ছবি : ইন্টারনেট |
মা
সুমিত্রা পাল
ক্লাশ ফোর-এ মাকে হারিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় বোবা হয়ে গিয়েছিল যেন তৃণা। তারই মধ্যে ঠাম্মি-র অনুরোধ-উপরোধে বাবা আবার বিয়ে করেছেন। নতুন মা, তার কাছে সৎমা। তার দু’চোখের বিষ।
দু’চোখে দেখতে পারে না তৃণা সৎমা-কে। তার সবসময় মনে হয়, মায়ের মৃত্যুর পর তিনি যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। সবাই তাকে ভালোবাসলেও তৃণা একটি একটি করে, দীর্ঘ বারোটি বছর ধরে তার প্রতি ঘৃণা-ই পোষণ করে এসেছে। তিনি কাছে টানতে চাইলেও সে সবসময় মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। দূরে সরে থেকেছে। মায়ের জায়গাটুকু সে কিছুতেই তাকে দিতে পারে না!
কিছুদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধ-পথ্যি সব চলছে। কিন্তু কিছুতেই শরীর ভালো হচ্ছে না। শেষে ডাক্তার যেদিন জানান, তার দুটি কিডনি-ই অকেজো। অবিলম্বে একটি কিডনির প্রয়োজন। যথাশীঘ্র ব্যবস্থা না হলে এই মেয়েকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
সেদিন সে দেখেছিল বাবার মুখটা কেমন যেন শুকনো হয়ে গেছে। সে জানে, কিডনি জোগাড় করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বাবার এত আর্থিক সঙ্গতিও নেই যে কিনে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর ব্যবস্থা করবেন। সেদিন প্রথমে তার খুব কান্না পেয়েছিল। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল- ভালোই হয়েছে। এবার সে নিজের মায়ের কাছে চলে যেতে পারবে। এই সংসারে থাকার এইটুকু ইচ্ছে তার নেই।
কিন্তু, সেই সৎ মা তা হতে দিল কই! তাকে একরকম মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি, নিজের একটি কিডনি দান করে। শুধু তাই নয়, নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি যেভাবে তৃণা-র সেবাযত্ন করেছেন তা নিজের মায়েরও অধিক।
এমনটাও যে ঘটতে পারে তা তৃণার ভাবনারও অতীত। যতবার ভাবছে, ততবার তার বুক জুড়ে এক কান্নানদী ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে। একরাশ অপরাধবোধে সে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।
দীর্ঘবছর ধরে যে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এসেছে, তা যেন আজ সুদে-আসলে তার কাছে হিসাব চাইছে। এই মুহূর্তে তার সামনে কী করে যাবে, তাকে কীভাবে মুখ দেখাবে, তাকে কী বলবে, ভেবে ভেবে সে সঙ্কুচিত হচ্ছিল, মরমে মরে যাচ্ছিল। আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ, এক গভীর আবেগ, বারে বারে তার চোখের কোণদুটিকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
কাছে যেতে পারছে না সে, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, সৎমা বলে অবহেলা করা সেই মহীয়সী নারীর ভাষাহীন ভালোবাসার নীরব আর্তি- বারোবছরে একবারও তো মা বলে ডাকলি না। জন্ম দিইনি, কিন্তু আমি যে তোর মা।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment