1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

আরোহণ

ছবি  : ইন্টারনেট 

আরোহণ

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রতিদিন শেষ বিকেলের মুহূর্তে কংসাবতীর তীরে এসে দাঁড়ান সত্যানন্দ।একটু পরেই তীর সংলগ্ন নবরত্ন মন্দিরে বেজে উঠবে শঙ্খ আর ঘন্টা ধ্বনি। কংসাবতী নদীর তীরে পাথরা গ্রাম বহু প্রাচীন। এই গ্রামের অবস্থান তাম্রলিপ্ত বাণিজ্য বন্দর থেকে বেশী দূরে নয়। গুপ্ত যুগে ব্যস্ত বাণিজ্য বন্দর তাম্রলিপ্ত থেকে বহু বাণিজ্যতরী সুদূরে পাড়ি দিত।  তাম্রলিপ্ত থেকে কিছু মানুষ পাথরা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করলেও তাম্রলিপ্তর তুলনায় পাথরা ছিল অখ্যাত।

          অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে সত্যানন্দ তাঁর পূর্বসূরী বিদ্যানন্দ ঘোষালকে স্মরণ করেন। সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য বিদ্যানন্দ কঠিন পরিস্থিতিতেও ছিলেন অনড় অটল। পাথরা গ্রামের মানুষ বিদ্যানন্দকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বিদ্যানন্দই এই গ্রামে মন্দির নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সময়টা ছিল ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দ। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ-র বিশ্বস্ত পারিষদ ও সামন্ত ছিলেন বিদ্যানন্দ ঘোষাল। বিদ্যানন্দ নবাবের দ্বারা রত্নাচক পরগণার রাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত হন। বিদ্যানন্দ পাথরা গ্রামে কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করে গ্রামটিকে হিন্দুধর্মের আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু করে তোলেন। আলিবর্দি খাঁ-র নির্দেশে বিদ্যানন্দ যতটা পরিমাণ রাজস্বের অর্থ সংগ্রহ করেন,তার অনেকটা দিয়ে মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার কারণে আলিবর্দি খাঁ রাজস্বের অর্থের পুরো ভাগ না পেয়ে অসন্তুষ্ট হন। বিদ্যানন্দ হয়তো জানতেন তিনি নবাবের রোষানলে পড়বেন, তবু তিনি জনগণের ধর্মাচরণের দিকটিকেই গুরুত্ব দেন। রাজস্বের অর্থ ঠিক মতো জমা না পড়ায় বিদ্যানন্দ ঘোষালকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কিছুদিন তাঁকে কয়েদখানার কষ্ট ভোগও করতে হয়। শেষ পর্যন্ত নবাব তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেন। হাতীর পদপিষ্ট করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে হাতীটি সেই নির্দেশ পালন করে না। বিদ্যানন্দকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঘটনাটি ভীষণ ভাবে পাথরা গ্রামের জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলে। সকলে বিদ্যানন্দ ঘোষালের জয়গান গায়।

         আগামীকাল পাথরা গ্রাম ছেড়ে সত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় সপরিবারে শহর অভিমুখে রওনা দেবেন। সত্যানন্দের পূর্বসূরীরা একের পর এক মন্দির নির্মাণ করে পাথরাকে প্রসিদ্ধ করে তুলেছেন। তাঁদের রেশমের ব্যবসা ও নীলচাষের অর্থ তাঁরা মন্দির নির্মাণের কাজে ব্যয় করেন। এখন  জীবিকার তাগিদে শহরে বাণিজ্যের অভিপ্রায়ে সত্যানন্দের দুই পুত্র পাথরা থেকে শহরে বসবাস করতে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্রদের ওপর বড় বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। পাথরার ধুলো মাটিতে সত্যানন্দ মানুষ হয়েছেন, তাই এই গ্রামের প্রতি নিবিড় টান আছে। কিন্তু পুত্রদের ছেড়ে তিনি এই বয়সে একা থাকতে চান না।

             ভিটে মাটি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতো সত্যানন্দ পাথরার মন্দিরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। বড় টেরাকোটা নবরত্ন মন্দিরের বিপরীত দিকে তিনটে আটচালা মন্দির। রাধাকৃষ্ণ, দশাবতার, দুর্গার স্থাপত্য মুগ্ধ করে। সব মিলিয়ে পাথরা গ্রাম মন্দির প্রধান হয়ে উঠেছে।

          সত্যানন্দ সন্ধ্যের আধো অন্ধকারে হেঁটে চলেছেন। হঠাৎ নিস্তব্ধ পরিবেশে একটি মন্দিরের পেছনে নারী পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ান। পুরুষ কণ্ঠটি চিনতে পারেন-- তাঁর পৌত্র সুরথের। আঠারো বছরের সুঠাম যুবক, নম্র, মার্জিত, পাঠশালা ও টোলে বিদ্যার্জন করেছে সুরথ। সত্যানন্দ শুনতে পান সুরথ নারীটিকে আশ্বস্ত করে বলে, "কেঁদো না। আমার ওপর ভরসা রাখো। কথা দিচ্ছি আবার এই গ্রামে আসবো। শহরে বাণিজ্যের প্রয়োজনে যাচ্ছি। এই বিচ্ছেদ সাময়িক।"

নারীটি কান্না ভেজা স্বরে বলে," ভালো থেকো। এই প্রতিশ্রুতি ভুলে যেও না।"

 সত্যানন্দ বুঝতে পারেন তিনি ও তাঁর পরিবার পাথরা গ্রামে অনেক অবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার স্মৃতি ফেলে রেখে যাচ্ছেন। সত্যানন হাঁটতে থাকেন গৃহাভিমুখে। এই মাতৃভূমি ও মন্দিরের মাঝে যাদের শৈশব কেটেছে, তারা পাথরাকে ভুলবে কি করে! পাথরার মন্দিরের ইঁটে প্রতিদিন ঘন্টার ধ্বনির সঙ্গে জীবন্ত হয় মন্দিরের ইতিহাসের পূর্ব অধ্যায়গুলো। বিদ্যানন্দ ঘোষালের উত্তরসূরী সত্যানন্দ আজ কিংকর্তব্য-বিমূঢ়,বড়ই বেদনা কাতর!

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment