।বাড়িতে ,তবে একটু দেখবেন রংটা যেন আমাদের থেকে নেয় ।দরকার হলে বা আপনি অনুমতি দিলে আমিও থাকবো মিটিংএ ।চাই কি ডিলারকেও ডেকে নেবো ।“

অধীরবাবু বুঝলেন এরা একদম আঁটঘাট বেঁধেই এসেছে ।মুখে বললেন “থাক বিশাখ ,আমি আগে কাল মিটিং ডাকি ,সবাইকে বলি।যদি সবাই রাজি হয় তোমাদের জানাবো ।“

না বাবা রাজি করাতেই হবে ।তোমার কথা ওরা ফেলতে পারবে না আমি জানি ।আর সত্যিই সাদা রং কি আর চলে বলো?”গার্গী বলে ।

হাঁ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অধীরবাবু “দেখি কি করি ।কালকর মিটিংএষ কথাটা সবাইকে জানাতে রাতের মধ্যে ।“রংবদলানোর কারিগর যখন ঘরেই ঢুকে গেছে ,পছন্দ হোক বা হোক ওরা রং বদলিয়েই ছাড়বে,তাঁ স্বপ্নের তাজমহলই আজ দূষিত হয়ে গেছে! 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment