1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

স্মরণ করি ঐতিহাসিক ১৯ মে র বরাকের ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ

ছবি : ইন্টারনেট

স্মরণ করি ঐতিহাসিক ১৯ মে র

 বরাকের ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ

পাভেল আমান


মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভাষার অধিকার রক্ষা নিয়ে আন্দোলন ও শহীদ হওয়া বিরল। অথচ ভাষাকে নিয়েই মানুষের বড় হওয়া সুখে দুখের দিন যাপন চেতনা ভাবনার জগতকে উদ্বুদ্ধ করা নাড়া দেওয়া। ভাষার সঙ্গে যেন মানুষের এক নাড়ীর সম্পর্ক। এভাবেই সাংকেতিক চিহ্নগুলো যখন অক্ষর শব্দের মধ্যে দিয়ে ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠলো তখন থেকেই ভাষা প্রতিটি মানুষের দিন যাপনের সঙ্গে ওতপ্রুত ভাবে জড়িয়ে গেল। এভাবেই ভাষার গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকতা কালের অমোঘ নিয়মে অপরিহার্য ও গতিশীল।ভাষা শুধু ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয় জাতিসত্তার অনন্য পরিচিতি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ৫২ ভাষা আন্দোলনের কথা আমরা সকলে জানলেও আসামের শিলচরের ভাষা শহীদদের লড়াই সংগ্রাম সম্পর্কে আমরা বাঙালিরা খুব একটা সচেতন নয়। আমরা বাংলাভাষী হিসেবে আমাদের পাশের রাজ্যের ঘটে যাওয়া সাধারণ মানুষের লড়াই সংগ্রাম এবং বীর ভাষা শহীদদের আত্ম বলিদানের কথা খুব একটা চর্চা করি না। বাঙালি হিসেবে এ আমাদের অকর্মণ্যতা ও দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয়।১৯৬০ সালে আসামের বারাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করার জন্য এক আন্দোলন সূচিত হয়। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ১৯৬১ সালে ১৯ মে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ ও আসামের রাইফেলসের গুলিতে বলি হয় ১১ টি  তরতাজ প্রাণ যারা ভাষা আন্দোলনের শরীক। প্রতি বছর এই দিনটি তাই পালিত হয় বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে। প্রাণ দেন- কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্রকুমাফ দেব, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তরণী দেবনাথ, সুকোমল পুরকায়স্থ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল এবং কমলা ভট্টাচার্য।  দীর্ঘ ২৪ বছর শারীরিক যন্ত্রণাসহ লড়াই করে শহীদ হন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস।বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের মহান দৃষ্টান্ত। ঠিক তেমনি ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে আসামে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯ মের রক্তস্নাত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে।

পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর (৫৬%) উপর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংখ্যালঘিষ্ঠ (৭%) ভাষা উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙালির ভাষা অধিকার খর্ব করে তাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের অসমিয়াকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। বরাক উপত্যকায় বসবাসরত বাঙালির যে ভাষা আন্দোলন তা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের মতোই তা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল দেশবিভাগের সময় থেকে। অবশ্য সে প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজও বঞ্চিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য ছোট ছোট জনগোষ্ঠী পৃথক রাজ্য পেলেও বরাক থেকে দাবিটুকুও উঠছে না সেভাবে। জনসংখ্যার নিরিখে বরাক যদি পৃথক রাজ্য হয়, তবে সেটা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য। বর্তমানে এই অঞ্চলের আট রাজ্যের মধ্যে ৩৮ লাখের ত্রিপুরা দ্বিতীয় বৃহত্তম। বরাকের লোকসংখ্যা ৪২ লাখেরও বেশি। 

ছবি : ইন্টারনেট

আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য’ এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সেখানে বাঙালির অধিকারহরণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অন্যথায় তাদের অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।ফলস্বরূপ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। আসামের বিধানসভাতেও অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল।১৯ মে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় দিন। শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরা নয়, আসামের বাংলাভাষী বাঙালিরাও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবনদান করেছে। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অমর ইতিহাস। এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ ‘জান দেবো, তবু জবান দেব না’ স্লোগানে মুখরিত হওয়া বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা আজ আমরা কতজনইবা মনে রেখেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনাটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত এবং বিস্মৃত অধ্যায়।ভাষা বৈচিত্রময়, কিন্তু মাতৃভাষার আবেগ সম্ভবতঃ অম্লান। আমাদের স্বর, আমাদের সুর, আমাদের মাতৃভাষা, এই সুর যারা উন্মুক্ত করেছেন, রক্ষা করেছেন স্বাধিকার, স্বীয় ভাষা ব্যবহারের আন্দোলনে যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা পৌঁছে দিয়েছেন, সেই সকল ভাষা আন্দোলনকারী, ভাষা শহীদদের কাছে আমরা সততই ঋণী। এই অধিকার রক্ষা করার অঙ্গীকারে, স্বীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদা দানের আগ্রহে, ভাষার মাধ্যমে স্বীয় সংস্কৃতিকে গর্বিত করাই হোক আমাদের প্র‍য়াস। আজকে চারিদিকে যখন বাংলা ভাষার চর্চা গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকতা কমে যাচ্ছে আমরা জীবন জীবিকার সুবিধার্থে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে সেক্ষেত্রে আমাদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে উদাসীনতা নিরূৎসাহীতা মাতৃভাষাকে বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মতে "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম"। আমরা বাঙালিরা রবীন্দ্র জয়ন্তী নজরুল জয়ন্তী পালন করি অথচ তাদের সাহিত্য সৃষ্টিকে প্রাত্যহিক জীবনে খুব একটা স্মরণ করি না। যে বাংলা ভাষার চর্চাতে তারা সারা জীবন উৎসর্গ করেছিল আমরা তাদের বাংলা ভাষার প্রতি নিবেদিত মানসিকতা ও অবদান ভুলে গেছি। আমরা দিনকে দিন শুধুমাত্র নামমাত্রই বাঙালি পরিচয় পরিচিত। প্রতিমুহূর্তে ভুলতে বসেছি বাঙালি সংস্কৃতি সাহিত্য কৃষ্টি ঐতিহ্য ঘরানা পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ। আজকের এই বিশেষ দিনে শিলচরের ভাষা শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি আমরা বাঙালিরা বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার চর্চা প্রসার গুরুত্ব সম্পর্কে আরো বেশি বাস্তবিক ও দায়বদ্ধ ভূমিকা পালন করি। আমাদের ভাবি প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বাঙালি পরিচয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment