1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

অজানা পথের বাঁক

ছবি : ইন্টারনেট

অজানা পথের বাঁক

সন্দীপ ঘোষ

বাবা আজ সকালে বেরিয়েছে | প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে ফেরার পথে সামনের বটগাছটার দিকে তাকিয়ে এগারো বছরের তিয়াসা আর তার ভাই সাত বছরের রাকেশের চোখ একেবারে ছানাবড়া ! তা তো হওয়ারই কথা | পানু গাছে উঠছে কেন ? ছোট ছোট ডাল ধরে গাছটার দেহের খাঁজে খাঁজে পা রেখে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠছে সে | আর উঠছেই বা কী করে ! বিস্ফারিত নেত্রে একমনে দেখে চলেছে ওরা দু'ভাই বোনে | বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে রাকেশ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায় ;

-----" দিদি,পানু ওভাবে গাছে উঠছে কেন রে ? "

-----" আমিও তো তাই ভাবছি |"

কয়েকটা মুহূৰ্ত , তারপর কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে বলে তিয়াসা ;

-----" পানু-- এই-ই-পানু , গাছে উঠছিস কেন ? পড়ে যাবিতো !"

কাঁদো কাঁদো হয়ে উত্তর দেয় পানু ;

-----" আমিও ইস্কুলে যাব, বই পড়ব, আমাকে ঢুকতে দেইনি ক্যানে ? আমি গাছে বসেই পড়া শুনব, শিকব |"

      পানুরা গরীব | ওদের এই গ্রামে বাড়ি নয় | পূবের কোন এক গাঁয়ে বাড়ি, শুনেছে রাকেশ-তিয়াশা | শীতের শুরুতে পানুর বাবা নীরু কালিন্দী সঙ্গে পানু আর ওর মাকে নিয়ে এসেছে এই গাঁয়ে (খেজুর গুড়) মহল করবার জন্য |  গুড়ের সময় চলে গেলেও ওরা আর নিজের  গাঁয়ে ফিরে যায়নি | এই গ্রামের লোকের পরামর্শে তাদের ক্ষেতে- খামারে কাজ নিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির কুঁড়েঘর বানিয়ে বেশ দিব্যি আছে | তবে পানুর বাবা পানুকে স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টা যে করেনি তা নয় | আসলে পানুর তো  জন্ম শংসাপত্রই নেই, তাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোময়বাবু ফিরিয়ে দিয়েছেন | তারপর পানুও হাল ছাড়েনি, অনেক বায়না করেছে , বাবা-মা কেউই কাণে তোলেনি পানুর বায়না | পানুর জন্মের পর নিজের অজ্ঞতার কারণে নীরু কালিন্দী ছেলের জন্মের তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করায়নি | ইতিমধ্যে সাত বছর অতিক্রান্ত  এখন আর চেষ্টা করেও পানুর জন্ম শংসাপত্র জোগাড় করে উঠতে পারেনি নীরু | 

পানু গাছের ডালে বসেই চেঁচিয়ে কেঁদে বলতে থাকে ;

-----" আমি পড়ব-আমি পড়ব- আমি পড়ব | ইখানে বসেই লেকাপড়া শিকব | তুই ইস্কুলে ককন যাবি রাকেশ ?"

-----" সে তো অনেক দেরী, বাড়ি যাই , সকালের পড়া করতে হবে,  স্নান করব, খাবার খাব, তারপরে ইস্কুলে যাব , নারে দিদি ?" 

-----"হ্যাঁ তাই তো--- তুই নেমে আয় পানু, ভাইয়ের সাথে স্কুলে যাবি, স্কুলে বসেই পড়বি |"

-----" ইস্কুলে ত  ডুকতে দেইনি মাস্টার, আইজকে দিবেক ?"

পানুর এই প্রশ্নে দু'ভাইবোনেই খানিক ধন্দে পড়ে যায় | নিজেকে সামলে নিয়ে আন্তরিকতা ও সহানুভূতির মাত্রাকে উচ্চে তুলে আত্মপ্রত্যয়ী জবাব তিয়াসার ;

-----" নিশ্চই দেবে, আজকে তুই স্কুলে যাবি - ই - যাবি | ভাইয়ের সাথে পড়বি, কেমন ? তুই নেমে আয় ভাই !"

বুকের ভেতরটা এক বুক আশায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল পানুর | স্কুলের প্রাচীর লাগোয়া বট গাছ থেকে সে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে সাবধানে নেমে আসে |

তিয়াসা চিন্তায় ডুবে যায় | পানুকে দেখানো স্বপ্ন সে সত্যি করতে পারবে তো ! মা-বাবা কী তার কথা শুনবে ! আজ কিছুদিন হল তার ভিতরে একটা চাপা অভিমান ক্রমশঃ ঘুরপাক খাচ্ছে | সব ব্যাপারে ভাইয়ের গুরুত্ব থাকলেও তার উপরে বাবা-মা কেমন যেন উদাসীন | তবুও ভাইকে সে খুব-খুব ভালোবাসে | সমাজের পুত্র-কন্যার বৈষম্যের বীজটা হয়ত সে উপলব্ধি করতে পেরেছে | তবে বাবা-মা যে তার কথা গ্রাহ্য করবে না, তা ধরে নিয়েই বাড়ি ফেরার পথে রাকেশকে বলে;

-----" ভাই, পানু স্কুলে যাক, লেখাপড়া করুক--- তুই কি চাস ? মানে তোর কি তাতে ভালো লাগবে ?"

-----" হ্যাঁরে দিদি, আমি সে কথাই ভাবছি, পানু স্কুলে গেলে আমার খুব ভালো লাগবে |"

-----" আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে জানিস ভাই ?"

-----" কি রে সেটা ?"

----" তাহলে শোন্ , বাড়ি ফিরেই মাকে পানুর কথা বলবি |"

কী বলতে হবে ভাইকে সব বুঝিয়ে বলে দেয় তিয়াসা |

আজকের পানুর ঘটনার কথা রাকেশ তার মাকে প্রথমে জানায়, তারপর জানতে চায়;

-----" পানু কেন স্কুলে যায় না মা ! ও স্কুলে গেলে ওকে কেন বের করে দেয় , আমার খুব কষ্ট হয় মা | বাবা কে বলোনা  পানুকে যেন আমাদের স্কুলে নিয়ে নেয় |"

পানুর কথা শুনে রাকেশের মা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন;

-----" তোর বাবা একটু পরেই ফিরবে, বলব |"

ভাইবোনের আনন্দ আর ধরে না ! যথা সময়ে বাবা ফিরে সব শুনলেন, তারপর বললেন; 

-----" ঠিক আছে মনোময়বাবুকে আমি অনুরোধ করব | আসলে কী জান, সরকারী নিয়মে সব বাচ্চাকেই ভর্তি নিতে হবে | কিন্তু তারপরেও আমরা মাষ্টারমশাইরা ইতস্তত বোধ করি |  ভর্তিছাড়া আমরা কোন ছেলে বা মেয়েকে স্কুলে নিতে পারিনা, বিশেষ করে যেখানে মিড-ডে-মিলের একটা বিষয় রয়েছে | বলে দেখি, আজকের দিনটার জন্য যদি বিবেচনা করেন-------"

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাকেশ, তিয়াসাও পাশের ঘর থেকে উঁকি দিয়ে এতক্ষণ সব শুনছিল, সেও মুখে হাত চাপা দিয়ে সরে যায় | সম্ভবত, কেঁদে ফেলেছে | রাকেশের বাবা অশোকবাবু থেমে যান | | রাকেশের মা পাশের ঘর থেকে বলে ওঠেন;

-----" শুধু আজকের জন্য কেন ? পানুর বার্থ সার্টিফিকেট জোগাড় করে বরাবরের জন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা যায় না ?"

------" দেখি কী করা যায় !" 

তিয়াসা নিশ্চিত, বাবা যখন বলেছে ভাল কিছুতো একটা হবেই | রাকেশও তাই মনে করে | ওদের মনের দ্বন্দ্ব কেটে গেছে |

শিক্ষকতার সম্পৰ্ক ছাড়াও মনোময়বাবুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও রয়েছে | ফোনে পানুর ভর্তিসহ সব কথা সারলেন মনোময় বাবুর সঙ্গে | তারপর ছেলেকে ডেকে বললেন;

--------" আজ থেকেই পানু স্কুলে যাবে | কীরে তুই খুশি তো ? ওর জন্মের সার্টিফিকেটের জন্য ওখানের স্থানীয় প্রশাসনিক কার্য্যালয়ে লোক পাঠানো হবে | পানুকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যাবি | যা রেডি হয়ে নে | স্কুলের সময় হয়ে আসছে আমাকেও বেরোতে হবে |"

যারপরনাই খুশি দু'ভাইবোনে | কারো ভালো করতে পারার মধ্যে যে এত আনন্দ লুকিয়ে আছে , দু'ভাইবোনে এই প্রথম আবিষ্কার করল | কিন্তু জীবনের গতিপথ যে বড়ই জটিল ! তাইতো হঠাত্ কোনো এক বাধা এসে দুটি অপরিণত মনের সুখানুভূতিকে এক লহমায় মুচড়ে দিয়ে যায় | রাকেশদের ক্ষেতে কাজ করে আদিবাসী যুবক লুসা পানুর স্কুলে যাওয়ার কথা শুনে বলে;

-----" না অরা নাই, দ্যাশের গর(ঘর) গ্যাচে, পানর ঠাগ্মা(ঠাকুমা) মরেচে,সেই লিগে (জন্য) |"সকাল থেকে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার মাঝে মেঘাচ্ছন্ন পূবের আকাশটা আরো ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায় | 

....সমাপ্ত...


No comments:

Post a Comment