![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি
রাজশ্রী দে
পশ্চিমঘাট পর্বত মালায় সূর্য সবে উঁকি দিচ্ছে , রু এক কাপ কফি হাতে টেরাসের দোলনায় এসে বসল l লাল আবির ছড়ানো আকাশ , এক ঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে গেল l আজ অফ ডে , হসপিটালে যেতে হবে না lগরম কফিতে চুমুক দিতে মন চলে যায় অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোতে !
১৯৮৬ সাল জয়েন্টে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে রু পোশাকি নাম রঞ্জাবতী চান্স পেল কলকাতা মেডিকেল কলেজে , ছোট থেকেই ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে তার l হবে নাই বা কেন বাবা সমুদ্র ও মা মেঘমালা দুজনেই তো কলকাতার বুকে নামকরা কার্ডিওলজিস্ট l কলেজের প্রথমদিন আলাপ হয়েছিল অনেকের সঙ্গে , তবে তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আর কথা বলা হয় নি l ওর নাম অমল কান্তি দাসl গাড়িতে আসতে আসতে হেসেছিল রু আপন মনে , ও নাকি এসেছে মালদা থেকে, তবে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ! ব্যাপক পড়াশোনায় l
কলেজে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা একটা গ্রুপ তৈরি করল, সেখানে অমল কান্তি ও রয়ে গেল l আজও মনে আছে ফ্রেশার ওয়েলকামে সিনিয়ররা ওর নাম শুনে বলেছিল নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর "অমল কান্তি " কবিতা পাঠ করতে l অসাধারণ আবৃতি করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল অমল lঅসম্ভব পড়ার প্রেসার তারমধ্যে প্রাকটিক্যাল , সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ হয়ে গিয়েছিলাম সকলেlবছরের পর বছর কেটেছে , কখন ক্যান্টিনের আড্ডায় , আবার হসপিটালের করিডোরে দেখা হয়েছে অমল কান্তির সঙ্গে l ধীরে ধীরে কখন যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও জানি না l বিশেষত পূজোর ছুটির সময় ও বাড়ি গেলে বুঝতাম এক অদ্ভুত কষ্ট , এক বিশাল শূন্যতা l
তারপর MBBS পাস করে হাউস সার্জেন হলাম , আমাদের ডিউটি আওয়ার্স ছিল অনেকক্ষেত্রে একই সময় l ভালোবাসা হয়েছিল মনে মনে , অমল যে আমায় ভালোবাসে তার সুবাস পেয়েছিলাম l ওরা কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনল , একসময় ওর মা বাবার সঙ্গে আলাপও হল l আমার ড্যাডি , মামনির সঙ্গে অমলের পরিচয় অনেকদিনের , কারণ আমাদের বাড়িতেই হত বন্ধুদের আড্ডা ! উত্তর কলকাতায় লাল রঙের ,সবুজ খড়খড়ি দেওয়া জানলা ,বিরাট গাড়ি বারান্দাওয়ালা বাড়ি আমাদের l অমল ওর বক্স ক্যামেরায় সুন্দর ফটো তুলত, ভালো কবিতা লিখত আর অদ্ভুত সব ছবি আঁকত l রুকে শিখিয়েছিল বাংলা গল্পের বই পড়তে , প্রথম উপহার দিয়েছিল সমরেশ মজুমদারের "উত্তরাধিকার "lচিনিয়ে ছিল প্রকৃতিকে , সময় পেলেই প্রিন্সেপ ঘাটে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসত দুজনে , জলের ঝলাৎ ঝলাৎ শব্দ রু ভালোবাসে l তাছাড়া পড়াশোনায় প্রচুর সাহায্য করত অমল l নিজেদের গাড়ি নিয়েও বেরিয়ে পরত কলকাতা শহর ছাড়িয়ে কখনও কোলাঘাট কখনও ডায়মন্ড হারবারের দিকে , সঙ্গী অবশ্যই মা বাবা বোন lমাকে অসম্ভব ভালোবাসে অমল, মনে হয় কখনই মায়ের কথার অবাধ্য হত না l তবে লুকিয়ে প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেটে খেতে অমল কান্তির জুড়ি মেলা ভার l
দু বাড়িতে বিয়ের কথা হয়ে গেল, MD করার পর সেটল হলেই বিয়ে , বন্ধুরা খুব আনন্দিত l আমি পুনেতে চান্স পেয়ে চলে এলাম , আর অমল কলকাতায় থেকে গেল, ও পেল ওখানকার এক হসপিটালে l যোগাযোগ রাখার একমাত্র মাধ্যম টেলিফোন , অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য সেই সামান্য কথা বলার সময়টুকু আর দুজনের কাছে রইলো না একটা সময় l
অবশেষে দুজনেই কলকাতায় সেটল হলাম , সামনের ফাল্গুনেই বিয়ে , রু বিয়ের বাজার করতে ব্যস্ত মামনির সঙ্গে lএদিকে অমল মা , বাবা , বোনের সঙ্গে হসপিটাল সামলে বেরোচ্ছে, কখনও নিউ মার্কেট , কখনও কলেজ স্ট্রিটের মোহিনী মোহন কাঞ্জিলালে , কখনও গড়িয়াহাটে lঅমলের পছন্দ অনুযায়ী ময়ূরকন্ঠী রঙের বেনারসি কেনা হল বৌভাতে রু পরবে বলে l নিমন্ত্রিতদের কার্ড দেওয়া সমাপ্ত , বিয়ের বাজার কমপ্লিট , ক্যাটারিংকে আগাম টাকা দেওয়া হল l বাড়িতে বিশাল প্যান্ডেল শুরু হয়েছে ,বিয়ে হবে ছাদে , পাশের লনে হবে ভোজন পর্ব l বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসা শুরু হয়ে গেছে যথারীতি l বন্ধুরা আসছে দূর দূরান্ত থেকে , কত দিনের স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে l
ঠিক বিয়ের দিন চারেক আগে ভোর বেলায় একটা ফোন এল অমলের বাড়ি থেকে , ওর মা জানালো এখানে বিয়ে দিতে আমরা অপরাগ কারণ রুয়ের সঙ্গে অমলের কুষ্ঠি মিলছে না , কিছুই করার নেই আমাদের l বিয়ে ভাঙলো আমার , মা ভক্ত অমল মেরুদন্ড সোজা করে বিয়ে করতে আসতে পারেনি l ড্যাডি শয্যাশায়ী হয়েছিল সারাজীবনের মত l অ্যাডভোকেট বড়মামা বাতাসে আস্ফালন করছিলেন ওদের নামে কেস করার জন্য, আর আমি লাল বেনারসীতে কাঁচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম এলোপাথাড়ি l প্যান্ডেলের রঙিন কাপড় খোলা শুরু হয়ে গিয়েছিল, প্রেমের বিয়ের একি কান্ড বলতে বলতে আত্মীয়রা এক এক করে বিয়ে বাড়ি থেকে প্রস্থান করেছিল l মামনি আমাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে হাহাকার করেছিলেন , আমি কাঁদি নি কারণ তখনও অমলকান্তির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম l
বিয়েটা হয় নি , চলে আসি পুনেতে , আদিত্য বিড়লা হসপিটালে জয়েন করি l বহু বছর অতিক্রান্ত , একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছি আমি, নাম রেখেছি দূর্গা l দূর্গা এখন কুড়ি বছরের , ফ্যাশন নিয়ে পড়ছে , দূর্গা আমার শক্তি , আমার অবলম্বন l
শুনেছি মায়ের পছন্দ মত সুন্দরী , গৃহকর্মে নিপুনা , লক্ষীমন্ত এক মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে অমলকান্তি lতার আগে নাকি নিজের কষ্ট ভোলার জন্য ড্রাগের নেশাও করেছে l কিন্তু এখন সে জমিয়ে প্র্যাকটিস ও সংসার করছে l
মেয়ে দূর্গা এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পাশে , কতক্ষন থেকে তোমাকে ডাকছি মা , কোথায় চলে যাও মাঝে মাঝে l রু বাস্তবের মাটিতে ফিরল, মেয়ের জন্য নিপুণ হাতে পোহা বানালো l কেন যে এরকম হয় আজকাল , সময় পেলেই মন চলে যায় সুদূর অতীতে l
পুনেতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে , গণেশ পূজোর পরে হয়তো বন্ধ হবে lডিনার সেরে , টিভিতে নিউজ দেখতে বসলো রু কলকাতার খবর , আর কলকাতা টানে না , বাবা মা গত হয়েছেন , বাড়িটা কেয়ারটেকারের কাছে পরে আছে lআশ্চর্য দুর্গাও যেতে চায় না ,হয়তো মায়ের যন্ত্রনা কিছুটা বুঝতে পারে lবাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পরছে , পাশের ফরেস্ট থেকে যেন ভেসে আসছে গাছেদের কান্না , মাঝে মধ্যে ময়ূরের কর্কশ ডাক l দূর্গা মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে আছে , মায়ের গায়ের গন্ধ নিয়ে ঘুমোতে এক অদ্ভুত ভালো লাগা মিশে থাকে l
গভীর রাত , একটানা বৃষ্টির শব্দ , রু যেন আজও শুনতে পায়............দূর থেকে ভেসে আসছে অমলের কণ্ঠস্বর........
...(সমাপ্ত)...
গল্পটা ভালো। তবে, গল্প বলাই স্টাইলে প্রব্লেম। গল্পের মাঝে এসে কখনো রু কখনো লেখিকা এক হয় গেছেন, আবার পরক্ষনেই বিচ্ছিন্ন হয়েছেন এতে গল্পের ছন্দপতন ঘটেছে।
ReplyDelete